বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৯

0
349

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৯
রুহানীর খোঁজ পেয়ে আরহান তৎক্ষণাৎ লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তখন ফ্লাইট ছিল বিধায় সে দ্রুত বের হতে পেরেছে। এদিকে রাফাতও খবরটা পেয়ে এয়ারপোর্টে এসে আরহানকে দেখে। আরহান ওর কাছে এসে খুশিতে কথাই বলতে পারছে না। খুশিতে ভাষা হারানোর মতো অবস্থা তার। কোনরকম নিজের উৎফুল্লতা জাহির করে বলে,

“রুহানীর খোঁজ পাওয়া গেছে রাফাত। ও লন্ডনে আছে। লন্ডন পু*লিশ ওকে উদ্ধার করেছে।”

রাফাত জোরপূর্বক খুশি হওয়ার চেষ্টা করে। সে আরহানে কাঁধ চাঁপড়ে বলে,
“কনগ্রেটস দোস্ত। অবশেষে রুহানীকে ফিরে পেলি।”

“আলহামদুলিল্লাহ। এখন আমি লন্ডন যাব। ওকে নিয়ে ফিরব।”

“যা। সেফলি নিয়ে আয় রুহানীকে।”

এটা বলে রাফাত ঘুরে চলে যাচ্ছিল তখন আরহান ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে,
“তুইও চল আমার সাথে। তোর আজকে কোথাকার ফ্লাইট? ”

“নারে আজকে আমার ডোমেস্টিক ফ্লাইট আছে। তুই নিয়ে আয়। তারপর তো দেখা হবেই।”

“হুম। বায়। ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে। দোয়া করিস।”

রাফাত ওষ্ঠকোণে মিথ্যে হাসি টেনে আরহানকে বিদায় দেয়। আরহান চলে যেতেই রাফাত রাগে পাশের ওয়েটিং চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে নিজের চুল নিজেই টানতে থাকে। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে মুখমণ্ডলে পানি ছিটিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। অতঃপর নিজে নিজেই স্বগোতক্তি করে,

“নো নো নো! রুহানী এই চালাকিটা করে ঠিক করেনি। ড্যাম! আমি ফেঁসে যাব। রুহানী আরহানকে অবশ্যই বলবে। কী হবে এখন? আমি এখানে থাকতে পারব না। আমায় পালাতে হবে। হবেই। কিন্তু সাফা? সাফাকেও তো পু*লিশরা পেয়েছে। ওর কী হবে? আরহান তো জেনে যাবে সাফা কোমাতে তাই সাফার কোন খোঁজ কেউ পাচ্ছিল না। রুহানী হয়তো সাফার কোমাতে যাওয়ার কারণটাও বলে দিবে। আরহান সাফার ট্রিটমেন্ট করবে তো? বা সাফার বাবা-মা? আমি ফেঁসে যাবো। কিন্ত আমি আড়াল থাকতে পারবো। তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ওরা আমার বোনকে বাঁচিয়ে রাখবে তো?”

সাফার কথা চিন্তা করে রাফাত আরো চিন্তায় পড়ে যায়। এবার বেসিনে পানি আটকে তাতে নিজের মাথা নিমজ্জিত করে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড সেভাবে রেখে মাথা উঠিয়ে আবারো আয়নায় দেখে। তারপর মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“ওয়েট ওয়েট! রুহানী জানে সাফা আমার বোন। কিন্তু কেমন বোন তা তো জানে না। এখন জানতে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া আরহান, তন্নি, রাইদা জানে আমি সাফাকে বোনের মতো স্নেহ করি। হাহ্! এবার বেঁচে গেলে রুহানী কিন্তু তোমার জীবন ন*রক হতেই হবে। অন্তত যতোদিন আমি বেঁচে আছি ততোদিন তো তুমি সুখের মুখ দেখবে না।”

রাফাত তারপর মাথা-মুখ মোছে ঢাকার ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে চলে গেল। ঢাকা থেকে সে ইন্ডিয়া যাবে। তারপর কোথাও চলে যাবে।

__________

দীর্ঘ জার্নি শেষে আরহান লন্ডন পৌঁছে। তারপর পু*লিশ স্টেশনে ছুটে। চোখের সামনে রুহানীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রুহানী আরহানকে দেখা মাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আরহান কয়েক মুহূর্তে নির্বাক, নিশ্চল থেকে নিজেও প্রেয়সীকে গভীর আলিঙ্গনে আগলে নেয়। দুই পক্ষেই নিরবতা। যেন ওরা শব্দহীন উপায়ে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করছে।

এভাবে কিছু সময় পর একজন পু*লিশ এসে বলেন,
“Mr Arhan, there we got two lady. Miss Sheikh and a lady who is in coma stage. We transfered her to the hospital. (মিস্টার আরহান, আমরা সেখানে দুইজন মহিলাকে পেয়েছি। মিস শেখ এবং আরেকজন মহিলা যিনি কোমাতে আছেন। আমরা তাকে হসপিটালে স্থানান্তর করেছি। ”

“ওকে থ্যাংকিউ স্যার।”

“ইউ মোস্ট ওয়েলকাম।”

পুলিশটি চলে যেতেই রুহানী আরহানকে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে কিছু বলতে চাইছে। আরহান জিজ্ঞাসা করে,
“কী হয়েছে? কিছু বলতে চাইছো?”

রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলে,
“ওই মেয়েটা সাফা। সাফা কোমাতে আছে।”

“সাফা! রিয়েলি?”

রুহানী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায়। সাফার কথা শোনা মাত্রই আরহান হতবাক হয়ে যায়। সাফা তাও কোমাতে! তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে রুহানীর হাত ধরে পু*লিশ স্টেশনের দরকারি ফরমালিটি শেষ করে হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। সেখানে কি*ডন্যা*পারের নামও জানতে চায়নি। হসপিটালে গিয়ে রিসিপশনে খবর নিয়ে সাফার কেবিনে যায়। সেখানে গিয়ে সাফা কে এই অবস্থায় দেখে আরহান যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে সাফার পাশে গিয়ে বসে। নিজে নিজেই সাফা কে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,

“জানিস তোকে আমরা কতো মিস করেছি। কতো খুঁজেছি। তারপর আমরা ভেবেছি তুই হয়তো স্বেচ্ছায় আড়াল হয়ে আছিস। কিন্তু তোকে আজ এই অবস্থায়, এই হালে দেখব তা কল্পনাও করতে পারিনি।”

রুহানী এসে আরহানে কাঁধে হাত রাখে। আরহান রুহানীকে দুঃখ করে বলে,
“জানো, ও আমার প্রথম বেস্টফ্রেন্ড। ও যখন ছোটো ছিল তখন থেকেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব। সাথে উঠা, বসা, লড়াই সবকিছু হয়েছে। হয়তো ও যা চেয়েছিল সেটাই হয়নি!”

রুহানী আরাহানকে নিজের দিকে ফেরায়। তারপর দুই হাতের আঁজলায় আরহানের মুখটাকে নিয়ে মায়াময়ী দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর নিঃশব্দে বলে,

“সাফা আপনাকে ভালোবাসে। তাই আপনার সাথে আমাকে ও মানতে পারেনি। যার দরুণ বেখেয়ালিতে ওর অ্যা*ক্সিডে*ন্টটা হয়েছে। আর এখন ও কোমাতে। ছোটো থেকে একসাথে আপনারা। তাই সাফার মনে আপনার জন্য ভালোবাসার অনুভূতি জন্ম নেওয়াটা তেমন কোনো অস্বাভাবিক কিছু না। হয়তো সেও ভেবেছিল আপনিও তাকে বন্ধুত্বের আড়ালে ভালোবাসেন। জানেন? কোন না কোন ভাবে আমার নিজেকে দোষী মনে হয়। আমি যদি আপনার জীবনের না আসতাম তাহলে হয়তো সাফাই আপনার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা হতো। আমিই ওর ভালোবাসা ওর থেকে কেড়ে নিয়েছি।”

রুহানীর মুখ নিঃসৃত বুলি শোনে আরহান অবাক হলো। মেয়েটা নিজেকে দোষ দিচ্ছে।
“তুমি নিজেকে কেন দোষ দিচ্ছ? তুমি আমার জীবনের না আসলে কি হতো সেটা তুমি দাবি করে কিভাবে বলতে পারো? সাফাকে আমি যদি ভালোবাসার নজরেই দেখতাম তাহলে একশটা রুহানী এলেও আমি সাফাকেই ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি সাফাকে কখনোই ভালোবাসার নজরে দেখিনি। ওকে আমি সব সময় বন্ধুত্ব, বোন এরকম নজরেই দেখেছি। হতে পারতো যদি আমি অন্য কাউকে ভালো না বাসতাম তখন হয়তো আমি ওর ভালোবাসাকে সম্মান দিতাম আবার ওকে বুঝাতেও পারতাম। সবকিছুই ডেসটিনি।”

রুহানী সাফার পানে উদাস হয়ে চেয়ে রইল। হঠাৎ আরহানের ব্রেনে কিছু প্রশ্নের উদয় হলো। সে রুহানীকে জিজ্ঞাসা করল,

“তুমি এসব জানলে কী করে? মানে সাফার অ্যা*কসি*ডেন্ট আমাদের একসাথে দেখে হয়েছে?”

রুহানী নজর লুকাচ্ছে। আরহানকে রাফাতের কথা বললে কি আরহান বিশ্বাস করবে? ভেবে ভেবে রুহানী অস্থির হচ্ছে। জায়গা থেকে উঠে চলে যেতে নিতেই আরহান তার হাত ধরে আটকায়। তারপর নিজের সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে চোখে চোখ রেখে শুধায়,

“কিছু লুকাচ্ছো তুমি? কী লুকাচ্ছো? কিভাবে জানলে এসব? সাফাকে আর তোমাকে একই জায়গায় কিভাবে পাওয়া গেল? কে কি*ডন্যা*প করেছিল তোমাকে?”

জবাব নেই রুহানীর কাছে। সে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। রায়হান ভাবল রুহানি কে একটু সময় দেওয়া দরকার। দেশে ফিরে না হয় সবকিছু জেনে নেবে। এখন সাফাকে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আরহান রুহানীকে বলল ,

“আচ্ছা তোমাকে এখন আমি জোর করছি না। কিন্তু সত্যটা তোমাকে বলতে হবে। তুমি সময় নাও তারপর বলো। আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে সাফাকে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করব। ”

আরহান রুহানীর গালে হাত রেখে হালকা হেসে চলে গেল। রুহানী লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে সাফার পাশে বসে। এক দৃষ্টিতে সাফার পান্ডুর মুখশ্রীতে চেয়ে থাকে।

________
রুহানীর আসার খবরে রিহা ফিরে এসেছে। এসেই নিজের মাকে উৎফুল্ল দেখে তার ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি ফোটে। রিহাকে দেখে জাহানারা শেখ ছুটে আসেন। তিনি উৎফুল্লিত চিত্তে বলেন,

“রুহানী আসছে। ওকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কতোগুলো দিন মেয়েটা আমার সাথে নেই। ওকে কতোগুলো দিন পর দেখব।”

রিহা মায়ের মুখে হাত রেখে প্রশান্তচিত্তে বলে,
“তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে মা। তোমার এই হাসি খুশী শান্তি ভরা মুখটা দেখার জন্য হলেও দোয়া করব রুহানী যেন ভালো থাকে।”

জাহানারা শেখ মিষ্টি হেসে বলেন,
“শুধু রুহানী না। আমার দুই মেয়েই যেন সবসময় ভালো থাকে। হাসি-খুশি থাকে। এক মেয়েও খারাপ থাকলে মা ভালো থাকে না।”

আবেগে রিহার নেত্রকোনে অশ্রু জমে। সে তার মাকে জড়িয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here