বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)পর্ব ২

0
780

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
১৮
“হাই মিস বোবাপাখি! হোয়াটসআপ?”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে হক চকিয়ে ওঠে রুহানী। অতিসত্বর নিজের নজর ওঠায়। কিন্তু তমশায় আবৃত কক্ষে কোন কিছুই স্পষ্ট না। টর্চের তীক্ষ্ণ আলো কেবল ভূমিতে কিছু জায়গা জুড়ে বিরাজ করছে যার দরুন শুধুমাত্র অবয়ব ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রুহানী কন্ঠস্বরটা মনে করাতে চেষ্টারত। অপরপাশের লোকটা ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বলে ওঠল,

“কী ভাবছ বোবাপাখি রুহানী?”

রুহানী এবার যেন আরও অবাক হলো। এবার কণ্ঠস্বর আগের মতো না! এবারের কণ্ঠস্বরটা পূর্বের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। যেন ভিন্ন কোন মানুষ এসে কথা বলছে! রুহানী বুঝতে পারছে না, একজন মানুষের কণ্ঠস্বর আচানক মূহুর্তেই এত পরিবর্তন কিভাবে আসতে পারে? রুহানীর অবাকের রেশ কা*টার আগেই আবারও ভিন্ন কোনো কণ্ঠস্বরে লোকটা বলে ওঠে,

“এতো ভাবুক হয়ে তো কোনো লাভ নেই। তুমি এখান থেকে বের হতে পারবে না। মুক্তি পাবে না।”

লোকটা এবার অট্টস্বরে হাসা শুরু করল যে হাসির রুহানীর শরীরের লোমকূপে পর্যন্ত কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। রুহানী ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যেতে ধরলে আবারও সূ*চালো, ধা*রালো কিছু তার হাতে সংস্পর্শে আসে। তাতে সে ‘আহ!’ করে উঠলে লোকটি হাসি থামিয়ে দ্রুত ছুটে আসে আর অস্থির কণ্ঠে হড়বড়িয়ে বলতে শুরু করে,

“কী হয়েছে? কী হয়েছে? ঠিক আছো বোবাপাখি? ইশ! তুমি তো তোমার কষ্টগুলো মুখ ফুটে বলতে পারো না। অনেক ব্যাথা করছে না?”

বলতে বলতে লোকটা ফিক করে হেসে ফেলে। ক্রমান্বয়ে সেই হাসি জোড়ালো হতে লাগল। রুহানী হতভম্ব হয়ে ভীত দৃষ্টিতে লোকটার অবয়বের দিকে চেয়ে আছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। লোকটা বেশ সময় নিয়ে হাসি থামিয়ে রুহানীর মুখ চেপে ধরল। তারপর হিসহিসিয়ে বলল,

“তুই এখান থেকে কখোনো ছাড়া পাবি না। কখোনো না। তোকে ম*রতে হবে। তাই এসব ব্যাথা পাওয়ার ড্রামা বন্ধ কর। আমি আপনজন হারিয়ে যেমনটা অনুভব করছি, তুইও তার আপনজনদের থেকে দূর হয়ে তেমনটা অনুভব করবি। এটাও অনুভব করবি, ভালোবাসার মানুষ অন্যকারও হলে কেমন লাগে। সব অনুভব করবি। এখানে, এই অন্ধকার ঘরেই বন্ধি থাকবি বাকি জীবন।”

বলতে বলতে লোকটা রুহানীর গালে সজোরে চ*ড় বসিয়ে দেয়। চ*ড়ের বেগে রুহানী উপুড় হয়ে পরে। অতঃপর লোকটা মাটিতে পরে থাকা টর্চলাইটটাকে লা*থি দিয়ে দরজা লক করে সেখান থেকে চলে যায়।

________

প্রেশার হাই হয়ে জাহানারা শেখ হসপিটালাইজড। ডাক্তার তাকে ঘুমের ইন*জেকশন দিয়ে রেখেছে। তার পাশে আয়েশা খানম আছেন। হসপিটালের করিডোর রহমত শেখ অস্থির হয়ে পায়চারী করতে করতে ফোনে রুহানীর খোঁজের আপডেট নিচ্ছে। আজমল খানও নিজের সোর্স লাগিয়ে রুহানীর খোঁজ করছে। আর আরহান তো নিজেই পা*গলের মতো বেরিয়ে গেছে নিজের প্রেয়সীকে খুঁজতে। রাত প্রায় অনেক। এগারোটা বাজে। এখনও রুহানীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রহমত শেখ ফোনে কথা বলা শেষ করে করিডোরের চেয়ারে ধপ করে বসে পরে। অতঃপর নৈঃশব্দ্যে নিজের হতাশা, দুঃখ বিসর্জন দিতে থাকেন। আজমল খান এসে তার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে স্বান্ত্বনা দিতে দিতে বলেন,

“আপনি নিজেকে এভাবে ভেঙে ফেলবেন না, রহমত সাহেব। আপনি যদি এভাবে ভেঙ্গে পড়েন তাহলে ভাবিকে কে সামলাবে বলেন? ভাবি ভিতরে ঘুমের ঔষুধে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর তিনি আবারও রুহানীর খোঁজ করতে লাগবেন। তখন তাকে কী জবাব দিবেন? বলেন? আপনাকে শক্ত থাকতে হবে। তিনি যদি দেখে আপনিও ভেঙে পড়েছেন তাহলে তিনি মনোবল পাবেই না। তাছাড়া আমরা সবাই আছি আপনাদের সাথে। আরহান নিজে গিয়েছে রুহানীকে খুঁজতে। সিলেটের সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হবে। রুহানীর খোঁজ আমরা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাব।”

রহমত শেআ হতাশ ও নিভু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করেন,
“আবার কিসের শত্রুতা শুরু হলো আমাদের সাথে? রুহানী কার কি ক্ষতি করেছে আমি তো সেটাই বুঝতে পারলাম না। ১৮ বছর আগে এই সিলেটেই আমি আমার ভাই-ভাবিকে হারিয়েছিলাম। রুহানী তার বাবা-মাকে হারিয়েছিল। ভাই-ভাবিকে গু*লি করা ব্যক্তির ফাঁ**সিও হয়েছে। তাহলে আবার কে ক্ষতি করতে চাইবে রুহানীর? কোন হামলা হলে সেটা হবে আমার উপর। কিন্তু রুহানীর উপর কেন? ও তো এসব ব্যবসায়ীক কোন ঝামেলাতেও নেই।”

“কার কী শত্রুতা, কিসে লাভ-ক্ষতি, তা তো আমরা বলতে পারব না। আমাদের উচিত সবার আগে রুহানীকে সহি-সালামত খুঁজে বের করা। তারপরই সব কিছুর জট খুলবে। আপনি ধৈর্য ধরুন। মনোবল হারাবেন না। বিশ্বাস হারাবেন না। রুহানীকে আমরা ঠিক খুঁজে পাবো।”

রহমত শেখ মৌন রইলেন। তিনি মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন রুহানী যেন সহি-সালামত ভাবে ফিরে আসে।

__________

আরহান শহরের অলিগলিতে পু*লিশের সাথে তাল মিলিয়ে রুহানীকে খুঁজে চলেছে। সিলেট বিভাগের প্রত্যেকটা থা*নায় রুহানীর মিসিং কে*স ফাইল করা হয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে আজমল খান ও আরহানের ক্ষমতা বলে। আরহানের সাথে আরহানের বন্ধুরাও যোগ দিয়েছে তারা সবাই মিলে রুহানিকে খুঁজে চলেছে। সময় তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলেছে। সময় তো আর কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না! ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত একটা। আরহান মাঝে রাস্তায় হাঁটুর গেড়ে বসে চিৎকার করে ওঠে,

“কোথায় তুমি রুহানী? প্লিজ আমার কাছে ফিরে এসো। আর লুকোচুরি খেলো না। প্লিজ প্লিজ।”

মুখে হাত চেপে কাঁদতে শুরু করে আরহান। অদূরে দাঁড়ানো আরহানের বন্ধুরা। রাফাত, অভিক, জাওয়াদ, কবির ওরা আরহানের এই ভেঙে পরা রূপ দেখে হতাশচিত্তে চোখ মোছে। চারজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায়। আরহানের পাশে গিয়ে বসে। রাফাত আরহানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

“তুই ভেঙে পরিস না। আমরা তো খোঁজ করছি। পু*লিশও খোঁজ করছে। এয়ারপোর্ট, বাস টার্মিনাল সব জায়গায় খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কড়া সিকিউরিটি ছাড়া কেউ সিলেট থেকে বের হতে পারবে না ও ঢুকতেও পারবে না। আমরা রুহানীর খোঁজ জলদি পেয়ে যাব।”

অভিক বলে,
“তোকে যতোদূর চিনি, তুই ভেঙে পরার মতো না। তুই তো মনোবল বাড়ানোর ইন্সপিরেশন। তুই রুহানীর মনোবল। তুই যদি ভেঙে পরিস তাহলে কীভাবে হবে?”

“হ্যাঁ দোস্ত। সিলেটের সব থা*নায় রুহানীর খোঁজ চলছে। আমরা নিজেরা ও লোক লাগিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। ঠিক পেয়ে যাব।”

জাওয়াদের সাথে এবার কবিরও তাল মেলায়,
“যে বা যারা এই জঘন্য কাজ করেছে, সে হয়তো আন্দাজও করতে পারতেছে না, কার হবু স্ত্রীকে নিয়ে গেছে। কার হবু পুত্রবধূকে কি*ডন্যা*প করেছে। একবার হাতে পেলে ওর ক*লি-জার সাইজটা দেখব জাস্ট।”

সবার মনোবল বাড়ানোর প্রয়াসে আরহান নিরুত্তর, নিরুত্তাপ! শূণ্য দৃষ্টিতে তমসাবৃত অম্বরে অক্ষিযুগল নিবদ্ধ করে রেখেছে। তার রুহানী তার যেকোনো মূল্যে চাই।

_____

কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পরেছে রুহানী। তারপর হঠাৎ নিজের উপর জলের আচানক বর্ষণে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,

“খেয়ে নে। তোর পরিবার ও ভালোবাসার মানুষের তোকে খোঁজ করা দেখে মজা নিচ্ছিলাম। তোর যে খাওয়া হয়নি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আমি রুম থেকে বেরোনোর পর লাইট জ্বালিয়ে দিব তখন খাবারটা খেয়ে নিস।”

তারপর রুহানীর দিকে এক প্লেট খাবার এগিয়ে দেয়। অন্ধকারের রুহানী হাত দিয়ে হাতড়ে খাবারটাকে দূরে ঠেলে দেয়। তাতে লোকটার ভীষণ রাগ হয় কিন্তু সে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে হেসে ওঠে। তারপর বলে,

“খেতে ইচ্ছে করছে না তোমার বোবা পাখি? খাইয়ে দেবো তোমায়? কিছু বলতে ইচ্ছে করছে? আমাকে মনে মনে ব*কা দিচ্ছ? ইশ আফসোস লাগছে! তোমার বকা গুলো আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছে না যে। কী করি বলো? তোমার এই মৌনতায় না, এক ধরনের শান্তি আছে। আমার কাছে মনে হয় কি জানো? আরহান এই শান্তির জন্যই তোমাকে বেছে নিয়েছে! তাছাড়া তুমি ভীষণ.. হট এন্ড… থাক বললাম না!”

কষ্টে, ঘেন্নায় রুহানী মুখ ফিরিয়ে নেয়। লোকটা সেটা তার অন্ধকারে দেখার জন্য ব্যবহার করা গ্লাসের সাহায্যে দেখে উচ্চস্বরে হেসে বলে,

“এতো ঘৃণা! ইশ! আমি তো তোমার ঘৃণার অ*নলে আরও কয়েকদফা দ*গ্ধ হতেও প্রস্তুত! কিন্তু তুমি খাবার খেতে প্রস্তুত না। সমস্যা নেই। আজ খাবে না, কাল খাবে না। কিন্তু এমন করে কয়দিন? যখন খিদের তাড়না সহ্য করতে পারবে না, তখন না খেয়ে থাকতেই পারবে না। খিদের চেয়ে বড়ো কিছু হয় না বুঝলে!”

কথাগুলো বলে লোকটা চলে যেতে যেতে একটা ভাঙা চেয়ারকে লা-থি দিয়ে জোড়ালো শব্দে স্থানান্তরিত করে দরজা লক করে বেরিয়ে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

আমার প্রথম বই “মেঘের আড়ালে উড়োচিঠি” ৩৩% ছাড়ে প্রিঅর্ডার করুণ আপনাদের পছন্দের যেকোনো বুকশপে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here