বিবর্ণ বসন্ত পর্ব ১১+১২

0
233

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
একাদশ পর্ব

ডায়েরীর পাতা থেকে——
বাড়ি থেকে পালিয়ে অনেকদূরের এক শহরে অচেনা কিছু লোকের উপস্থিতিতে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেললাম শুধু মায়া আর অন্ধ আবেগের টানে। সহস্র বিষ কাঁটা যেন হৃদপিণ্ডে অনবরত খুঁচিয়ে মারছিল। ধুমধাম সানাইয়ের সুর বাজল না, হাজার লোকের উপস্থিতি ছিল না, বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয় পরিজনের দোয়া আশীর্বাদের হাত মাথায় পডল না! কোনো এলাহি আয়োজন নেই, বাড়ি থেকে অচেনা সুদূরে অচেনা লোকের স্বাক্ষীতে শুরু করলাম আমার নতুন জীবন। ওর অবশ্য সেসবের চিন্তা নেই, তিনকূলে কেউ ছিল না ওর। একমাত্র সম্বল ওর বাবার রেখে যাওয়া বসতভিটা বিক্রির কিছু টাকায় মোটামুটি স্বল্প ভাড়ার বাসায় শুরু হল দুজনের ভালোবাসার সংসার। ভালোবাসার কোনো কমতি অবশ্য তখনও হয়নি। আমার মনে অনেকদিন থেকে জমা হওয়া একটা প্রশ্ন ওকে করেই ফেললাম বিয়ের পর,

“আমি তো দেখতে একদমই সুন্দর নই। কী এমন দেখেছিলে আমার মধ্যে?”

ও মুচকি হেসে বলেছিল, “গায়ের রঙই কি সব? তোমার সুন্দর চোখ দুটোতে যে সাত সমুদ্র মায়া জমে আছে তা কি জানো? সেই মায়া এড়ানোর সাধ্য আমার ছিল না যে!”

আমার সেই সাত সমুদ্র জমানো চোখ থেকে টুপটাপ জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল, আনন্দের জল! এতো সুন্দর করে কেউ কখনো আমাকে বলেনি। হঠাৎ করে জীবনটা ভীষণ সুন্দর মনে হলো!

জমানো টাকা ফুরিয়ে গেল তিন মাসেই, আমার নিয়ে আসা গয়না থেকে কিছু বিক্রি করে চলতে লাগলো সংসার। দিন যেতে লাগল আর আমি খেয়াল করলাম কোনো কাজের চেষ্টা ওর মধ্যে নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হলাম মনে মনে। সব টাকা ফুরিয়ে গেলে কী করব তা নিয়ে ভাবনায় পরে গেলাম। ওকে বলতেই ও হেসে বলল,

“আরে, এত চিন্তা করছো কেন? দেখবে সব ঠিকঠাকই হবে।”

কিন্তু কীভাবে হবে, মাথায় কিছুই আসছে না। অথচ তখন প্রায় সাত মাসের সংসার আমাদের। সম্বল শেষ প্রায়! মফস্বলের মেয়ে আমি, শহরের অলিগলি কিছুই ভালোমতো চিনি না। তবুও কাজের খোঁজ করলাম। বাড়িওয়ালার সহায়তায় দুটো বাচ্চাকে পড়ানো শুরু করলাম।

অন্তত শেষ সম্বল টুকুর আয়ু আর একটু যেন দীর্ঘায়িত হয় সেই চেষ্টা। আমার অনবরত কথায় অতিষ্ঠ হয়েই কিনা জানি না, ও বের হয় কাজের সন্ধানে। কিছুদিনের চেষ্টায় একটা কাজ জুটিয়েও ফেলে। খুব বড় কিছু না হলেও দুজনের আয়ে ভালোই চলবে। বুকে চেপে বসা পাথর নেমে গেল যেন! ভাবলাম, যাক! এবার হয়তো সব ভালোই হবে। কিন্তু স্বস্তি সরে গিয়ে চিন্তা আসতে বেশি সময় নিল না, যখন দেখলাম দুমাস না যেতেই কাজটা ছেড়ে দিল ও। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল,

“ছেড়েছি, ভালোই করেছি। এসব কাজ কেউ করে নাকি! সকাল থেকে সন্ধ্যা গাধার খাটুনি। ওতে আমার পোষাবে না।”

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। ততদিনে জমানো যা ছিল সব শেষ। দুটো টিউশনি দিয়ে কোনভাবেই সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে খুঁজে পেতে আরেকটা টিউশনি জোগাড় করলাম। ওর সরলতা মাখা অত্যন্ত সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে জোড় গলায় কিছু বলতেও পারতাম না। হাজার হোক, ভালোবাসার তো কমতি ছিল না।

এভাবেই ভালো আর মন্দে একবছর কেটে গেল আমাদের ভালোবাসার সংসারের। এদিকে আমি হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করি, ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। ডাক্তার দেখানোর পর জানায় নতুন একজন আসতে চলেছে আমাদের সংসারে।

একই সাথে খুবই খুশি হলাম, আরেক দিকে ভীষণ দুঃশ্চিন্তা মাথায় আসন গেড়ে বসল। ওপাশের লোকটা অবশ্য ভীষণ খুশি হলো। অনেকরকম ছেলেমানুষী করতে লাগলো। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে এই লোকের ভালোবাসার ক্ষমতা অপরিসীম। কিন্তু দ্বায়িত্ব নিতে না জানলে শুধু ভালোবাসা কোনো কাজে আসে না। এই লোকটাকে তা বোঝাতেই পারছিলাম না।

দিন চলতে লাগলো তার মতো করেই। আরও কয়েক মাস পরে শারীরিক নানারকম সমস্যা দেখা দিতেই বাধ্য হয়ে টিউশনি গুলো ছাড়তে হলো। সেইসাথে রোজগারের একমাত্র দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। বাসা ভাড়া বাকী পরল। বাধ্য হয়ে ওকে তাড়া লাগালাম কিছু একটা বন্দোবস্ত করতেই হবে। ঝগড়া, মন কষাকষি শুরু হলো। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের সন্ধানে নামলো সে। একমাস অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ছাপোষা একটা চাকরি জোগাড় করল। আমি তাতেই খুশি হলাম। আমার জন্য ওর মধ্যে দ্বায়িত্ব বোধের জাগরণ ঘটেনি, অনাগত অংশের জন্য নিশ্চয়ই তা ঘটবে। এই ভেবেই আস্বস্ত হলাম।

সেসময় বাড়ির সবাইকে খুব মনে পড়ত। আগে শুনতাম প্রথম সন্তান জন্মের সময় মেয়েদের বাপের বাড়ি থাকাটা একটা অলিখিত নিয়ম। আমার বেলায় সেসব কিছু হলো না। কীভাবে হবে? সব পথ তো আমি নিজের হাতেই বন্ধ করে এসেছি। মাঝেমাঝেই ভীষণ ভেঙে পড়তাম, মনকে প্রবোধ দিতে পারতাম না কোনোভাবেই। তখন সে পাশে থেকে আমাকে সামলে নিতো। নিজেকে সেসময় খুব সুখী মনে হতো। ভাবতে লাগলাম, খুব বেশি ভুল হয়তো করিনি।

দেখতে দেখতে ফুটফুটে এক পরী যেন এলো আমার কোল জুড়ে। কী যে মিষ্টি দেখতে! আমি সারাদিন চেয়ে চেয়ে দেখতাম। দেখতে আমার মত হলেও গায়ের রঙ পেয়েছে বাবার মতো। দেখতে দেখতে মাস ছয়েক পেরিয়ে গেছে, আমার ছোট্ট মেয়েটা এখন ঠিক যেন জীবন্ত পুতুল। সোনারঙা চেহারার জন্য ওর বাবা ওর নাম রাখল অতসী। সুখের যেন কোনো সীমা নেই! কিন্তু স্থায়ী সুখ হয়তো কপালে লেখা নেই, তাই আবার গেল সব ভেঙেচুরে!

তোর যখন সাতমাস বয়স, তখন ওর মাথায় আবার ভূত চাপলো। এবারের চাকরিটাও ছেড়ে দিল। মন নাকি আর টানছে না। কিছুদিন থাকলো বাসায় বসে। এদিকে তোর খাবার, ওষুধ দরকার। কিন্তু হাতে টাকা পয়সা নেই। কীভাবে আসবে তারও বন্দোবস্ত নেই। জীবনে প্রথমবার আফসোস হলো, কেন এরকম একজন আজন্ম বোহেমিয়ান লোককে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিলাম!

সব থেকে বেশি আফসোস হচ্ছিল কেন পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম না। তাছাড়া মেট্রিক পাশে তখন ভালো চাকরিও পাওয়া যেত সেটার চেষ্টা না করে ওর উপরে ভরসা করেছিলাম বলে অনুশোচনা হলো। তাহলে হয়তো এই দিন দেখতে হতো না। কিন্তু এসব কিছুই মুখ ফুটে ওকে বললাম না। শুধু কিছু একটা করার তাড়া দিতাম। এই নিয়েই শুরু হয় অশান্তি। বাবার বলা কথাটা তখন মনে পড়ল, সুন্দর চেহারায় শুধু মন ভুলে কিন্তু পেট ভরে না।

এর মধ্যে একদিন সে বেরিয়ে গেল রেগে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় তার ফেরার নাম নেই। চিন্তায় অস্থির হয়ে তোকে বুকে চেপে বসে থাকি। কিন্তু তার দেখা নেই। রাতের অন্ধকার কেটে আলো ফুটল, উৎকন্ঠিত আমি ভাবছিলাম সে কোথায় গেল। সকাল হতেই তোকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। অল্প কিছু পরিচিত জায়গা খুঁজে অস্থির হয়ে বাসায় ফিরলাম। ভাবলাম হয়তো ফিরেছে। কিন্তু বাসায় এসে তালা দেখে হতাশ হলাম।

নিরুপায় হয়ে বাড়িওয়ালা চাচার সাহায্য চাইলাম। উনিও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন। সেদিন তো ফিরলই না, তারপরও ফিরল না। প্রচন্ড ভেঙে পরলাম। সন্ধান চালিয়ে যেতে লাগলাম, খারাপ কিছু হলো কিনা ভেবে ভেতরটা কেঁপে উঠছিল বারবার। ঠিক সাত দিনের মাথায় একটা চিঠি পেলাম। প্রেরকের জায়গাটা খালি। আশান্বিত মনে দ্রুত হাত চালিয়ে খামটা খুললাম, এখানে হয়তো ওর কোনো খবর থাকবে। কিন্তু যা দেখলাম তা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।

কেন করল ও এরকম? মনে হচ্ছিল খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখছি, ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এটাতো স্বপ্ন নয়, একেবারে নিরেট বাস্তব। চিঠিতে কোটেশন আকারে লিখা ছিল,

“তোমাকে কী ডেকে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না। সে অধিকার আমি নিজেই শেষ করেছি। তোমার সামনে দাঁড়াবার সাহস আমার নেই। তাই চিঠিই লিখলাম। আমি জানি এটা না লিখলে তুমি হাজার কষ্ট হলেও তা উপেক্ষা করে অপেক্ষায় থাকবে।
আমি চির বোহেমিয়ান একজন মানুষ, কীভাবে যেন হঠাৎ করে তোমাতে আটকে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল তোমাকে না পেলে জীবন বৃথা। নাওয়া খাওয়া ভুলে তোমাকে পাওয়ার নেশায় মাতলাম। পেয়েও গেলাম, তুমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমার মত এক ভবঘুরের হাত ধরলে। আর আমি বাঁধা পরে গেলাম সংসারের জাঁতাকলে। এরপর অতসী এলো, আরও জড়িয়ে গেলাম। কিন্তু আমার স্বাধীনতা খর্ব হতে থাকল। বণ্য প্রানীকে বনেই মানায়, খাঁচায় আবদ্ধ জীবন তার জন্য নয়। আমার মধ্যেও বন্যতা আছে, মুক্ত বাতাসে শ্বাস ফেলে বাঁচতে ইচ্ছে করে খুব। তাই মুক্তির সন্ধানে বেরোলাম। আমি ক্ষমা চাইছি না। জানি তার যোগ্য আমি নই। তবে তোমাকে আমি মন থেকেই চেয়েছিলাম, এখনো খুব করে চাই। কিন্তু বাঁধন যে আমার সহ্য হয় না। তাই তা ছিড়ে ফেললাম। তুমি ফিরে যাও, নতুন করে শুরু করো সব। ভালো থেকো।
ইতি
আশফাক।”

এই ওর শেষ চিঠি। আমি তাকে বাঁধতে পারিনি, তোর জন্যও ওর কোনো দ্বায়িত্ব ছিল না। আমাকে অকূলপাথারে ফেলে দিব্যি পালিয়ে গেল কাপুরুষের মতো। মুক্ত স্বাধীন জীবনই যদি ওর চাই তবে আমাকে ওর সাথে জড়াল কেন? আমি তো ওকে খাঁচায় পুরতে চাইনি! শুধু একসাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। তবে কেন এই প্রহসন!

আমার পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে ওর হাত ধরেছিলাম, ও আমার সেই দ্বায়িত্বটুকুও নিতে পারল না। এদিকে চারমাসের বাড়িভাড়া বাকি, তোকে রেখে যে বাইরে কাজ করব তাও সম্ভব নয়। এরমধ্যে বাসার অন্য এক ভাড়াটিয়া পিছে পিছে ঘুরঘুর করতে থাকল। কী এক কঠিন পাথর সময় যে পার করছিলাম!

অবশেষে নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতে ফেরার, কোনো এক রাতের অন্ধকারে যা ছেড়ে এসেছিলাম চিরতরে। একমাত্র সম্বল গলার চেইনটা বাড়িওয়ালা চাচাকে দিয়ে আবারও ফিরে এলাম নীড়ে। কিন্তু সে নীড় তো আর আগের মতো নেই। আমূল বদলে গেছে।’

একটু পড়ে অন্বেষা ডায়েরি বন্ধ করল। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল রাত তিনটা ঊনিশ। পরেরদিন অফিসে যেতে চাইলে ঘুমাতে হবে এখনি। কিন্তু সহসা ঘুম এলো না। অতসীর মায়ের জন্য এত কষ্ট হতে লাগলো যে চোখ ঝাপসা হলো। অতসীর সাথে ওর কতটা মিল, পার্থক্য শুধু ওর বাবা ওর মাকে ফেলে চলে গেছে আর ওর ক্ষেত্রে মা। মা যখন বাবাকে রেখে চলে গিয়েছিলো তখন বাবারও কি এরকম কষ্ট হয়েছে? মায়ের প্রতি ওর অভিমান আরও গাঢ় হলো। কখনো না দেখা অতসী আর ওর মায়ের অনুভূতি যেন ও খুব কাছ থেকে অনুভব করল, বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল!

আঠারো.
কোনো এক খোলা প্রান্তরে আবিদ দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে সুনসান নীরবতা। আচমকা অতসী ওর সামনে এসে দাঁড়াল, ওর কপাল বেয়ে রক্ত পরছে। বলতে লাগল,

“সেদিন ফেলে কেন চলে গেলে? তুমি না গেলে হয়তো আমি বেঁচে থাকতাম। কেন আমার হাতটা ধরলে না সেদিন?”

প্রতিটি কথা অনেকবার করে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু জলের পরিবর্তে যেন রক্তবিন্দু ঝরছে। আবিদ হাত বাড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অস্থির বোধ করল ও। ডাকছে অতসীকে, কিন্তু অতসী ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে!

ঘুম ভেঙে গেল আবিদের, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। প্রায় দেড় দশক চলে গেলেও এই দুঃস্বপ্ন আজও পিছু ছাড়েনি ওর। হয়তো এ জীবনে আর মুক্তি নেই সে দুঃস্বপ্ন থেকে। পানি খেল ঢকঢক করে। ডায়েরির খোঁজ করতেই মনে পড়ল অন্বেষাকে দিয়েছে সেটা।

প্রতিদিনের অভ্যাস ডায়েরির পাতাগুলোয় একবার হাত বুলানো। হাজার হলেও অতসীর হাতের ছোঁয়া লেগে আছে তাতে! অন্য কেউ শুনলে নিতান্ত পাগলামি বা ছেলেমানুষি ভাবতে পারে, কিন্তু এটা ওর একান্ত গহীনের অনুভূতি।

বারান্দায় বসল ও, আকাশে আজ চাঁদ নেই। অমাবস্যা কিনা ওর জানা নেই। তবে ওর মনে হলো ওর ভেতরটাও আজকের আকাশের মতো আঁধারে ঢাকা। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তাতে। বাইরে কাঠিন্যের খোলসে আবৃত থাকলেও ভেতরে ভেতরে একটা অস

হায় ভেঙে পরা মানুষ ও!
………

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
দ্বাদশ পর্ব

বরাবরের মতো সেরাতেও আর ঘুম নামল না চোখের পাতায়। প্রায় প্রতিদিনই দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এরপর হাজার সাধাসাধিতেও ঘুমকুমারী আর আবিদের চোখে ভর করে না। একেবারে ভোরের দিকে ঘুমায় ও। সুন্দর সকালটা তাই আর খুব একটা দেখতে পায় না এখন। আজ খুব ইচ্ছে হলো সূর্যাস্ত দেখার। ইশ! কত্তদিন দেখা হয় না!

না, ভুল হলো হয়ত, কিছুদিন আগে দেখেছিল, অনেকবছর পর! জার্নালিস্ট মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু সেদিন সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। মেয়েটার নামটা যেন কী ছিল? কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়ল, অন্বেষা! কী আশ্চর্য! নামটা মনে করতে এত কষ্ট হলো কেন? বয়স কী তবে বেড়ে যাচ্ছে, বুড়িয়ে যাচ্ছে নাকি? একচল্লিশ বছর তো খুব একটা বেশি বয়স নয়! তবে মেয়েটা দারুণ ইন্টারেস্টিং, খুব নাছোড়বান্দা! কিছুটে ক্ষ্যপাটে ভাব আছে মনে হয়। নিজের মনেই হেসে ফেলল ও। সবসময়কার মেকি হাসি নয়, একেবারে মন থেকে উঠে এলো তা। বহুবছর পর মন থেকে হাসল!

ভাবলো ছাদে যাবে কিনা, দোটানা পিছু ফেলে উঠে এল ছাদে। এখনও অন্ধকার কাটেনি ঠিকঠাক, চমৎকার আলো আঁধারী চারপাশে। সোহান বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। দারোয়ান, শেফ আর মালি এখনও উঠেনি। কখন উঠে তাও অজানা আবিদের। ভোরের হিমশীতল বাতাস লাগছে গায়ে, কী বিশুদ্ধ ফুরফুরে বাতাস!

‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ কথাটা আবিদের একেবারে অর্থহীন মনে হয়, অন্তত ওর ক্ষেত্রে। অর্থহীনই তো, নইলে প্রায় পনেরো বছর ধরে দৃষ্টি সীমায় তো দূর পৃথিবীতেই যে নেই, সে এতগুলো বছর ধরে ওর মনে একেবারে আসন গেড়ে বসে আছে কী করে! আজও সমান দহনে পুড়িয়ে যাচ্ছে ওকে।

শেষ বিদায়ের দিন ওকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদেছিল অতসী, কী ব্যাকুল অনুনয় ছিল বিয়ে করার। ছেলেমানুষি আবেগ ভেবে কেন ও এড়িয়ে গেল? কতটা অসহায় হয়ে ওকে এতটা মরিয়া হয়ে চেয়েছিল। ভাবতেই ভেতরটা হুহু করে উঠে! আবিদকে এতটা স্বার্থপর ভেবেছিল অতসী? যদি নাই ভাবে তবে ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ওকে জানাল না কেন? আবিদের কাছে ভালোবাসার চাইতে ওর স্বপ্ন নিশ্চয়ই বড় ছিল না। আক্ষেপে ক্ষয়ে যায় ভেতরটা!

সূর্য উঁকিঝুঁকি মারছে তখন, কী সুন্দর সোনালী আভা ফুটে উঠেছে চারপাশে। বিশাল জায়গা জুড়ে এই বাসাটা। যার বেশীরভাগ জুড়েই রয়েছে গাছপালা, নানান প্রজাতির গাছ। চারপাশে সবুজের সমারোহ।
অনেকদিন পর এরকম একটা সুন্দর সকাল এলো ওর জীবনে!

এখনও বসন্ত, বিদায় নেবে অবশ্য দ্রুতই। গ্রীষ্ম আসতে একুশ দিন বাকি। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ম্যাগাজিনের বৈশাখী সংখ্যায় ওর লেখা চেয়ে দুদিন পরপরই ফোন করছেন প্রকাশক সাহেব। কিন্তু আবিদ কিছুতেই লিখতে পারছিল না, দু এক লাইন লিখে সেটা নিজেরই ভালো লাগে না। আবার নতুন করে শুরু করে। আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে যেন! রাইটার্স ব্লক? নাহ! সেরকম নয়। আজ আগ্রহ বোধ করছে, হয়তো লিখতে পারবে।

দ্রুত পা চালিয়ে লাইব্রেরী ঘরে নেমে আসে। বসে যায় লিখতে। কিছুক্ষণ ভেবে ভেবে এক দুই লাইন লিখতেই বাকিটা দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে লাগলো কলমের ডগায়। নিজেকে ভুলে ডুবে গেল লেখায়।

ঊনিশ.
অন্বেষার আজ একটা লাইভ ছিল। সংবাদপত্রগুলোও এখন নিজেদের ফেসবুক পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ শো নিয়ে ব্যাস্ত। আজ একজন সেলিব্রেটির ইন্টারভিউ নিল ও। শুরু হয়েছিল সাড়ে সাতটায়, আটটা পনেরোতে শো শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে নয়টা। বাসায় ফিরতেই বাবা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোকে খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে যুদ্ধ জয় করে ফিরলি?”

“আর বলো না, আজ সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলাম। ঘুরে ঘুরে মরেছি শুধু!”

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, “তোর মা ফোন করেছিল, তুই নাকি ফোন ধরছিস না?”

ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখল এগারোটা মিসড কল! শো’য়ের সময় ওর নিজের ফোন সাইলেন্ট করে রাখে বরাবরই। ওই সময়েই ফোন করেছিলেন উনি। পরে আর ফোন চেক করা হয়নি। কিছু বলল না অন্বেষা, ক্লান্তি ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে আজ। বাবা কেমন যেন উসখুস করছেন, আশ্চর্য, বাবা তো কখনো এমন করেন না!
“কিছু বলবে, বাবা?”

এবার যেন কাঁচুমাচু ভঙ্গিটা বেড়ে গেলে, “হ্যাঁ রে আনিকা বলছিল ও তোকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে চায়। তোর সাথে কিছুটা টাইম স্পেন্ড করতে চায়। তুই নাকি রাজি হচ্ছিস না?”

অন্বেষা একে ক্লান্ত, তার উপর এই কথা শুনে মেজাজ সপ্তমে চড়েছে, কী ভাবেন উনি নিজেকে!
“উনি চাইলে সারাজীবনই আমাদের সাথে কাটাতে পারতেন। তখন তো উনি সেটা চাননি। চলে গেলেন নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করে। এখন কেন পিছে পড়েছেন? উনার সঙ্গ যখন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সেসময় তাকে পাইনি, এখন আর আমার তার সঙ্গ প্রয়োজন নেই।”

মেজাজ না হারিয়ে ভীষণ শীতল গলায় কথাগুলো বলল ও। বাবাও চোখ নামিয়ে নিলেন। নিজের রুমে গিয়ে বাইরের জামা বদলে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বের হলো। বাবার মুখ থমথমে, পেপার নাড়াচাড়া করছেন, বোঝাই যাচ্ছে পড়ছেন না উনি। ওকে আসতে দেখেও কোনো প্রকার হেলদোল নেই। বুঝতে পারল কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু এখানে ওর দোষটা কোথায়?
বাবার পাশে বসে বলল,
“বাবা, তুমি মন খারাপ করেছো আমার কথায়?”

বাবা চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন, মেঘ কিছুটা কমেছে মনে হচ্ছে।
“নাহ! রাগ করিনি। খাবি না?”

অন্বেষা আর কথা বাড়ায় না, খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু না খেলে বাবা আরও কষ্ট পাবেন। তাই খাওয়া পর্ব শুরু হলো। খাবার শেষ করে বাবার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে উঠে এলো। একটা প্রশ্ন উদয় হলো মনে, বাবা কি এখনো মাকে ভালোবাসেন? কী জানি, হয়তো বাসেন, হয়তো না!

অতসীর ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

ডায়েরির পাতা থেকে…..
আশফাক নিরুদ্দেশ হবার পর চলে এলাম তোর নানাবাড়িতে। নিজের বাড়ি বলতে আর সাহস হলো না। যে মানুষগুলোকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকেই ভরসা করলাম। কিন্তু লোকগুলো বদলে গেছে আমূল। বাবা তো আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন৷ এসেছি অব্দি কোনো কথাই বলেননি। অভিমানের কাঁটা হয়তো বেশিই বিঁধেছে!

আমার প্রতি সবার আচরণে মনে হতো আমি ভিনগ্রহের কোন আগন্তুক! কেউ ঠিকঠাক কথা বলত না, এমনকি মা’ও না! এসব নিয়ে ভীষণ কষ্ট হলেও প্রস্তুত ছিলাম এর জন্য। যাই হোক মাথায় উপর ঠাঁই তো পাওয়া গেছে। যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম, সে তো আমাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলে চলে গেছে। কয়েক মাস যাবার পর দেখলাম, সবাই বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। আমার আবারও বিয়ে দিতে চাইছে। তোকে আঁকড়ে ধরলাম। এ আমি কিছুতেই পারব না। শেষমেশ সরাসরি প্রস্তাব এলো আমার কাছে। বাবা উনার ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। যেতেই তার পাশে বসতে বললেন, কতদিন পরে বাবা কথা বলছেন আমার সাথে। মন ঠিকই জানে কঠিন কিছুই হবে।

“শোন, একবার ভুল করেছিস। এবার আমাদের কথাটা শোন। এভাবে থাকা যায় না। সামনে আগানোর চিন্তা কর এবার।” ঠান্ডা গলায় কথা বলছেন বাবা।

“কিন্তু আমার তো ডিভোর্স হয়নি।”

বিয়ে না করার অজুহাত খুঁজে বললাম। বাবা একটা খাম আমাকে ধরিয়ে দিলেন। খামের উপরে আমার নাম লেখা। মুখ খোলা, বাবা পড়েছেন বুঝলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ভেতরের কাগজটা বের করলাম। ডিভোর্স পেপার! শেষ যে ক্ষীণ আসা ছিল ওর ফিরে আসার তাও শেষ। চোখ থেকে পানি গড়াতে লাগলো গাল বেয়ে। বাবা পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলালেন,

“দ্যাখ, তোর সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। নতুন করে শুরু কর।”

“অতসী কে রেখে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়, বাবা!” ভাঙ্গা গলায় বলেছিলাম।

“আমি আর তোর মা বুড়ো হয়ে গেছি। তোর ভাইদের নিজেদের সংসার হয়েছে। তাই ঠিক করেছি কোনো নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক দিয়ে দেব। অতসী ভালো থাকবে।”

আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল, অথচ বাবা কী অবলীলায় কথাটা বলে দিলেন! আমি সব ছিন্ন করে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পালিয়ে গিয়ে যে ভুল করেছিলাম তার জন্য এতবড় শাস্তি! এত কঠিন শাস্তি! পাশে মা বসে ছিলেন পুতুলের মতো, শুধু চোখে পানি ছিল।

“শোন, তুই আমার সন্তান। তোকে পানিতে ফেলে দেব না। রাজি হয়ে যা। আর এটাতে সিগনেচার করে দে।”
আমি সেটা হাতে নিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলাম কোনো ঠিকানা লেখা আছে কিনা। কিন্তু একটা উকিলের ঠিকানা ছাড়া কিচ্ছু নেই। শুধু একটা চিরকুট, পাঁচটা শব্দ শুধু তাতে,

“সাইন করে দিও। ভালো থেকো।”।

আর কিচ্ছু নেই। এটা ওরই লেখা, আমি খুব ভালো করে চিনি এই লেখা। যেটুকু আবেগ ছিল ওর প্রতি তা নিমেষে উবে গেল। ওর জন্য জন্ম নিল সম্পূর্ণ বিপরীত এক অনুভূতি ঘৃণা।

শুনেছিলাম ভালোবাসা আর ঘৃণার বাস নাকি পাশাপাশি হয়। একটা কমে গেলেই অপরটা জায়গা করে নেয়। এই কথার সত্যতা সেদিন জানলাম, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বাবা কলম বাড়িয়ে দিলেন, আমি দৃঢ়চিত্তে স্বাক্ষর করলাম তাতে, এবার আর হাত কাঁপলো না, একদমই না!

আমার কথা, আমার মেয়ের কথা যার ভাবনায় নেই, যে দ্বায়িত্ব এড়ানোর জন্য কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায়, সে ঘৃণারও যোগ্য নয়! শুধু করুণা করা যায় তাকে!
……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here