#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
( কপি নিষিদ্ধ )
বাগানে তৈরি করা বসার জায়গার পেছনে বড়বড় করে লেখা ‘ ধ্রুব ও নিনীকার হলুদ সন্ধ্যা।’ পাশাপাশি বসে আছে ধ্রুব ও নিনীকা। নিনীকার পড়োনে হলুদের মধ্যে সুন্দর কাজ করা লেহেঙ্গা। ফুলের গহনা পড়ানো হয়েছে। ধ্রুবর পড়োনে হলুদ পাঞ্জাবি। ধ্রুব সবাইকে দেখিয়েই বউয়ের হাত ধরে বসে আছে।
সর্বপ্রথম হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন ধারা ও ফাহিম। তারপর একে-একে সমস্ত আত্নীয়রা। নিনীকার দু-চোখ কাউকে খুঁজছিলো।
সবার শেষে একটি মমতাময়ী হাত ছুঁয়ে দিলো নিনীকার গাল। মিথিলা একা নন পাশে রমজান শেখ দাড়িয়ে আছেন। সবার নজর এদিকেই। আত্নীয়দের মধ্যে একজন বলেই ফেললেন,
‘ কতো ইয়াং শ্বশুর শ্বাশুড়ি ধ্রুবর। ‘
রমজান শেখ হাতে হলুদ নিলেন, সবার আগে ধ্রুবর গালে ছুয়ালেন। তারপর নিনীকার গালে লাগিয়ে দিয়ে হাসলেন। নিনীকা শক্ত হয়ে বসে রইলো। বিস্ময়ে সে কথা বলতে পারছে না।
রমজান শেখ হাতের গিফটটা ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিলেন। ধ্রুব হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করলো। ফটোশুট হলো। খাওয়া দাওয়া হলো। সবশেষে দুজনকে বাগানে ব্যবস্থা করা জায়গায় বসিয়ে গোসল করানো হলো। ধ্রুব বউকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। ধারার আদেশে নিনীকাকে ফারিনের রুমের ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
তারপর এলো মেহেদী লাগানোর পর্ব। ডোয়িং রুমে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিনীকা ও ধ্রুবের পড়োনে সবুজ রঙের কারুকাজ করা পোশাক। নিনীকার হাতে প্রথম মেহেদী ধ্রুব নিজেই লাগিয়ে দিলো। বড়বড় করে লিখলো ‘ধ্রুব’ নামটি। বউয়ের মেহেদী দেওয়া শেষে ধ্রুবর হাতে মেহেদী লাগানো হলো। হাতের নখে মেহেদী দিয়ে মাঝে বউয়ের নামটাই লিখতে দিলো শুধু।
মেহেদীর ফটোশুট শেষ হতে হতে রাত্রীর বারোটা বেজে গেছে। নিনীকার দু-চোখ সেই দুজন ব্যক্তিকে খুঁজছে মনে মনে। ফারিনের থেকে জানতে পেরেছে তারা হলুদের অনুষ্ঠানের পরপরই চলে গেছেন, ধারা জোর করলেও থাকেন নি।
পুরো দু’তলা আত্নীয় স্বজনে ভর্তি। ধ্রুবর রুমে তার মামাতো দু’টো ভাইও থাকবে। খাওয়া দাওয়া করে সবাই একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে চলে গেলো। ভোরের আগে উঠে আবার বিয়ের আয়োজন করতে হবে। যদিও ধারা কমিউনিটি সেন্টারে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফাহিম মাহবুব তাতে নারাজ। তাদের বংশের কারো বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হয়নি। বউ কথা কও এই হয়েছে৷
বিয়ের দিন। ভোরে উঠতে হয়েছে সবাইকে। বাদ যায়নি ধ্রুব ও। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকেও কাজ করতে হচ্ছে। বাবুর্চি ইতিমধ্যে বাগানে রান্না করার জন্যে আগুন ধরিয়ে ফেলেছে। সবাই কিছু না কিছু করতে ব্যস্ত। ধারা কিচেনে গিয়ে নাস্তা বানিয়ে নিলেন। কম হলেও চল্লিশ জনের মতো হবে। অনুষ্ঠানে তো আরও মানুষ আসবেন, সবমিলিয়ে দুশোরও উপরে মেহমান। বিশাল আয়োজন হচ্ছে।
খাওয়ার ব্যবস্থা’টা বিশাল ডোয়িং রুমেই করা হয়েছে। কোণায় কনে ও বরের বসার জন্যে দুটি কারুকাজ করা চেয়ার।
দুপুর দুটো। ধারা নিনীকাকে নিচে নিয়ে আসতে বললেন। ফারিন, সুমিত্রা ও সাথে দুটো মেয়ে মাথার উপর দোপাট্টা ধরে আছে। লেহেঙ্গার দুটো সাইড উঁচু করে ধীরে ধীরে নেমে আসছে মেজর ধ্রুব মাহবুবের অর্ধাঙ্গিনী নিনীকা শেখ।
সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো ধ্রুব মুগ্ধ চোখে দেখলো। এর আগে নিনীকাকে বিয়ের সাজে দেখা হয়নি তার। শেষ সিড়িতে পা রাখতেই ধ্রুব নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। নিনীকা সেটায় হাত রেখে তাদের জন্য ব্যবস্থা করা স্থানে চলে গেলো। সবার মধ্যমনি দুজন।
স্যুট বুট পড়া ফাহিম মাহবুব স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলেন। ধারা নীল জামদানী পড়েছেন। ফারিন পড়েছে সাদা গাউন। সুমিত্রা শাড়ি পড়েছে৷
‘লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে মুছে ঠিক করে নাও। ‘
ফাহিম মাহবুব রুমাল এগিয়ে দিলেন। তারপর ফোনের ক্যামেরা বের করে ধরলেন। ধারা সেদিকে তাকিয়ে রুমাল দিয়ে নিজের লিপস্টিক ঠিক করে নিলেন। ভালোবাসা নিয়ে ধরলেন স্বামীর হাত। এগিয়ে চললেন ছেলে ও পুত্রবধুর দিকে।
নিনীকা ও ধ্রুবকে সামনাসামনি দাড় করানো হয়েছে। আংটিবদল হবে। ধ্রুব জ্বলজ্বল করা হীরের আংটি তার অর্ধাঙ্গিনীর হাতে পড়িয়ে দিলো। নিনীকাকে সোনার আংটি দেওয়া হলো ধ্রুবকে পড়ানোর জন্যে। আংটিটা হাতে নিয়ে সে কিছু মুহুর্ত থমকে রইলো। সে যদি আজ চাকরি করতো তবে নিজের হাসবেন্ডকে নিজেই আংটি কিনে পড়িয়ে দিতে পারতো।
সদর দরজা দিয়ে অত্যন্ত সুদর্শন ও সুন্দরী দেখতে একটি জুটির আগমন ঘটেছে। রমজান শেখ মৃদু জোরে বললেন,
‘ মেয়ের জামাইকে তো আমাদের পক্ষ থেকে আংটি দেওয়ার কথা। ‘
নিনীকা চমকে তাকালো। মিথিলার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। তিনি একটি আংটির বক্স এগিয়ে দিলেন। ধারা আগেরটা নিনীকার থেকে নিয়ে নিলেন। মিথিলা বললেন,
‘ কিছু মনে করবেন না আপা, এটা তো নিয়ম বলুন। ‘
ধারন হাসলেন,
‘ কিছু মনে করিনি। ‘
নিনীকার ঠোঁটের কোণে হাসি। সোনালী রঙের ঝলমলে আংটিটা পড়িয়ে দিলো ধ্রুবর আঙ্গুলে।
দুজনকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানো হলো। একে একে মানুষজন আসছে, উপহার দিয়ে যাচ্ছে। ফটোশুট হচ্ছে। ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,
‘ লাল রঙে রাঙানো রক্তজবা আমার, আমি তোমাতে মুগ্ধ হই বার-বার। ‘
নিনীকা মাথা নিচু করে হাসলো। আলগোছে টেনে ধরলো ধ্রুবের বাহু। মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ লাল শেরওয়ানিতে আমার সুদর্শন জামাই। ‘
অনেক মেহমান খেয়ে চলে গেছে। ধ্রুব ও নিনীকাকে খাওয়ানোর জন্যে টেবিলে বসানো হয়েছে। ধ্রুব নিজ হাতে বউকে খাইয়ে দিলো।
সবার খাওয়া শেষ হতে হতে গোধুলী পেরিয়ে গেলো। জ্বলজ্বল করে উঠলো চারিদিক। ডোয়িং রুমে রঙবেরঙের লাইট অন করা। মালা বদল করা হলো। পৃথিবীতে যখন অন্ধকার নেমে আসবে ঠিক সেই মুহুর্তে দুজনের মাথায় দোপাট্টা ধরা হলো। সামনে ধরা হলো কারুকার্যময় আয়না।
সুমিত্রা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আয়নাতে কি দেখা যায় জিজু মশাই? ‘
ধ্রুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। লাল রক্তজবার মতো ঠোঁট, নাকে নোলক, বন্ধ চোখ জোড়ায় সৌন্দর্যের আলপনা আঁকা। সিঁথিতে শোভা পাচ্ছে ছোট্ট একটি টিকলি। তার নজর আটকালো থুতনির ওই কালো কুচকুচে তিলে।
সুমিত্রা পুনরায় তাড়া দিলো,
‘ কি দেখা যায় জিজু? বলছেন না কেন? ‘
বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেলো। ধ্রুব সেই কাজল কালো চোখে তাকিয়ে সম্মোহনী গলায় শুধালো,
‘ আমার মিসেস। ‘
নিরব এই প্রথম সম্বোধন করলো,
‘ আয়নায় কি দেখতে পাচ্ছেন ভাবি? ‘
নিনীকা কারুকার্যময় আয়নায় তাকালো। এ কয়েকদিনে চাপদাড়ি হয়ে গেছে, থুতনির নিচে, কপালে কাটা দাগ। হলদে ফর্সা মুখ, নিচের ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে। পড়োনে শোভা পাচ্ছে লাল শেরওয়ানি। গলায় মালা, পর্যবেক্ষণের এই মুহুর্তে তার ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। নিনীকা মুগ্ধ চোখ সেই হাসিতে আটকে গেলো। শুধালো,
‘ মেজর ধ্রুব মাহবুবের মিসেস এর ভালোবাসাময় পুরুষ। ‘
চারিদিকে হৈহৈ পড়ে গেলো। সবার মুখে হাসি। ধ্রুব বউকে কোলে করে রুমে রওনা হলো। দরজা খুলতেই চোখেমুখে মুগ্ধতা ধরা দিলো। ফুলের বাগান করে ফেলেছে রুমটা। ফুলে সজ্জিত বিছানায় নিনীকাকে বসিয়ে দিলো। ফারিন তড়িৎ গতিতে নিনীকার পাশে বসলো।
‘ মাম্মা বলেছে নিচে যেতে। ‘
ধ্রুব অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। সুমিত্রা ফারিনের মাথায় চাপড় মারলো।
‘ শয়তান মেয়ে আমার জিজুটাকে ভালো করে বউকেও দেখতে দিচ্ছে না। ‘
ফারিন কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
‘ আমার কি দোষ? মাম্মা বলেছে সে না বলা পর্যন্ত এদের একা না ছাড়তে। ‘
নিনীকা গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। সুমিত্রা ধাক্কা দিলো,
‘ কি ভাবছিস? ‘
নিনীকা নিজের মোবাইল খুঁজলো। মনে পড়লো মোবাইলটা ধ্রুবর কাছে। সুমিত্রাকে বলল ধ্রুবকে ডেকে দিতে। সুমিত্রা বিনাবাক্যে ডাকতে চলে গেলো। ধ্রুব এসে বউয়ের কাছে বসলো।
‘ ডেকেছিলে? ‘
‘ মোবাইল দাও। ‘
ধ্রুব মোবাইল বের করে দিলো।
‘ আমি ভেবেছি তোমার আমাকে প্রয়োজন। ‘
সুমিত্রা দরজার পাশে লুকিয়ে ছিল। শব্দ করে হেসে ফেললো। ধ্রুব উঠে দাড়ালো। নিনীকা ফোনে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,
‘ মা চলে গেছে কি না জানতে হবে। ‘
নিনীকা ডায়াল করতেই মিথিলা রিসিভ করলেন। নিনীকাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।
‘ নিনীকা আমরা বাড়িতে যাচ্ছি, তোমার বাবাকে একটু পর ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তোমার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা আমার মা। ‘
নিনীকার রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। কোনো প্রতুত্তর না করে মোবাইল কান থেকে নামিয়ে রাখলো।
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? ‘
সুমিত্রা এগিয়ে এলো,
‘ আপনি তাড়াতাড়ি যান জিজু, আন্টি এখন আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখলে রেগে যাবেন। ‘
ধ্রুব চলে গেলো। নিচে অনেক কাজ আছে। ধারার বাবার বাড়ির ও ধ্রুবদের বংশের আত্নীয়রা কিছু রয়ে গেছেন। তারা একেবারে আগামীকাল বৌভাতের পর যাবেন।
ধ্রুবকে ঘরে পাঠানো হলো নয়টার পর। দরজা বন্ধ করে সে যখন বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো তখন দেখতে পেলো তার বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের সাজ এখনো রয়ে গেছে। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। ধ্রুবর বুক ধক করে উঠলো। আলগোছে নিনীকার মাথা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হাত দিয়ে সামনে আসা চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। গালে হাত ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলো,
‘ মিসেস? ‘
নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ধ্রুব প্রশ্ন করলো,
‘ কেঁদেছ কেন? ‘
নিনীকা ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ধ্রুবের চোখ টলমল করছে, ঠোঁট বেঁকে যেতে চাইছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিনীকা এক সময় শান্ত হলো। ধ্রুব শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আজ হয় সব বলবে নয়তো আর কখনোই বলার দরকার নেই। ‘
(চলবে)