#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
শিশির ভেজা ঘাসকে পা দিয়ে পিষে ফেলে হেঁটে চলে যাচ্ছে নিনীকা। পড়োনে শীতের ভারী পোশাক। হুডির দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে সুমিত্রার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে সে। মাথায় টুপি। যা সুমিত্রা কয়েকমাস আগে দার্জিলিং থেকে নিয়ে এসেছিল।
বান্দরবান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ে ভরপুর। নিনীকারা সড়কে এসে দাড়ালো। গাড়ি চলাচল হচ্ছে। তন্মোধ্যে একটি সেনাবাহিনীর গাড়ি অতিক্রম করে যায় তাদের। নিনীকার বুক কেঁপে উঠলো। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো গাড়িটার যাওয়ার দিকে। সুমিত্রা ওর হাত ধরে রাস্তা পাড় হচ্ছে। সামনের কাঠের কটেজে তারা উঠেছে। এসেছে গতকাল সন্ধ্যায়। সকাল হওয়ার পর একটু হাঁটতে বের হয়েছিল।
বাংলাদেশে ঘুরতে আসার পরিকল্পনা’টা সুমিত্রার। সে-ই আগে ইচ্ছে প্রকাশ করে। তারপর বিভিন্ন ভাবে নিনীকাকে রাজি করায়। সুমিত্রা বাংলাদেশে এসেছে এই প্রথমবার। সেজন্য তার সবকিছুর প্রতি মারাত্মক কৌতুহল।
দু’জন কটেজের রুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নিলো। তারপর বের হয়ে আসলো কটেজ থেকে। এগিয়ে চললো পাহাড়ের দিকে।
ছোট ছোট পাহাড় গুলো সবুজ। সব জায়গায় ঘাস। উঁচুনিচু জায়গা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। পথের দ্বারের একটি হলুদ ফুল হাতে নিলো নিনীকা। তাদের দিকে তখন এগিয়ে আসছিল পাহাড়ি একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। নিনীকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ফুলটার নাম কি দাদা?’
তিনি নিনীকার হাতের ফুলটি পর্যবেক্ষণ করলেন।
‘ এ তো ভৃঙ্গরাজ। ‘
নিনীকার নামটা পছন্দ হলো। সে কানে গুঁজে নিলো একটি। বাকি কয়েকটা হাতে রেখে আকাশের দিকে তাক করে পিকচার তুলতে লাগলো।
রোদে চারিদিক ঝলমল করছে। পাহাড়ি তাদের সাবধান করলেন,
‘ওদিকে আর্মি ক্যাম্প, আপনারা যাবেন না।’
নিনীকার ভ্রু কুঁচকে গেলো,
‘আর্মি ক্যাম্প তো আমরা কি করবো? দেশের একজন নাগরিক হয়ে যেখানে সেখানে যাতায়াত করার অধিকার আমার আছে। আর্মিদের কাজ হলো সুরক্ষা দেওয়া, কাউকে প্রকৃতি দেখা থেকে বঞ্চিত বা আলাদা করা নয়।’
সুমিত্রা হাতে চাপ দিয়ে থামতে বললো। ফিসফিস করলো,
‘একটু বেশিই বকছিস না? চুপ যা।’
পাহাড়ি নিজের পথে চলে গেলেন। নিনীকা সুমিত্রার হাত টেনে পাহাড়ের দিকে যেতে লাগলো। দেখবে কে তাকে আটকায়।
ছোট ছোট পাহাড়গুলোর মধ্যে কিছু টা গাঢ় গর্তের মতো নিচু জায়গা আছে। সেগুলোতে ছোট্ট তাঁবু টাঙানো কয়েকটা। পাশে একটি কাঠের কটেজ। তাঁবু থেকে কটেজ, কটেজ থেকে তাঁবু পর্যন্ত আর্মিরা আনাগোনা করছে। কারো হাতে বন্দুক তো কারো হাতে নানান কিছু। কেউ কেউ কাপড় মেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ জিপের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে।
সুমিত্রা আড়ালে থেকে ফিসফিস করে বলল,
‘কেন যে এখানে এসেছি ইয়ার। চল চলে যাই।’
নিনীকা বিরক্ত হলো।
‘ এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ‘
সুমিত্রার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো,
‘ সব জায়গায় তো তোর মেজর জামাই থাকবে না নিনীকা। থাকলে তো চিন্তা ছিল না। সুতরাং রিস্ক নেবো না। চল চলে যাই। ‘
নিনীকার চেহারা থমথমে। সুমিত্রা কি বলেছে বুঝতে পেরে জিহবায় কামড় দিলো।
‘স্যরি ইয়ার, মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। তবে সত্যিই বলেছি বল? দেখ সেনাবাহিনীরা যদি তোকে আমাকে জোর করে বেঁধে ফেলে। যদি ভালোমন্দ কিছু করে ফেলে তবে আমরা নিজেদের রক্ষা করবো কিভাবে? আমাদের তো পরিচিত কেউ নেই।’
নিনীকা মৃদু জোরে চিৎকার করলো,
‘চুপ কর।’
সুমিত্রা চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু নিনীকার মৃদু জোরে চিৎকার আর্মিদের কানে পৌঁছে গেছে। কয়েকজন বন্দুক হাতে নিয়ে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। সবার চোখ চারিদিকে ঘুরছে। আওয়াজের উৎস খুঁজছে।
সেনবাহিনীর দক্ষ অফিসারদের চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না তারা। দুজন অফিসার নিনীকা এ সুমিত্রার হাত টেনে বের করে আনলো আড়াল থেকে।
সুমিত্রা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,
‘নিনীকা বলেছিলাম বেশি বেশি না করতে।’
নিনীকা ঢুক গিললো,
‘আরে আমি তো কৌতুহল নিয়ে দেখতে এসেছিলাম।’
অফিসাররা তাদের নিয়ে কটেজের সামনে এলো। একজন অফিসার গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,
‘আপনাদের মধ্যে কে চিৎকার করেছে?’
নিনীকা মৃদু স্বরে বলল,
‘আমি-ই।’
আরেকজন অফিসার বন্দুক ধরে রেখেছে। প্রশ্ন করলো,
‘আপনারা কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন? কুচক্রীদের মধ্যে কেউ?’
সুমিত্রা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি ঘুরতে। কৌতূহল বসত এদিকে চলে এসেছি। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন।’
নিনীকা নিজেও বলল,
‘ আসলে আমি বুঝতে পারিনি নাহলে জোরে কথা বলতাম না। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখীত। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন। ‘
অফিসার দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘আপনাদের কি আমাদের নিজের আত্নীয় মনে হচ্ছে? যে আপনারা বলবেন আর ছেড়ে দিবো।’
আরেকজন অফিসারদের নির্দেশ দিলো এদের বন্দি করে রাখো। সিদ্ধান্ত তারা এসে নিবেন।’
নিনীকা ও সুমিত্রাকে কটেজের সিঁড়ির উপরের কাঠের উঠানে হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে রাখা হলো। দু’দিকে দুজন অফিসার বন্দুক ধরে রেখেছেন।
একজন অফিসার তাদের পরোখ করে আরেকজনকে বলছেন,
‘ নীল ড্রেস পড়া মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে।’
সেই আরেকজন অফিসার বললেন,
‘আমার তো সাদা ড্রেস পড়া মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে।’
‘আজ রাতের কোনো ব্যবস্থা করা যায়?’
‘উপরে যারা আছেন তারা যদি অনুমতি দেন তো করা যাবে।’
নিনীকা ও সুমিত্রার শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। সুমিত্রার কপোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
‘ বলেছিলাম আসার দরকার নেই। শুনলি না। সব সৈনিক ধ্রুব জিজুর মতো নয় নিনীকা। আমাদের এখন কি হবে! হে ভগবান রক্ষা করো।’
নিনীকা ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। সে কাঁদতে চাইছে না। আপাতত এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুজতে হবে।
নিনীকা ও ধ্রুবের দার্জিলিংয়ের সেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার তিনমাস পাড় হয়ে গেছে। নিনীকার দিনগুলো তেমন ভালো যেতো না। প্রথম কয়েকদিন পড়াশোনাতে মন দিতে পারেনি। সবকিছুতে ধ্রুবকে ভেবে যেতো। তার সবকিছু জুড়ে ধ্রুব, ধ্রুব, ধ্রুব! যে মানুষটাকে সে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। যার থেকে নিজ থেকে দূরে সরে এসেছে, আজও সেই মানুষটাতে মনে মনে সে খুঁজে বেড়ায়।
ধ্রুবের সাথে সম্পর্কিত কোনোকিছু চোখে পড়লেই নিনীকা নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সুমিত্রা অতিষ্ঠ হয়ে বারবার বলে বাংলাদেশে এসে ধ্রুবের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে। জীবনকে একবার সুযোগ দিতে। কিন্তু নিনীকার মনে খুঁত খুত থেকে যায়। পুরুষদের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে মন নানান তর্ক করে নিজের সাথে। দোটানায় পড়ে যায় সে। একদিকে নিজের কঠিন সত্তা, অন্যদিকে ধ্রুবের প্রতি দূর্বল হওয়া কোমল মন।
আজ নিনীকা ধ্রুবের টানেই এদিকে চলে এসেছে। সেনাবাহিনীর জিপ গাড়ি যখন সড়ক দিয়ে গেলো তখন তার মনে হলো ধ্রুব আছে কোথাও। পাহাড়ি যখন বলল ক্যাম্পের কথা। তখনও সে ধ্রুবকে ভেবেই এগিয়ে এসেছে।
যাকে সে মনে করতে চায় না। যাকে তার কঠিন সত্তা বার-বার প্রত্যাখ্যান করে তাকেই তার কোমল মন ভেবে যায় প্রতিনিয়ত। নিনীকার এই মুহুর্তে নিজের কোমল মনের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। নিজে একা নয় সুমিত্রাকেও বিপদে ফেলে দিলো সে।
একবার যদি সে এখান থেকে বেরোতে পারে তবে সবার আগে নিজের কোমল মনে ছুরির আঘাত করবে। এমন মন তার দরকার নেই। যে মন তার কথা ভাবে না, ভাবে ওই পুরুষদের কথা যাদের নিনীকা বিশ্বাস করতে পারে না। যাদের বিশ্বাস করার কথা ভাবলে নিনীকার সব এলোমেলো হয়ে যায়। নিনীকার নিঃশ্বাস আটকে আসে। চোখের সামনে ভাসে নিজের মায়ের প্রতিনিয়ত দুঃখ, বেদনা। কতো ভালোবাসা কতো বিশ্বাস কতো ভরসা নিয়ে তার মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। শেষে কি পেয়েছিল? পায়নি, আজও পেয়ে যাচ্ছে কাঁটার আঘাত!
যার জন্মদাতা নিজের সন্তানের সামনে অন্য নারীকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়, তার সন্তান হয়ে নিনীকা কিভাবে বিশ্বাস করবে পুরুষ জাতিকে! মেয়েদের জীবনের প্রথম পুরুষ হয় তাদের বাবা। যাদের দেখে মেয়েরা পুরুষদের সম্পর্কে প্রথম ধারণা করে। নিনীকার এ পর্যন্ত যতো ধারণা হলো সব নিকোষ অন্ধকার। নিনীকার দুঃখের মতো অন্ধকার, কালো সব!
(চলবে)
[ হাত এগোচ্ছে না কি লিখলাম কে জানে ]