বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ২২+২৩

0
264

#বিবর্ণ_বসন্ত
২২তম_পর্ব
~মিহি

কলেজ থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়েই রান্নাঘরে ঢুকলো সুমি। সকালে তাড়াহুড়োয় না খেয়েই বেরিয়েছিল। অনামিকাকে যদিও বলেছিল বাইরে খেয়ে নিবে কিন্তু বাইরের খাবার খেতেও ইচ্ছে হয়নি আজ। চটজলদি প্লেট নিয়ে পাতিলের ঢাকনা তুলতেই দেখলো ভাতে পানি দেওয়া। দুপুর কেবল দেড়টা। এখনি ভাতে পানি দেওয়ার কী ছিল বুঝলো না সুমি। এরই মধ্যে রাহেলা বানু পানি খেতে আসলেন রান্নাঘরে। সুমিকে প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।

-‘এমন প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যে?’

-‘এখনি ভাতে পানি কেন?’

-‘আরে আজ গরম বেশি পড়েছে তো তাই অনামিকা বললো সবাই খেয়ে ভাতে পানি দিয়ে রাখতে। তুই নাকি বাইরে থেকে খেয়ে আসবি!’

সুমি সংক্ষেপে ওহ বলে কথা শেষ করলো। অতঃপর রান্নাঘরের তাকে বিস্কুটের বয়াম খুঁজতে লাগলো। বয়ামটাও খুঁজে পেল না সেখানে।

-‘ফুফু, বিস্কুটের বয়াম কই?’

-‘ঐটা তো অনামিকার ঘরে। ওর সারাদিন কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে তো তাই।’

সুমি এবার আর কিছু বললো না। প্লেটটা রান্নাঘরে রেখেই ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ক্ষুধায় ঘুমও আসছে না তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

রাহেলা বানু সুমির চলে যাওয়া দেখে হাসলেন। মনে মনে আওড়ালেন,’ভুল বোঝা বড্ড সোজা আর সেই ভুল বোঝাবুঝিটা দূর করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ!’ রাহেলা বানুর এ সামান্য হাসির অন্তরালে একটা সম্পর্কের বিভৎস হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। নিষ্ঠুর হাসিটা তার ঠোঁটে বহাল তবিয়তে থাকলো। রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে পুরনো একটা গানের সুর গুনগুন করতে লাগলেন তিনি।

সুমির ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে ভাবতেই তার অদ্ভুত লাগলো। সারাদিন না খাওয়া, পেট ব্যথায় মনে হচ্ছে নড়তেও পারবে না। সুমি উঠে লাইট জ্বালাতেই রাহেলা বানু প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সুমি অবাক হলো। এত রাতে তিনি খাবারের প্লেট হাতে এ ঘরে কেন?

-‘ফুফু, এত রাতে তুমি এখানে?’

-‘দুপুরে তো কিছু খাইলি না। সেই কখন ঘুমাইলি, ভাবলাম ক্লান্ত তাই আর ডাকিনি। এখন খেয়ে নে।’

সুমির চোখ ছলছল করতে থাকে। মাকে হারানোর পর থেকে মনে একটা শুন্যতা বিরাজ করছিল। আজ অনেকদিন পর সেই মায়ের স্নেহটার পরশ পাচ্ছে যেন সে। পরক্ষণেই মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে আসে। সারাটা দিন কেটে গেল, অনামিকা একটাবার তার খোঁজ নিল না? এতটাই বুঝি পর সে? হাতমুখ ধুয়ে চটজলদি খেতে বসলো সে।

______________________

-‘সোহরাব সুমি কি উঠেছে?’

-‘তুমি এখনো ঘুমাওনি অনামিকা! এমনিতেই পেটব্যথায় তুমি অস্থির আবার ঘুমোচ্ছোও না!’

-‘ঘুম আসছে না। দেখে আসেন তো সুমি উঠলো কিনা, না খেয়ে ঘুমিয়েছে ও।’

-‘চিন্তা করো না। ফুফু আছে ওর কাছে। তোমার যে সকাল থেকে পেটব্যথা একবার বলছো আমাকে? ডাক্তার দেখাতে হতো। কালকেই চেকআপ করাতে যাবো আমরা।’

-‘আরে কিছু হয়নি আমার, অযথা চিন্তা করছেন আপনি।’

-‘চুপ! যা বলছি তাই, ঘুমোও এখন।’

অনামিকা চোখ বন্ধ করলো। পেট ব্যথা ধীরে ধীরে কমছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল অনামিকা। সে জানলোও না কেউ একজন তাকে নিয়ে কতটা ভুল ধারণা মনে নিয়ে ক্ষোভ পুষছে! যাদের সবাই ভুল বোঝে তারা কী এক মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে তা এখনো অনামিকা জানেনা তবে জানবে বোধহয় অতি শীঘ্রই।

সোহরাব অফিস থেকে হাফ ডে’র ছুটি নিয়েছে অনামিকাকে চেকআপ করানোর জন্য কিন্তু হঠাৎ একটা মিটিং পড়ে যাওয়াতে সে যেতে পারছে না হাসপাতালে। এদিকে অন্তরা বেগম একা অনামিকাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারবেন কিনা ভয় হচ্ছে সোহরাবের। তিনি নিজেও অসুস্থ মানুষ। শেষমেশ সোহরাব সুমিকে বললো অনামিকাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। সুমি কিছু বলার সুযোগ পেল না। আজ তার ইমাদ ও আফ্রিনের সাথে দেখা করার কথা ছিল। সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সোহরাব একবার তাকে জিজ্ঞাসাও করলো না সে যেতে ইচ্ছুক কিনা। সুমির যাওয়ার কথা শুনে যেই না অনামিকা রাজি হলো, অমনি সে সুমিকে বললো সাথে যেতে। সুমির ইচ্ছের দাম নেই? কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমির মাথায়। অনামিকার চোখমুখে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। অনামিকা ভেবেছে সুমি তার সাথে গেলে দুজনে একসাথে সময় কাটাবে। ভাবনাগুলোই বোধহয় আমাদের সাথে সবচেয়ে বড় প্রতারণাটা করে!

হাসপাতালে যথেষ্ট ভীড়। একজন কমবয়সী ডাক্তার সদ্য পাশ করে এই হাসপাতালে ইন্টার্নি করছেন। তার কেবিনেই যথেষ্ট ভীড় দেখা যাচ্ছে তবে তিনি মেডিসিন স্পেশালিস্ট। অনামিকা আর সুমি বসে আছে গাইনোকলজিস্টের কেবিনের সামনে। আচমকা সেই যুবক ডাক্তার নিজ কেবিন ছেড়ে বেরোতেই সুমির সাথে তার চোখাচোখি হয়। সুমি বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললেও ডাক্তারটির দৃষ্টি বহুক্ষণ সুমির উপর থেকে সরে না। শেষমেশ যখন অনামিকা সুমিকে নিয়ে গাইনোকলজিস্টের কেবিনে ঢুকলো, তখন ছেলেটির দৃষ্টি সরলো। স্মিত হেসে চুলে হাত বুলিয়ে আবারো কেবিনে ঢুকলো সে। কী উদ্দেশ্যে সে কেবিন থেকে বেরিয়েছিল তাও তার মনে নেই। শুধু মনে সুমির ছবিটাই গেঁথে থাকলো। ‘ডাক্তার অনীল?’ রোগীর ডাকে ঘোর কাটলো অনীলের। ততক্ষণে সে ঠিক করে ফেলেছে গাইনোকলজিস্ট ম্যামের থেকে সুমির ডিটেইলস বের করার উপায়।

________________________

-‘ডাক্তার কী বলেছেন?’

-‘সব ঠিক আছে সোহরাব। আপনি অযথা চিন্তা করবেন না।’

-‘সময়ই দিতে পারছি না তোমাকে।’

-‘অফিসে আরেকটা বিয়ে করে রেখে এসেছেন যে।’

-‘এরকম মনে হয় আমাকে?’

-‘হতেই পারেন।’

সোহরাব রাগ করে পাশ ফিরলো। অনামিকা তা দেখে মৃদু হাসলো। সোহরাব ইদানিং বাচ্চাদের মতো রাগ করতে শিখেছে। মাঝেমধ্যে তো ঠোঁট ফুলিয়েও বসে থাকে। আবার কখনো কখনো অনামিকার কোলে মাথা রেখে আজগুবি সব গল্পের আসর বসায় বাচ্চার সাথে।

-‘এই যে বসন্তের আব্বু, শুনছেন?বসন্ত কিন্তু বাবার মতো রাগ করবে কথা না শুনলে।’

-‘ঐ এক বুদ্ধি পেয়েছো। আজ ওর জন্য তোমায় ছেড়ে দিলাম যাও। আমার বাচ্চাটা আমাকে বোঝে তাও। তুমি তো ছাই বোঝো!’

-‘তাই নাকি? আমি রাগ করবো এখন যাও।’

অনামিকা রাগ করার কথা বললেও সোহরাবের তাকানোতে আর রাগ করতে পারলো না। সোহরাবের দৃষ্টিতে ইদানিং অদ্ভুত একটা মায়া লক্ষ করেছে অনামিকা। এ মায়ার সাগরে বারবার ডুবতে ইচ্ছে করে অনামিকার।

__________________________

রাতে সুমির মন খারাপটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ইমাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাও অনেকটা বেড়ে গেল। ইদানিং ইমাদের সাথে কথা না হলে তার পাগলামি ভাব হয়না তবে ইমাদের কথাবার্তা তাকে কিছুটা হলেও ভালো রাখে। এটা ভেবেই সুমি ইমাদের নম্বর ডায়াল করলো। নম্বর ওয়েটিং দেখে সুমি কল কেটে দিল। কল কেটে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করলো। পড়াশোনায় এখন ভালোই মনোযোগ বসেছে তার। একবার পড়তে নিলে টানা দুই-তিন ঘণ্টা পড়তেও ক্লান্তি আসে না। পড়তে পড়তে দেড় ঘণ্টা কখন পেরিয়েছে সত্যিই বুঝলো না সুমি। দেড় ঘণ্টা পর ফোন হাতে নিয়ে আবারো ইমাদের নম্বরে কল দিলো। আবারো ওয়েটিং! খানিকটা অবাক হলো সুমি। এতক্ষণ ধরে কার সাথে কথা বলছে? কল কাটার আগেই ইমাদ রিসিভ করেছে।

-‘কী সমস্যা তোমার? দেখছো তো ওয়েটিং, বারবার কল দিচ্ছো কেন?’

-‘এমনিতেই।’

-‘আমি তোমার কেনা গোলাম না! আমাকে টাকা দিয়ে কিনে রাখো নাই যে যখন ইচ্ছে তখন কল দিবা। তোমার সাথে বন্ধুর মতো বিহেভ করি মানে এই না যে তোমার সাথে প্রেম করতেছি। আমার অলরেডি প্রেমিকা আছে। তোমার ভাইয়ের অনুরোধে অনেক ভালো ব্যবহার করছি, আর নিতে পারতেছি না তোমারে। রেহাই দাও আমায় প্লিজ।’

কথাটুকু বলেই কলটা কেটে দিল ইমাদ। সুমি একবারও বলতে পারলো না সে মাত্র দুবার কল দিয়েছিল শুধু একটু কথা বলার জন্য। ইমাদের প্রেমিকা আছে জেনেও কষ্ট হচ্ছে না সুমির। কষ্ট হচ্ছে ইমাদ তাকে অযথা এতগুলো কথা শোনালো তার জন্য। বিগত কয়েক মাসে ইমাদ নিজেই সুমিকে সময় দিয়েছে, সুমি জোর করেনি অথচ আজ সব দোষটাই তার? নিয়তির পরিহাস মাঝেমধ্যে অবোধগম্য!

চলবে…

#বিবর্ণ_বসন্ত
২৩তম_পর্ব
~মিহি

‘সুমির বিয়েটা দিয়ে দিতে আপনার কী সমস্যা সোহরাব?’ খানিকটা উচ্চস্বরেই বললো অনামিকা। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে তখনি কেডল দরজার কাছে এসেছে সুমি। ভাবীর উচ্চস্বরে বলা কথাটুকু তার কানে এলো। নিঃশব্দে প্রস্থান করলো সে। এতটাই বোঝা হতে শুরু করেছে সে পরিবারে? ইমাদের পাগলামি নাহয় কমেছে তার কিন্তু একটু সময় তো দরকার নিজেকে সামলাতে। অনামিকা সব জেনেবুঝে কিভাবে পারলো এমন করতে? সুমির রাগ হচ্ছে না, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। মায়ের অভাবটা খুব করে অনুভব করছে সে। মানসিক যন্ত্রণাগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একবার ডাক্তার আফ্রিনের সাথে কথা বললে ভালো হতো। সুমি এখনো জানেনা আফ্রিন ইমাদের বোন নয়। আফ্রিনের নম্বর তার কাছে নেই। নিতে হলে ইমাদের শরণাপন্ন হতে হবে। সুমির এখন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সপ্তাহ দুয়েক আগে ইমাদের বলা কথাগুলোর পর সুমি আর যোগাযোগ করেনি তার সাথে কিন্তু এখন মনটা আবার বিক্ষিপ্ত হচ্ছে দিনকে দিন। আফ্রিনের সাথে কথা না বলা অবধি এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ক্লান্ত শ্রান্ত সুমি জানালার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আনমনে বিড়বিড় করে,’এতটাই বুঝি বোঝা হয়ে পড়েছিলাম? যে ভাবীকে সবসময় সম্মান, শ্রদ্ধা করে বড়বোনের আসনে বসিয়েছি, সেই ভাবীই আমাকে সহ্য করতে পারে না। নিয়তি নিষ্ঠুর-নির্মম হয় জানতাম তাই বলে এতটা? আমার আগের পাপগুলোর শাস্তি বুঝি সুদসমেত এখন ফেরত পাচ্ছি? হতেও পারে। চারিদিকে ঝড় যখন একসাথে উঠেছে তখন বোধহয় পাপেরই ফল এটা।’

____________________

সোহরাব চুপ করে আছে। অনামিকাও বেশ অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ। সুমির জন্য একটা ডাক্তারের সম্বন্ধ এসেছে। অনামিকা চাচ্ছে বিয়েটা ঠিক করতে, সুমি একটা ভালো পরিবারে যাবে এটাই তার ইচ্ছা। সোহরাব ইমাদের কথা বলতে পারছে না। অনামিকা সুমির মতামত নিতে চাচ্ছে কিন্তু সোহরাব জানে সুমি রাজি হবে না। এতে যদি সুমির আবার মন খারাপ হয় এ ভয়ে সোহরাব তাকে অনামিকার সাথে কথা বলাতেই চায় না। অনামিকার খানিকটা রাগ লাগছে। সুমির বিয়ে তো সে একা দিয়ে দিচ্ছে না, সে শুধু সুমির মতামত জানতে চায়। সোহরাব বড় ভাই হিসেবে মতামত দিতেই পারে তবে সুমির মতামতটাই তো মুখ্য।

-‘সোহরাব, ছেলেটা ডাক্তার এটা বড় কথা নয়। কিন্তু ও প্রথম দেখাতেই সুমিকে পছন্দ করে ফেলেছে, অনেক পাগলামি করে ঠিকানা জোগাড় করেছে। আমাদের কি একবার উচিত না বিষয়টা নিয়ে ভাবা?’

-‘ঘুমোও অনামিকা। কাল কথা বলবো এসব নিয়ে।’

-‘আপনার সময় কখন আসলে? আমাকে সময় দেওয়ার সময়টুকুও তো নেই! অফিসে থাকলেই পারেন, আপনার নতুন কলিগ তো ভালোই খেয়াল রাখে।’

-‘কার কথা বলছো?’

-‘তানি।’

-‘ওহ!’

-‘এখনি ব্লক করেন। কলিগ মানে যা তা পোস্টে মেনশন দেওয়ার অধিকার আছে নাকি? আমি সিওর এই মেয়ে আপনাকে লাইন মারার চক্করে আছে।’

-‘কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাও তুমি!’

-‘অনীলের পরিবারকে সামনের শুক্রবার আসতে বলি? আপনি ওদের সাথে কথা বলে নিয়েন। আমি সুমির সাথে কথা বলে দেখবো।’

-‘ধ্যাত! অনামিকা সবসময় বেশি বোঝো কেন? সুমির বিয়ে দেওয়ার জন্য মরে যাচ্ছো? ধৈর্য ধরো একটু। সবে মাকে হারিয়েছি। সুমি কি অত সহজে মানবে? ও তো চায় এই বাড়িটাতে থেকে একটা কিছু করতে। ওর ইচ্ছের দাম নাই?’

অনামিকা চুপ হয়ে গেল। সুমির ভালো করতে গিয়ে আসলে সে সুমির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। আসলেই তো সুমির সাথে কথা না বলেই এত তাড়াহুড়ো করা উচিত না কিন্তু সোহরাব সুমির সাথে কথা বলতে চাইছে না কেন? সোহরাব কি কিছু লুকোচ্ছে অনামিকার থেকে? সোহরাব বোধহয় অনামিকার সন্দেহ ধরতে পারলো।

-‘আমি কাল সুমির সাথে কথা বলবো। তুমি এর আগে কিছু বোলো না কাউকে।’

-‘বেশ।’

অনামিকার সংকোচ খানিকটা দূর হয়। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সে। অন্যদিকে সোহরাবও ঠিক করে সুমির সাথে কথা বলতে হবে। ইমাদের সাথে সুমির সম্পর্কের গভীরতা এখন জানাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ঘুম আসেনা তার চোখে।

________________________

আজ শুক্রবার। সুমি নয়টার দিকে ইমাদের নম্বরে কল দেয় আফ্রিনের সাথে কথা বলার জন্য। ইমাদ সুমির নম্বর দেখে বিরক্ত হয়। সে এসেছে তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে অথচ সেখানেও এই মেয়েটা কল করে বিরক্ত করছে। ইমাদ ঠিক করলো আজ কড়া কিছু কথা শোনাতেই হবে। ইমাদের প্রেমিকাও জানে সুমির কথা। সে জানে সুমি ইমাদকে বিরক্ত করে সবসময়। ইমাদ ফোন রিসিভ করে সুমিকে কিছু বলার সুযোগই দিল না,’তোমার মধ্যে ন্যূনতম লজ্জা নাই? আরে ভাই তুমি তো সুস্থ হইছো, আর কত? আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমারে পড়াইতে যাওয়া। আমার প্রেমিকা আছে জানার পরও ছ্যাঁচড়ার মতো পেছনে পড়ে আছো কেন? শরম লেহাজ কি এক ফোঁটাও নাই?’

সুমির চোখ বেয়ে গড়ালো নোনা জল। এই মানুষটাই কি তার অসুস্থ সময়ে জীবনের মানে বুঝিয়েছিল? এত রঙ কেন মানুষের? এর চেয়ে তো আল্লাহ সাদা কালো মানুষ বানালেই পারতো! সুমির গলায় কথা আটকে আসে। সাহস করে শব্দগুলো বের করতে পারে না সে। এরই মধ্যে আরেকটা রুক্ষ মেয়েলি গলার কর্কশ কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে,’এই মেয়ে! আর কত নিচে নামবে হ্যাঁ? কেন কল দিছো ইমাদরে?’

-‘আফ..আফ্রিন মানে ওনার বড় আপুর নম্বরটা লা..লাগ…’

-‘ঢঙ করো আমার সাথে? বাহানা খোঁজো না? ওর কোনো বড় আপুই নাই! মিথ্যেবাদী কোথাকার! কল রাখ থার্ড ক্লাস একটা।’

সুমি কল কেটে দিল। চোখের কোণা এখনো সিক্ত। একটা মানুষ কতটা বহুরূপী হতে পারে আজ জানা হলো সুমির। স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে সুমি কোনোদিন ভালোবাসার দাবি নিয়ে ইমাদের সামনে দাঁড়ায়নি, বন্ধু হিসেবে থাকতে চেয়েছিল। প্রতিদানস্বরূপ আজ ভালো বাক্যই শুনতে পেল। সুমির মাথা চিনচিন করছে। আফ্রিন যদি ইমাদের বোন না হয় তবে কে? এখানেও মিথ্যে? এই মিথ্যের শুরুটা কোথায়? সুমি ঠিক করলো ডাক্তার আফ্রিনের সাথে চেম্বারে গিয়ে দেখা করে আসবে। একবার গল্পে গল্পে চেম্বারের ঠিকানা জেনেছিল সে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই সোহরাবের মুখোমুখি হয় সুমি। সোহরাবের মুখ গম্ভীর। এ গম্ভীর মুখে কতখানি রহস্য লুকিয়ে আছে তা সুমির ব্যতিব্যস্ত মাথায় ঢোকে না। সে ম্লান দৃষ্টিতে কেবল ভাইয়ের কথার অপেক্ষা করতে থাকে।

-‘কিছু বলবে ভাইয়া?’

-‘হ্যাঁ বলতাম আর কী…’

সোহরাবের সংকোচ অনুধাবন করে সুমির গতরাতের ঘটনা মনে পড়ে। অনামিকা সুমির বিয়ে দেওয়ার জন্য সোহরাবের সাথে চেঁচামেচি করছিল। বোধহয় সে কারণেই সোহরাব কথা বলতে এসেছে।

-‘সুমি, আমি ভাবছিলাম তোর বিয়ে নিয়ে। তোর পছন্দটা বল তুই। তোর পছন্দের মানুষের সাথেই….’

-‘ইমাদকে আমি পছন্দ করিনা ভাইয়া আর। তোমরা যার সাথে বিয়ে ঠিক করবে আমি তাকেই বিয়ে করবো কিন্তু এখন না। ভাবীর শরীর ভালো নেই এখন, ফুফুও অসুস্থ। সবকিছু আগের মতো ঠিক হোক, তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভেবো।’

-‘একটা ছেলে তোকে পছন্দ করেছে। তুই কি দেখা করবি একবার?’

-‘তোমার অনুমতি থাকলে আমার আপত্তি নেই।’

খানিকটা নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বললো সুমি। জীবন নিয়ে তার আর কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। মানুষ বলে, জীবনে অতৃপ্তি থাকলেই নাকি বেঁচে থাকার ইচ্ছে বহাল থাকে কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি যে মানুষের বাঁচার ইচ্ছে তিলে তিলে শেষ করে দেয় সে কথা মানুষ কেন বলে না? সুমির মাথায় প্রশ্নরা ঘুরপাক খেতে থাকে। ডাক্তার আফ্রিনের সাথে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে।

চলবে…

[গল্প শেষের পথে, আপনারা আপনাদের মতামত জানাবেন অবশ্যই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here