বিয়ে থা পর্ব-১২

0
8

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

(কপি নিষিদ্ধ)

ফারিন অপলক তাকিয়ে নিনীকাকে দেখছে। ননীর পুতুল যেনো। কি সুন্দর শুভ্রতায় মোড়ানো তার ভাবী। ভাই এই পুতুল কোথায় পেলো? মনের কথা মুখে প্রকাশ করতেই ধ্রুব মাথা চুলকে হাসলো।

‘তোর সম্মানিত পিতা আমাকে বিয়ে করিয়েছেন, যখন তুই আর মা মামাদের কাছে গেছিলি।’

ফারিন আঁতকে উঠলো।

‘হায় আল্লাহ এসব কি বলো? মাম্মি জানলে তো খবর করে ছাড়বে ব্রো।’

ধ্রুব চিৎ হয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো।

‘যখন জানবে তখন দেখা যাবে।’

ফারিন নিনীকার পাশে গিয়ে বসলো। নিনীকাকে অপলক চিপসের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,

‘খাচ্ছো না কেন? ভাইয়া বললো তুমি অনেক ক্ষুধার্ত।’

নিনীকা চিপসের প্যাকেট সাইট করে রেখে বিস্কুট খেতে শুরু করলো। ফারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার চিপস পছন্দ না?’

নিনীকা বহু কষ্টে বলল,

‘পছন্দ ছিলো।’

বিস্কুট খেতে গিয়ে নিনীকার কাশি উঠে গেলো। ধ্রুব তড়িৎ গতিতে উঠে বসেছে। পানির বোতল ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে বলল,

‘পানি খাও আগে। আস্তে ধীরে খাবে তো। ‘

ফারিন মৃদু জোরে ধমক দিলো,

‘ভাবিকে একদম বকা দিবে না ব্রো। সি ইজ এ ডল। কতো আদুরে সে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাকে।’

ধ্রুব কিছু বললো না। নিনীকাকে চোখের ইশারায় পানি খেতে বললো। নিনীকা চুপচাপ খেয়ে নিলো। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে এক কোণায় শুয়ে পড়লো। ধ্রুব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। তার নিজেরো ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু এসব খেয়ে পেটের এক কোনা ও ভরবে না। অগত্যা ফারিনকে বললো সব নিয়ে চলে যেতে। ফারিন মাথা নাড়ালো। ধ্রুব সাবধান করলো,

‘মা যেনো কিছু জানতে না পারে।’

ফারিন চলে যাওয়ার পর সে দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিনীকার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলো। নিনীকা শক্ত হয়ে থাকলো। ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।

তীব্র অস্বস্তিতে নিনীকার দমবন্ধ হয়ে আসছে। ধ্রুবের হাতের বিচরণ তার পেটে। পা তুলে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেছে নিজের সাথে। নিনীকার নড়াচড়া করার উপায় নেই। কিছু সময় পর ধ্রুবের গরম নিশ্বাস তার গলায় অনুভব করলো। মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

নিনীকার মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটারও ক্ষিধে পেয়েছিল। সে যদি বলতো তাহলে নিশ্চয়ই খেতো। কেন সে বললো না? নিনীকা নিজের ভাবনার উপর বিরক্ত হচ্ছে। হঠাৎ করে এই লোকের প্রতি তার এতো মায়া কাজ করছে কেন?

মাত্র দুদিন ধরে লোকটা তার সাথে থাকছে। নিনীকাদের ট্রিপ ছিল তিনদিনের। সে মনে মনে ভেবে নিলো আরেকটু বেলা গড়ালে সুমিত্রার সাথে কথা বলবে। তাদের তিনদিনের ট্রিপের আজ শেষ দিন। গতকালই তারা শিলিগুড়ি ফিরে যাবে। তখন আর এই মানুষটার সাথে দেখা হবে না। দুদিনে হওয়া এই মায়া ভুলতে নিনীকার কঠিন মনের সময় লাগবে না। এরকম কতো মায়া সে অনায়াসে ফেলে এসেছে। আবারও না-হয় ফেলে যাবে দার্জিলিংয়ের মাটিতে।

ধ্রুবের ঘুম ভাঙলো সাড়ে নয়টায়। নিনীকা তখন থাই গ্লাসের ফাঁক গলিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার ঘুম ধরা দেয়নি আর। ধ্রুব হাতের জোরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো তাকে। দু-হাত দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমঘুম কন্ঠে বড্ড মায়া নিয়ে শুধালো,

‘আমার ননীর পুতুলকে মিষ্টি সকালের শুভেচ্ছা।’

নিনীকা তাকিয়ে থাকলো। ধ্রুব ভালো করে চোখ মেলেনি। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। মুখে কিঞ্চিৎ চাপদাড়ি৷ হয়তো পেশাগত কারণে ক্লিন করে ফেলে। চুলে আর্মি কাট। চুলগুলো বড় হয়ে কপালে পড়ে আছে। কি সুন্দর ঘন চুল। নিনীকা হাত বাড়িয়ে চুলে ডুবালো। ধ্রুব তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকিয়েছে। নিনীকা নিজেও তাকিয়ে থাকলো। মন অঘটন ঘটাতে চাইলো। মস্তিষ্ক বাঁধা দিলো। মন ও মস্তিষ্কের তর্কে মন জিতে গেলো। ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে নেই। আজ আছো কাল না-ও থাকতে পারো। ইচ্ছে পূরণ করে ফেলো।

নিনীকা তাই করলো। ধ্রুবের অপলক তাকিয়ে থাকা ও তার ইচ্ছে পূরণে বাঁধা দিতে পারলো না। সে মুখ উঁচু করে পরম আবেশ, মায়া মিশিয়ে ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিলো ধ্রুবের কপাল। দীর্ঘক্ষণ ঠোঁটের স্থায়িত্ব রাখলো কপালে। আলগোছে হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিলো। নিনীকা যখন ইচ্ছে পূরণ করে বালিশে মাথা রাখলো তখন ধ্রুব চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নিনীকার মারাত্মক লজ্জা অনুভব হলো। নিজের পুরনো সত্তায় ফিরে গেলো। ঢুক গিলে বললো,

‘আ’ম স্যরি মিস্টার মেজর।’

ধ্রুব চট করে চোখ মেলেছে। সুখি একটা হাসি দিয়ে বলল,

‘আমি চাই এরকম ভুল তুমি সারাজীবন করো মিসেস। তুমি জানো না তুমি আজ আমায় কি দিয়েছো। এতো মায়া, ভালোবাসা নিয়ে মা-বাবা ছাড়া কেউ কখনো আমাকে স্পর্শ করেনি। বড়ো হওয়ার পর সেটাও ফুরিয়ে গেছে। কত বছর পর কেউ আমার কপালে স্পর্শ করলো ভালোবেসে। আমার অনুভূতি বুঝতে পারছো মিসেস? আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

ধ্রুবের অকপট স্বীকারে নিনীকার দমবন্ধ হয়ে এলো। নিজেকে সংযত করে কঠিন কথা ছুঁড়ে দিলো।

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না, আর না কখনো বাসবো। হঠাৎ কি হয়েছিল জানিনা। হয়তো মোহের বশে আপনার কপালে স্পর্শ করেছি। তাই বলে আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলিনি।’

ধ্রুব হাসলো,

‘আজ বাসোনি কাল যে বাসবে না তার কি গ্যারান্টি?’

‘কাল আর আসবে না, আপনার সাথে আজই আমার শেষ দিন। কাল থেকে আপনি আপনার পথে আমি আমার।’

ধ্রুব রেগে গেলো।

‘কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে? ‘

নিনীকা দমলো না,

‘আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক আছে। আপনার মাথা হয়তো ঠিক নেই। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমি পালিয়ে এসেছিলাম। আপনার সাথে সংসার করবো না বলেই পালিয়ে এসেছি, সেখানে আপনি ভাবলেন কিভাবে আমি দু’দিনে আমার মতামত চেঞ্জ করে আপনার সাথে থেকে যাবো?’

ধ্রুব জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো,

‘এমন করে বলো না মিসেস।’

‘আমি এমন করেই বলি। আপনি কি বাচ্চা? আপনার কি আত্নসম্মান নেই? একজন মেজর হয়ে কিভাবে একটা মেয়ের পেছনে পড়ে আছেন আপনি। এসব কি আপনাকে মানায়?’

ধ্রুবের শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠো,

‘তুমি আমার..মিসেস নিনীকা। আমার..

‘আমি আপনার কেউ না। কেউ না আমি আপনার। সামান্য কাগজ কলমের সম্পর্ক আমাদের। এক সাইনে যেটা মুছে যাবে। আপনি চাইলে সব ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি সাইন করে দিবো।’

ধ্রুব উঠে বসলো। সাথে টেনে বসালো নিনীকাকে। প্রচন্ড জোরে চেপে ধরলো নিজের সাথে।

‘তোমার এতো বড় দুঃসাহস! এতো সাহস তোমার। কে টে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। চেনো আমায়? আর একবার উচ্চারণ করে দেখো শুধু!’

নিনীকা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলো,

‘কি করবেন আপনি?’

ধ্রুব চিৎকার করলো,

‘নিনীকা…’

‘আপনি আমার কেউ হোন না। আমি সাইন করে দিবো বলেছি না? আপনি সব ব্যবস্থা করুন। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু ছয়মাসের মধ্যে তিনমাস অতিক্রম হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। তিনমাস পর কাগজ পাঠিয়ে দিবেন। ব্যস।’

নিনীকার শক্ত কথা ধ্রুবের বুক জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সে বহু কষ্টে ঢুক গিললো।

‘তুমি ক্ষুধার্ত মিসেস, চলো আমরা খেয়ে আসি। তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিনীকা তীব্র আঘাত করার চেষ্টা করলো,

‘আমি ক্ষুধার্ত নই। আমার মনে হচ্ছে আপনি ক্ষুধার্ত। আপনারা সব পুরুষ এক। মেয়েদের কি মনে হয় আপনাদের? যখন ইচ্ছে তখন চেপে ধরবেন। অধিকার আছে বলে বিছানায় টেনে নিবেন?’

‘নিনীকা থেমে যাও..’

‘থামবো না আমি। সত্যি কথা গায়ে লাগছে? তবে শুনুন। আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। যেমনটা করি নিজের জন্মদাতাকে। আপনাদের পুরুষ জাতীর প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা। আমি আপনাদের ঘৃণা করি। আপনাকে ঘৃণা করি। শুনতে পেয়েছেন আপনি?’

ধ্রুবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। দু-হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো নিনীকা কাঁধ। ঝাকিয়ে বলল,

‘তোমাকে কি আমি খেয়ে ফেলেছি? নাকি বিছানায় টেনে নিজের পুরুষত্ব দেখিয়েছি? ঠিক কোন কারণে তুমি আমাকে জঘন্য স্থানে নামাচ্ছো?’

নিনীকা তাছ্যিল হাসলো,

‘দেখাননি? এইযে আমাকে আটকে রেখেছেন, সেটা কি? জোর করে বুকে ঘুমাতে বাধ্য করছেন। ইচ্ছে হলে চেপে ধরছেন, সেটা কি?’

ধ্রুবের হাত ধীরে ধীরে নিনীকার কাঁধ থেকে নেমে গেলো। আস্তে করে নামলো বিছানা থেকে। ট্রলি বের করে দরজা খুলে দিলো। জানালার দিকে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। মনের আঘাত লুকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘চলে যাও। আর এসো না। আমি কখনো তোমার উপর অধিকার দেখাতে যাবো না। তুমি মুক্ত।’

নিনীকা ধীরে পায়ে হেঁটে দরজার সামনে দাঁড়ালো। ট্রলিতে হাত রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো ধ্রুবকে। যে বর্তমানে জানালার দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। নিনীকা দরজার বাহিরে পা রাখলো। ঠোঁটে দাঁত গেঁথে গেলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা।

জানালার দিকে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকা ধ্রুবের কপোল বেয়ে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখলো না। ভালোবাসার মানুষের কথার আঘাতে কিভাবে মন ভেঙে গেলো তার!

নিনীকা দুর্বল পায়ে হেঁটে এসে থামলো সুমিত্রার বুক করা রুমের সামনে। দরজায় পর পর দু’বার টুকা দিতেই তা খুলে গেলো। সুমিত্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘নিনীকা ইয়ার!’

নিনীকা প্রায় ঝাপিয়ে পড়লো। ফুপিয়ে উঠলো।

‘আজই শিলিগুড়ি ফিরে চল।’

সুমিত্রা মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো না। আশ্বাস দিলো,

‘আমরা আজ এখনই রেডি হয়ে ফিরে যাবো। শান্ত হো।’

ঠিক এক ঘন্টা পর তারা বেরিয়ে গেলো। গেইটের সামনে থেকে যখন টেক্সি ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে তখন বাম দিকের শেষ কামরার জানালার পাশে দাড়ানো মেজর ধ্রুব মাহবুব বুক চেপে ধরেছে। তার মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজা কে টে নিয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব দূর্বল কন্ঠে বিরবির করলো,

‘পাষাণী মিসেস!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here