#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
ঊনবিংশ পর্ব
ছাব্বিশ.
আজ আবিদের সাথে দেখা করার দিন। খুব সকালে ফুরফুরে মনে ঘুম থেকে উঠল অন্বেষা। রাতে জানালার পর্দা ভালোভাবে টেনে দিতে ভুলে গিয়েছিল, একরাশ সোনালী রোদ ওর মাথার কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। শান্ত, মিষ্টি রোদ! ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন সময়টা সবে ছয়টা আটচল্লিশ, এত সকাল সকাল কখনোই ঘুম ভাঙ্গে না ওর, আজ ব্যত্যয় ঘটল। রোদ মুখে পড়ায় জেগে গেছে। সময়ের ব্যবধানে শুধুমাত্র মানুষই বদলায় না, প্রায় সবই বদলে যায়। এই যেমন সকালের রোদ খুব মিষ্টি মায়ামাখা হয়, রোদের প্রতিটি কণা উপভোগ করতে ইচ্ছে হয়, আবার ক্ষণেক পরেই তা রূপ বদলে কী ভীষণ রুক্ষ! কিছু সময়ের ব্যবধানে শেষ বিকেলেই আবার কী অদ্ভুত মায়াময় স্নিগ্ধতা মাখা লালচে রোদ্দুর! সময় সবকিছুই বদলে দেয়, মানুষের অনুভূতিগুলোই হয়তোবা সবথেকে বেশি বদলায়। কিছুদিন আগে আবিদের প্রতি ধারণা আর সদ্য জন্মানো অনুভূতির কী আকাশ পাতাল ফারাক! আনমনেই মিষ্টি একটা হাসি খেলে গেল মেয়েটার অবয়বে।
এলোমেলো ভাবনা থেকে বেরিয়ে বিছানা ছাড়ল ও, আজ কেমন আলসেমিতে পেয়ে বসেছে ওকে। অফিসে আজ তেমন কাজের চাপ নেই, একদিন ছুটি কাটানোই যায়। ছোটবেলায় স্কুলে যাবার আগেও এরকম আলসেমি চাপত ওর উপরে, স্কুলে না যাবার কতরকম বাহানা খুঁজে নিত তখন! মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, জ্বর, সর্দি আরও কতরকম ছুতো! বাবা ঠিক বুঝে ফেলতেন সেসব, অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবেই পাঠানো হত! কখনো বা ওর একরোখা জেদই জিতে যেত। আবারও হাসল ও, আনমনেই। আজ কেমন যেন ভাবালুতা পেয়ে বসেছে ওকে!
এত স্নিগ্ধতায় যে সকালের শুরু, তার স্থায়িত্ব অবশ্য খুব বেশি সময়ের হলো না, ছুটি নেয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল, বিপত্তিটা ঘটল সকালের খাবার শেষে রুমে আসতেই মা’র কল পেয়ে।
“কী ব্যাপার, তোমাকে ফোন দিলে কখনই ধরতে চাও না কেন? সবসময় হাজারটা কল দেবার পর ধর!”
কল ধরতেই এরকম কথা বলায় অন্বেষার মেজাজ গেল বিগড়ে,
“আমি তো আর সারাদিন ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি না, নানারকম কাজ থাকে। যখন দেখেন ধরছি না, তারমানে আমি নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু তবুও আপনি কন্টিনিউয়াসলি কল করতেই থাকেন। এটা নিশ্চয়ই আমার সমস্যা নয়।” অণ্বেষা রুক্ষ গলায় বলল।
মায়ের গলা কিছুটা মিইয়ে গেল,
“আচ্ছা, বাদ দাও। কেমন আছ?”
“আমি ভালোই থাকি। এখন শিখে গেছি ভাল থাকতে! আপনি যে সময় করে আমাকে কল করেছেন এতেই আমি ধন্য হয়ে গেছি।” নির্লিপ্ত গলায় তাচ্ছিল্যের সুর!
“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আমি বরাবরই তোমার খোঁজখবর নেই, তুমিই বরং এড়িয়ে চল সবসময়। দেখা করতে চাইলেও কর না…”
এটুকু বলতেই অন্বেষা বলল, “এখন দেখা করে আমি কী করব, যখন আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিল তখন তো আপনি ছিলেন না?” গলায় অভিমান ঢেলে অন্বেষার জবাব।
“আমি তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, তুমিই গোঁ ধরে বসে রইলে বাবার সাথে থাকবে। বাবার জন্যই তোমার আজন্ম টান, চিরকাল আমাকে ভুলই বুঝে গেলে। আমি দূরের মানুষই রইলাম তোমার কাছে!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক বেয়ে।
“আপনি নিজেই দূরত্বটা তৈরী করেছেন, আমাদের কোন দায় নেই এখানে। যেটুকু দায় সবটা আপনার! আপনি তো ঠিকই আপনার জীবন সাজিয়ে নিয়েছেন, বাবাতো পারেনি…”
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল অন্বেষা।
নীরবতা নেমে এল কিছু সময়ের জন্য, সহসা কথা বলতে পারল না কেউ।
সম্পর্ক ভাঙ্গার দায় হয়তো দুজনেরই, তবুও ভুলের পাল্লাটা কারও দিকে বেশিই হেলে যায়। মা হয়তো আর তা নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলেন না, তাই অন্য প্রসঙ্গ টানলেন,
“কার দায় কার নয় সেসব থাক, সবকিছুর পরও আমি তোমার মা, জন্ম দিয়েছি তোমাকে। আমারও ইচ্ছে করে তোমার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। তোমাকে একটা ট্যুরের ব্যপারে বলেছিলাম, শুধু তুমি আর আমিই থাকতাম। যাবে আমার সাথে?”
এক অদ্ভুত হাহাকার ফুটে উঠল গলায়। অন্বেষাকে সেটা স্পর্শ করল, কিন্তু অভিমানের পাহাড় যে বড্ড বেশি উঁচু, ডিঙাতে তাই অনেক সময় লাগবে হয়ত! তবে কিছুটা নরম হলো ও,
“দেখি, ডিসিশন চেইঞ্জ করলে আপনাকে জানাব। রাখছি।”
ফোন রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, সুন্দর সকালটায় সহসা মেঘের ছায়া দেখা দিল। চোখ বন্ধ করতেই টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল।
সাতাশ.
দুপুরের পর থেকেই আবিদের বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল অন্বেষা, সকালের মন খারাপ এখন আর নেই। হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত ইচ্ছে হলো। সবসময় তো অফিসের পরেই আবিদের সাথে দেখা হয়েছে, ফরমাল গেটআপেই দেখা গেছে সবসময়। আজ নাহয় কিছুটা ব্যতিক্রমই হোক। মনে হতেই কিছু সালোয়ার কামিজ বের করল, নীল রঙের একটা বেছে নিল। এটা এর আগে যেদিন পরেছিল সেদিন বাবা বলেছিলেন, এটাতে নাকি ওকে ভীষণ মানিয়েছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুটা রাঙিয়েও নিল। শেষবার আয়নায় নিজেকে পরখ করে চমকে উঠল অণ্বেষা! ভালোবাসা চিরকাল ওর কাছে গালগপ্পো ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি, হয়ত বাবা মায়ের ভালোবাসায় বাঁধা সংসার টেকেনি বলেই। নিজের একমাত্র রিলেশনশিপেও কোনো টান অনুভব করেনি বলেই তা ভেস্তে দিয়েছে। তবে আবিদের জন্য এত টান, এত মায়া আর বিশ্বাস কীকরে জন্মাল? অণ্বেষা নিজের মনেই ভাবল, এত সাজ এত রং কীসের জন্য? বাহ্যিক রূপ তো চোখ ভোলায় শুধু, মন ভরায় না!
ওই বিষাদপুত্রের মনের রাস্তা যে বড্ড পিচ্ছিল, পারবে তো ও ওই মানুষটার হৃদয় প্রাচীর ভেঙ্গে তাতে প্রবেশ করতে? কেঁপে উঠে সমস্ত হৃদয়, প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরীর মত থরথরিয়ে কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা!
আবিদের বাসায় পৌঁছার পর দেখল সোহান দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজায়, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেউ ওকে এইমাত্র এক গ্লাস চিরতার রস খাইয়ে দিয়েছে। অন্বেষা খেয়াল করে দেখেছে এই লোক কেন যেন ওকে সহ্য করতে পারে না, ওকে দেখলেই ওর মুখ আপনা আপনি তেঁতো হয়ে যায়। কারণটা জানা নেই ওর, হয়ত শুরুর দিকে ওর নাছোড়বান্দা আচরণের কারণে! বিরক্তি চেপে রাখার কোন চেষ্টাও নেই, যথারীতি আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। নিরস গলায় জানাল,
“স্যার ছাদে। আপনি এলে ওখানেই পাঠাতে বলেছে।”
অণ্বেষা ছাদে উঠে আসতেই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল, হৃদস্পন্দন বাড়ছে আলোর গতিতে! নিজের মনের উপর ওর একবিন্দুও নিয়ন্ত্রন নেই যেন! সহসা মেজাজ গেল চটে, ওর মন আর ওরই কিনা কথা শুনছে না! ওইতো দেখা যাচ্ছে বিষাদপুত্রকে, বরাবরের মতোই গুরুগম্ভীর! ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল,
“কেমন আছ, অন্বেষা?”
“ভালো, আপনি?”
জবাবে ম্লান হাসল আবিদ, মুখে কিছু বলল না। নয়দিন পর কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখতে পেল অণ্বেষা, কয়েকদিনের ছটফটানি বিদায় নিল অবশেষে, তবে এর পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ঢিপঢিপানি!
দুরুদুরু কম্পমান হৃদয়ে অন্বেষা বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ, আজকে সময় দিয়েছেন বলে। আসলে আমি সেদিন আপনাকে হার্ট করে কথাগুলো বলতে চাইনি। আমি অনেক সময় কী বলে ফেলি নিজেও জানি না। সত্যি বলতে…”
অণ্বেষাকে থামিয়ে দিয়ে আবিদ বলল, “দেখো, যা হবার সে হয়ে গেছে। তোমাকে এতবার স্যরি বলতে হবে না। তোমার গিলটি ফীল করার কোন কারণ নেই। সত্য সবসময় কঠিন হয়। আমি রিয়্যালিটির সাথে নিজেকে অ্যাডপ্ট করে নিয়েছি!”
“আপনি ভুল বললেন, আপনি কোনভাবেই অ্যাডপ্ট করতে পারেননি, বরং গা ভাসিয়েছেন স্রোতে। গভীর পানিতে নেমে সাঁতার না কেটে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, স্রোতের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন নিজের অদৃষ্টকে। এভাবে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না। তার থেকে সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করুন, দেখবেন জীবন সত্যিই ভীষণ সুন্দর!”
একদমে কথাগুলো বলে থামল অণ্বেষা।
আবিদের চোখে কি কিছুটা মুগ্ধতা খেলে গেল নাকি ওর দেখার ভুল!
চোখে মুখে বিষন্নতা ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি নেই যেন আবিদের! অণ্বেষার মনে হচ্ছিল রূপকথার সেই জীয়ন কাঠি আর মরণ কাঠির মতো বাস্তবে যদি কোন কাঠি থাকত, ‘আনন্দ কাঠি আর দুঃখ কাঠি’ নামে! দুঃখ ভর করলে কাঠির অদলবদলে নিমিষেই পৃথিবীর সকল আনন্দ ধরা দিত হাতের মুঠোয়, দুঃখ বেদনা বলতে তখন যা থাকত তা হত কেবলই বিলাসিতা! তা তো কখনোই সম্ভব নয়, তাই ও নিজেই আবিদেরর জীবনের আনন্দ কাঠি হতে চায়, পরশ পাথর হতে চায়!
“হয়তো তুমি ঠিক, তবে এখন আর তীরে আসার ইচ্ছে নেই। সাঁতার কাটতে ভুলে গেছি কবেই!” অতি সন্তর্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল আবিদ।
“অন্তত হাত পা ছুড়ে চেষ্টা তো করুন, নয়ত বুঝবেন কী করে ভুলেছেন কিনা?”
অণ্বেষা ভাবছে এই লোক হাসতে কেন পারে না? আবারও বলল অণ্বেষা,
“জানেন আপনাকে দেখে এখন আমার একটা ছড়া মনে পড়ল!”
আবিদ বিস্ময় চাপতে না পেরে বলল, “মানে কী?”
অণ্বেষা ছোট বাচ্চাদের মত মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল, “রামগরুড়ের ছানা
হাসতে তাদের মানা।”
অণ্বেষার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল আবিদ, ওর সেই ভুবন ভুলানো হাসি! হাসির শব্দ প্রতিফলিত হচ্ছে যেন পুরো বাড়ি ছাদে, আশেপাশের গাছপালা আর ফুল ফলে! খোলামেলা জায়গা বলে হয়ত দুঃখের বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে আকাশ পানে, বদ্ধ জায়গায় তা আরও গেঁথে যায় মনে, মস্তিস্কে!
অন্বেষা শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ওর এইসব নিতান্ত ছেলেমানুষী কথায় আবিদ হেসে ফেলবে এটা ওর কল্পনাতেও ছিল না। এতসুন্দর হাসিও বুঝি কোন ছেলের হয়! এত অদ্ভুদ সুন্দর হাসি যে ছেলের সে নাকি হাসতে ভুলে গেছে! এটা কখনো হয়? অণ্বেষা মনে মনে দোয়া করল, “বিষাদপুত্রের এই হাসি যেন চিরস্থায়ী হয়।”
মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল সেই অপার্থিব হাসি!
…….
বাকিটা পরের পর্বে