#বিবর্ণ_বসন্ত
১৯তম_পর্ব
~মিহি
-‘খারাপ সংবাদটা তবে বলি সোহরাব সাহেব?’
-‘জ্বী।’
-‘আপনার স্ত্রী এখন আর আপনার স্ত্রী থাকছেন না, তিনি অতিসত্বর আপনার বাচ্চার মা হতে চলেছেন।’
সোহরাবের নিঃশ্বাস আটকে আসলো। এটা দুঃসংবাদ? একবার ইচ্ছে করলো ডাক্তারের নাক বরাবর একটা ঘুষি হাঁকাতে। ডাক্তার সাহেব বোধহয় সোহরাবের মনের কথাটা ধরতে পেরে মুচকি হাসলেন।
-‘ওর শরীর নিয়ে কমপ্লিকেশন আছে। খায়না কেন মেয়েটা? প্রেশারও লো। শরীরের যত্ন নিতে বলবেন। আসছি আমি।’
-‘দুঃসংবাদের মিষ্টি তো খেয়ে যান।’
ডাক্তার হাসলেন। তন্বী মিষ্টি এনে দিল। সোহরাবের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। অনামিকা এত বড় একটা কথা তাকে জানায়নি এখনো? খানিকটা অভিমান, অনেকটা বিষণ্ণতায় আনন্দের মুহূর্তটা যেন চাপা পড়লো সোহরাবের। অন্যদিকে সাজিয়ার উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙা। রাহেলা কেবল দেখে যাচ্ছে। পরিস্থিতি হঠাৎ একেবারে বদলে গেছে।
অনামিকার জ্ঞান ফিরেছে। সাজিয়া তার পাশেই বসে, অন্তরাকে খবর দেওয়া হয়েছে। অনামিকার চোখজোড়া সোহরাবকে খুঁজছে। অনুসন্ধিৎসু চোখজোড়া অবশেষে সোহরাবকে পেল দরজার সাথে হেলান দেওয়া অবস্থায়। অনামিকা আন্দাজ করতে পারছে না আসলে কী হয়েছে। মুখে তার প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঘোরাফেরা করছে।
-‘কী হয়েছে মা?’
-‘তুই বুঝিসনি কী হয়েছে? এত বড় কথা লুকালি?’
কপট রাগ দেখালো সাজিয়া। অনামিকা আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কী এমন লুকিয়েছে সে?
-‘কী লুকিয়েছি মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
-‘সোহরাব, তোমার বিবিজান এখনো অজ্ঞ। তুমিই তাকে খবরটা দাও।’
কথাটা বলেই সাজিয়া এবং তন্বী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সোহরাব দরজাটা হালকা ভেজিয়ে অনামিকার পাশে বসলো।
-‘কী হয়েছে সোহরাব?’
-‘আমি বাবা হচ্ছি।’
অনামিকা এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। শরীরে অন্যরকম একটা অনুভূতি তড়িতের ন্যায় কাজ করলো। সোহরাবের মুখে হাসি নেই কেন?সোহরাব কি খুশি না?
-‘আপনি খুশি নন?’
-‘এত বড় একটা সিদ্ধান্ত একা নিলে? আমি তো কখনো তোমার পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাধা হতে চাইনি। অনেক সময় ছিল আমাদের কাছে। তোমার কত স্বপ্ন ছিল!’
-‘সোহরাব! একটা বছর গ্যাপ দিলে সব শেষ হয়ে যাবে না। সংসার সামলে কি পড়াশোনা করা যায় না? আপনি পাশে থাকলে আমি পারবো সব।’
সোহরাব অনামিকার হাতজোড়া নিজের হাতে নিল। সোহরাবের চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি! আসলে সে বুঝেই উঠতে পারছে না কিভাবে ব্যক্ত করবে। আলতো করে অনামিকার হাতে চুমু খায় সে।
-‘একটা হিসেব করেছি বিবিজান।’
-‘কী হিসেব?’
-‘আমাদের বাচ্চাটা খুব সম্ভবত বসন্তকালে পৃথিবীর মুখ দেখবে। বসন্তের কোকিলের মধুর কণ্ঠে তার আগমন হবে, প্রকৃতিও নবাগত কিশলয় বরণ করবে, আমরা বরণ করবো আমাদের বসন্তকে।’
-‘বসন্ত নাম রাখবে?’
-‘হুম। ছেলে হোক কিংবা মেয়ে, সে হবে আমাদের বসন্ত।’
অনামিকার চোখ জুড়ে ঔজ্জ্বল্যের ভীড়। নতুন এক পথচলা শুরু হতে চলেছে তার। সোহরাবের খুশিগুলো যেন তার চোখই বলে দিচ্ছে।
-‘আপনি খুশি সোহরাব?’
-‘আমার খুশি আমি দেখাতে পারছি না অনামিকা। এতটা খুশি যে তোমায় কী করে বোঝাবো বুঝতে পারছি না।’
সোহরাবের হঠাৎ কী হলো কে জানে। অনামিকাকে কোলে তুলে নিল সোহরাব। অনামিকা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সোহরাব অনামিকাকে কোলে নিয়েই ঘোরালো। অনামিকা সোহরাবের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
রাহেলা বানুর মাথা রাগে ফেটে যাচ্ছে। তন্বীর বিয়ে ভেঙে এখন অনামিকা নিজের জীবনের সুখ উপভোগ করছে। তা তো হতে দেবে না রাহেলা। বলতে বলতেই রাহেলার ফোনে কল আসলো। আননোন নম্বর থেকে কল। রাহেলা বানু কী ভেবে যেন রিসিভ করলো।
-‘হ্যালো ফুফু, মা কই? ফোন ধরছে না যে? বাড়িতে যাবো কখন? আমি কি একা চলে যাবো?’
রাহেলা চুপ হয়ে গেলেন। দাবার গুঁটিটা তবে হাতে এসেছে। রাহেলা বানু হাসলেন। ভয়ঙ্কর এক খেলা চলছে তার মাথায়।
-‘তোর মায়ের কী আর তোর জন্য সময় আছে? যে-ই অনামিকা এসেছে, সেই থেকে তো অনু অনু করছে। তুই বরং একাই চলে যা বাড়িতে। চাবি আছে তো?’
সুমি গম্ভীরমুখে হ্যাঁ বলে ফোন রেখে দিল। রাহেলা বানুর ঠোঁটে কুৎসিত হাসি ফুটে উঠলো। সংসারে ভেজাল লাগানোর মধ্যে তিনি অদ্ভুত একটা তৃপ্তি খুঁজে পান। এ তৃপ্তির পৈশাচিকতায় রাহেলা বানুর আত্মা অবধি কলুষিত হয়ে উঠেছে। একটা হাসিখুশি পরিবারে বিবাদ জন্ম দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করতে যে মানুষের বিবেকে বাধা দেয় না, তাকে আর মানুষের কাতারে ফেলা যায় না। মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্ব লাগে কিন্তু রাহেলা বানু তো পৈশাচিক তৃপ্তির সম্মুখে মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়েছে।
____________________
অনামিকাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকে সোহরাবের চিন্তা বেড়ে গেছে। সুমির বিষয়টা অনামিকা একবার আন্দাজ করতে পারলেই মেয়েটা টেনশনে পড়ে যাবে। এমনিতেই টেনশন করতে করতেই শরীরের এ অবস্থা করে ফেলেছে, এখন বাড়তি টেনশন দিয়ে অনামিকাকে আরো অসুস্থ করে ফেলার ইচ্ছে নেই সোহরাবের। সোহরাব চাচ্ছে অনামিকাকে যত দ্রুত সম্ভব অন্তরা বেগমের কাছে পাঠিয়ে দিতে। সুমি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। সুমির আচার আচরণ অনেক সময়ই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। তাছাড়া সোহরাব আজ দেখেছে অনামিকা আসাতে সুমি তেমন খুশি না। এর পেছনের কারণটা হয়তো সুমির অসুস্থতা তবে অনামিকাকে নিয়ে সোহরাব কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। এখন তো তাদের জীবনে বসন্ত আসতে চলেছে। তার জন্য হলেও অনামিকাকে ভালো রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে সোহরাব।
-‘কী ভাবছেন এত?’
-‘অনামিকা, প্রথম বাচ্চা তো সচরাচর মায়ের বাড়িতে হয়। তুমি কি…’
-‘এইতো এলাম, এখনি তাড়াতে চাইছেন সোহরাব?’
-‘আরে না…’
সোহরাব কিছু বলার আগেই সুমি চিৎকার করতে শুরু করে। অনামিকা অবাক হয়। সুমি আগে কখনো এভাবে চেঁচামেচি করেনি। সে বরাবরই শান্ত স্বভাবের ছিল। মেয়েটার কোনো বিপদ হলো না তো? সোহরাব বুঝতে পারছে নিশ্চিত সুমির কোনো বিষয়ে রাগ উঠেছে যার কারণে সে এরকম করছে। সোহরাব অনামিকাকে ঘর ছেড়ে বেরোতে দিল না, নিজেই সুমির ঘরের দিকে এগোলো। সুমির ঘরে আগে থেকেই সাজিয়া শেখ দাঁড়িয়ে আছেন। সুমি ইতিমধ্যে একটা প্লেট ভেঙে ফেলেছে, এখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
-‘সুমি, কী হয়েছে?’
-‘আমি সেমাই খেতে চেয়েছি, মা বানাচ্ছে না ভাইয়া! আমার ইচ্ছের কোনো দাম নাই?’
-‘মায়ের শরীরটা কি খুব ভালো আছে, সুমি? এই অবেলায় সেমাই খেতে হবে তোর? আমি বানিয়ে দিচ্ছি দাঁড়া।’
-‘না, তোমার হাতের সেমাই খাবো না। ভাবী সেমাই অনেক ভালো বানায়, ভাবীকে বলো।’
-‘তোর ভাবী অসুস্থ, ও এখন রান্নাঘরে যেতে পারবে না।’
সোহরাবের কথা শেষ হওয়া মাত্র সুমি ড্রেসিং টেবিলে থাকা সব জিনিস এদিক সেদিক ছুঁড়ে ফেলল। সোহরাব খানিকটা রেগেই সুমির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। এত হৈচৈ শুনে অনামিকাও ঘরে বসে থাকতে পারলো না। সোহরাবের নিষেধ সত্ত্বেও সে সুমির ঘরে ঢুকলো।
-‘কী হয়েছে সুমি? ঘরের এ অবস্থা কেন?’
-‘ভাবী, আমি তোমার হাতে সেমাই খেতে চেয়েছি বলে ভাইয়া মেরেছে।’
-‘সোহরাব! আচ্ছা সুমি, তুমি একটু বসো। আমি এক্ষুনি বানিয়ে অনছি।’
অনামিকা রান্নাঘরের দিকে এগোতে নিলে সোহরাব আটকায় তাকে।
-‘তোমার মাথা ঠিক আছে অনামিকা? এই শরীর নিয়ে তোমার রান্নাঘরে যেতে হবে না।’
-‘তুমি চুপ করে বসো তো, কিচ্ছু হবেনা আমার।’
সোহরাব এবার বিরক্ত হলো। অনামিকার নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখার বোধবুদ্ধিটা কবে হবে? সোহরাবও অনামিকার সাথেই রান্নাঘরে ঢুকলো। অনামিকাকে রান্না করতে দিল না সে। চুপচাপ টুলে বসিয়ে নিজেই সবটা রান্না করলো। অনামিকা বারবার নিষেধ করলেও সোহরাব শুনলো না। সুমির অবস্থা অনামিকার চেয়ে সোহরাব ভালো জানে তাই সোহরাব এটাও বোঝে সুমিকে কিভাবে সামলানো যায়। সেমাই রান্না শেষ করে সোহরাব বাটিটা অনামিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’এখন যাও দিয়ে আসো।’ অনামিকা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সুমি তো তার হাতের সেমাই খেতে চেয়েছিল, সোহরাব রান্না করেছে বুঝতে পারলে সুমি নিশ্চয়ই চেঁচামেচি করবে। চেঁচামেচির নাম নিতে নিতেই চেঁচামেচি শুরু হলো। সুমির ঘর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছে। সোহরাব বাটিটা রান্নাঘরে রেখেই সুমির ঘরের দিকে ছুটলো।
চলবে…
[দুঃখিত দুঃখিত দুঃখিত! কোনোরকম বাহানা দিব না, রবিবার থেকে ইনশাআল্লাহ নিয়মিত গল্প পাবেন।]