বিরহের নাম তুমি পর্ব-২০

0
347

#বিরহের_নাম_তুমি
#পর্ব_২০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
৫৪.
বারান্দার এক কোণে চেয়ারে বসে আছে জারিফ। দৃষ্টি তার রাস্তার দিকে। মাথার ভেতর সব ভিত্তিহীন চিন্তা-ভাবনা। আজকাল আর সে কোথাও শান্তি খুঁজে পায় না। সবসময় অস্বস্তিরা তাকে জেঁকে ধরে। দু’মাসে সে এখন মোটামুটিভাবে হাঁটতে পারে ভালোই। তবে এভাবে সে হাঁটতে চায় না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার চেয়ে তো পঙ্গু হওয়াও ভালো ছিল। আর তারচেয়েও বেশি ভালো হতো যদি সে মারা যেত। নিজের জন্য তার যতটা না কষ্ট হয়, তারচেয়েও বেশি কষ্ট হয় প্রীতির জন্য। তার ভাবনারও বাহিরে ছিল, মেয়েটা যে তাকে এত ভালোবাসে। মনে মনে এজন্য তার গভীর অনুশোচনা হয় মাঝে মাঝে। বিষয়টা এমন নয় যে, সে প্রীতিকে ভালোবাসেনি বা ভালোবাসে না। সেও প্রীতিকে ভালোবাসে। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, তার ভালোবাসায় অল্প হলেও খাদ ছিল। সে প্রীতিকে ভালোবাসলেও সূচনার প্রতি যে তার অনুভূতি ছিল সেটি অস্বীকার করার মতো জো নেই। আর এজন্যই হঠাৎ হঠাৎ গভীর রাতে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা চিনচিনে ব্যথা সে অনুভব করে।

‘বাইরে কী দেখছ তুমি?’ প্রীতির হাতে খাবারে প্লেট। সে ইদানীং এই বাড়িতেই বেশি থাকে। নিজের সব সময়টুকু সে জারিফকে দেওয়ার চেষ্টা করে। যাতে বাড়িতে বসে বসে জারিফ নিজেকে একা না ভাবে। ডিপ্রেশনে না পড়ে।
জারিফ প্রীতির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,’কিছু না।’
‘মন খারাপ?’
‘না।’
‘বেশ। খাবার খেয়ে নাও।’
‘রেখে দাও, পরে খাব।’
উত্তরে প্রীতি নিরব রইল। নিজেই ভাত মাখতে শুরু করে। এক লোকমা ভাত জারিফের মুখের সামনে ধরে বলে,’হা করো। ওষুধ খেতে হবে।’
জারিফ একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অজানা কষ্টের মাঝে তখন সে ভেসে যায়। এক্সিডেন্টের জন্য প্রীতিকেও যে পাড়াপড়শি থেকে নানান রকম কথা শুনতে হয়েছে, জারিফ সেটা জানে। সে এটাও জানে, প্রীতির পরিবার এখন আর তার সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে না। এখানে অবশ্য তাদের তো দোষ নেই। প্রতিটা বাবা, মা-ই তাদের মেয়ের জন্য ভালো ছেলে চাইবে। সে প্রীতিকে ফিরিয়ে দিলো না। খাবার মুখে তুলে নিলো। খাবার খাইয়ে দিতে দিতে প্রীতি গল্প বলছে। জারিফ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। খাওয়া শেষ হলে প্লেট রেখে ওষুধ নিয়ে আসে প্রীতি।

জারিফ মনের মধ্যে পুষে রাখা কথাগুলো আটকে রাখতে পারল না। বলল,’প্রীতি,আমার মনে হয় তোমার একটাবার আঙ্কেল-আন্টির কথা শোনা উচিত।’
‘কোন কথা?’
‘এইযে এখন তুমি যা করছ তা কি ঠিক করছ? সামনে তোমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ রয়েছে। তুমি চাইলেই ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবে। ভালো থাকতে পারবে। অযথা কেন আমার পেছনে সময় নষ্ট করছ?’
প্রীতি কতক্ষণ ওষুধ হাতে নিয়ে বসে থাকে। উত্তর দিতে পারে না কোনো। সে ওষুধগুলো রেখে জারিফের চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। জারিফের সেই মুহূর্তে মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট প্রীতির ঐ হাসিতে জমাট বেঁধেছে। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। প্রীতি বলে,’হ্যাঁ, চাইলেই আমি ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করতে পারব। এ কথাটা আসলেই সত্য। তবে সুখে থাকতে পারব না, ভালো থাকতে পারব না। আর তোমার পেছনে সময় নষ্ট করছি, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

জারিফ বাকহীন, দিশেহারা। প্রীতির ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলা কথাগুলো তাকে ভেতর থেকে ভেঙেচূড়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। সে এই মেয়েটিকে ছাড়তে পারবে না। পারবে না ভালো থাকতে। প্রীতির এক আকাশ সমান ভালোবাসা সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারবে না, কিছুতেই না। সে জড়িয়ে ধরে প্রীতিকে। শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। মন প্রশান্তিতে ভরে যায়। স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয় তার।
______
৫৫.
ছুটির দিন বিধায় বেশ সকাল করেই ঘুম থেকে উঠেছে ভূমিকা। যেহেতু আজ রাসেলের অফিস নেই, সেহেতু সকালে রান্নাবান্না করার ঝামেলাও ছিল না। সে হাই তুলে পাশে তাকায়। রাসেল নেই। ইদানীং রাসেল শরীর নিয়ে বেশ সচেতন। সকালে হাঁটতে বের হয়, জিমে যায়। ভূমিকে নিয়ে সে একদিন হাঁটতে বের হয়েছিল। এসব সকালে হাঁটাহাঁটি, বিদেশি কালচারের সাথে সে অভ্যস্ত নয়। একটুখানি হেঁটে আর দৌঁড়িয়েই সে হাঁপিয়ে পড়েছিল। হাঁটুতে দু’হাত রেখে উবু হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল আর বলেছিল,’আমি আর আসব না। শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।’
ভূমির এহেন অবস্থা দেখে রাসেল হেসে কুটি কুটি। হঠাৎ করে আজ এসব মনে পড়ায় ভূমিও মুচকি হাসে। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চুলায় চায়ের কেটলি বসিয়ে ঘরদোর সব গুছিয়ে ফেলে।

চায়ের পানি থেকে অল্প একটু গরম পানি তুলে নেয় আটা মাখানোর জন্য। সে ঝটপট কয়েকটা পরোটা বানিয়ে ফেলে। চা বানানো শেষে আলু ভাজি করে আর ডিম পোচ। স্বাস্থ্য সচেতন হলেও বাংলাদেশের এই ভারী খাবারগুলোই রাসেলের পছন্দ। টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে রাসেল বাড়িতে ফিরে আসে। মিষ্টি একটা হাসি প্রদান করে বলে,’গুড মর্নিং।’
‘মর্নিং।’ ভূমিও হেসে বলল।

দুজনে এক সাথেই খেতে বসে। রাসেল খেতে খেতে বলল,’আমি একটু বাইরে যাব। বাড়িতে আসতে লেট হতে পারে।’
‘মাত্রই তো বাইরে থেকে এলে।’
‘আরে এখন যাব বন্ধুদের সাথে ঘুরতে। তোমায়ও নিয়ে যেতাম। কিন্তু সব যাচ্ছে ছেলেরা মিলে।’
‘ওহ। সমস্যা নেই, ঘুরে এসো। একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার আছে।’
‘তুমি আমার ভালো বউ।’
‘ঢং।’
রাসেল শব্দ করে হেসে ফেলে। ভূমি আড়চোখে লুকিয়ে রাসেলের মুগ্ধ করা হাসিটা দেখে। খাবার শেষ করে রাসেল গোসল করে রেডি হয়ে নেয়। কালো প্যান্টের ওপর সাদা শার্ট পরেছে। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দেখতে সুন্দর লাগছে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বডি স্প্রে দিচ্ছিল রাসেল, ভূমি তখন আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মুচকি মুচকি হেসে বলে,’নায়ক সাহেব এত সেজেগুজে যে বের হচ্ছেন, যদি কেউ কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়?’
রাসেল আয়নায় তাকিয়ে মৃদু হাসে। কিছু বলে না। খাটের ওপর থেকে ওয়ালেট আর ফোন নিয়ে ভূমির উদ্দেশ্যে বলে,’আমি যাচ্ছি ভূমি। তুমি কিন্তু দুপুরে খেয়ে নিও।’
‘দুপুরের আগেই আসবে না?’
‘না। বললাম তো লেট হবে।’
‘তাহলে কি বিকাল হবে?’
‘সন্ধ্যা হতে পারে নয়তো রাত। বোঝোই তো সবাই মিলে একসাথে বের হচ্ছি।’
‘আচ্ছা সাবধানে যেও। টেক কেয়ার।’
‘তুমিও সাবধানে থেকো।’

রাসেল চলে যাওয়ার পথে ভূমি পিছু ডেকে বলে,’শোনো, ভালোবাসি।’
রাসেল ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,’ভালোবাসি।’
রাসেল বাইক নিয়ে দৃষ্টির আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত ভূমি দরজার কাছে দাঁড়িয়েই রইল। তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে এসে বসে। আজ একটু রাসেলের সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল তার। থাকুক, রাসেলের নিজেরও কিছু সময় প্রয়োজন। তবে ভূমি জানে, এ কথা যদি সে রাসেলকে বলতো তবে সে আজ যেত না। কতক্ষণ একা একা ভালো লাগে? তাদের বাড়ির পাশেই অনেক বাড়ি রয়েছে। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের সাথে তার টুকটাক কথা হতো। একজন বাংলাদেশি আছে। তার সাথে ভূমির বেশ ভালোই সম্পর্ক। তাই বাড়িতে তালা দিয়ে সে ঐ বাড়িতে যায়। দরজায় নক করতেই মিসেস চৌধুরী দরজা খুলে দেয়। ভূমিকে দেখেই তিনি ভীষণ খুশি হয়ে বললেন,’এসো এসো ভেতরে এসো। তোমাকে তো তেমন দেখাই যায় না। সারাদিন করো কী বাড়িতে?’
‘এইতো টুকটাক বাড়ির কাজ করি। আর সারাদিন ঘুমাই।’ ভেতরে যেতে যেতে বলল ভূমি। সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল,’বাড়ির বাকিরা কোথায়?’
‘বাচ্চারা বায়না ধরেছে ওর চাচার বাসায় যাবে। তাই একটু আগে ওদের বাবা নিয়ে গেল।’
‘আপনি গেলেন না কেন?’
‘ইচ্ছে হয়নি। তুমি কী খাবে বলো?’
‘আমি কিছুই খাব না। মাত্রই খেয়ে বের হয়েছি।’
‘তা বললে তো হবে না। কফি তো খাওয়া যেতেই পারে। বসো তুমি।’

মিসেস চৌধুরী দুই মগ কফি নিয়ে এসে পাশে বসলেন। এক মগ ভূমিকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’তোমার হাজবেন্ড কোথায়?’
‘বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে।’
‘তাই তো বলি, অফ ডে তে ভূমিকা আজ আমার বাসায় কেন।’ বলেই তিনি হাসলেন। তার সঙ্গে ভূমিকাও হাসিতে যোগ দিলো। তিনি হুট করে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। বললেন,’চলো আজ আমরা দুজন গিয়ে আশেপাশে কোথাও ঘুরে আসি।’
প্রস্তাবটা তার পছন্দ হলেও তৎক্ষণাৎ রাজি হতে পারল না। যদি রাসেল কিছু বলে? সে বলল,’আগে রাসেলকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি?’
‘জিজ্ঞেস করার কী আছে আবার? আমার সাথেই তো বের হচ্ছো। কোনো সমস্যা হবে না। রাসেল তো আমায় চেনে। তাও তুমি ফোন দিয়ে একবার বলে নাও।’

ভূমি বেশ কয়েকবার রাসেলের নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। মিসেস চৌধুরী বললেন,’বিজি আছে মনে হয়। তুমি আমার সাথে চলো। রাস্তায় ফোন দিলে তখন আমি কথা বলবোনে।’
ভূমি আর না করতে পারল না। রেডি হয়ে তার সাথে বের হয়ে পড়ে।

প্রথমে দুজনে আমেরিকার বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরে। রেস্টুরেন্টে কিছু খেয়ে যায় শপিং-এ। কিছু কেনাকাটা করে। এর মাঝে রাসেল ভূমিকে কলব্যাক করেনি। শপিংমল থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। মিসেস চৌধুরী বললেন,’চলো রেস্টুরেন্টে খেয়ে, বাড়ি চলে যাব।’
‘আমার তো ক্ষুধাই লাগেনি আপু।’
তিনি হেসে বললেন,’চড়ুইপাখির মতো পেট হলে যায় হয় আরকি! অল্প হলেও খেতে হবে, চলো।’
রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পথে তিনি ভূমির হাত চেপে ধরে বলেন,’ঐটা রাসেল না?’
ভূমি চমকিত হয়ে তার ইশারাকৃত স্থানটিতে তাকায়। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,’হ্যাঁ, হ্যাঁ ওটা তো রাসেলই। তুমি যে বললে ওর বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে? সাথে তো একটা মেয়ে ছাড়া অন্য কাউকে দেখছি না।’
ভূমি শান্তকণ্ঠে বলল,’না, আপু। ঐটা রাসেল নয়।’
‘কী বলো তুমি? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ও রাসেল। চলো যাই গিয়ে ডাকি।’
‘আরে না! অযথা অন্য মানুষের পিছু কেন করতে যাব আমরা? ঐ ছেলেটা সাদা শার্ট পরে আছে। রাসেল তো আজ নীল শার্ট পরে গেছে। দাঁড়ান আমি ওকে কল দিচ্ছি। রিং হলে হয় কাটবে নয়তো রিসিভ তো করবে।’

ভূমি ফোন করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। না, ঐ মানুষটি ফোন তুলছে না। ভূমি বলল,’দেখেছেন, বললাম না ঐটা রাসেল না?’
‘ও। আমারই তাহলে দেখার ভুল।’
ভূমি হাসল। বলল,’এখন তাহলে রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক?’
‘হ্যাঁ, চলো।’
রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার অর্ডার করলেন মিসেস চৌধুরী। তিনি শপিং নিয়ে কথা বলছেন। ভূমির মন অস্থির। সে চেষ্টা করছে তার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার। খাওয়ার সময়ে খেয়াল হলো, খাবার তার গলা দিয়ে নামছে না। সে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। রাসেলকে কল দিতে গিয়েও আবার দেয় না। সে তখনো রাসেলকে ফোন করেনি। আসলে কল করার কথাটি মিসেস চৌধুরীকে মিথ্যে বলেছিল সে!

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। পর্ব ছোটো হওয়া নিয়ে কেউ অভিযোগ করবেন না প্লিজ! পরীক্ষার মধ্যে লেখাটাই অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। তবুও সময় সুযোগ পেলে, লিখে পোস্ট করি। পরিবর্তী পরীক্ষাগুলোর মাঝেও লেখার সুযোগ পেলে পোস্ট করে দেবো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here