বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১৬+১৭

0
231

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
ষোড়শ পর্ব


অতসীর বাড়িতে গিয়ে মনে হচ্ছিল এটা কোনো শ্মশান যেন! কী গুমট পরিবেশ! একেবারে দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছিল! আবিদের আশঙ্কার পালে জোর হাওয়া লাগছিল ক্রমশ! আশেপাশে তাকাতেই দেখল এক মহিলা বারান্দার মেঝেতে বসে দেয়ালে গা এলিয়ে ঠেস দিয়ে আছেন। চোখ দুটো বড্ড অনুভূতিহীন, তবে অবিকল অতসীর চোখের মতো চোখ দুটি! এটাই তবে অতসীর মা, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল আবিদ।

“অতসী কোথায়? সব এমন এলোমেলো লাগছে কেন?”

অতসীর মা একেবারে নির্বিকার বসে রইলেন, আবিদের মনে হলো উনি বুঝি শুনতে পাননি, দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতেই তাকালেন ওর দিকে, আস্তে আস্তে অনুভূতি ফুটল মরা চাহনিতে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বললেন,

“তুমি আবিদ? এত দেরী করলে কেন আসতে? এলেই যদি আরও আগে এলে না কেন? আমার মেয়েটা…”

এটুকু বলতেই চোখ থেকে টুপটাপ জলের ধারা নামল গাল বেয়ে। বুকের ধুকপুকানি অনবরত বেড়েই চলছে ওর, কী এক আশঙ্কার মেঘ দানা বাঁধছিল জোরেশোরে!
ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
“কী হয়েছে ওর? সরাসরি বলুন না?”

নির্বিকার মুখে অদ্ভুত এক হাসি দেখল আবিদ, কিন্তু সে হাসি চোখে ফুটল না। কারও হাসিও যে ভেতরটা ছিড়েখুঁড়ে দিতে পারে তা সেদিনের আগে ওর জানাই ছিল না।

“নেই। আমার মেয়েটা আর কোথাও নেই। ওই যে উপরে বিশাল আকাশ, তার ওপারে আছে ও।”

নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর, মনে হচ্ছিল অসম্ভব বাজে কোনো দুঃস্বপ্ন এটা। ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এ যে নিরেট বাস্তবতা। যা এড়ানোর সাধ্য ওর নেই। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতেই। বুকের ভেতর থেকে নিংড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কষ্টেরা। হাত পা কাঁপছে থিরথির করে!
শব্দেরা বেরোতে চাইছে না, অনেক লড়াইয়ের পরে অবশেষে শব্দেরা ঠিকানা পেল,

“এ অসম্ভব! কোনোভাবেই সম্ভব না। ও কেন চলে যাবে, কীভাবে যাবে? আমায় কথা দিয়েছিল ও। ও যেতে পারে না। আপনি মিথ্যে বলছেন! আমি বিশ্বাস করি না!”

হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে অদ্ভুত একরোখা স্বরে কথাগুলো বলল ও। বাচ্চাদের হাতে ক্ষতিকর কোনো জিনিস চলে এলে তা সরিয়ে নিলে বাচ্চারা যেভাবে গোঁ ধরে বসে থাকে, ঠিক সেই স্বরেই কথাগুলো বলেছে ও। কিন্তু অতসীর মা কোনো ছেলে ভুলানো রূপকথা শোনাচ্ছেন না, শোনাচ্ছেন তার বুকে আগলে রাখা রাজকন্যার করুণ পরিনতির উপাখ্যান!

“তুমি সেদিন ওকে কেন ফিরিয়েছিলে? যদি না ফেরাতে হয়তো আমার মেয়েটা বেঁচে থাকত, সুখে ঘরকন্না করত!”

কথাগুলো আবিদের হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছিল। অতসীর মা ভেতরে চলে গেলেন কিছু না বলেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরলেন, হাতে ডায়েরির মতোই কিছু একটা। আবিদকে উঠে ভেতরে আসতে বললেন। আবিদ যন্ত্রের মতো অনুসরণ করল শুধু। বসার ঘরে বসতেই পানি এগিয়ে দিলেন। আবিদ ঢকঢক করে এক চুমুকেই তা শেষ করতেই ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিলেন।
“এটা পড়ো।”

কাঁপাকাঁপা হাতে সেটা নিয়ে পাতা উল্টাতেই অতসীর হাতের লেখা দেখল, এরপর দ্রুত পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হতেই মনের মধ্যে তুফান বইছিল আর চোখ বেয়ে বারি ধারা! এতটুকু মেয়েটা এতটা সয়েছে, আর ও তখন ওর পাশে থাকতে পারে নি৷ এই কঠিন পৃথিবীর সমস্ত কাঠিন্যের সাথে একা লড়াই করেছিল মেয়েটা! ও তখন ভীনদেশে নিজের স্বপ্ন সাজানোয় মুখর ছিল! ও যখন ঠোঁটে জীবনের জয়গান গাইছিল, অতসীর ঠোঁটে তখন কেবলই মৃত্যু সংগীত! নিজের উপরেই কেন যেন ধিক্কার জন্মাল। বাকিটা শুনতে চাইলেই বলতে শুরু করলেন অতসীর মা।


সেদিন রাতে অতসী জাকির সেই পাতালপুরী থেকে পালিয়ে প্রথম এসেছিল মায়ের কাছেই। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল কারণ সে-সময় ওর বাবা বাসায় ছিলেন না। ওর পালানোর খবর জানতে জানতে ও এখান থেকে পালাতে পারবে। নিজের জন্য মাকে বিপদে ফেলতে চায় না। আর ওকে এতদিন পরে এভাবে দেখে মায়ের বুক অজানা আশঙ্কায় ধ্বক করে উঠেছিল।

বিয়ের পর থেকেই নানা ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু কোনোভাবেই সফল হননি। সমঝোতার সংসারে প্রথম থেকেই দুজন দুই মেরুর মানুষ, অতসীর বিয়ের পর থেকে স্বামীর সাথে দূরত্ব প্রায় অলঙ্ঘ্য। অতসীকে দেখে আঁকড়ে ধরেছিলেন শক্ত করে। এই মেয়েটাই যে তার সবেধন নীলমনি!

কিন্তু মেয়ের পরের কথাগুলো শুনেই ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা, মেয়ে জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে!

“মা, আজকের পরে কী হবে আমি জানি না। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই।”

আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখা একটা ডায়েরি আর কিছু কাগজ বের করে এগিয়ে দিল।

“এগুলো রাখো, খুব গোপনীয় এগুলো। কেউ যেন না জানে, কাকপক্ষীও যেন না জানে। আবিদের কথা তোমাকে বলেছিলাম। আবিদ আজ হোক কাল হোক বেঁচে থাকলে আসবেই। এগুলো ওকে দিও। এখানে জাকির কিছু খারাপ কাজের ডকুমেন্টস আছে। কাজে লাগবে। এসব অনেক বড় প্রমাণ। আমি জান লাগিয়ে জোগাড় করেছি। আমার জন্য দোয়া করো। আর হয়তো দেখা হবে না।”

মা কিছুতেই ওকে একা ছাড়তে রাজি হয় না।
“আমিও যাব তোর সাথে। তোকে একা একা কোত্থাও যেতে দেব না।” দৃঢ় গলায় মা বললেন।

অতসী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, জাকির মতো নরপিশাচের সাথে তুমি আমি পারব না। তোমাকে ছাড়া আমার আশেপাশে যারা আছে কাউকে বিশ্বাস করি না। তাই এসব তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। এগুলো সুরক্ষিত রেখে আবিদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে। ওকেও আমি আমার নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি। তুমি আর আমি দুজন একসাথে মরে যাওয়া কোনো কাজের কথা না। ওই শয়তানটার শাস্তির জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে, মা। আমি আসি। আবারও বলছি, আজ আমি এখানে এসেছিলাম একথা ঘুনাক্ষরেও যেন কেউ না জানতে পারে। এক্ষুনি লুকিয়ে ফেলো এসব। দোয়া করবে আমার জন্য। আসি, আবেগের বশে ভুল করে ফেলো না।”

শেষ বারের মত মাকে আলিঙ্গন করে বেরিয়ে পরল অতসী। মাকে এসব না বললে কিছুতেই ওকে একা ছাড়তে রাজি হতো না। মেয়ে যে তাকে মিছে একটা বেঁচে থাকার বাহানা দিয়ে গেছে এটা অনেক পরে বুঝেছিলেন। এই কিছুদিনেই তার ছোট্ট অতসীটা কত্ত বড় হয়ে গেছে, কত্ত সমঝদার হয়েছে। গর্ব হলো মেয়ের জন্য।

সেই রাতে অতসী গেল স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে, প্রথমে ওরা অভিযোগ নিতে রাজি হলো, পাচারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া মেয়েদের উদ্ধারের আশ্বাসও দিল। কিন্তু জাকির নাম বলার পর থেকেই শুরু হলো নানারকম টালবাহানা।

থানায় ঝুলানো ঘড়ি জানান দিচ্ছিল রাত তখন নয়টা ঊনপঞ্চাশ। প্রায় আধাঘন্টা ওকে বসিয়ে রেখেছে, তখনই বুঝেছে গড়বড় আছে বড়সড়। জাকিকে এখানে আসতে দেখে বুঝে নিল যা বোঝার। আরও আগেই বুঝেছিল এরকমই হবে হয়তো। তবু সাধ্যানুযায়ী চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি ও। বিবেকের দংশন নিয়ে তো আর বাঁচতে হবে না। কিন্তু এখন আর ভয় করছে না কেন যেন। বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে যাবার মতো মেয়ে নয় ও। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়তে চায় ও। অন্তত একটা আঁচড় হলেও বসাতে চায়। সেটা যে ভাবেই হোক।

জাকি প্রায় টেনেহিঁচড়ে আবারও পাতালপুরীতে নিয়ে যায় ওকে। পুলিশকে জানিয়েছিল জাকির অপকর্মের বিবরণ, এসব কিছুই ওর জন্য হুমকিস্বরূপ। জাকি জেনে গিয়েছিল অতসী বেঁচে থাকলে যেকোনো সময় ওর আসল রূপ সামনে আসবে আর বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু তার আগে জানা দরকার আর কাকে বলেছে এসব ও। আর কেউ জানলে তাকেও সরিয়ে দিতে হবে। স্বাক্ষী রাখা ওর ধাতে নেই। কিন্তু অতসী মুখ খুলছে না। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েও কুলুপ এঁটে রইল। অজ্ঞান হবার পর সাঙ্গপাঙ্গ সমেত অতসীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে কিছু না পেয়ে ফিরে এলো।

ততক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে অতসীর, জাকি আবারও চড়াও হতে এলেই বিপত্তির শুরু। জাকি ভেবে পেল না এই পিস্তল ওর কাছে কিভাবে এলো। তবুও হালকা ভাবেই নিল, ভাবল চালাতে পারবে না।

অতসীর হুঁশিয়ারি সত্বেও সামনে এগুতেই গরম বুলেট বিদ্ধ করল ওর বুকের কিছুটা নিচে, একেবারে হৃৎপিণ্ড বরাবর চালিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য ওর হাতের টিপ খুব একটা ভালো নয়। মরার আগে এই কীটকেও সাথে নিতে চেয়েছিল, তাই দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতেই অপরপাশ থেকে আসা বুলেট বিদ্ধ করল ওর কপাল বরাবর। বুকে হাত চেপে অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে জাকি। জাকির প্রথম বউয়ের জোগাড় করে দেয়া স্টিলেটাটা খুব একটা কাজে এলো না। এক প্রাণোচ্ছল, উদ্ভাসিত মেয়ের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল এভাবেই!

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে ওদের হাসপাতালে নিয়ে গেল, অতসীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হলো। আর জাকিকে নেওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে।
জাকি কিছুদিনেই সেরে উঠে জবানবন্দি দিল, কোনো এক ছেলের সাথে ওর ঢলাঢলি চলছিল, ওই ছেলের সাথে নাকি পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে।

পালাতে বাধা দেবার জন্যই নাকি অতসী ওকে গুলি করেছিল, পরে আত্মরক্ষার্থে ও গুলি করেছে, হাতের টিপ নাকি ওর খুব খারাপ তাই হাতে মারতে চেয়েও কপালে লাগে। খারাপ এইম নিয়েও কেউ কপালের মাঝ বরাবর গুলি চালাতে পারে ওর এই বয়ান ছোট বাচ্চারাও হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু পুলিশ তা বিশ্বাস করল। ওই এলাকায় ওরাই ক্ষমতা! টাকা আর ক্ষমতায় রাতকে দিন আর দিনকে হয়তো সত্যিই রাত করা যায়!

অতসীর লাশ দেখে একটুও কাঁদলেন না মা, নিথর হয়ে চেয়ে রইলেন শূন্য দৃষ্টিতে। আশ্চর্যজনকভাবে কেঁদে বুক ভাসাল অতসীর বাবা৷ হাজার হলেও স্নেহের ছায়া দিয়ে বড় করেছেন, মায়াটা সত্যিই ভেতর থেকেই এসেছে। ভেবেছিলেন মেয়েটা বিয়ে দিলে যদি এতবড় ক্ষমতা পাওয়া যায় তো মন্দ কী! মেয়ে তো আর খারাপ থাকবে না। প্রেম টেম তো থাকেই লোকের। বিয়ের পরে তো ঠিকই সংসার করে তারা সব ভুলে।

কিন্তু তার ওই লোভ যে মেয়ের জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দেবে এক ফুৎকারে এটা তিনি ঘুণাক্ষরেও চাননি। সেই থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করেন তিনি। চিকিৎসা করিয়েও খুব বেশি লাভ হয়নি। দিনদিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে অবস্থা। জাকি এখনও বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে। এখন আরও ভয়ানক ও। এই এলাকায় সর্বময় ক্ষমতা ওর এখন, জবাবদিহিতার বালাই নেই!


পুরো ঘটনা শোনার পরে বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেল আবিদের। দুচোখে জলের ধারা নামছে অবিরাম। ওর অতসীর প্রতি হওয়া নির্মমতা কোনোভাবেই মানতে পারছে না ও।
মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এই বলে, ফুলের মতো কোমল, নিষ্পাপ মেয়ের নির্মম পরিনতির জন্য যারা দায়ী, তাদের কাউকে ছাড়বে না ও! সবাই শাস্তি পাবে!

এক বসন্ত ওকে দিয়েছিল দুহাত ভরে, তার পরের অন্য এক বসন্ত ওর সবকিছু নিংড়ে ওকে নিঃস্ব করে দিয়েছে চিরতরে। চলেই যদি যাবে তবে কেন এই মায়া, ভালোবাসা আর বন্ধনে জড়ানো! বুকের ভেতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে যেন!
…….

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
সপ্তদশ পর্ব

বাইশ.
শুনতে শুনতে অন্বেষার বুকটাও ভারী হয়ে এলো, হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল ভারিক্কি চালে অভ্যস্ত আজন্ম কঠিন লোকটার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে চাপা যন্ত্রণার আর্তনাদ, অশ্রু যেন বড্ড বেপরোয়া আজ, আবিদের কথাই যেন শুনছে না! অন্বেষার মনে হচ্ছিল আবিদের কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদা উচিত, নয়তো বুকে আসন গেড়ে বসা কষ্টের জগদ্দল পাথরটা কিছুতেই নড়বে না!

পুরুষের কাঁদতে নেই, আবেগের প্রকাশ করতে নেই এসব বুলি অন্বেষার কাছে ভীষণ অর্থহীন আর অন্তঃসারশূন্য মনে হয়। ওরা তো মানুষই, নাকি কষ্টেরাও নারীতে পুরুষে ভেদাভেদ করতে জানে? কষ্ট সবারই হয়, মাঝে মাঝে এতটাই সীমানা অতিক্রম করে যায় যে তা পুরো হৃদয় দখল করে শিকড় গেড়ে বসে যায়। তখন সে ব্যথা উগড়ে ফেলতে হয় শিকড়সমেত। এরজন্য খুলে দিতে হয় হৃদয়ের সমস্ত আগল। তাতেই না দুঃখ, ব্যথারা হৃদয়ের ফাঁক গলে কান্না হয়ে বেরিয়ে যাবার অবকাশ পায়। নয়তো তা বুক চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে মারে, সে হোক পুরুষ কিংবা নারী। তাই সেই পাথরচাপা কষ্টগুলো কান্নায় ঝেড়ে ফেলতে হয়। কান্না সবসময় দুর্বলতার প্রকাশ হয় না, এটা গা ঝাড়া দিয়ে নতুন করে উঠে দাঁড়াতে প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে।

আবিদকে দূর থেকে দেখে অন্বেষার মনে হয়েছিল ভীষণ নাক উঁচু, আত্মম্ভরি এক লোক। কিন্তু কাছে আসতেই ওর এই ধারণা ভেঙে যায়, আজকের পর তো কর্পূরের মতো উবে গেল! কী আশ্চর্য! দূরত্ব ছোট হতেই মানুষটা একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল, নাকি ওর দেখার চোখ বদলে গেল!

আবিদ বহুদিন পরে মনের রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়েছিল, বুঁদ হয়ে গিয়েছিল সেই বিবর্ণ অতীতে। সামনে স্বল্পপরিচিত একজন বসে আছে এটাই ভুলে বসে ছিল। আচমকা তা খেয়াল হতেই নিজেকে আবারও খোলসে মুড়িয়ে ফেলল। কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল যেন! নিজের আবেগ অনুভূতি আড়ালে রাখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন। অন্যের সামনে বহুদিন নিজেকে মেলে ধরা হয়নি ওর। নিজেকে দ্রুতই ধাতস্থ করে বলল,

“এই ছিল অতসী আর আমার গল্প।”
“এরপর কী হলো?”
“এর আর কোনো পর নেই…..”
শেষ না করতেই অন্বেষার গলায় শ্লেষ, “মানে কী? অতসীর শেষ অনুরোধ, জাকির পরিনতি…… ”

আবিদ ম্লান হেসে বলল, “জাকির পরিণতি যা হবার ছিল তাই হয়েছে, আমি দেশে ফেরার ঠিক সাত মাসের মাথায় ওর লাশ পাওয়া যায়, ও মারা যাওয়ায় ওর প্রভাব আর থাকে না। বাকিটা পুলিশই করে, নতুন যে ক্ষমতায় আসে সে দক্ষ হাতেই সব সামলেছিল। ওর সব খারাপ কাজের বয়ান উপরমহল বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল। সবাইকে উদ্ধার করা হয়, তারপর ভাগ্য বিড়ম্বিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।” এবার উত্তর পেল আবিদের ‘উইমেন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’কে ডোনেশন দেবার কারণ। আরেকটা প্রশ্ন মনে খচখচ করতেই করে বসল,
“কিন্তু জাকি কীভাবে খুন হয়েছিল?”

“জাকির মত লোকের শত্রুর অভাব হয় নাকি, ক্ষমতা নিয়ে অন্য গ্রুপের সাথে কামড়াকামড়িতে হয়তো শেষ হয়েছে!”

আবিদের চোখের দৃষ্টি যেন কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এই কথা বলার সময়, নাকি অন্বেষার দেখার ভুল! তবে আর কথা বাড়ায় না ও।

আবিদ আবারও মুখ খুলে, “জাকির খুন কিছু পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজেই ছিল কিছুদিন, তোমার মনে থাকার কথা নয়।”

আবিদ নিজের হাতে ওই মানুষরূপী অমানুষকে ওর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছিল একথা সযত্নে এড়িয়ে গেল, যেমনটা এড়িয়েছিল সেই সময়। কিছু কথা না বলাই থাকুক না হয়!
“ফটোগ্রাফি ছাড়লেন কেন? আপনার ড্রীম প্রফেশন ছিল ওটা?”

“মন আর টানেনি, যার জন্য ভীনদেশে গিয়ে অতসীকে হারিয়েছি, সেটা করার জন্য আর মন থেকে সাড়া পাইনি! তাই ওটা বাতিলের তালিকায় ফেলে দিয়েছি সেই কবেই।”

“আপনি থাকলেই যে অতসীর সাথে এসব হতো না, তা তো আপনি বলতে পারেন না। তাছাড়া আপনি থাকলে হয়তো দুজনেই শেষ হয়ে যেতেন!”

“ওর খারাপ সময়ে ওর হাতটা তো ধরে রাখতে পারতাম, অভয় দিতে পারতাম কিছুটা হলেও। তাছাড়া এখনো যে বেঁচে আছি সেটাই বা কে বলল? এটাকে বেঁচে থাকা বলে কিনা আমার জানা নেই!”

আবিদের বিষণ্ন সুর অন্বেষাকে স্পর্শ করে ভীষণভাবে!
মুহূর্ত কয়েক নীরব থেকে প্রশ্ন করে,
“অতসীর আর আপনার পরিবারের লোকজন কোথায়? যতদূর জানি এই বাসায় আপনি একাই থাকেন!”

“একা কোথায়? সোহান থাকে, আরও দু’একজন তো থাকেই।”

“আমি আপনার নিজের লোকের কথা জানতে চাইলাম।”

“অতসীর বাবা এখন চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন, অবস্থার খুব একটা উন্নতি নেই। অতসীকে খোঁজেন বেশিরভাগ সময়। এখন তো অনেক বয়সও হয়ে গেছে। বেচারা, লোভ সব শেষ করে দিল!” দীর্ঘশ্বাস বেরোল একটা।

অন্বেষার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আবিদ বলল, “ওর মা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে।”

“আর আপনার পরিবার?”

“ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। বাবা ওর সাথেই থাকেন, নিজের সন্তানকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে কোন বাবা-মা চায় বলোতো? প্রাণপণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে ছোট ছেলের সঙ্গী হয়েছেন। নাতি নাতনিকে নিয়ে খুব ভালো আছেন, আমার জন্য প্রচন্ড রাগ জমে আছে। আর মা, সে-তো ছেলেকে সংসারী করার স্বপ্ন নিয়ে ব্যর্থ মনোরথে পারি জমাল ওপারেই!”

আবিদের চোখ চিকচিক করছে আবার, আজ আমি ঝরবই, এরকম একটা পণ নিয়ে নেমেছে যেন জলধারা!

অন্বেষার এবার সহানুভূতির চাইতে রাগটাই বেশি হলো, কী ভাবে নিজেকে এই লোক! নিগূঢ়তম কষ্ট অনেকেরই থাকে, তাই বলে তা আঁকড়ে কি কখনো বাঁচা যায়, না বাঁচা উচিত? নিজের কষ্টে আশেপাশের মানুষকে কেন কষ্ট দিচ্ছে এই লোক?

তীব্র ঝাঝের সাথে অন্বেষা বলল, “আপনি কখনো আপনার কাছের মানুষদের কথায় গুরুত্ব দেন না কেন? অতসীর কথা আপনি ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আপনার পরিবারের লোকেরা আপনার জন্য কষ্টে আছেন। অতসীও আপনাকে সামনে এগুতে বলেছিল, আর আপনি…”

সহসা থেমে গেল অন্বেষা, রাগের মাথায় বড্ড বেশিই অনধিকার চর্চা করে ফেলেছে ও। সাথে এলেবেলে ধরনের বেফাঁস কথাও বলে ফেলেছে। অন্বেষার কেবলই মনে হচ্ছিল বলে ফেলা কথা ফেরত আনার জন্য কোনো সিস্টেম থাকা উচিত ছিল, তাহলে অন্তত আজ বেঁচে যেত!

অন্বেষার কথাগুলো আবিদের হৃদয়কে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল, ওকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সবকিছুর জন্য আবিদই দায়ী। ওর মনে গেড়ে বসা ধারণা আরও পোক্ত হলো। অতসীর তীব্র আকুতি ভরা কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠল চোখে, কেন সেদিন ওর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারল না?

ভেসে উঠল ওর মায়ের অনবরত চাওয়া, “বাবা, এবার নিজের দিকে একটু ধ্যানটা ফেরা। তোকে এভাবে দেখে আমার কতটা অশান্তি হয় তা কি বুঝতে পারিস? অতসীর কথাটাও ভাব, ও তো তোকে সামনে এগুতেই বলেছিল। তবে কিসের জন্যে থমকে আছিস? তোর একটা গতি না দেখে গেলে মরেও শান্তি পাব না রে!”

প্রতিনিয়ত এই কথাগুলোই বলতেন উনি। ছেলের জন্য দোয়া করতেন প্রতি নামাজে। শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন সব মায়া কাটিয়ে।

অন্বেষার কথায় মনে হতে থাকল এই জন্যও তো ও নিজেই দায়ী। আশেপাশের কেউ ভালো নেই, কাউকে ভালো রাখতে পারেনি ও। মিথ্যে ওর এই জন্ম, মিথ্যে এই বেঁচে থাকা! কী ভীষণ ব্যার্থ এক মানুষ ও, পরাজিতও কী নয়?

আচমকা উঠে চলে গেল ভেতরে, অন্বেষা কিছু বলার সুযোগ পেল না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব, কেন যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ভুলভাল বলে আবিদকে কতটা যন্ত্রণায় ফেলেছে এখন তা হাড়েহাড়ে টের পেল। অনধিকার চর্চা তো করেছেই, সাথে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। এসবে আবিদের হাত তো কোথাও নেই, পুরোটা দোষ ভাগ্যের। অপরাধবোধের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া একজনের উপর আরও ভার চাপিয়ে দিয়েছে ও, নিজের অজান্তেই!

বাসায় ফিরতে ফিরতে অন্বেষার মনে খচখচানিটা বাড়ছিল অনবরত। তীব্র অনুশোচনা কাঁটার মতো বিঁধে থাকল হৃদয়ে, মননে। অস্বস্তি ঘিরে থাকল পুরোটা সময়।

প্রগাঢ় এক মায়া অনুভব করল আবিদের প্রতি, মনে হলো যে করেই হোক এই লোকের কষ্ট কিছুটা হলেও যদি কমানো যায়! সাত সমুদ্র ভালোবাসা জমিয়ে রাখা যায় বুঝি, এত লম্বা সময় ধরে! চিনচিনে ব্যথা বাজতে থাকল অনবরত পুরোটা হৃদয় জুড়ে!

অন্বেষার মনে হলো, কিছুকিছু মানুষ ভালোবাসার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, আবিদ সেই দলেরই একজন। আবিদের মতো কিছু লোক এখনো আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো এত সুন্দর, পঁচে গলে যায়নি সব! নয়তো কবেই চলে যেত আশফাকের মতো কাপুরষ কিংবা জাকির মতো অমানুষের দখলে!
…….
বাকিটা পরের পর্বে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here