#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
অষ্টম পর্ব
ডায়েরির পাতা থেকে—
মা, বাবা আর আমি, তিনজনকে নিয়ে ভীষণ সুখী এক পরিবার। আমার কাছে সবসময় তাই মনে হতো। কিন্তু এর পুরোটাই যে কতটা ফাঁপা আর অন্তঃসারশূন্য তা কখনো আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ধরা পড়েনি! অনেক ছোটবেলায় পাশের বাড়ির একজন মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল,
“নিজের মাইয়্যা হইলে না জানি আরও কত কী করত, মাইনষেরটারে নিয়াই কত্ত আদিখ্যেতা!”
তখন আমার বয়স ছয় কী সাত। এটা শুনে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলাম। বাবা, মা আমাকে বুঝিয়েছিল ওই লোক পাগল! পাগলের পাগলামিতে কান দিতে আছে নাকি! আমিও তাই বিশ্বাস করে ভুলে গিয়েছিলাম তা। পরেরদিন থেকে ওই লোকটাকে আর দেখিনি কখনো। আমিও ভুলে গেছি কবেই। বাবার প্রভাবে কিংবা ভয়ে কেউ সত্য আমার সামনে আর প্রকাশ করেনি, তবুও উনি আর রিস্ক নিতে চাননি।
কয়দিন মানুষ মুখ বন্ধ রাখবে ভয়ে? এসব ভেবে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো হোস্টেলে। ছুটিতে আসতাম, আবার চলে যেতাম ছুটি ফুরালে। এস.এস.সি’র পরে একেবারে চলে এসেছিলাম গ্রামে। ইন্টারমিডিয়েট এখানেই করলাম। কিন্তু সেই অন্তরালের কথা আর সামনে আসেনি। তবে একটা কথা সত্যি, আমি অগাধ স্নেহ পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে। কীভাবে জানলাম সব তা বলার আগে আরও কিছু বলা বাকি। আগের কথা আগে বলি নয়তো এলোমেলো লাগবে, বুঝতে পারবে না।
তোমাকে এখনো জানাইনি, আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম তুমি আমাকে দেখার আগেই। তুমি আমাদের গ্রামে আসার পরেই। রোদ থেকে বাঁচতে ইয়া বড় হ্যাট পরেছিলে মাথায়, মুখটাও লুকিয়ে ছিল আড়ালে, গলায় ঝুলানো ছিল ক্যামেরাটা। আমাদের এলাকার সবথেকে বড় বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যখন হ্যাটটি খুললে, তখন আমার দুনিয়া যেন থমকে গেল!
মনে হচ্ছিল গ্রীক মিথলজি থেকে কোনো গ্রীক দেবতা যেন উঠে এসেছে আমার সামনে। কোনো ছেলেকে এভাবে দেখছি ভেবে নিজেকে খুব করে শাসিয়েছিলাম, নিজেকে কড়া ধমক দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তবুও চোখদুটো কথা শুনছিল না আমার! কী বেহায়া দৃষ্টি! নিজের চোখই বেঈমানি করছিল বড্ড!
এরপরের দিন আবার তোমাকে দেখলাম। ছবি তোলায় এতই নিমগ্ন ছিলে যে আশেপাশের দুনিয়া থেকে বিস্মৃত ছিলে! খেয়াল করলেই দেখতে পেতে তোমার দিকে আমার মুগ্ধ দৃষ্টি। ভাগ্যিস খেয়াল করনি, কী লজ্জার হতো ব্যাপারটা বলতো!
সে যাক, আমি ঘুড়ি উড়াতে উড়াতে সহসা চোখ গেল তোমার দিকে। যাকে আমি নিজে মুগ্ধ হয়ে দেখি তার চোখে নিজের জন্য মুগ্ধ দৃষ্টি দেখা কতটা ভালোলাগার বলে বোঝাতে পারব না! এত ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে যে দেখছিলে, আমার মধ্যে কি সত্যিই এরকম কিছু ছিল? তোমার মুখ থেকে জানতে ইচ্ছে করে ভীষণভাবে। কিন্তু সে আর কোনোদিন সম্ভব নয়!
তুমি আবার ভেবো না যে, শুধু চেহারা দেখে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম! হুটহাট প্রেমে পড়া আমার স্বভাব নয় মোটেও। কিন্তু তোমার সেই মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে যখন তোমার সামনে দাঁড়ালাম, খেয়াল করলাম এক অদ্ভুত সারল্য আছে সে চাহনিতে। একেবারে শিশুর সারল্য! তাতেই মরলাম তোমাতে! হারিয়ে গেলাম সে চোখে! তোমার চোখে সেদিন তাকিয়েই নিজের সর্বনাশ দেখেছিলাম। মুগ্ধতা সরে গিয়ে জায়গা করে নিল ভালোবাসা। সেই প্রথম এবং একমাত্র প্রেমে পড়া আমার!
বসন্ত উঁকি দিয়ে গেল মনে। কিন্তু এত সহজে কী করে ধরা দেই বলো? আমার কয়েক রাতের ঘুম হারাম করার শাস্তি দিতে হবে না তোমায়? তাই পালিয়ে বেড়ালাম, আমার জন্য তোমার ব্যাকুলতা খুব কাছ থেকে দেখতাম! সেটা শুধুই মোহ নাকি সত্যিকারের গভীর অনুভূতি তা বোঝার চেষ্টা করতাম। বাচ্চাদের আড্ডায় আমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে তখনও সেখানেই ছিলাম আমি। আমাকে না দেখে কী যে মন খারাপ হলো তোমার!
যেদিন দ্বিতীয়বার তোমার সামনে দাঁড়ালাম সেদিন কী এক বুক ঢিপঢিপ করা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমায়। হৃদয়ে যেন হাজার শব্দের দামামা তখন! নিজেকে কিছুটা রাঙিয়েও নিয়েছিলাম। ছেলেমানুষী হলে হোক, বয়সটাই তো তেমন। নিজেকে এই বলেই বুঝিয়েছিলাম। আমার কথায় ধরাশায়ী হবার পর তোমার সেই বোকাবোকা চাহনির প্রেমে পড়েছিলাম আমি। তাই ইচ্ছে করেই জ্বালাতন করতাম তোমায় যেন সারাক্ষণ তোমার ভাবনায় আমি থাকি। বিরক্ত হলেও যেন আমাতেই থাকতে পারো।
এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, কাঙ্ক্ষিত কথাটা বললে আমায়। যে কথাটা শোনার জন্য তীর্থের কাকের মত প্রতীক্ষায় ছিলাম আমি। এত দ্রুত বলতে পেরেছিলে আমি উসকেছিলাম বলে, নয়তো কত যুগ সময় নিতে আল্লাহ মালুম! মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব রঙ যেন আছড়ে পড়ল আমার মনে!
সেবার বসন্ত যেন আমাকে পূর্ণতা দিতেই এসেছিলো। হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছিল ওর সকল রঙ দিয়ে, কী ভীষণ রঙিনই না ছিল সে বসন্ত! কে জেনেছিল পরের বসন্তেই রিক্ত হব, কতটা ভীষণ নিঃস্ব হব! ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি কখনো, কখনোই না!
ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর প্রথম যেদিন পূর্ণিমা থাকবে সেদিন তোমার হাত ধরে না বলা কথাগুলো বলব, তাই হৃদয়ে জমিয়েছিলাম অনুভূতির মেলা! আমাকে নিয়ে তোমার অনুভূতিও সেদিনই শুনবো ভেবেছিলাম। কিন্তু কিছুই হলো না, না হলো বলা আর না হলো শোনা!
সহসাই আমাদের স্বপ্ন যাত্রা গেল থমকে, এক কালো ছায়ার প্রভাবে, জাকি। শুনেছিলাম লোকটা নাকি সাপের থেকেও বিষাক্ত, এখন সেটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করি। তোমার হয়তো মনে আছে ওর কথা, ওকে দেখেই খুব ভয় পেয়েছিলাম। কারণ ওর দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিল না। খুব খারাপ কিছু ছিল তাতে। তোমাকে বলিনি কারণ তুমি এর প্রতিবাদ করে দুজনেরই বিপদ বাড়াতে। তোমাকে যতটা চিনেছি, তুমি এমনি এমনি ওকে ছাড়তে না। কিন্তু ওর প্রভাব কতটা সেটা তুমি জানো না। তাই ঝামেলা এড়াতে কিছু না বলে চলে এসেছিলাম।
যেদিন কানাডা থেকে তোমার চিঠির খবরটা এলো সেদিন তোমার চোখেমুখে স্বপ্ন জয়ের উচ্ছ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছিল! ছবি তোলার সময় তোমার বুঁদ হয়ে থাকাটা ইঙ্গিত দেয় এটা তোমার কতটা ভালো লাগার। তোমার খুশি আমার কাছে কতটা দামী তা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। তুমি চলে গেলে, কথা দিয়ে গেলে কানাডার ফ্লাইটে উঠার আগে আবার আসবে আমার সাথে দেখা করতে। তাই শুরু হলো প্রতীক্ষা।
তুমি চলে যাবার প্রায় দিন দশেক পরে একদিন বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখে জাকিকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। বাইরে না গিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। কখনো যা করিনি তাই করলাম। কী মনে করে জানি না কান পেতে রইলাম ওর উদ্দেশ্য জানতে।
বাবার গলা শুনলাম,
“আরে জাকি, কি খবর? অনেক দিন দেখি না তোমারে!”
জাকির গলা পেলাম এবার, “হ্যা চাচা, সময়ই পাই না তেমন, দ্যাহেন না কী প্যাচ মোচড় লাগে দলের মইধ্যে, এইগুলা সব আমারই সামলান লাগে। আমি একলা মানুষ কয়দিক যাই কন তো?”
“হ্যা, সেইটা বুঝছি, তা হঠাৎ কী মনে কইরা আসলা এইদিকে?”
“একটা জরুরী কাজে আসছি, চাচা। সামনের ইলেকশনে আব্বা আর দাঁড়াব না কইতেছে।”
“সে কী! তাইলে এইবার পার্টি কারে নমিনেশন দিব? আর হুট কইরা এই সিদ্ধান্তের কী কারণ?”
“আব্বা কয়, বয়স হইসে আর কত এইগুলা করব। এহন কয়দিন একটু শান্তিতে থাকতে চায়। পার্টি থেকে আমারে নমিনেশন দিবার চায়! কিন্তু আমারে তো চিনেন চাচা, এইসব ঝুট ঝামেলা আমার ভালো লাগে না। আমি নির্বিবাদী মানুষ। তাই একটা প্রস্তাব নিয়া আসছি আপনের কাছে।”
বাবা এবার যেন উৎসাহ পেল, “তা প্রস্তাবটা কি বইলা ফালাও?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে জাকিকে বলতে শুনলাম,
“আপনি এই এলাকার একজন মান্যগণ্য লোক। আব্বার পরে আপনেই ঠিক লোক এমপির জন্যে। তাই আমি পার্টি অফিসে নমিনেশন নিয়ে যেই আলোচনা হবো সেইখানে আপনের নাম প্রস্তাব করতে চাইছিলাম। আপনে রাজি হইলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতাম।”
তড়িৎ বসার ঘরে চোখ বুলালাম, সহসা যেন চকচক করে উঠল উনার চোখজোড়া! তার চোখে তখন ক্ষমতার লোভ। নিজের ভাগ্যকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না! যার চোখে সারাজীবন ভরসা দেখেছি সে চোখে লোভ দেখে ব্যথিত হলাম ভীষণ ভাবে।
সেই লোভ কষ্ট করে চাপা দিয়ে বললেন, “আমি কি আর এত যোগ্য নাকি?” হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই বলে উঠলেন,
“কিন্তু তুমি তো আমারে আগে ভাই বলতা, আজকে হটাৎ চাচা ডাকলা যে!”
কিছুটা অবাক হয়েছিলেন উনি। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম জাকির মতলব।
“কয়দিন আগে বিকেল বেলা অতসীরে দেখলাম ওই বিদেশী ফটোগ্রাফার পোলার লগে ঢলাঢলি করতে। আপনের একটা সম্মান আছে না? তাই ভাবলাম আপনেরে বলি। তাছাড়া ওর বিয়ার বয়স হয়ে গেছে, পাত্র হিসেবে আমি খুব একটা খারাপ না। তাই ভাবলাম আপনে আমার সাথে ওর বিয়ে দিলেন সাথে রাজত্বও পাইলেন। আগের দিনে রাজা মেয়ে বিয়ে দিয়ে রাখাল বালক জামাইরে রাজত্ব লেইখ্যা দিত, এই আপনে নাহয় মেয়ে বিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন জামাইয়ের কাছ থেকে রাজত্ব নিলেন!”
বাবাকে চিন্তা করার সুযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ পর আবারও মুখ খুলল জাকি, আমার দিকে পেছন ফিরে বসা বলে ওর মুখটা তখন দেখতে পাচ্ছিলাম না। নইলে মূর্তিমান শেয়াল দেখতে পেতাম তা আমি নিশ্চিত। প্রতিপক্ষ টোপ গিলতে যাচ্ছে ভেবে নিয়েই বলতে শুরু করল,
“কয়দিন আর একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকবেন? আইজ এমপি হইলে কয়দিন পরে মন্ত্রীও হইতে পারেন। কত্ত ক্ষমতা! বিনিময়ে অতসীরে খালি আমার সাথে বিয়ে দিবেন।”
আমাকে আবাক করে দিয়ে বাবা লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “আমি একটু চিন্তাভাবনা করি, তারপরে তোমারে জানাই। এইরকম সিদ্ধান্ত তো হুট করে নেয়া যায় না।”
জাকি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “চাচা তাড়াতাড়ি জানায়েন কিন্তু, মিটিংটা আর সপ্তাহ খানেক পরেই। এর মইধ্যে না জানাইলে আমার হাতে কিছু থাকব না!”
ভেবেছিলাম হয়তো জাকির সাথে ঝামেলা হবে ভেবে ভেবে দেখার কথা বললেন। যত যাই হোক বাবার কাছে সবার আগে তো আমার ভালো থাকা। বিশ্বাস ছিল তার কাছে ক্ষমতার চেয়ে নিশ্চয়ই আমিই বড় হব। কিন্তু তা যে আমার কতবড় ভুল ধারণা ছিল, তা টের পেয়েছিলাম তুমি আসার আগের দিন সন্ধ্যায়।
জাকি প্রস্তাব দেবার পাঁচ দিন পরে বাবা আর মায়ের মধ্যে কী একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। আমি বুঝতে শেখার পর কখনো তাদের নিজেদের মধ্যে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। তাই প্রচন্ড আবাক হলাম, ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে তাদের রুমের দিকে গেলাম, ঢুকতে যাবো ঠিক তখনই আমি থমকে গেলাম। মুখোমুখি হলাম এক ধ্রুব, গোপন সত্যের, যা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কোনদিন! মুহূর্তেই যেন পুরো জীবন মিথ্যে হয়ে গেল আমার!
…….