#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
চতুর্দশ পর্ব
ডায়েরির পাতা থেকে………
যেখানে বাঁচার জন্য প্রতিটা সেকেন্ডে এতটা লড়াই করতে হয়, সেখানে দুটো বছর তোমার জন্য কী করে অপেক্ষা করতাম বলো? তুমি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝো না!
বিয়ের পর চেনা পরিবেশ ছেড়ে জাকির প্রাসাদতুল্য বিশাল বাড়িতে এসে উঠলাম। সে থেকেই মুক্ত হরিণী থেকে হয়ে গেলাম অবরোধ বাসিনী। বাইরে বের হবার কোনো উপায় ছিল না, কড়া পাহারা বাড়ির চারপাশে। এমনকি এ বাড়িতে যারা কাজের লোক তাদেরও কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া সাবার জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা। জাকি বাড়িতে ফেরে রাতে, ও যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ যেন পুরো নরক মনে হয় সময়টাকে। মনে হয় একটা ঘৃণ্য জীব বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ চারপাশটা। গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়। এ বাড়িতে আসার পর থেকে অনুভূতি শূন্য রোবট মনে হয় নিজেকে। এটা বাড়ি নয় যেন পাতালপুরী, যেখানে বন্দী আছে হতভাগ্য রাজকন্যা!
ওর বাবা-মা থাকেন অন্য বাসায়। কালেভদ্রে দেখা করতে আসেন। ওর মাকে নরম নিরীহ মনে হয়, কিন্তু ওর বাবার মধ্যেও জাকির মতই ধূর্ত একজনের বাস দেখেই বোঝা যায়। কাজের লোকেরাও কথা বলে না ভয়ে। এ বাড়িতে আমার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী রানু। জাকির প্রথম স্ত্রী! এটা আমি আগে জানতাম না। অনেকেই জানে না। প্রথম থেকেই সে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল। হয়তো দুজনের দুঃখটাই এক বলে। আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হলেও বন্ধুত্ব হয়েছিল তার সাথে। রানু না থাকলে আমি হয়তো দম আটকেই মরতাম।
তুমি আমাকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলে তা আমি পাইনি। পেয়েছিল জাকি। বিয়ের পর কোনো এক রাতে দম্ভভরে ক্যাটক্যাটে হেসে বলেছিল,
“তোমার ওই ভীনদেশী চ্যাংড়া নাগর, প্রেমপত্র দিসিল তোমারে। কী যে রসের কথা লেখছে। বেচারা!”
ঘৃণায় পুরো শরীর রিরি করছিল ওর ভাষা শুনে। আরও জঘন্যরকম নোংরা কথা বলেছিল, কিন্তু সেসব আমি লিখতে পারব না। কী নোংরা ভাষা! ছিঃ!
বিয়ের আগে থেকেই জানতাম জাকি ধুরন্ধর আর জঘন্য। এমন কোন হীন কাজ নেই যা ও করে না। ড্রাগ সাপ্লাই থেকে শুরু করে ভেজাল ওষুধ তৈরী করা, সরকারি তহবিল থেকে টাকা আত্মসাৎ, মেয়ে সংক্রান্ত বিষয় সহ যাবতীয় খারাপ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে আছে সে। এমনকি নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলে খুন করে ফেলতেও হাত কাঁপে না ওর। কিন্তু ও যে এতটা হিংস্র তা জানলাম আরও পরে।
কয়েকদিন আগে আমি ডাইনিং রুম থেকে পানি নিয়ে আমার ঘরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ওর কথা শুনে পা থেমে গেল।
“আইজকা রাইতের মইধ্যে যেন বর্ডার পার হয়, যেমনেই হোক। আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। পিচকাগুলারে পরে পাঠা, মাইয়্যাগুলান রাইতের ভিতরে পার করবি। কোনো গণ্ডগোল যেন না লাগে। তাইলে কিন্তু আমি চুপ কইরা থাকুম না।”
শীতল রক্তের স্রোত নেমে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। নারী আর শিশু পাচারের সাথেও জড়িত পশুটা। আরও কত মানুষের জীবন ধ্বংসের কারণ এই বিষাক্ত সাপটা, ভেবেই গুলিয়ে এলো ভেতরটা। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত আমার। কোনোকিছু না বলে পা টিপে টিপে রুমে চলে এলাম। জাকির লোকেদের চোখ এড়িয়ে বাইরে বেরোনো সম্ভব নয় কোনোভাবেই। ও বাসায় যতক্ষণ না থাকে ততক্ষণ বাসার একমাত্র ল্যান্ডলাইন ডেড থাকে। পাতালপুরীর বাসিন্দাদের পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা! যা করার ও বাসায় থাকতেই করতে হবে। কিন্তু এখন বুঝে ফেলবে। অপেক্ষা করতে হবে সুযোগের।
হঠাৎ ওর একটা কল আসায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বের হলো। ওর সেলফোনটা তাড়াহুড়ায় ফেলে গেছে। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কী একটা ভেবে ফোনটা হাতে নিলাম, কন্টাক্ট লিস্ট ঘেটে স্থানীয় থানার নাম্বারে ডায়াল করতেই পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল! ফোন টেবিলে রেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম জাকি দাঁড়িয়ে!
“কী করতে চাইতেছিলা? ভাবছিলাম উড়াউড়ির শখ শেষ, এহন দেহি আমি ভুল। কারে ফোন করতাছিলা?”
ওর চিৎকারে কেঁপে উঠলাম আমি, ওকে দেখতে হিংস্র কোনো জন্তু মনে হচ্ছিল তখন, যার সামনে থেকে সদ্য শিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
“এইবারের মতো মাফ করলাম, আরেকদিন কিছু করার চেষ্টা করলে সেদিন বুঝবা আমি কী?”
এই বলে ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম ফেলে যাওয়া ফোন নিতেই ও আবার ফিরে এসেছিল।
এরপর কয়েকদিন কোনো ঘটনা ছাড়াই কেটে গেল, বিপত্তি ঘটল কাল রাতে। ওর লোকেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়েদের কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে, কিংবা প্রেমের ফাঁদে ফেলে মেয়েদের নিয়ে আসে। এরপর পাচার করে দেয় বাইরের দেশে, কিংবা দেশেই কোন নরকে! আগেরবার কিছু করতে পারিনি বলে বিবেকের দংশনে মরছি। এবার আর কিছুতেই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারলাম না, বিদ্রোহ করে বসল মন। পথ খুঁজতে লাগলাম পালানোর। একটা সুযোগও পেয়ে গেলাম। রান্না করেন যিনি তাকে আমি খালা বলি। সে বাইরে যেতে পারে মাঝেমধ্যে। উনি আমাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। রানু আর খালা দুজনের প্ল্যান হলো খালার একটা শাড়ি পরে কোনো রকমে প্রধান ফটক পেরুতে পারলেই এই পাতালপুরী থেকে মুক্তি। খালা মাথায় ঘোমটা টেনে যাতায়াত করেন, তাই খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। জানিনা কতটা কী করতে পারব, হয়তো ধরা পড়ে যাব, জীবনটাও যেতে পারে। কিন্তু চেষ্টা না করে এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেব না। এভাবে মরার অপেক্ষায় দগ্ধে মরার চাইতে একেবারে মরে যাওয়াটাই শ্রেয় আমার কাছে।
আর হয়তো তোমাকে লেখা হবে না। যদি বেঁচে থাকি তবেই লিখব, নয়তো এটাই শেষ। আমার ক্ষমতা নেই ওর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করার৷ তবুও বিনা যুদ্ধে হাল ছাড়তে পারব না আমি। আমি যদি শেষ হয়ে যাই তাই তোমাকে সব জানিয়ে রাখলাম। এটা তোমার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে রেখেছি। যখনই এটা হাতে পাবে ওই অসহায়দের সাহায্য করবে। ওই ঘৃণ্য পশুটা কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি যেন পায় তার ব্যবস্থা করবে।
তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ থাকবে, নিজেকে দায়ী করবে না। আমার এই পরিনতি আমার ভাগ্যে ছিল। আমাদের নিয়তিতেই লেখা ছিল আমরা একে অপরের নই। আমি যদি বেঁচেও থাকি তবুও তোমার আর হতে পারবো না। দুঃখ করবে না। নতুন করে সামনে এগিয়ে যাবে। আমার মা’কে দেখে রেখ। সারাজীবন কষ্ট ছাড়া কিছুই পায়নি বেচারি। বেঁচে থাকলে আমিই বলব পরের গল্পটা। আর নইলে অন্য কারো কাছে শুনবে। অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে, তোমার ভালোবাসা পেয়ে নিজের জীবন পূর্ণতা পেয়েছে। আর কী চাই জীবনে। নাইবা হলাম একে অপরের। ভালো থেকো।
বিদায়।
ঝরে যাওয়া সোনালী ফুল’
★
এ পর্যন্ত পড়ে অন্বেষা থমকাল, পুরো ডায়েরি খুঁজে আর লেখা দেখল না, জাকির কিছু খারাপ কাজের বয়ান ছাড়া। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কিছু পেল না। তবে একটা ছবি পেল। একেবারে শেষ পাতায়। ঘুড়ি উড়াতে মগ্ন থাকা এক উদ্ভাসিত মুখ। কী যে স্নিগ্ধ হাসি! এটাই অতসী, সেই ছবি যেটা আবিদ তুলেছিল অতসীতে মোহাবিষ্ট হয়ে। এত হাস্যোজ্জ্বল মুখের মানুষের মুখ থেকে হাসিটাই মুছে গিয়েছিল চিরতরে! বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো ওর।
ইশ! আবিদ যদি সেদিন অতসীর বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরত, যদি অতসী আবীদকে সব বলত! খুব কী খারাপ হতো যদি জাকি নামক অভিশাপ ওদের জীবনে না আসত!তবে দুজনে হয়তো এখন অত্যন্ত সুখী দম্পতি হতো! সুখে ভরা একটা ভালোবাসার সংসার হতো! নানা সমীকরণ মেলাতে থাকে অন্বেষা। ভালোবাসা এত পোড়ায় কেন?
অতসীর বাকি গল্পটা আবিদের কাছে আছে। কীভাবে খুন হয়েছিল মেয়েটা জানতে মনটা আকুপাকু করছিলো। কালকে অবশ্যই আবিদের সাথে দেখা করতেই হবে, যে করেই হোক। বিষন্ন মনে ঘুমিয়ে যায় অন্বেষা।……