#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akther
১০.
— সুইসাইড করেননি, আপনি?
সামনে বসে থাকা আনুমানিক চব্বিশ বছর বয়সী এক মনমরা তরুণীকে প্রশ্নটি করে ডক্টর. রোয়েন মূতর্জা। মেয়েটার চোখদুটোতে বিষন্নতায় ঘেরা। জীবনের প্রতি নেই কেন মায়া। যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা শুধুমাত্রই তিরষ্কার। কাছের মানুষ থেকে পাওয়া ধোঁকা।
দক্ষিণা বাতাসে জানালার সাদা পর্দা উড়ছে। পিনপতন নীরবতা পুরো কেবিন জুড়ে। দু’জন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেবিনের বাইরে কিছু মানুষ দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে আছে।
— আমি অতটা দূর্বল নই যে আত্মহননের পথ বেছে নিব। কখন যে চেতনা হারিয়ে পরে গিয়েছি মনে পরছে না।
— আপনার মামা গতকাল আপনাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছেন। এসেই বলছেন আপনি সুইসাইড করেছেন। আমাদের অন্য বিভাগের ডক্টর এসে আপনাকে চেক-আপ করেন। আপনি আত্মহত্যার করার জন্য কিছুই গ্রহণ করেননি। এই কথাটি জানার পর আপনার মামা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন কিন্তু দুশ্চিন্তা করা বাদ দেননি।
কথাগুলো বলার সময় ডক্টর রোয়েন একাধারে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রয় মানুষের বেশে বসে থাকা কোনো মোমের পুতুলের দিকে। চোখেমুখে এতটা দুঃখী দুঃখী ভাব জমে আছে যে, যে কেউ দেখলে হলফ করে বলতে পারবে মেয়েটা প্রচন্ড ডিপ্রেসড।
— দেখুন মিস তনুজা আমি একজন সাইকোলজিস্ট। আপনার জীবনের উত্থান-পতনের গল্পটা শুনতে চাই। সব ঘটনা জানার পর যদি পারি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।
— আমি কি পাগল, ডক্টর?
— নো নো মিস তনুজা। আপনি একবারে সুস্থ।
— আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। সকালে একজনকে দেখে আমি চিৎকার চেচামেচি করেছি বলে আপনি কাউন্সিলিং করতে এসেছেন।
— আপনি ভুল ভাবছেন। আমি যাস্ট আপনাকে হ্যাল্প করতে চাইছি। কে বলতে পারে কার কখন কাকে প্রয়োজন পরে যায় ? নিসংকোচে আপনি আপনার জীবনের গল্প আমাকে জানাতে পারেন।
কথাটি বলে অপেক্ষা করছে রোয়েন । কখন তনুজা তার জীবন গল্প বলতে শুরু করবে।
জানালার কাচ গলিয়ে তনুজার দৃষ্টি তখন পাশের উঁচু দালানের মাঝে। দুটো কাক একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। আর, অন্যপাশে একা দাঁড়িয়ে আছে একটি কাক। হয়তো, এই কাকটার মতো তনুজা নিঃসঙ্গ। জীবনটা এত বিভীষিকাময় কেন? এক জনমে এত দুঃখ কেন পেতে হলো? কেন একজনকে ভালোবেসে বারবার ব্যর্থ হতে হচ্ছে?
চোখ দুটো বন্ধ করে অতীতের স্মৃতির দাঁড় গড়ায় পৌঁছে গিয়েছে তনুজা। মনে পরে যাচ্ছে সোনালী সেই দিনের উজ্জ্বল মূহুর্তকে।
অতীত……
গ্রীষ্মের দুপুরে পুকুর ঘাটে বসে হাঁসের সাতার কাটানোর দৃশ্য দেখছিল উনিশ বছর বয়সী এক কন্যা। মাঝে মাঝে পানিতে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছে। ঢিলের কারণে পানির তরঙ্গ মিশে যাচ্ছে পানিতে।
পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছে টগর। বড়শি পেতে রেখেছে পুকুরের জলে। কখন একটি মাছ এসে টগরের বঁড়শিতে আঁটকাবে আর টগর অমনি লাফিয়ে উঠবে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাছটাকে টেনে আনবে পানি থেকে। এমন কল্পনায় ডুবে ডুবে টগর প্রহর গুনছে। এমন সময় ধুপ করে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায় টগর আর তনুজা। তনুজা আর টগর একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর উঠে দিলো ভৌ-দৌঁড়। কে কার আগে দৌঁড়ে যাবে তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা হচ্ছে।
তনুজা এক দৌঁড়ে গিয়ে নীচে পরে থাকা কাঁচা আমটি হাতে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠলো। টগরের দৌঁড়ানোর গতি কমে ধীরে ধীরে। তনুজার সামনে এসে হাঁটুতে হাত রেখে দূর্বল গলায় বললো,
— এবারও তুমি জিতে গেলে! কিন্তু, পরের বার জিততে পারবে না। কারণ, তুমি তো আগামী বছর শ্বাশুরবাড়িতে থাকবে।
কথাটি বলে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো টগর। তনুজা রাগে চোখ ছোট ছোট করে টগরের কান মলে দিয়ে বললো,
— তবে রে দুষ্টু! আমি চলে যাই আর অমনি আপনি সব আম একা সাবাড় করবেন সেই আশায় প্রহর গুনছেন! হুহ্, শকুনের দোয়ায় কখনো গরু মরে নে। কথাটি মনে রাখিস টগর ফুল।
— কান ছাড়ো আপি। আর আমাকে একদম টগর ফুল বলে ডাকবে না। বিশ্রী লাগে শুনতে।
রাগে মুখ ফুলিয়ে রাখে টগর। তনুজা ভাইয়ের মনমরা চেহারা দেখে টগরের কান থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। তবুও টগর সেই আগের মতো মুখ করে রাখলো। তনুজা টগরের মন খারাপ দূর করার জন্য টগরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
— চল, টগর; গাছ থেকে কাঁচা আম পেরে শুকনা মরিচের গুঁড়ো, লেবুপাতা আর চিনি দিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাই।
টগর সেই আগের মতো মুখ করে রইলো। তনুজা হাল ছেড়ে দিয়ে আম বাগান থেকে বের হয়ে যাবে
এমন সময় টগর পেছন থেকে তনুজাকে ডাক দিয়ে বললো,
— চলো আপি। তুমি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থেকো। আমি ওপর থেকে আম ফেললে তুমি কুড়িয়ে নিও, ঠিক আছে?
— ঠিক আছে মানে দৌঁড়েবে। চল চল আম্মি চলে এলে রক্ষা নেই।
— ঠিক বলেছো। তাড়াতাড়ি চলো, আপি।
দুই ভাইবোন মিলে বড়ো আমগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। টগর ভালো করে পরনের লুঙ্গি কাছা দিয়ে “বিসমিল্লাহ” বলে গাছে উঠতে শুরু করলো। উঁচু শাখায় পৌঁছানোর পর একটি মোটা ডালে বসে আম পারছে আর নীচে তনুজার উদ্দেশ্য আমে ছুঁড়ে ফেলছে টগর। তনুজা সবকটা আম কুড়িয়ে ওড়নায় নিয়ে টগরকে বললো,
— তুই নীচে নেমে আয়। আমি গিয়ে আমের ভর্তা বানাই।
তনুজা এক দৌঁড়ে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে। একচালা ঘর। একপাশে মাটির চুলা অন্যপাশে শুকনো ডালপালা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। টিনের বেড়া থেকে বটি নিয়ে একতলা বাড়ির মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলো। বিল্ডিংয়ের ভেতরে ছোট্ট একটি রান্নাঘর আছে। সেখানে আছে এলপিজি গ্যাস দিয়ে চালিত গ্যাসের চুলা। রান্নাঘর থেকে একটি বড়ো বোল নিয়ে আমগুলো বোলের মাঝে রেখে বের হয়ে কলপাড়ে চলে যায় তনুজা। টিউবওয়েল চাপিয়ে পানি দিয়ে আম ধুয়ে নিলো। তারপর, বিস্তীর্ণ উঠোনে কাঠের পিঁড়িতে বসে আম কেটে নেয়। তারপর, শুকনো মরিচের গুড়ো চিনি এবং দুটো লেবু পাতা কুচি করে কেটে খুব ভালো করে ভর্তা বানিয়ে ফেলে তনুজা। ততক্ষণে টগর বাড়িতে এসে হাতমুখ ধুয়ে তনুজার পাশে কাঠের পিঁড়ি পেতে বসে পরেছে।
তনুজা একটুখানি আমের ভর্তা মুখে দিতেই ওর চোখমুখ কুঁচকে এলো। তনুজা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
— ওর চেহারা এমন কেন?
অচেনা পুরুষালি কন্ঠ শুনতে পেয়ে তনুজা একচোখ খুলে তাকায়। ব্লু রঙের টিশার্ট আর কালো জিন্স প্যান্ট পরনে থাকা যুবককে দেখে তনুজা দু-চোখ খুলে এক দৌঁড়ে ঘরে চলে যায়।
তনুজা আচমকা এমন আচরণ দেখে অচেনা যুবকটি টগরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কে মেয়েটা?
— আমার বোন।
টগরের হাতে থাকা বোলের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি দেখলো কাঁচা আমের ভর্তা।
হুট করে মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতির আনোগানা বেড়ে গিয়েছে। টক খেতে গিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলা মেয়েটার চেহারায় এত আদুরে ভাব কেন? এতটা স্নিগ্ধ অনুভব এর আগে কখনো অনুভব করেনি কেন সে?
টক খেতে গিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলা মেয়েটাকে দেখে হৃদয়ের আঙিনায় কিছু তো একটা বলছে। কিন্তু, সেই কিছুটা কি?
#চলবে