বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ২৪

0
652

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২৪
#লেখিকাঃদিশা মনি

❝তাহলে এনগেজমেন্ট করে নেওয়া যাক।❞

সুমনার কথায় সবাই মনযোগ দেয়। আলো দূরে দাড়িয়ে ভাবছিল,
‘ব্যবহার, কথাবার্তা সবই বর্ণ মাহমুদের মতো কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি বর্ষ স্যার।’

এলিনাকে নিয়ে আসা হয় সামনে। সুমনা বলে,
‘নে এবার এই রিংটা এলিনাকে পড়িয়ে দে বর্ণ।’

বর্ষ মুচকি হাসে। কেউ বোধহয় সন্দেহ করছে না যে সে বর্ষ। বর্ণকে এমনভাবে নকল করেছে যে কারো সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিলনা। বর্ণর উপর খুব ক্ষেপে আছে সে। আজ শুধুমাত্র বর্ণর খামখেয়ালী পনার জন্য এই এলিনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এলিনাকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না বর্ষ।

এলিনা বর্ষর দিকে তাকাচ্ছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। বর্ষর ইচ্ছা করছিল এলিনার গালে ঠা’স করে একটা থা’প্পর মা’রতে। এইরকম বে’হায়া মেয়েকে তার একদম সহ্য হয়না। এলিনা বর্ষর কাছে এসে বলে,
‘হেই বর্ণ লং টাইম নো সি। কেমন আছো?’

‘ভালো।’

‘তোমার ঐ চাশমিশ হে’বলা ভাইকে তো কোথাও দেখছি না। কোথায় ও?’

নিজের নামে এরকম কথা শুনে বর্ষর চোখ রাগে লাল হয়ে যায়। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সবার সামনে এলিনার গালে থা’প্প’র মা’রে। এই আকস্মিক ঘটনায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। আলো ঢোক গিলে বলে,
‘আমি তো বর্ষ স্যারকে বলেছিলাম অসুস্থ হওয়ার নাটক করতে। এটা উনি কি করলেন। আল্লাহ কি হবে এবার।’

বর্ষর হুশ ফেরে। রাগের মাথায় এ কি করে দিল সে। এখন কিভাবে সবকিছু সামলাবে সেটাই ভাবছে। এলিনা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। এরিক এসে বর্ষর কলার ধরে বলে,
‘হাউ ডেয়ার ইউ বর্ণ? কোন সাহসে আমার বোনের গায়ে হাত তুললে?’

এই ব্যবহারে বর্ষর রাগ আরো বেড়ে যায়। এরিককে ঠেলে সরিয়ে দেয়।

‘আমি বর্ণ নই বর্ষ। আমার ভাই তোমার বোনকে রিজেক্ট করে চলে গেছে।’

বর্ষ আর এক মুহুর্ত সেখানে দাড়ায় না। দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। পুরো ঘটনায় তাজ্জব বনে যায় সুমনা। এখন কিভাবে সবকিছু সামলাবেন সেটাই ভাবছেন। এলিনার মা বলেন,
‘এটা আপনি ঠিক করলেন না মিসেস মাহমুদ। আমার মেয়েকে এত বড় ইনসাল্ট।’

এরিক রাগে ফুসতে থাকে। প্রতিশোধস্পৃহার জন্ম নেয় তার অন্তরে। এলিনার ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে শপথ করে,
‘বর্ণ আর বর্ষ মাহমুদকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি আমি দেবো।’

৪৭.
গোটা বাড়ির পরিস্থিতি থমথমে। এনগেজমেন্টের ওখানে যা হলো তাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে থেকে আরো বেশি ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। বর্ষ রেগে বাড়ি থেকে চলে গেছে। সুমনাও নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।

জরিনা আচমকা গেস্টরুমে প্রবেশ করে। আলো, জোনাকি দুজনে কেবলমাত্র খাবার খেয়ে রুমে এসেছে। জরিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে। রেগে বলে,
‘তোমরা যে এমন কিছু একটা করবে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। এভাবে আ’গুন নিয়ে না খেললেও পারতে৷ পু’ড়তে কিন্তু তোমাদেরই হবে।’

জরিনার কথার কোন মানে খুঁজে পায়না তারা কেউ। আলো জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কিসের কথা বলছেন।’

জরিনা শান্ত হয়। সে জানে এই মেয়েগুলোর তেমন দো’ষ নেই। না চাইতেই তারা এরকম পরিস্থিতিতে আটকে গেছে। জরিনা নিজেও তো এমন ভুল করেছিল। নিজের ইতিহাস আজ অনেকদিন পর জরিনা মেলে ধরতে চায় এই মেয়েদুটোর সামনে। যাতে মেয়েগুলো সচেতন হতে পারে। সে যেই পথে পা বাড়িয়েছে সেই পথে যেন পা না বাড়ায়।

৪৮.
‘আমি জরিনা, এই বাড়ির ছোট মেয়ের সাথে একই স্কুলে পড়তাম, অনেক মেধাবী ছিলাম আমি। কিন্তু আমার পরিবার অনেক গরীব ছিল। আচমকা আমার আব্বুর মৃত্যুতে আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আমরা সবাই দিশাহীন হয়ে যাই। আমার সব ভাইবোনেরা ছোট ছিল, তাই বাধ্য হয়ে আমি একটি বাড়িতে কাজের লোকের কাজ নেই। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তাম। কিন্তু পরে আর পড়াশোনা চালাতে পারি নি। আমি যেই বাড়িতে কাজ নেই তারা অনেক ধনী ছিল। সেই বাড়ির দুই ছেলে ছিল। বড় ছেলে খুব অহংকারী আর দাম্ভীক ছিল, ছোট ছেলে ছিল খুব সহজ সরল। তার সরলতা আমায় মুগ্ধ করত। কখনো আমার সাথেকে কাজের লোকের মতো আচরণ করেনি। সবসময় আপনজনের মতোই দেখত। আর এই ব্যাপারটা আমাকে তার উপর দূর্বল করে দেয়। আমি ভালোবেসে ফেলি তাকে। সেও আমাকে পছন্দ করত, তার আচরণে ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। বয়সটা আবেগের ছিল, তাই নিজের ভুল বুঝতে পারিনি। আমি একদিন তাকে জানিয়ে দেই নিজের মনের কথা। সেও খুশি হয়। শুরু হয় আমাদের নতুন সম্পর্ক। সবকিছু ভালোই চলছিল, একদিন হয়ে যায় বিপদ। উনি আমায় বললেন আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চান। আমি তখন না করে দেই, এরপর কিছুদিন থেকে উনি আমায় উপেক্ষা করেন। যাতে আমার কিশোরী মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একসময় থাকতে না পেরে আমি ওনার আবেদনে সাড়া দেই। একদিন রাতে চুপিসারে ওনার সাথে মিলিত হই। এভাবে দিন ভালোই যাচ্ছিল, আমার খুব কষ্ট হতো কিন্তু তবুও ওনার জন্য সব সহ্য করতাম। এরকমই একদিন ওনার বড় ভাইয়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাই আমরা৷ সেদিন উনি আমায় অনেক মেরেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম আমায় বের করে দেবে কিন্তু তা হয়নি৷ আমায় কাজে বহাল রাখা হয়। এমন কিছু হয়ে যায় যা আমার কল্পনাতীত। ওনার বিয়ে ঠিক হয়৷ আমি সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম। ওনাকে বলেছিলাম বিয়েটা না করতে। কিন্তু উনি আমার কথা না শুনে বিয়ে করতে রাজি হন। কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবে অন্য কারো হতে দেখে খুব খারাপ লাগে। তবুও আমি সব সহ্য করছিলাম। যেদিন ওনার স্ত্রী বাড়িতে থাকত না উনি আমার কাছে আসতেন। আমি কিছু মনে করতাম না। ভালোবাসায় এত অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে ভালোমন্দের বিচার ভুলে গিয়েছিলাম। এভাবে একসময় আমি গর্ভবতী হয়ে যাই৷ কথাটা ওনাকে জানানোর পর উনি বাচ্চা নষ্ট করতে বলেন, আমি রাজি না হলে আমার উপর অত্যাচার শুরু করেন। আমি এসব সহ্য করতে না পেরে আমার বান্ধবী মানে এই বাড়ির ছোট মেয়ে জ্যোতিকে জানাই। সে আমায় নিজের বাড়িতে চলে আসতে বলে। আমি সিদ্ধান্ত নেই চলে আসব। যেদিন আমি আসার চেষ্টা করে সেদিন ওরা দুইভাই মিলে আমায় পাকড়াও করে। ওরা ভেবেছিল আমি চলে গেলে ওদের বিরুদ্ধে মামলা করব। তাই আমায় একটা ঘরে বন্দি করে রাখে। সেই সময়টা আমার কাছে জা’হান্নাম মনে হতো। প্রতিরাতে ওরা দুই ভাই আমার উপর অত্যাচার কর‍ত। আমি খুব করে চাইতাম সেখান থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু পারতাম না। একদিন সাহস করে জ্যোতির সাথে যোগাযোগ করি। জ্যোতি আমায় সাহায্য করবে বলে। দূর্ভাগ্যক্রমে ওরা এ ব্যাপারে জেনে যায়। সেদিন আমার উপর অনেক বেশি অত্যাচার নি’র্যাতন করে। আমি মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন জ্যোতি এসে গিয়েছিল বলে বেচে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে বাচাতে পারিনি।’

জরিনার কথাগুলো শুনে আলো, জোনাকি দুজনেই খুব কষ্ট পায়। তারা জানতোই না যে তার জীবনে এরকম ভয়ংকর অতীত ছিল। সব বলার পর জোনাকি আবার বলে,
‘বড়লোকেরা কখনো গরীবদের ভালোবাসে না। শুধু তাদের সাথে খেলে। তাই আমি নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তোমাদের বলব আমার মতো ভুল করো না। চলে যাও দূরে। এইজন্যই আমি প্রথম থেকে তোমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম কারণ তোমাদের মাঝে আমি নিজের অতীতকে দেখেছিলাম।’

জোনাকি বলে ওঠে,
‘হ্যা আমরা আজই চলে যাবো, আলো রেডি হয়ে নে।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
✨✨গল্পটা প্রায় শেষের দিকে। তাই সাইলেন্ট পাঠকদেরও মন্তব্য করার অনুরোধ করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here