#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ০৮
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
কিরণ!
উপস্থিত সকলেই পিছু ফিরে তাকালো। মিহু সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোভঙ্গি এমন যেন সে মাত্রই ধরণীতে পদার্পণ করেছে। যেন এ ঘটনা সম্পর্কে সে অবগত নয়। জান্নাত মিহু দেখেই ভ্রু কুচকে ফেললো। ঠোঁট আংশিক বাকিয়ে নিচু গলায় বললো,
ভাব দেখ! ভাজা মাছ যেন উল্টাতে জানে না অথচ পুরো রান্না করে গিলতে জানে।
মেহরাবের বেশ হাসি পেলো। মানুষটা ছোট কিন্তু কথা বলাতে দাদী নানীর সমতুল্য। জান্নাতের বিরক্তির মুখটা দেখেও মজা পাচ্ছে। কি বিরক্তি সে চেহারায়! মেহরাব খেয়াল করলো বিরক্তিতেও মেয়েটাকে দারুণ মানায়। মিহুর কন্ঠে মেহরাবের ঘোর কাটলো। চট করে চোখ বন্ধ করে নিলো। দু আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘসতে শুরু করলো। নিজ কর্মে ভিষণ লজ্জিত হলো। জান্নাত! শেষ মেষ এ মেয়ে নিয়ে ভাবছে? মেহরাব ঘন ঘন দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করলো। মিহু ততক্ষণে কিরণের কাছে চলে এসেছে। মিহুর আচরণে সকলেই বুঝতে পারছে কৃত্রিম উদ্বেগ।
কি ব্যপার? কি হয়েছে? তোমরা সবাই এ সময়ে এখানে? আর কিরণকে ওভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছো কেন?
জান্নাত ছোট্ট মস্তিষ্কে মিহুর অভিনয় ভয়ানক আগুন ফোটাচ্ছ। ঋতু মিতুকে কুনই দিয়ে ধাক্কা দিলো। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি বিনিময় করে নিলো। ছেলে সামাজের তো কথাই ভিন্ন। মেয়ে সমাজ যেখানে রাগে, বিরক্তিতে ফেটে চৌচির সেখানে তাদের কাছে বিষয়টা ব্যপক বিনোদনের লাগছে। না লাগার কথাও না। যেখানে সবাই জানে সামনের জন অভিনয় করছে শুধুমাত্র অভিনেতা বা অভিনেত্রীই জানে না তার অভিনয় ধরা খেয়েছে অভিনয় করার আগে সেখানে তো বিনোদন আবশ্যকই। মেহরাব ও জিহাদ মুচকি হাসছে। রোহান তো বসেই পড়লো সিঁড়িতে। ওরা প্রত্যেকে জানে মিহুকে, মিহুর আচরণ ও মিহুর এই বিশেষ গুণ। এতোদিন শুধু বিনোদন নিলেও আজকের ঘটনাতে মিহু বারুদ জ্বেলেছে। রোহান শুধু ভাবছে কালকে দুপুরে এ বাড়িতে কি কি হতে চলেছে। কিরণ তো পরলো মহা ঝামেলায়। মিহুর অনবদ্য অভিনয়েন বিপরীতে কি আচরণ করা উচিৎ তাই ভেবে পাচ্ছে না। আশে পাশে তাকিয়ে সকলের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি দেখে মিহুর দিকে তাকালো। কিছু বলা প্রয়োজন।
জান্নাত মিহুর নেকামি বিষয়টা নিতে পারলো না। ওর আত্মা যেন বের হয়ে সামনে এসে বলছে মিহুকে পারে তো পচা পানিতে ডুবিয়ে আনতে। কিন্তু তা তো সম্ভব না। কিন্তু কমও যাবে না কিছু। ঠোঁটটা প্রসারিত করে মেকি মেকি ভাব আনলো। তারপর ফটাফট বলে ওঠলো,
সেকি! তুমি জানো না এখানে কি হচ্ছে?
মিহুর চটপট জবাব দিলো,
না তো! আসলে আমি তো যাচ্ছিলামই কিরণের সাথে রান্নাঘরে। কিন্তু হঠাৎ ফোন এলো তাই বাগানের দিকটায় ছিলাম।
জান্নাতের কথার গতিবেগ মিতু বুঝতে পারলো। তাই জান্নাতের কাঁধটা জোড়ে চাপ দিলো। জান্নাত ইশারা বুঝলেও মানলো না। একইরকম অভিব্যক্তি নিয়ে পুনরায় বললো,
ইশ! তাহলে তো বিরাট ক্ষতি করে ফেললে। টাকি মাছ ধরার খেলা হচ্ছিলো। কে কতগুলো ধরতে পারে। সেইটাই খেলে উঠছি মাত্র। আর ভাবিকে ধরে ওঠাচ্ছি কারণ ভাবিটা না এতো অলস! জানো হাঁটতেই চাচ্ছে না। আমাদের মতো ছোট ছোট বাঁচ্চাকে জ্বালাচ্ছে। ভাইয়া নেই কিনা! থাকলে তো কোলে নিয়েই….
জান্নাত শেষ কথাটা বলে কিরণের কাঁধে নিজের কাঁধ দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলো। কিরণ বড় বড় চোখে তাকালো জান্নাতের দিকে। কিন্তু তাতে জান্নাতের খুব একটা পরিবর্তন এলো না। আগের মতই ঠোঁটে লম্বা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মিহুর দিকে।
সকলেই বুঝতে পারলো জান্নাত শেষ কথাটাতে মিহুকে বেশ জব্দ করতে চাইলো। হলোও মনে হয়। মিহু চোখে এদিক ওদিক ফিরিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। মিতু ঋতুও কিরণে নিয়ে এগিয়ে গেলো রুমে।
বাংলায় একটা কথা আছে ” ছোট মরিচের ঝাল বেশি।” মেহরাব ভাবলো এ কথা জান্নাতের জন্যই প্রযোজ্য। মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেলো। জান্নাতকে চোখের আড়াল হতে দেখেই ছোট করে বললো,
” ছোট মরিচ! ”
—
সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো মিহুর। তবুও যেন ঘুম ছাড়ছে না। আড়মোড়ে পাশ ফিরেই চোখ চড়কগাছ! ঝড়ের বেগে ওঠে বসলো। স্বপ্নের মতো লাগছে। তার বরাবর সোফায় বসে আছে অর্ণব। এক পায়ের উপর আরেক পা রাখা। মন প্রাণ ধ্যান সব ফোনে। অর্ণব এতো সকালে তার ঘরে এ ব্যপারটা মিহু হজম করতে পারছে না। পাথরের মতো জমে বসে আছে। অর্ণব মিহুর ওঠে বসার শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালো। মিহুর চুপচাপ বসে থাকার কারণটাও আন্দাজ করছে। ঠোঁট বাকিয়ে চিকন হাসি দেখা মেললো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ওঠে দাঁড়ালো অর্ণব। মিহুর কাছে গিয়ে নিচু হলো। মুখোমুখি হয়ে সেই হাসি নিয়েই বলল,
চমকে গিয়েছিস মনে হয়? নাকি তোর রুমে এসেছি বলে রাগ করেছিস? আচ্ছা তাহলে বের হয়ে যাচ্ছি। আসলে তোকে দরকার ছিল তো তাই।
কথাটা বলে অর্ণব চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেই মিহু তাড়াহুড়ো করে হাত টেনে ধরে বললো,
না না! রাগ করবো কেন আমি? তাও তোমার উপর! আমি তো বিশ্বাস করতে পারি নি যে তুমি এভাবে আমার ঘর আসবে।
আরো অনেক কিছু যা তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। অপেক্ষা কর। তোর জন্য একটা বিশেষ উপহার আছে।
অর্ণব কথাটা বলেই রুম ত্যাগ করলো। মিহু বসেই রইলো নিজের অবস্থানে। মিহুর মন বলছে এসব তার স্বপ্ন। চোখ মেললেই স্বপ্ন ভঙ্গ হবে। অর্ণব দূরে চলে যাবে। তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। অর্ণবের কন্ঠে হুস ফিরলো। মিহু তাকালো অর্ণবের দিকে। অর্ণবের হাতে বাটি। কিসের বাটু বোঝার জন্য বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো মিহু। অর্ণবের কাছে গিয়ে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
কি এনেছো অর্ণব?
অর্ণব মুচকি হাসলো। মিহুকে টেনে আবারো বসিয়ে দিলো বিছানায়। হাতে ধরিয়ে দিলো সেই বাটিটা। মিহু এবার বাটির দিকে তাকালো। বাটি ভর্তি নুডুলস। অর্ণব তার জন্য নুডুলস নিয়ে এসেছে! তাও আবার এতো সকালে! মিহু প্রথমে খুশি হলেও পর পরই মনে দানা বাঁধলো সন্দেহের। হঠাৎ এতো আপ্যায়ন? সন্দেহের চোখে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব সোফার সামনের টেবিলটায় বসে আছে। দু হাঁটুতে তার দু হাত মুষ্টিবদ্ব করে সামনে ধরে রেখেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ণবের এ দৃষ্টিতে মিহুর মনে ভয় দানা বাঁধল। মৃদু ধরফর শুরু হলো বুকের ভেতর।
মিহুর চোখে সন্দেহ দেখে অর্ণবের হাসি পেলো। উৎসাহি কন্ঠে বললো,
কি হলো বসে আছো যে? এতো কি চিন্তা করছো? সবার জন্য আজকে আমি বিশেষভাবে রান্না করেছি। সবাইকে নিজে বসিয়ে খাইয়েছি। শুধু তুমিই বাকি ছিলে। সেই কমতিটাই পূরণ করছি। নাও শুরু করো খাওয়া।
মিহু এখনো ব্যপারটা সহজভাবে নিতে পারছে না। মিহুর এই আতংকিত মুখটা দেখেই অর্ণবের আনন্দ হলো। আর কিছুক্ষণ পরেই মিহুর অবস্থা কেমন হবে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। ক্ষোভে তার মাথার নিউরনগুলোর তুমুল তোড়পাড় শুরু করলেও বাহিরে সে শান্ত রয়েছে। তার আভ্যন্তরিন ঝড় থামবে আর কিছুক্ষণ পরেই। মিহুর নাজেহাল, কাতর চেহারাই এ মুহুর্তের জন্য অর্ণবের শান্তির কারণ হবে। অর্ণব পা নড়ছে। সময়ের ব্যবধানে তার গতি বেড়ে যাচ্ছে। আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা।
চলবে ~~~~~~~