#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
রৌদ্রজ্বল সকাল। বারান্দায় রোদ চিকচিক করছে। সেথায় একটি চেয়ারে পা তুলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ফারিন। সামনে এসএসসি পরীক্ষা তার। পড়াশোনায় তাদের বংশের এপর্যন্ত সবাই মোটামুটি ভালোই মেধাবী ছিলেন। ফারিনও তার ব্যতিক্রম নয়। তাকে কখনো জোর করে পড়তে বসাতে হয়না। তার উপর সে যেমন মা বাবা ভাইয়ের কাছে আহ্লাদী, বাহিরের সবার কাছে ঠিক ততোটাই বুঝদার ম্যাচিউর একটি মেয়ে। তার আহ্লাদীপনা সবকিছু শুধুমাত্র আপনজনদের জন্য। নিজের এই গন্ডি গুলো তাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। সে নিজ থেকেই বুঝেছে। এই যেমন তার বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রেম করে বেড়ায়, কিন্তু সে এসব থেকে চল্লিশ হাত দূরত্ব বজায় রাখে। তার মতে এগুলো সময় নষ্ট। ফ্যান্টাসি অবশ্যই থাকে, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। আরাম আয়েশে জীবনযাপন করলেও তার মা বাবা তাদের দু’ভাই বোনকে বাস্তবতা মানতে শিখিয়েছেন। একবার তো ফারিন সারাজীবনের মতো শিক্ষা পেয়েছিলো। ফারিনের তখন কতোই বা বয়স হবে এগারো। সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তার ক্লাসের একটি মেয়ের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে। কারণ টা ছিলো এই, ‘মেয়েটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছিলো। সাথে মেয়েটার মা তাদের বাড়িতে কাজও করতেন। সুতরাং ফারিন মেয়েটিকে তুই করেই ডাকতো। মেয়েটি মেধাবী ছিলো। ফারিনের সাথে তার টক্কর চলতো, কে ফাস্ট হবে। একদা মেয়েটি রেগে ফারিনকে বলেছিলো, ‘তুমি স্কুলে আমাকে তুই বলবে না, এখানে আমি তোমার ক্লাসমেইট হই। ‘
ফারিনের সেদিন রাগ হয়েছিলো। সে তো সবসময় ডেকে অভ্যাস বলে ডাকতো। তাছাড়া তারা ছিল ক্লাসমেইট। এক ক্লাসে সবাই তুই বলেই বেশি ডাকে। গায়ে লাগায় ফারিন খুঁচিয়ে বলেছে,
‘ পড়িস তো আমাদের দেওয়া জামাকাপড়, আবার আমাকেই কথা শুনাচ্ছিস। আমার বাবা যদি বেতন না দেয় তোর মা তোর বেতন দিতে পারবে? ‘
ছোট্ট সেই মেয়েটি ফারিনের মতোই নিষ্পাপ পুষ্প। কোমল মনে আঘাত লাগে তার। সেদিন দৌড়ে গেছিল ‘বউ কথা কও’ এ। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে বলেছিল,
‘ এখানে আর কাজ করলে আমি পড়বো না মা। একদম পড়বো না। ‘
বিচক্ষণ ধারার কানে সব গেলো। কাজের মহিলাটি কেঁদে ফেললেন। ধারা নিজের সন্তানের এহেন কর্মকাণ্ডে কষ্ট পেলেন। সেই ছোট্ট ফারিনকে একমাস হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছিলো। আর সেই মেয়েটিকে ধারা গাড়ি দিয়ে পাঠাতেন। টিফিনে আবদার’কৃত খাবার দেওয়া বন্ধ করে শুকনো রুটি তুলে দিতেন। ফারিন বুঝতে পেরেছিল! সেই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। জীবনের ওই শিক্ষাটা তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তারপর থেকে তারা দুজনেই একসাথে স্কুলে গেছে। আজ তাদের মধ্যে একটি সম্পর্কও আছে। মেয়েটি ফারিনের বেস্টফ্রেন্ড! চমৎকার না? সেই মেয়েটা! রোজা। ‘
রোজা ফারিনের সাথেই পড়ে। তার মা এখন আর কাজ করেন না। ঘর সামলান। ধারা রোজার বাবাকে নিজেদের গাড়ির ড্রাইভার করে নেন। মাঝে মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে অনেক কিছু করেন ও। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো রোজাকেই ধারা ধ্রুবের জন্যে মনে মনে পছন্দ করতেন। কিন্তু বয়সের গ্যাপ বেশি হওয়ায় কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেননি। ফারিন সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে জানে তার মা জনদরদী। সুতরাং নিজের ছেলের জন্যে রোজাকে পছন্দ করবেন সেরকম টা না ভাবার কোনো কারণ নেই।
ফারিনের মোবাইলে শব্দ হলো। রোজার মেসেজ-
‘ এই প্রশ্নটার উত্তর কি হবে জানিস? ‘
ফারিন বই বন্ধ করলো। রোজার সাথে মেসেজে কথা বলতে লাগলো। তন্মোধ্যে এলো একটি ফোনকল। নাম্বারটি তার চেনা। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নিরবের চিন্তিত কন্ঠোস্বর।
‘ হ্যালো ফারিন বলছেন? ধ্রুব স্যারের ফোন অফ কেন? কাইন্ডলি তাকে একটু বলে দিবেন? জরুরি প্রয়োজন। ‘
ফারিনের চোখমুখ কুঁচকে গেলো। এই লোকটা দরকার হলেই তাকে ফোন দিবে। কেন রে বেটা? আর কেউ নেই?
‘ মাকে কল করতে পারতেন। ‘
নিরব কাশলো,
‘ আসলে আন্টির নাম্বার নেই। ‘
‘ এ কেমন কথা? বাড়ির সবার নাম্বার আছে অথচ মায়ের নাম্বার নেই। ‘
নিরব মিনমিন করে বলল,
‘ আমি রাখছি, আপনাকে কল করার জন্যে দুঃখীত। ‘
ফারিন কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলো। চোখেমুখে প্রচন্ড বিরক্তি। পড়ার সময় ডিস্টার্ব তার পছন্দ হয়না। একে তো রোজার মেসেজে তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটলো, সাথে নিরবের কল! আড়চোখে একবার মোবাইল স্কিনে তাকালো। বেলা গড়িয়েছে অনেক। সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। সকালে তার ঘরে গ্রিন্টি এসেছে। বাবা মা হাটাহাটি করেছেন যথা নিয়মে। এখন নাস্তা করার সময়। ধ্রুব বা নিনীকাকে দেখা যায়নি। ধারার আদেশ তাদের যেনো ডিস্টার্ব না করা হয়। জার্নি করে ঘুমিয়েছে যখন ইচ্ছে উঠুক। সেজন্য ফারিন ডাকেনি। এবার ডাকতেই হচ্ছে।
–
দরজার টুকা পড়লো। উষ্ণতায় মুড়িয়ে ঘুমানো ধ্রুবের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। দরজার শব্দ আরেকটু বিকট হলো। এবার সে ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ভারী মাথাটা তুলতেই সম্মুখে নিনীকার মোমের মতো মুখখানি নজরে এলো। ধ্রুবের পিঠে দু-হাত জড়িয়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে। ধ্রুব মাথাটা পুনরায় আগের স্থানেই রাখলো। চোখ বন্ধ করতেই আবারও কানে এলো শব্দ টা। সাথে ফারিনের কন্ঠ,
‘ ব্রো উঠো, দশটা বেজে যাচ্ছে যে। তোমার ক্যাপ্টেন ফোন করেছে জরুরি প্রয়োজন। ‘
ধ্রুবের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে গলার স্বর উঁচু করার চেষ্টা করলো,
‘ দেখছি। ‘
ফারিনের কন্ঠোস্বর আর পাওয়া গেলো না। ধ্রুব গভীর চোখে নিনীকাকে দেখতে ব্যস্ত হলো। মোমের মতো শরীরে কিছু দাগ স্পষ্ট। ধ্রুবের হতে গিয়ে মোমের মতো শরীরে দাগ পড়ে গেছে। ধ্রুব হাত দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে সেগুলো। নিনীকা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠছে বার-বার। একসময় তার ঘুম ছুটে গেলো। ততোক্ষণে ধ্রুবের আলিঙ্গন গভীর হয়েছে। নিনীকার বুঝতে একটু সময় লাগলো বটে।
বিছানা ছাড়তে দেরি হলো। ধ্রুব যখন বউ কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে তখন ঘড়ির কাটা দশটা পেরিয়েছে। ভেজা শরীরে বের হয়ে সে প্রথম মোবাইল অন করে চার্জে দিয়েছে। তারপর বউকে নিয়ে ফিটফাট হয়ে নিচে নেমেছে। খাবার টেবিলে চারজন। নিনীকার লজ্জায় মাথা নিচু করা ছিল। ধারা গম্ভীর মুখে নাস্তা তুলে দিয়েছেন। বুঝদার ফারিন অনেক কিছুই বুঝে নিয়েছে। খেতে খেতে বললো,
‘ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে খাওয়া হয়নি। ‘
নিনীকা যেনো আরও লজ্জা পেলো। ধ্রুবের কাছে শুনেছিল ফারিন ডেকে গেছে। বেচারি এক ঘন্টা আগে ডেকেছে অথচ তারা নেমেছে এক ঘন্টা পর।
‘ বিয়ের পর মেয়েদের আলাদা সুন্দর লাগে। তোমাকে এই মুহুর্তে সদ্য বিবাহিত বউ মনে হচ্ছে। সাথে আমার বেটাকেও নতুন বর নতুন বর লাগছে। তাই না ফারিন? ‘
ধারার কথায় ফারিন গাল ভরে হাসলো।
‘ হ্যা তোমাদের দুজনের মুখটা আজ অন্যান্য দিনের থেকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বিয়ে করার ইফেক্ট। ‘
নিনীকার পড়োনে লং স্কার্ট ও টিশার্ট। গলায় ছোট্ট একটি স্কার্ফ ঝুলানো। ফারিন মুচকি হেসে বলল,
‘ তোমার সাদা ভালো লাগে তাই না? আমি কি তোমাকে ভাবী বলে ডাকতে পারি? ‘
কি নিষ্পাপ আবদার। নিনীকা হেসে সম্মতি জানালো। ফারিন মুগ্ধ হয়ে বলল,
‘ তোমার সবকিছুই সুন্দর ভাবী। তোমার বরটাও সুন্দর। তোমার ননদও সুন্দর। তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই সুন্দর। ‘
ধ্রুব ফোড়ন কাটলো,
‘ বরটা তেমন সুন্দর না। মুখে অজস্র কাটা দাগ। ‘
ফারিন গরম চোখে তাকালো,
‘ সেই কাটা দাগই তোমার সৌন্দর্য। তুমি যে মেজর সেটার পরিচয় এই কাটা দাগ গুলো দেখলেই মানুষ ঝুঝতে পারবে। বুঝলে? ‘
ধ্রুব ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো। অগোচরে হাত রাখলো নিনীকার স্পর্শকাতর স্থানে। নিনীকা শরবত খাচ্ছিল। নাকেমুখে উঠে গেলো সব। কাশতে কাশতে বেচারির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো। ধ্রুব আফসোসে ভেসে বউয়ের কাশি কমাতে ব্যস্ত হলো। কি বউ তার আদর করলেও কেশে উঠে। খোদা!
(চলবে)