বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ২১

0
278

#বিবর্ণ_বসন্ত
২১তম_পর্ব
~মিহি

মাস তিনেকের ব্যবধানে অনামিকার জীবনটা একরকম বদলে গেল। এক নিস্তব্ধ নিশুতি রাতে সাজিয়া শেখ পা বাড়ালেন পরপারের উদ্দেশ্যে। সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ করেই মারা গেলেন। অনামিকা ভেঙে পড়লো। যে মানুষটা তার বাচ্চাকে কোলে করে খেলানোর অজস্র স্বপ্ন বুনে ফেলেছিলেন, সে মানুষটা বাচ্চাটার মুখটুকুও দেখতে পারলেন না। এ নিয়তির কেমন পরিহাস? সোহরাব ভেঙে পড়লেও অনামিকার জন্য নিজেকে শক্ত করলো। একা হাতে সবটা সামলালো সুমি। পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দেয়! যে সুমিকে সামলাতে এতদিন কাঠখড় পুড়িয়েছেন সাজিয়া, আজ সেই সুমিই সবাইকে সামলাচ্ছে। অন্তরা বেগম নিজের বাড়ি ছেড়ে এখন অনামিকার কাছে থাকেন। অনামিকার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। শরীর আগের চেয়েও দুর্বল। সাজিয়ার মৃত্যুর পর থেকে অনামিকার খাওয়া দাওয়া একরকম বন্ধের দিকে গেছে। সুমি জোর করেই অনামিকাকে খাওয়ায়, অন্তরা সবসময় তার পাশে থাকেন। সবার সান্নিধ্য পেলেও সোহরাবকে অনামিকা খুব অল্প সময়ের জন্য পায়। সোহরাবের প্রমোশন হয়েছে। কাজের চাপে তার বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক সময় অনামিকা ঘুমিয়ে পড়ে। সোহরাব নিজের উপর বিরক্ত হয় বারবার। অনামিকার জন্য একটু সময় বের করতে তার সর্বক্ষণ প্রচেষ্টা। সাজিয়ার মৃত্যুর রেশ এখনো কারো মন থেকেই সরেনি তবে রাহেলা বানু এখন আর এ বাড়িতে আসেন না আগের মতো। বলতে গেলে তার সংসারেই তিনি মন বসিয়েছেন। জগৎ তো থেমে থাকার নয়। প্রকৃতি নিজের নিয়মে চলছে, শুন্যতার মাঝে অনামিকাও মানিয়ে নিচ্ছে। সুমি পড়াশোনায় মন বসিয়েছে, সংসারের কাজেও অন্তরা বেগম ও অনামিকাকে সবসময় সাহায্য করে। সুমির এ পরিবর্তন আফ্রিনকে ছাড়া হতো না। ইমাদের সাথে এখনো সুমির কথা হয়, বলতে গেলে দিনে একবার হলেও কথা হয়। জীবনটা হঠাৎ বদলে যাওয়া বোধহয় একেই বলে।

কলেজ শেষ করে মাত্র বেরিয়েছে তন্বী। একজন মহিলা হঠাৎই পথ আটকালো তার। তন্বী মহিলাটিকে চিনতে পারলো না। পানের কারণে ঠোঁট অনেকটাই লাল হয়ে আছে মহিলার। তন্বী কিছু বুঝে উঠলো না। মহিলাটি মুখ খুললেন।

-‘তুমিই তারান্নুম জাহান?’

-‘জ্বী। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’

-‘সালাম কালাম শেখায় না মা-বাপ?’

-‘আসসালামু আলাইকুম।’

-‘ওয়ালাইকুম সালাম। তো পড়াশোনা কেমন করতেছো?

-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

-‘তা চেহারা-সুরত তো মাশআল্লাহ খারাপ না। প্রেম পিরিতি করে ধরা খাইছো নাকি?’

-‘জ্বী? কী সব বলছেন? চেনা নাই, জানা নাই, আমার নামে যা তা বলে বেড়াচ্ছেন?’

-‘আজব তো। তোমার মা-ই তো দুই বাচ্চার বাপের সাথে বিয়ে ঠিক করছে। তা দেখলাম তুমি মাইয়া সুন্দর তাই জিগাইলাম।’

-‘আমার বিয়ে? আপনাকে কে বলেছে?’

-‘আমিই তো ঘটকালি করছি।’

-‘আপনি? আপনাকে ঘটকালি করতে কে বলছে?’

-‘তোমার মা-ই বলছিল।’

-‘ওহ। বিয়েটা ভেঙে দিন, বলুন মেয়ে রাজি না।’

-‘তোমার কথায় তো হবেনা। কমিশন পাইছি আমি, বিয়ে ভাঙবো ক্যান?’

তন্বীর ইচ্ছে করলো মহিলাটির চুল টেনে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে। আজকাল তার মনটা বড্ড বিদ্রোহ করতে চায়। সব গড়পড়তা ছাপিয়ে পাখনা মেলার জন্য অন্তর্পুরে প্রতিনিয়ত বিদ্রোহের রণসংগীত বাজে।
তন্বী একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এ সিদ্ধান্তের জন্য ভবিষ্যতে পস্তাতে হলেও সে পিছপা হবে না। ভয়ঙ্কর সে সিদ্ধান্ত তন্বীকে প্রলোভন দেখালো এক মুক্ত জীবনের।

সন্ধ্যে হওয়া হওয়া ভাব। তন্বীর উপর বেশ চটে আছেন রাহেলা বানু। তন্বীর কলেজ ছুটি হয় সাড়ে বারোটায় অথচ সন্ধ্যে ছ’টা বাজে তন্বীর আসার নাম নেই। রাহেলা বানু ঝাড়ু হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আজ মেজাজটা অতিমাত্রায় বিগড়েছে তার। এমন প্রলয়ঙ্করী রূপ দেখলে তন্বী নিশ্চিত ঐ ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তটা নিত না। প্রলয়ঙ্করী রূপেই রাহেলা বানু দেখলেন এক অনাকাঙিক্ষত দৃশ্য। তন্বী বধূসাজে নাদিমের হাত ধরে বাড়ির ফটকে পা রেখেছে। তৎক্ষণাৎ রাহেলা বানুর বুকে কিঞ্চিত ব্যথা অনুভব হলো। ক্ষণিকের ব্যথা তুচ্ছ করে গর্জন করে উঠলো রাহেলা বানুর কণ্ঠস্বর।

-‘তুই বউসাজে কেন তন্বী? বিয়ে করেছিস তুই?’

তন্বী জবাব দিতে পারলো না অথচ সমস্ত সাহস সে এই মুহূর্তটার জন্য জমিয়ে রেখেছিল। তন্বীর কথা আটকে আসছে। নাদিম অবশ্য ঘোর থেকেই বেরোতে পারেনি। তন্বী হঠাৎ এসে যখন বললো হয় তাকে বিয়ে করতে হবে নাহলে চিরতরে হারাতে হবে তখন আসলে ভাবার কিছু ছিল না তার। তন্বীর থেকে দূরে থাকাটা তা পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিয়ে করার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। নাদিমের পরিবারে কেউ নেই, এতিম বলেই তার প্রতি রাহেলা বানুর এত ঘৃণা-বিদ্বেষ। নাদিমের এক বন্ধুর মারফতে সে একটা পার্ট টাইম চাকরি পায় এবং এখানে বাসা ভাড়া নেয় কয়েক বছর আগে। এখন অবশ্য ইনকামটা অনেকটাই বেড়েছে তবুও বংশটাও এ সমাজে একটা ফ্যাক্ট। রাহেলা বানুর থেকে ভয়ঙ্কর কিছু বাক্য প্রত্যাশিত ছিল তার কিন্তু তা হলো না। রাহেলা বানু শান্তস্বরে বললেন,’বের হয়ে যাও এখান থেকে।’ নাদিম ভেবেছিল তন্বী বোধহয় কিছু বলবে। কিন্তু তন্বী নিরুত্তরভাবে চলে গেল। নাদিম বিস্মিত চোখে মা মেয়ের দূরত্ব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর সেও তন্বীর পিছে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল।

-‘এতটা নির্জীব কবে হলে তন্বী? তোমার মা একা মানুষ, তাকে বোঝাতে পারতাম।’

-‘নির্জীব এতকাল ছিলাম নাদিম, এখন একটু বাঁচতে দাও। মায়ের জেদের কাছে আর কতবার বলি হবো বলতে পারো?’

-‘তার জন্য ওনাকে একা ছাড়া কি উচিত হবে?’

-‘পাশেই তো আছি, একা ছাড়লাম কই? ওনার জেদ কমানোর দরকার আছে।’

তন্বী যাওয়ার পর রাহেলা বানু দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে রইলেন। মনে ঠিক কী চলছে ঠাওর করতে পারলেন না। ক্রোধ নাকি ক্ষোভ কিংবা একাকীত্ব কোনো একটার রাজত্ব তো চলছে মনে। আশেপাশে কেবল অন্ধকার, এ ঘোর তমসায় এক মানবী মেঝেতে বসে নিজের একাকীত্বের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। এর কারণ কি সে নিজেই নয়? কর্মফল শব্দটা বোধহয় এসব মানুষদের জন্যই উদ্ভাবিত। রাহেলা বানুর ক্রোধ তার চোখজোড়ায় অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো। এ ক্রোধের আগুনে কেউ একজন তো জ্বলতে চলেছিল, হোক সে নিষ্পাপ।

________________________________

রাহেলা বানু অসুস্থ হওয়ার খবর সোহরাবের কাছে পৌঁছেছে আগে, তারপর সে জেনেছে তন্বীর বিয়ের খবর। এর প্রেক্ষাপট জানার অবকাশ পায়নি সে। অনেকটা মানবিকতার খাতিরেই রাহেলা বানুকে নিজের বাড়িতে এনেছে। তন্বীর নামটুকুও তিনি শুনতে ইচ্ছুক নন এ মুহূর্তে। এ বাড়িতে যথেষ্ট মানুষজন আছে ভেবেই সোহরাব এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনামিকা অবশ্য এখন মোটামুটি ভালো আছে। সংসারের দায়িত্বগুলো সে নিজের কাঁধে নিয়েছে। সুমি আছে সাহায্য করার জন্য। তাছাড়া অন্তরা বেগম অনামিকাকে কোনো কাজই একা করতে দেন না, সব কাজে তিনি অনামিকার আশেপাশে থেকে তাকে সাহায্য করেন। বলতে গেলে সংসারটা স্বাভাবিকতার দিকে যাচ্ছে। রাহেলা বানুর অসুস্থতার সময়টাতে তন্বী চেয়েও পাশে থাকতে পারেনি তবে অনামিকার কাছ থেকে ক্ষণে ক্ষণে সে খবর রেখেছে। অনামিকা তন্বীকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তন্বী তার মায়ের কাছে ফিরতে রাজি নয়। মায়ের কাছে ফেরার অর্থ নাদিমকে ছেড়ে আসা কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে কী করে তা ভেঙে ফেলবে? নাদিমও তার জীবনে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের চেয়ে বেশি না হলেও নাদিমকে তন্বী ভালোবাসে। রাহেলা বানু একসময় সব বুঝে মেনে নিবেন এই ভরসায় তন্বী নিজের জীবনে এতবড় ঝুঁকিটা নিয়েছে। তখনো সে রাহেলা বানুর সবটা সত্যি জানতে পারেনি। আরো একটা ভয়ঙ্কর সত্য তখনো লুকিয়ে ছিল রাহেলা বানুর মনে যা তিনি কাউকে জানতেও দেননি, বুঝতেও দেননি। এ সত্যটা জানলে বোধহয় তন্বী নির্দ্বিধায় নাদিমের হাত ধরে বাকিটা পথ চলতে পারতো। রাহেলা বানু আদৌ তা হতে দিবেন? হয়তোবা তা এ অসুস্থতার প্রহর শেষে তার পূর্বরূপ কিংবা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করলে বোঝা যাবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here