#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৯
ঘুমন্ত অদ্রিকে ধ্রুব যেন কতকাল পরে দেখছে। বহুদিন পর ওকে এত কাছে দেখে ধ্রুব’র গলা শুকিয়ে আসে। ও অদ্রির কপাল থেকে চুল সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে দেয়। তখনই অদ্রি নড়েচড়ে ওঠে, আচমকা চোখ খুলে তাকায়। প্রথমে বুঝে ওঠতে পারে না ও কোথায় আছে, পরক্ষণেই সব মনে পড়ে। অন্ধকারে হঠাৎ ধ্রুবকে নিজের কাছে দেখে অদ্রির ভ্রু কুঁচকে যায়। এদিকে ধ্রুবও বেশ ঘাবড়ে যায়। ও ভাবতেই পারেনি এভাবে ধরা পড়ে যাবে। অদ্রি চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,
— আপনি এখানে কি করছেন?
ওর চিৎকারে ধ্রুব কিছুটা দূরে সরে গেলো। অদ্রি প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। এদিকে ধ্রুব হতচকিত হয়ে গেলো। ওর মাথায় কোনো অজুহাত আসছে না। অদ্রির প্রশ্নের জবাবে কি বলবে এবার সে? প্রমিজ করেছিলো তো সে অদ্রির কাছাকাছি যাবে না। কথা তো সে রাখেনি। আসলে ধ্রুব তো যেতে চায়নি, মনটাই তো আপনাআপনি ওকে অদ্রির কাছে টেনে নিয়ে গেছে। ধ্রুব নিজেকে গালি দিতে লাগলো। কোন কুক্ষণে যে ওখানে গিয়েছিলো, অদ্রি তো ওকে এবার খারাপ লোকই ভাববে! ও আমতা-আমতা করেই বলল,
— তো তোমার ঘুম ভেঙে গেছে? আসলে ঘরে অনেক মশা তো, আমি ভাবছিলাম কি করা যায়…
এতক্ষণ অদ্রি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর হৃদযন্ত্র বেশ দ্রুত ছুটছে। ধ্রুব’র কান্ড দেখে ওর চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে। লোকটা এমন কান্ড করবে ও তো ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি! অন্ধকার মিশে আছে ঘরের আনাচে-কানাচে। শেষ রাতের মুগ্ধ হাওয়া জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছিলো। সেই আলোয় অদ্রি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ধ্রুবকে দেখতে পেলো। কি জানি ওকে এভাবে দেখে, ওর কথা শুনে অদ্রির ভীষণ হাসি পেয়ে গেলো। শব্দ করে এবার হেসেই ফেললো।
এদিকে অদ্রিকে হাসতে দেখে ধ্রুব চমকে গেলো। এতটাই চমকালো যে ও নড়তে ভুলে গেলো। তারপর!
শেষ রাতের প্রকৃতির রুপে মুগ্ধ হওয়া প্রেমিকের মতো ও বলে ফেললো,
— এইযে, তোমার হাসি কি দারুণ! অথচ আমার সাথে এভাবে কখনোই হাসো না তুমি। কেন অদ্রি?
অন্ধকারে ধ্রুব’র মুখটা ঠিক ভালোভাবে বোঝা যায় না।
বাইরের আলোতেই অস্পষ্টভাবে সব বোঝা যাচ্ছে। অদ্রি আঁচ করতে পারলো ধ্রুব’র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। ওর মুখে এই কথা শুনে অদ্রি হাসি থামিয়ে ফেললো। একটুক্ষণ বিরতি! ধ্রুব’র কথার জবাব দিলো না অদ্রি। বরং প্রশ্ন করলো,
— সিরিয়াসলি? আপনি মশা তাড়ানোর জন্য আমার কাছে গিয়ে ভাবছিলেন যে কি করা যায়?
ধ্রুব মুখ গোঁজ করে উত্তর দিলো,
— দেখছিলাম তোমাকে মশা বিরক্ত করছে কিনা…
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে বলল,
— কিন্তু আমি তো কোনো মশা দেখতেই পাচ্ছি না। এ ঘরের মশা কি শুধু আপনাকেই কামড়ায় নাকি?
ধ্রুব ধরা পড়তে চাইলো না। সেজন্য বলল,
— তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না! নিচে মশা আছে অনেক…
অদ্রি বলল,
— আমি তো অবিশ্বাস করিনি।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। এরপর ঘরের লাইট অন করলো। মুহূর্তেই সাদা আলোতে ঘর ভেসে গেলো। আচমকা চোখে আলো পড়ায় চোখ কুঁচকে গেলো ধ্রুব’র। ও বিরক্তি নিয়ে বলল,
— করছোটা কি? আলো জ্বালালে কেন?
অদ্রি ব্যস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
— আপনাকে তো মশা বিরক্ত করছে, সেজন্য স্প্রে
করে দিচ্ছি। নয়তো ঘুমাতে পারবেন না।
ধ্রুব অনেকটা ব্যঙ্গ করেই বলল,
— আমার জন্য এতকিছু না করলেও চলবে।
অদ্রি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— কেন?
ধ্রুব জোর গলায় বলল,
— তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।
অদ্রি চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব’র আচরণ বেশ অদ্ভুত। অদ্রি ওর কথায় তেমন গা করলো না। একটা মশাও ওর চোখে পড়লো না তবুও চুপচাপ ঘরে স্প্রে করে দিলো। ধ্রুব’র পিঠ ব্যথা করছে। মেঝেতে শোয়ার ওর অভ্যেস নেই। সেটা মুখফুটে বলতেও পারছে না। ওর মুখভঙ্গি দেখে অদ্রি সেটা মুহূর্তেই বুঝে গেলো। হতাশ গলায় বলল,
— আপনি বিছানায় আসুন তো!
ধ্রুব অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে৷ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। পরক্ষনেই এদিক-ওদিক দেখার ভান করে বলে ওঠলো,
— কাকে কি বলছো?
অদ্রি কটমট করে বললো,
— আমি তো ভূত দেখতে পাচ্ছি না ঘরে। আপনি পাচ্ছেন?
ধ্রুব ওর ত্যাড়া কথা শুনে এক মুহূর্ত থম মেরে বসে রইলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে অদ্রি বিছানায় শুয়ে পড়লো। ধ্রুব আর দেরি করলো না। তড়িঘড়ি করে বালিশ নিয়ে বিছানায় চলে এলো। যাক বাবা, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নয়তো অদ্রির মন আবার ঘুরে যাবে। তখন হয়তো এ ঘরেই আর ওর থাকা হবে না। ধ্রুব বিছানার অন্যপাশে নিজের জন্য জায়গা করে নিলো। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখলো অদ্রির থেকে।
অদ্রি কপাল কুঁচকে ওর কর্মকাণ্ড দেখলো।
ধ্রুব হেডবোর্ডে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আই থিংক তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না?
অদ্রি তেজ নিয়ে বলল,
— সমস্যা হলেও কি আর করা যাবে, তবুও মানিয়ে নিচ্ছি। আর আপনি তো আমার এ ঘরে থাকা নিয়ে যা হুলস্থুল করেছিলেন…
ধ্রুব ভড়কে গেল,
— কখন?
— ভুলে যান কেন আপনি? সবকিছু মনে রাখা প্রয়োজন জীবনে চলতে গেলে।
ধ্রুব’র ইচ্ছে করলো ওকে বলতে, “এখন সবকিছু মানিয়ে নেওয়া যায় না?” কিন্তু বললো না। সব কথা মুখে কেন বলতে হবে? বুঝে কেন নেয় না? ও কপট রাগ নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলালো। এরপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
— একটা প্রশ্ন…
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই অদ্রি ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,
— বলে ফেলুন!
ধ্রুব একরাশ অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— তুমি তখন রাদিফের সাথে এতো হেসে হেসে
কি কথা বলছিলে?
অদ্রি অবাক গলায় বলল,
— গেস্টের সাথে তাহলে কিভাবে কথা বলা উচিৎ আমার?
ধ্রুব বিরক্ত গলায় বললো,
— না সেটা মিন করিনি। তুমি তো আমার সাথে এভাবে কথা বলো না। সেজন্য জানতে চাইছি!
অদ্রির চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছিলো। ধ্রুব’র প্রশ্নের উত্তর দিলো,
— ওনি বলছিলেন আমি খুব কিউট, হাসিটা সুন্দর।
তাই ভদ্রতাসূচক হেসেছি।
উত্তর দিয়েই অদ্রি উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। ফর্সা মুখ রাগে, ক্ষোভে লাল হয়ে ওঠলো ধ্রুব’র। মুঠোতে ধরে রাখা চাদর দুমড়েমুচড়ে ফেললো। চোখ বন্ধ করে নিজের অস্থিরতা প্রশমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। খুব নিচু স্বরে বলতে লাগলো,
— আ’ম স্যরি, আ’ম স্যরি, আ’ম স্যরি অদ্রি।
কিন্তু অদ্রি ওর সেই কথা শুনতে পেলো না।
ধ্রুব’র চোখ লাল হয়ে আছে। প্রথম পরিচয়েই রাদিফ যেখানে এ কথাগুলো বলতে পেরেছে সেখানে ধ্রুব আজ পর্যন্ত কখনোই অদ্রিকে এই কথাগুলো বলতে পারে নি, প্রশংসা করে নি। অদ্রির প্রতি ভালো লাগা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সবসময় ওকে খোঁচা দিয়েছে, কটুক্তি করেছে। এরপর চেয়েছে অদ্রি নিজে থেকে সবকিছু করুক, ধ্রুব’র মন বুঝুক। কিন্তু ও তো কখনোই তেমনভাবে অদ্রিকে বোঝার চেষ্টা করেনি! ওর মনে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারেনি এতদিনেও!
তাহলে ও ভাবে কি করে যে অদ্রির মতো মেয়ে ওর সাথে সহজ আচরণ করবে?
শুক্রবার। ছুটির দিন। সকালের কমলা রঙের
রোদ্দুর এসে পড়ছে ছাদের কার্নিশে। আকাশ ঘন নীল। মেঘ নেই একদম। টবে লাগানো বাগানবিলাস গাছটি গোলাপিবর্ণের পাতা নিয়ে ঠাঁই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে ছাদজুড়ে। রোদ ঝলমলে প্রকৃতি। জরিনা ছাদের গাছগুলোর পানি দিচ্ছে। অদ্রি চেয়ারে বসে আকাশ দেখছে। আর ওর পাশে ফ্লোরা বসে নিজের
নানান মজার গল্প বলছে। অদ্রি সেগুলো শুনে হাসছে৷ অনেকক্ষণ নিজের গল্প শোনানোর পর এবার ফ্লোরা অদ্রিকে জিজ্ঞেস করল,
— তো আজকের প্ল্যান কি?
অদ্রি বুঝতে না পেরে বলল,
— কিসের প্ল্যান?
ফ্লোরা উচ্ছ্বসিত কন্ঠ বলল,
— আজ তো ছুটির দিন। সারাদিন কি করে কাটাবে তারই কোনো প্ল্যান করলে কি-না!
অদ্রি মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলো,
— এইতো, পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকবো। ছুটির দিন নিয়ে আমার আলাদা কোনো প্ল্যান থাকে না।
ফ্লোরা খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
— কেন? তোমরা তো কাপল। ব্রো তোমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যায় নি?
অদ্রি চুপ রইলো। ঠোঁটে অন্যরকম হাসি। ফ্লোরা যেন উত্তরটা নিজেই বুঝে নিলো। যেন এহেন আজগুবি কথা সে খুব কমই শুনেছে। ও বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠলো,
— কি বলো! ছুটির দিনে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যায় না এটা কোনো কথা নাকি! করে টা কি সারাদিন?
অদ্রি এই প্রশ্নে ইতস্তত করে বলল,
— আমি ঠিক জানি না।
ফ্লোরা এবারেও অবাক হলো। ও সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে সরাসরিই প্রশ্ন করলো,
— আমি আসলে বেশ কৌতূহলী একটা মেয়ে। কোনোকিছু আশেপাশে অস্বাভাবিক দেখলে যতক্ষণ না জানতে পারবো ততক্ষণ সেটা মনের ভেতর খোঁচাবে। আমি কি তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো? পার্সোনাল বলতে পারো! নিজের মধ্যেই রাখবো, কারো সাথে শেয়ার করবো না।
অদ্রি হাসার চেষ্টা করে বলল,
— বলো।
ফ্লোরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠলো,
— তোমার কথাগুলো শুনে আমার কাছে তোমাদের সম্পর্কটা বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। আমার ধারণা কি সত্যি?
অদ্রি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— হয়তো সত্যিই। আমাদের সম্পর্কটা এখনো স্বাভাবিক নয়, কখনো হবে কি-না আমি শিওর নই।
ফ্লোরা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো। ওর মন খারাপ হয়ে গেলো। তবে এসব ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করায় ও অভ্যস্ত নয়, আর ব্যাপারটা শোভনীয়ও নয়। তাই
আর কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলো না অদ্রিকে। চলে গেলো অন্য প্রসঙ্গে। একটু পরেই সিঁড়িঘরে জুতার শব্দ পাওয়া গেলো। রাদিফ আর ধ্রুবকে দেখা গেলো। ধ্রুব’র হতে কফির মগ, রাদিফের হাতে জুস। অদ্রি আর ফ্লোরাকে বসে থাকতে দেখে রাদিফ এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। হেসে হেসে নানান কথা জিজ্ঞেস করলো। বলা চলে টুকটাক গল্পই জুড়ে দিলো তিনজন। ধ্রুব শুধু ইটের ওপর বসে শুধু অবলোকন করছিলো ওদের গল্প-আলাপ। একপর্যায়ে রাদিফ অদ্রিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— সম্পর্কে তুমি “ভাবি” হলেও আমি এক্ষেত্রে আনইজি ফিল করছি, কারণ তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমি তোমাকে শুধু ‘অদ্রি’ বলেই ডাকি?
এরপর রাদিফ ধ্রুব’র দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— তুই আবার কিছু মনে করবি না তো?
তপ্ত রোদ্দুরের মতো তেজি ধ্রুব’র কন্ঠ,
— আমি মনে করি ‘ভাবিই’ সুইটেবল৷
কিন্তু অদ্রি ওর কথা গ্রাহ্যই করলো না। বলল,
— আপনি ওনাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন?
ভাবি ডাকে আমি অভ্যস্ত নই। অদ্রি বলে ডাকলেই আমি খুশি হবো।
ধ্রুব ওর এই কথা শুনে হাতে থাকা কফির মগ ছুঁড়ে ফেলে গটগটিয়ে হেঁটে নেমে পড়লো ছাদ থেকে। আর তিনজোড়া চোখ একরাশ বিস্ময় চেয়ে রইলো টুকরো হয়ে পড়ে থাকা মগটির দিকে!
[ অদ্রির স্বভাব নিয়ে যাদের রাগ বা আক্ষেপ আছে তাঁরা একটু ধৈর্য্য ধরুন!]
চলবে…