বিয়ে পর্ব ৩

0
252

#বিয়ে
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৩

ধ্রুব রেগে বলল,
— চেঞ্জ করার সময় দরজা লক করতে হয় এটুকু কমনসেন্স নেই তোমার?
অদ্রি এগিয়ে এসে ধ্রুবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর কঠোর গলায় বলল,
— আছে।
বলেই ওর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। ধ্রুব বাক্যহারা হয়ে গেলো। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে ধ্রুব’র। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। না চাইতেও সে যে চেঞ্জ করা দেখে ফেলেছে এটা বললে বোধহয় মেয়েটা ওকে খু’নই করে ফেলবে! কিন্তু এই ধ্রুবকে চোখ রাঙানোর সাহস করে কি করে এই মেয়ে? ধ্রুব’র বউ বলে? ধ্রুব সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

কাপড় চেঞ্জ করা শেষে অদ্রি দরজা খুলে দিলো। শায়লাকে খোঁজার জন্য বাইরে পা রাখতেই ধ্রুবকে চোখে পড়লো তার। বিরক্তি ভঙ্গিতে রুমে ফিরতে যাবেই তার আগেই
ধ্রুব চেহারায় কঠোর ভাব এনে বলল,
— নিজেকে খুব বেশি ইম্পোর্টেন্ট ভাবার কিছু নেই। বলতে হয় বলেই বলছি এই বাড়িতে মা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই, তাই চেঞ্জ করার সময় দরজা আটকে নিলেই তোমার জন্যই মঙ্গল।
অদ্রি রুক্ষ স্বরে বলল,
— বাড়িতে যেহেতু মা-বউ রয়েছে তাই ঘরে ঢোকার আগে নক করে ঢোকা উচিৎ। একপাক্ষিক কথা বললেই চলে না। নিজের ভুল স্বীকার করতে শেখেন। ভুলটা আপনি করেছেন কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার বিন্দুমাত্র লেশ আপনার মধ্যে দেখছি না। এসব শিক্ষা কি আপনার নেই?
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বলল,
— আমার ভুল? দরজা তো তুমি লক করোনি!
— সেটা বড় ব্যাপার নয়। নতুন বাড়িতে এ ধরনের প্রবলেম হতেই পারে, কিন্তু বাড়ির সদস্যদের এক্ষেত্রে সুন্দর মনোভাব বজায় রাখতে হয়।
ধ্রুব রেগে বলল,
— কি বোঝাতে চাইছো? আমাদের মনোভাব খারাপ?
অদ্রি বলল,
— না তো। আমি আপনার উদ্দেশ্যেই কথাটা বলেছি।
ধ্রুব উঁচু গলায় বলল,
— তারমানে আমাকে তুমি সরাসরি খারাপ ছেলে বলছো?
অদ্রি ঘরের দরজা ভিড়াতে ভিড়াতে ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,
— হুঁ।

ইগনোর! কি দারুণভাবে অদ্রি বুঝিয়ে দিয়েছে ধ্রুবকে সে ইগনোর করতে চাইছে! ধ্রুবের ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। এই প্রথম কেউ ওকে এত বাজেভাবে ইগনোর করছে। ধ্রুব চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলালো। রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। কি ভেবে এসেছিলো মেয়েটিকে উপদেশ দিতে? ভালোর জন্যই তো! কিন্তু এই মেয়ে উলটো তাকেই খারাপ বানিয়ে দিয়েছে। এত সাহস? সরাসরি আবার এটা বলছেও? মা-বাবা এ কোন মেয়ের পাল্লায় ফেলে দিলো ওকে? এমন একটা মেয়েকে কি দেখে ওদের ভালো লেগেছে যে ধ্রুবর গলায় ওকে ঝুলিয়ে দিয়েছে? ধ্রুব রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। আজ এর একটা হ্যাস্তন্যাস্ত করতেই হবে!

আশফাক সাহেব পুত্রের সাথে বাগবিতণ্ডা করতে চায় না বলেই দোতলার গেস্টরুমে দরজা বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আর শায়লা হাসান মগে গরম দুধ ঢালছেন।।অদ্রিকে নিজের রুমে ফ্রেশ হতে বলে একটু রান্নাঘরে এসেছেন হরলিক্স বানাতে। অদ্রির মতো পুতুল দেখতে মেয়েটাকে নিজের মেয়ে করে নিয়ে এলেন, অদ্রি-ধ্রুবকে কি সুন্দর মানিয়েছে। কথাটা ভেবেই তার মনটা ভালো হয়ে এলো। আর ঠিক তখনি ধ্রুব এলো। নিজের রাগ সংযত করে প্রশ্ন করল,
— এসব হচ্ছেটা কি মা? তোমরা কি আমার লাইফ
নিয়ে একটুও চিন্তিত নও? লাইফ পার্টনার আমার প্রয়োজন নেই, আমি কখনোই ওকে মানবো না। তোমরা আর জোর করতে পারবে না আমায়।
শায়লার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলো। কিন্তু তিনি বিচলিত হলেন না। ব্যাপারটিকে এভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এসব চিন্তা করেই তিনি পুত্রের দিকে তাকিয়ে
ভাবলেশহীনভাবে বললেন,
— তুমি না মানলে আমি বা তোমার বাবা জোর
করতে পারি না। কিন্তু তুমি আর কখনোই আমাকে মা বলে ডেকো না। আমি এমন ছেলে চাইনা যে তার মায়ের সিদ্ধান্তকে অসম্মান করে, নিজের স্ত্রীকে বউ বলে মানতে চায় না। আমি হয়তো তোমাকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
ধ্রুব হতভম্ব হয়ে বিরক্তিকরভাবে বললো,
— এসব কি বলছো তুমি?
শায়লা এগিয়ে এসে বলল,
— তুমি চাইলে তোমার পা ছুঁয়ে মাফ চাইবো। নিজেদের ভুলের ক্ষমা চাইবো৷

ধ্রুব’র মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। মা কি পাগল হয়ে গেলো? এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হুট করেই বেরিয়ে গেলো। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করলো। মা কিভাবে অন্য একটা মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকে মা ডাকতে নিষেধ করলো ধ্রুব ভেবে পেলো না। ভাবনার মাঝেই কখন যে চোখদুটো আপনাআপনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো টের পেলো না ধ্রুব!

রাতে অদ্রি থেকেছে শায়লার সাথে। অদ্রির মায়ের
সাথে তার বন্ধুত্ব, একসাথে গ্রাম ঘুরে দেখা, কতদিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছে সেসব গল্প বলছিলো শায়লা। একসাথে কলেজে পড়া এবং বেড়ে ওঠা তাদের।
অদ্রি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো সবকিছু। মন হালকা লাগছিলো ওর। শায়লা যখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো অদ্রি শায়লার মাঝে নিজের মাকে বহুদিন পর পেলো। ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তেই শায়লা ধমক দিয়ে বললেন,
— একদম কাঁদবি না। মায়ের সামনে মেয়ের কান্না করতে নেই। আবার কাঁদতে দেখলে ঠাটিয়ে চড় মারবো বোকা মেয়ে।
অজান্তেই অদ্রি হেসে ফেললো। এত অধিকারবোধ আর স্নেহমাখা আচরণ তার মা’কে মনে করিয়ে দেয়।
অদ্রি নিজেকে হালকা অনুভব করলো। বলল,
— আন্টি, আমার কি এখন থেকেই আপনাকে মা বলতে হবে?
শায়লা ঠাট্টা করে বলল,
— কেন নয়?
অদ্রি ইতস্তত করে বলল,
— না এমনি।
শায়লা অদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— তোর যখন ইচ্ছে তখন থেকে ডাকবি। না পারলে আন্টি ডাকিস। কিন্তু মোটেও আপনি বলবি না।
— তাহলে?
— তুমি করেই বলবি। বুঝলি?

অদ্রি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। শায়লাকে ওর খুব ভালো লাগছে। আজকালকার দিনে এরকম মনখোলা মানুষ পাওয়া দুষ্কর। এতটুকু সময়ের মধ্যে অদ্রির মনে যতটুকু জায়গা করে নিয়েছে তার ছিঁটেফোঁটা সাথী বেগমও করতে পারেনি বা করার চেষ্টা করে নি।
নতুন জায়গায় অদ্রি অস্বস্তিবোধ করবে দেখে আশফাক সাহেব অন্য ঘরেই ঘুমালেন। এভাবেই নানান গল্প করতে করতে শায়লা একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন।
এদিকে অদ্রির চোখে ঘুম নেই। কিছু ঘন্টার ব্যবধানে নিজের ঘর, বিছানা-বালিশ ত্যাগ করে পুরোপুরি নতুন একটি বাড়িতে সে আছে তা মেনে নিতে চাইছে না এই মন। ঘুম ভাঙলেই যেন সে দেখবে এটা স্বপ্ন ছিলো এই আশায় নির্ঘুম এক রাত কাটলো ওর। ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে এলো ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে।

যখন ওর ঘুম ভাঙলো দেখলো তখন সূর্যের কিরণ
খানিকটা তেজস্বী। হালকা বাতাস জানালা ঠেলে ঢুকছিলো। নিজেকে অচেনা জায়গায় দেখে খুব
অবাক হলো অদ্রি। তারপর ধীরেধীরে যখন সব মনে পড়লো তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে পড়লো বিছানা থেকে। দেয়াল ঘড়ি বেলা বারোটার কাঁটায়।
অদ্রি বুঝে পেলো না এখন তার কি করা উচিৎ।
দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে শায়লাকে খুঁজতে
নিচে নামছিলো। হঠাৎই হাসির শব্দ শুনে ও চমকে গেলো। লিভিংরুমে বসা একদল মহিলা। অদ্রিকে দেখিয়ে তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠলো,
— এইটাই বউ নাকি? গেঞ্জি-প্যান্ট পইরা নতুন বউ যে ঘুরাফেরা করে তা স্ব চক্ষে দেইখা নিলাম।
পাশ থেকে আরেকজন বলল,
— এই বাড়িতে কোনো মেয়ে আছে নাকি? এটাই
বউ হইবো। শায়লা ভাবির মাথায় কি আক্কেল
নাই যে নতুন বউ এইসব পোশাকে ঘরময় ঘুরে
বেড়ায়?
— আরে আস্তে কও। শায়লা ভাবি এইসব পছন্দ
করবে না। তার বউ সে যেভাবে ইচ্ছে রাখুক।
আমাদের কি?
— সমাজ, আত্মীয় বইলা একটা কথা আছে। এগুলা মাথায় রাখতে হয়।
শায়লা এসে কথাগুলো শুনে ফেললো। এসে কিছু কঠোর কথা বলতে যাবে তখনি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্রিকে চোখে পড়ে। বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে
পড়ে যায় অদ্রি। ঠিকই তো, ও এভাবে কেন ঘুরে বেড়াবে? ও কি এখানকার কিছু চেনে? ওর তো ঘরেই বসে থাকা উচিৎ ছিলো। এত অপমান শুনে অদ্রি একদৌড়ে ঘরে চলে গেলো। কান্না পাচ্ছে তার। একটু পরই শায়লা ঘরে এলেন। ওকে এভাবে বসে থাকতে
দেখে বললেন,
— ওদের কথায় পাত্তা দিবি না। আমি কি ছেলের
বউ এনেছি নাকি? মেয়ে এনেছি। আমার বাড়িতে
আমার মেয়ে যেটায় কমফোর্টেবল ফিল করে সেটাই
পরবে। তোর ইচ্ছে হলে তুই শাড়ি-থ্রিপিস পরবি, নয়তো না। মানুষের কথায় কান দিতে গেলে দেখবি
তুই তোর নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছিস। বুঝলি? এবার
কান্না বন্ধ কর।
অদ্রি ভেজা চোখ নিয়ে হেসে বলল,
— তুমি খুব ভালো আন্টি, একদম আমার মায়ের মতো।
— হয়েছে আর প্রশংসা করতে হবে না। ফ্রেশ হয়ে নিচে খেতে আয় আমার সাথে। ওরা নতুন বউ
দেখতে এসেছে। একেকজন একেক কথা বলবে,
পাত্তা দিবি না। এজন্যই ছেলেকে নিজে একা গিয়ে বিয়ে দিয়েছি।
— মোটেও প্রশংসা করছি না। তুমি আসলেই ভালো। আচ্ছা আমি তাহলে জামা পরে নেই?
শায়লা ভ্রু কুঁচকে বলল,
— একটু আগে কি বললাম মনে নেই? তোর যেটাতে
কমফোর্টেবল লাগে সেটাই পর!
অদ্রি বলল,
— থ্যাংকস তোমাকে।
শায়লা চোখ টিপে হেসে বললেন,
— আমার ছেলে তোকে দেখে কবে যে দিন-দুনিয়া ভুলে যাবে আমি শুধু সেটাই ভাবছি!
অদ্রি শুধু হাসার চেষ্টা করলো। অমনি দরজা থেকে ভেসে আসলো ধ্রুবের গলা,
— তোমার এই মেয়েকে দেখে দিন-দুনিয়া ভুলে যাবে এই ধ্রুব? এই স্বপ্ন শুধু দেখেই যাও। এই দিন যেদিন আসবে সেদিন তোমরা যা বলবে আমি তাই করবো। নিজেকে যে কি ভাবে! হাহ,পাগলের সুখ মনে মনে!

বলেই ধ্রুব বাঁকা হাসলো। আর অদ্রি খিটমিট করে চাইলো ধ্রুবের প্রতি! শায়লা বোকার মতো দুজনকে দেখছে।

[ দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা করে বাসায় এসে গল্প লিখেছি। আপনারা নিজেদের মন্তব্য জানাবেন। নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here