বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ৪

0
511

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
রুহানী ছেলেটির কথায় পাত্তা না দিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যেতে নিল। তখনই ছেলেটা আবারও রুহানীর সামনে চলে এসে রুহানীর মুখাবয়ব দৃশ্যমান করার জন্য নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বা*লিয়ে বলে,
“চার দিন আগে আপনি আপনার চাচা-চাচির সাথে সিলেটে আপনাদের পুরনো বাংলোতে উঠেছেন। রাইট? আপনার চাচা বলছিলেন, এতদিন পর এখানে আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার বিয়ে। কিন্তু উনি এটাতো বলেননি আপনি কথা বলতে পারেন না।”

রুহানী ছেলেটির মুখশ্রীর উৎসুকতা দেখে সামনে চলতে থাকে। ছেলেটি ইশারায়ও কোনো রকম জবাব না পেয়ে পাশেপাশে চলতে থাকে। তখন রুহানীর ফোনের মেসেজ টোন বেজে ওঠে। রুহানী দেখে তার চাচার মেসেজ। উনারা রুহানীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই জানতে চাইছেন রুহানী কোথায় আছে।

মেসেজটা পড়ে রুহানী লিখল,
“আমি বাংলোতে যাচ্ছি। ফাংশন শেষ হলে তোমরাও চলে এসো।”

ফিরতি মেসেজে রেহমান শেখ লিখেন,
“তুই তো গাড়ি নিয়ে যাসনি। কোথায় তুই? এতো রাত করে একা বেরিয়েছিস আবার গাড়িও নিসনি। সিলেটে এখানকার রাস্তাঘাট রাত হলে নির্জন হয়ে যায়। তুই কই আছিস বল। আমরা এখনি আসছি।”

“না চাচ্চু, আমি ঠিক আছি। তোমরা সব রিচুয়াল শেষ করে তারপরে আসো। আমি বাংলোতে পৌঁছাতে পারব।”

রুহানীর মেসেজ দেখে মোটেও মনে শান্তি পেলেন না রহমত শেখ ও জাহানারা শেখ। জাহানারা শেখ স্বামীকে বলেন,
“তুমি একদম ওর কথা শোনো না। গাড়ি পাঠাও। যেখানে আছে সেখান থেকে ড্রাইভার গাড়ি করে ওকে বাংলাতে পৌঁছে দেবে। তারপর না হয় ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আবার এখানে আসলো। রাস্তাঘাট তো এখন পুরো নিরব।”

রহমত শেখ বললেন,
“আমিও তাই বলি। আমি ওকে বলছি যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়াতে। গাড়ি এখনই যাবে। তাছাড়া বেশি তো পথ না। হেঁটে যেতে সময় লাগবে কিন্তু গাড়িতে যেতে তো ১০-১৫ মিনিটের বেশি লাগে না।”

“হ্যাঁ তাই বলো।”

রহমত শেখ রুহানীকে মেসেজে বললেন,
“তুই যেখানে আছিস সেখানেই দাঁড়া। গাড়ি এখনই আসবে। আর কোন কথা না। রাত বিরেতে কোন বিপদ হলে তখন কি করবি?”

চাচ্চুর মেসেজ দেখে রুহানী ভাবতে থাকে, সে এখন কি বলবে? সে তো বড়ো রাস্তা দিয়ে আসেনি। এসেছে চা বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে। ভাবনার মধ্যে রুহানী হঠাৎ লক্ষ্য করে অপরিচিত ছেলেটি তার ফোনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। এতে রুহানী বেশ বিরক্ত হলো। সে ফোনের নোটে গিয়ে টাইপ করল,

“কারও অনুমতি ছাড়া তার ফোনের দিকে নজর দেওয়াটা ব্যাড ম্যানার্স।”

ছেলেটি লেখাটা পড়ে মুচকি হেসে বলল,
“যাক, আজ আপনিও বলে দিলেন আমার ম্যানার্স নেই। আমার বাবাও তাই বলে। ইটস অকে। তবে আপনার চাচা যে গাড়ি পাঠাচ্ছেন, তাকে লোকেশনটাও বলুন। আপনি তো রাতের বেলাতে শর্টকাটের চক্করে নির্জন চা বাগানে এসে পরেছেন। নাহলে দেখবেন সে বড়ো রাস্তায় গাড়ি পাঠিয়ে আপনাকে না পেয়ে চিন্তা করছেন।”

রুহানী চিন্তায় পরল ঠিক কিন্তু ছেলেটির কথার জবাবে লিখল,
“সেটা আমি বুঝে নিব। আপনাকে বলতে হবে না।”
“অকে!”

রুহানী এবার সাহস করে তার চাচাকে লিখল,
“আমি প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। আর দুই-তিন মিনিট লাগবে। গাড়ি পাঠিও না। শর্টকাট দিয়ে এসেছি তো।”

রুহানীর মেসেজটা পাওয়া মাত্রই রহমত শেখ হতবাক হয়ে গেলেন। শর্টকাট বলতে যে চা বাগানের ভেতর দিয়ে তা তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন। জাহানারা শেখ অস্থীর কণ্ঠে বলেন,

“আমার মনেই হচ্ছিল ও কিছুতে ফেঁসে গেছে। ও কি এখানে এসে চা বাগানের শর্টকাট রাস্তায় গিয়েছে? চিনবে কী করে? বিপদে পরলে কাউকে ডাকবে কী করে? আমি যদি জানতাম, আমাকে জোড় করে পাঠিয়ে দিয়ে ও সেন্টার থেকে বের হয়ে যাবে! তাহলে তো আমি ওকে একা ছাড়তামই না।”

রহমত শেখও চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“বাংলোর দারোয়ানকে ফোন করে বলি শর্টকাট দিয়ে এগুতে। আমরাও বের হই। ছাদ থেকে একবার ওকে চা বাগানের পুরো দৃশ্য দেখানোর সময় শর্টকাটটা দেখিয়েছিলাম। আমি কি জানতাম যে ও এটার সূত্র ধরে বেরিয়ে যাবে!”

তখনি রহমত শেখের ফোনে একটা কল আসে। হঠাৎ এই নাম্বার থেকে ফোন দেখে রহমত শেখ কিঞ্চিত ভাবনায় পরেন। তিনি ফোন রিসিভ করলে অপর পাশ থেকে সালাম আসলে সালামের জবাব দিয়ে বলেন,

“কী ব্যাপার আরহান? হঠাৎ ফোন করলে যে।”

“একচুয়েলি আংকেল, আপনার ভাতিজিকে আমি চা বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে দেখলাম। আমি এখন উনার সাথেই আছি। উনার সাথে আপনার কনভার্সেশন দেখে মনে হলো আপনাকে ফোন করে বলি যে আমিই উনাকে বাংলো পর্যন্ত পথটুকু পৌঁছে দিব। আপনি চিন্তা করবেন না।”

রহমত শেখ হড়বড়িয়ে বলে ওঠলেন,
“রুহানীর তোমার সাথে? আমরা তো ওকে না পেয়ে বেশ চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। একা মেয়েটা কোথায় গেল! বাবা, তুমি একটু কষ্ট করে ওকে বাংলো পর্যন্ত পৌঁছে দাও। রাস্তাঘাট তো বেশ নিরব। আমরাও একটু পরেও রওনা হবো। গেস্টরা চলে গেলেই বেরিয়ে পরব। মেয়েটা যে না বলে বেরিয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। এমনিতেই ওর মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তুমি একটু উপকার করো বাবা, রুহানীকে একটু পৌঁছে দাও।”

রহমত শেখের মুখ থেকে রুহানী নামটা শুনে আরহান নামের ছেলেটি মনে মনে নামটা বেশ কয়েকবার আউড়ালো। অতঃপর বলল,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না আঙ্কেল। আমি রুহানীকে ঠিকমতো বাংলোতে পৌঁছে দিব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”

আরহান কথা বলা শেষ করে ফোন রেখে রুহানীর দিকে ফ্ল্যাশলাইট দিলে দেখে, রুহানী তার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরহান রুহানীর চোখের সামনে হাত নেড়ে বলে,

“কী হলো ম্যাম? এভাবে তীরের মতো দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করার কারণ কী?”

রুহানী হাত নেড়ে কিছু বুঝাল। আরহান তা বুঝতে পারল না বিধায় রুহানী টাইপ করল,
“আপনি চাচ্চুকে ফোন করেছেন কেন? এতটুকু রাস্তা আমি একাই যেতে পারব।”

রুহানী আরহানের চোখের অতি নিকটে ফোনটা ধরলে আরহান খানিক পিছিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরে লেখাটা পড়ে হেসে বলল,
“আচ্ছা! আপনি একাই যান! আমি শুধু আপনি যদি ভুল পথে অগ্রসর হোন, সেটা দেখিয়ে দেবো। আর কিছু না। যেহেতু আপনার চাচা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, আপনাকে সেফলি বাংলাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাই আপনি না চাইতেও আমাকে আপনার সাথে সাথে বা পেছনে পেছনে যেতে হবে। আই হ্যাভ নো চয়েজ ম্যাম।”

রুহানী নিজের বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আগে আগে হাঁটতে থাকে। আরহানও চুপচাপ হাঁটছে। রুহানী ভুল দিকে যেতে নিলে বলে দিচ্ছে। একটু পর আরহানের কিছু মনে পরল। সে বলল,

“আপনার চাচার সাথে কথা বলার সময় মনে হলো তিনি কোন একটা বিয়ে বাড়িতে আছেন। তাছাড়া আপনার চাচা সেদিন বলেছিলেন, আপনার বিয়ের উদ্দেশ্যেই আপনারা সিলেটে এসেছেন। তাহলে আপনি এখানে কেন?”

আরহানের প্রশ্ন শুনে রুহানী থমকে দাঁড়াল। অতঃপর আবারও হাঁটা ধরল। আরহানও জবাব না পেয়ে আর আগ্রহ দেখাল না। সে পরে জেনে নিবে। প্রায় কিছুক্ষণ পর ওরা বাংলোতে পৌঁছে গেল। রুহানী আরহানের দিকে তাকিয়ে কৃতঙ্গতা স্বরূপ হেসে মোবাইলে টাইপ করল,

“আমাকে এতো কষ্ট করে পৌঁছে দিয়েছেন। তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

তারপর ফোনটা কয়েক সেকেন্ড আরহানের চোখের সামনে ধরে রাখে। আরহান হালকা হেসে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রুহানী গেইটের ভেতরে ঢুকে গেছে। আরহান তা দেখে মা*থা চুলকে নিচু স্বরে স্বগতোক্তি করে,

“মেয়েটি বেশ অন্যরকম!”

এরপর আরহান হাঁটতে হাঁটতে রহমত শেখকে ফোন করে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি রুহানীকে পৌঁছে দিয়েছি। আপনারা এবার নিশ্চিন্তে আসতে ধীরে আসুন। ”

রহমত শেখ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কী বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দিবো বাবা। খুব উপকার করলে। কাল আমাদের বাংলোয় তোমার ও তোমার বাবার দাওয়াত রইল। আসলে খুব খুশি হবো।”

“চেষ্টা করব আংকেল।”

আরহানের সাথে কথা বলা শেষে রহমত শেখ ফোন রাখতেই দেখলেন রিহা তার দিকে এগিয়ে আসছেন। এখনি রিহাকে নিয়ে জিহানের পরিবার রওনা হবে। রিহা রহমত শেখের কাছে এসে বেশ ভাব নিয়ে বলল,

“কোথায় তোমার আদরের ভাতিজি? শুনলাম, ওকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? তুমি কি তবে তোমার ভাইকে দেওয়া কথা রাখতে পারলে না? যেই ওয়াদার জন্য তুমি ও মা, রুহানীকে আমার থেকে বেশি ইম্পোর্টেন্স দিয়েছ! কী হলো ড্যাড? বলো?”

রহমত শেখ হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন,
“রুহানীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। ও বাংলোতে ফিরেছে। তুমি এখন তোমার শ্বশুর বাড়িতে যাও। আশা করব সেখানে গিয়ে শুধরে চলবে।”

এই বলে রহমত শেখ তার মেয়ের পাশ থেকে সরে গেলেন। রিহা বাঁকা হেসে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।

কনে বিদায় শেষে রহমত শেখ তার স্ত্রীকে নিয়ে বাংলোর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here