#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ০৫
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। অতি সুপরিচিত প্রবাদ -” যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।” এ প্রবাদটি পূর্বে শুধু শুনে থাকলেও আজ এর মর্মার্থ হারে হারে টের পাচ্ছে অর্ণব। পিঠে নরম বালিশটা আশ্রয় করে বসে আছে। ডান হাতটার অবস্থান ঠিক চোখের উপর। বিছানায় পা টান টান করে মেলে রাখা। বাম হাতের আঙ্গুলগুলো খেলা করছে পেটের উপর। তার পাশেই অবহেলায় খোলা পড়ে রয়েছে ল্যপটপটি। যেখানে জ্বলজ্বল করছে সিনিয়র অফিসারের বলা উক্ত দ্বিতীয় আবেদনটি। মিশনে যাওয়ার আবেদন। গতকাল রাত এগারোটার পরপরই আবেদনটি অর্ণবের মেইল থেকে পাঠানো হয়েছে অথচ তা অর্ণব পাঠায়নি। বিগত এক বছর যাবৎ মিশনে যাওয়ার কয়েকটি সুযোগ অর্ণব সেচ্ছায় ত্যাগ করেছে। দেশের জন্য যা করণীয় সে দেশে থেকেই নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে করতে সর্বদা প্রস্তুত কিন্তু দেশ ছাড়তে সে নারাজ। ডিপার্টমেন্ট যেন আশায়ই ছিল অর্ণবের মতো দক্ষ এবং সুকৌশলী অফিসারকে মিশনে পাঠানোর। তাই আবেদন পেতেই তারা গ্রহণ করে নিয়েছে।
অর্ণবের চোখে মুখে হতাশার প্রতিচ্ছবি। সে জানে এ কাজ কিরণের। কিরণের বলা সকালের শেষ কথাটা অর্ণবকে বিচলিত করে ফেলেছিল। ভেবেছিল হয়তো কিরণ ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তখনও ভাবতে পারে সে তাকে দূরে পাঠানোর জন্য কর্মক্ষেত্রের আশ্রয় নিয়েছে। মেয়েটা দু দিনেই ওর ল্যপটপের পাসওয়ার্ড জেনে এতো বড় একটা কাজ করে ফেলেছে। কেন? শুধুমাত্র জেদ, অভিমান, প্রতিশোধস্পৃহায়? কিরণ জানে এ দিকে অর্ণব প্রতিরোধক কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না। না নিজে কিছু বুঝছে আর না অর্ণবকে বোঝানোর সুযোগ দিচ্ছে। ই মেইলটি দেখার পর থেকে অর্ণবের বুকে যেন চিন চিন ব্যথা করছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এ ব্যথা যেন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দূরত্ব যে তাকেও পোড়ায়। প্রেয়শীর থেকে মনের দূরত্ব যেন আরো ভিষণ বাজেভাবে পোড়ায়।
নিচ থেকে কিরণের চিকন কন্ঠের উচ্ছাস শোনা যাচ্ছে। অর্ণব একহাতে ল্যপটপ বন্ধ করে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। বসার ঘরে ছোট খাটো আসর জমেছে। কিরণ, আলো, তিন্নি, হৃদ, শুভ ও রাতুল বসেছে বিশাল কোনো আলোচনায়। আলো কিরণের বোন। দু বছরের ছোট। শুভ কিরণ ও আলোর একমাত্র ফুপির একমাত্র ছেলে। রাতুল তিন্নির বড় ভাই, কিরণের মামাতো ভাই। কাজিন মহলের একমাত্র বর্হিভূত মানুষ হৃদ। তবে একদমই বাহিরের তা না। প্রিয় বান্ধবী ছাড়াও হৃদের আরো এক সম্পর্ক রয়েছে। কিরণের বাবার দুর্সম্পর্কের চাচাতো বোনের মেয়ে। সেদিক থেকে হৃদও ভাই বোন সমাজের সদস্যের আওতায় পরে যায়। তবে কিরণ তাকে সবথেকে কাছের বন্ধু হিসেবেই পরিচয় করাতে অধিক পছন্দ করে।
ওদের এই অহেতুক গল্পগুজবের নিরব দর্শক হয়ে রইলো অর্ণব। উপরের রেলিং ধরে দাড়িয়ে কিরণের হাস্যজ্জল মুখটায় তাকিয়ে রয়েছে কেবল। কিরণের এ হাস্যজ্জল মুখটা কেন যেন অর্ণবকে খুব অসন্তুষ্ট করছে। এই হাসির দেখা তো তার সাথে থাকলে মেলে না! এতো কথার ঝুলি তো তার সামনে খোলে না! অর্ণব বুঝতে পারলো তার মধ্যকার হিংসাত্মক সত্তার উপস্থিতি। কি অদ্ভুত এ প্রেম! এ প্রেম গড়ে এ প্রেম ভাঙ্গে, এ নেশা করেছে যে জন সেজন এর পীড়া বোঝে। কিরণের দিকে তাকিয়ে রইলো অর্ণব। অভ্যন্তর থেকে আক্ষেপের সুরে বেড়িয়ে এলো,
ইশ্ সূর্যরাণী! যদি তুমি জানতে
বক্ষঃস্থল ভিজিয়ে দিতে আক্ষেপের অশ্রুপাতে..
—
” স্বপ্নকুঠির” লেখা নেইম-প্লেটেরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মিহু। এ স্বপ্ন কুঠির লেখা বাড়িটা কিছুদিন আগ পর্যন্তও ওর স্বপ্নের কুঠিরই ছিল। কল্পনায় কত কিছু যে সাজিয়েছে তা কেবল ওর রব এবং ওর আত্মাই বলতে পারবে। অথচ আজ সে সবকিছু ফ্যাকাশে। রঙ্গিন কাল্পনিক সংসারটার পাতা উল্টাতেই ধূসর বাস্তবতা। কাঙ্ক্ষিত মানুষটা অন্যের দখলে ভাবতেই পায়ের নিজের মাটি নরম হয়ে এলো। দুমরে মুচরে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে মিহুর ভেতরের দৃশ্য। আর বাহিরটা রঙ্গিন পাথরের মতো স্বচ্ছ ও মজবুত।
মিহু! দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? ভেতরে আয়?
মায়ের ডাকে মিহু ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। গেট পেড়িয়ে প্রবেশ করলো দুতলা বিশিষ্ট বাড়িটায়। দরজা পেরতেই বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো অর্ণবের ইউনিফর্ম পরিহিত ছবিটায় নজর আটকিয়ে গেলো। আজ নতুন নয়। প্রতিবারই এমন হয়। এসেই এই ছবিটার দিকে প্রথম তাকাবে মিহু। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। এই সুপুরুষটি তার না ভাবতেই যেন যন্ত্রনা শুরু হচ্ছে। মন বলছে সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিবে। ধ্বংস করে দিবে এ পৃথিবী। যে পৃথিবীতে অর্ণব তার নয় সে পৃথিবী রাখতেও মন নারাজ। মনের তুফান দাবিয়ে রেখেই মিহু ছুটে জড়িয়ে ধরলো অর্ণবের মা, মিসেস রেহনুমা রিজওয়ানকে। একমাত্র ভাগ্নিকে এতদিন পর কাছে পেয়ে সেও যেনো আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো। কাজের জন্য বিয়েটাতে অনুপস্থিত ছিল বড় বোন ও এ মেয়ে। নিজের কোনো মেয়ে না থাকায় মিহুকে দিয়েই যেন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে চায়। বোন ও ভাগ্নিকে সোফায় বসিয়ে কুশলাদি বিনয় পর্ব শেষ করতেই মিহু রেহনুমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
মণি! তা কোথায় তোমার ছেলে আর ছেলের বউ? আমায় দেখে কি তারা পালিয়েছে?
রেহনুমা সরল হাসিতে জবাব দিলেন,
কি যে বলিস তুই! ওরা আসলে বাড়িতে না। বউমার তো বৌভাত ছিল গতকাল। তাই বাপের বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু তুই আসবি শুনে অর্ণব চলে এলো বলে দেখ। আর আজকে তো ওর বড় চাচারাও আসবে। ওই যে মেহরাব ও মিতুকে চিনিস না? ওরাও আসবে। ভাইয়েরও নাকি কিসব কাজ ছিল। তাই তোদের মতো ওরাও বিযেতে আসতে পারে নি। তাই আজ আসছে। আজ মনে হচ্ছে আসলেই কোনো উৎসব রে। তোদের ছাড়া উৎসব, উৎসব লাগে না।
এতোই যখন ভালোবাসো তখন একেবারে রেখে দিলেই তো পারতে মণি!
মিহুর কথার গভীর মানেটা রেহনুমা বুঝতে না পারলেও মিহুর মা রিমা ঠিকই বুঝতে পারেন। তার একমাত্র নাড়ি ছেঁড়া ধন মিহু। যে মেয়ের চোখের পানি যেখানে সহ্য হয় না সেখানে সেই মেয়েকে বিগত পনেরো মেন্টাল এসাইলামে উন্মাদের মতো আচরণ করতে দেখেছে। এমন কথা বলে কান্না করে পাগল হতে দেখেছে। পুনরায় এমন কথা শুনে তার বুকের মাঝে ধক করে ওঠে। যদি কিছু করে বসে এখানে? তার এখানে উদ্দেশ্য বিফলে যাবে। তাই কথা এগোনোর আগে পরিস্থিতি সামলে চলে গেলেন রুমে।
—
দেড় মাস পর আমার মিশনে যাওয়ার ডেট। এক বছরের জন্য যেতে হবে। খুশি তো তুমি সূর্যরাণী?
অর্ণবের গাম্ভীর্য গলায় এমন কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে কিরণ। শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে কেবলই গাড়িতে ওঠেছে। সিট ব্লেট লাগানোর সময় অর্ণবের এ কথা শুনে হাত ফসকে বেড়িয়ে গেলো বেল্টটি। সে তো জানে অর্ণব মিশনে যাবে। দ্রুতই তবে এতো দ্রুত তা একদমই আশা করে নি। জেদের বশে কিরণ কাজটি করলেও সে যে কষ্ট পাচ্ছে না ব্যপারটা একদমই তা নয়। বরং সে কষ্ট লাঘব করতে সকালে সেই আড্ডা মহল গড়ে ছিল। আবারো সেই চেনা ব্যথায় বুক ভারি হয়ে আসছে। পানির ভারে চোখ ভার হয়ে আসছে। মাথা নিচু করে রেখেই পাশ ফিরে বসলো কিরণ। বাহিরে তপ্ত রোদ! মুখ ফিরিয়ে রাখা বাহিরে। রোদের এ তপ্ততাও যে তার অন্তর্নিহিত তপ্ততাকে হারাতে ব্যর্থ! গাড়ি চলতে শুরু করলো। আধঘন্টা সময় পেড়িয়ে গেলো পিনপতন নীরবতায়। কিরণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অর্ণবের দিকে। কফি রঙ্গের পিরিহিত শার্টটা অর্ণবের শরীরে বসে গিয়েছে যেন। অর্ণবের হাতের হালকা পাতলা কালো লোমগুলো ল্যপ্টে গিয়েছে ওর শ্বেত বর্ণের হাতের সাথে। চোখগুলো ঢেকে রয়েছে রোদ চশমার আড়ালে। হাত দুটো সোজা স্টেরিয়েং এ রাখা। লোকটা একমনে গাড়ি চালিয়েই যাচ্ছে। রা শব্দও কাটছে না দাঁতে। যন্ত্রের মতো শুধু রাস্তা দেখছে আর গাড়ি চালিয়ে চলছে। মনের ভেতর কি চলছে তা জানতে অর্ণবের চোখ দুটো দেখার অদ্যম ইচ্ছে জাগছে কিরণের। আচ্ছা! সে কি জেদের বশে খুব বেশি করে ফেলেছে?
দেড় ঘন্টার পথ পেড়িয়ে কিরণ অর্ণব এসে পৌঁছিয়েছে। গেটের বাহিরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে অর্ণব। এই দেড় ঘন্টা সে একবারও কিরণের সাথে কোনো প্রকার কথা বলে নি। নিরবতায় কিরণও ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনো ঘুমিয়ে আছে। প্রায় পাচ মিনিট যাবৎ অর্ণব সিটে মাথা হেলিয়ে রেখেছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে রয়েছে কিরণের ঘুমন্ত আদলটায়। আস্ত প্রেম নিয়ে যেন ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা। শুধু আফসোস অর্ণবের গভীর প্রণয়টা বুঝতে চাইছে না। এত বছর দূরে থেকে আবারো দূরত্ব অর্ণবের অস্থির, ব্যকুল হৃদয় মানতে নারাজ। কিন্তু সে যে উপায়হীনও। অর্ণব নিজের সিট ব্লেটটা খুলে নিঃশব্দে ও আলতোভাবে ঠোঁট স্পর্শ করালো কিরণের মাথায়।
মনে মনে বললো,
আমায় পোড়াও সখি তবু শান্তির নীড়ে থাকো তুমি!
পুনরায় নিজের জায়গায় এসে গাড়ি চালু করে প্রবেশ করলো গেইটের ভেতরে । নরম স্বরে ডেকে ওঠালো কিরণকে। কিরণ ওঠেই অর্ণবের দিকে তাকালো। কিন্তু অর্ণব নেমে গেলো। বাহির থেকে কিরণের দরজা খুলে দিল। বিনা বাক্যে নেমে এলো সে। হঠাৎই অর্ণবের ফোন বেজে ওঠে। অর্ণবের ইশারায় কিরণ ভেতরে প্রবেশ করলো। আর অর্ণব চলে এলো গাড়ির দরজার কাছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশের ব্যক্তি বলে,
স্যার! আপনার অনুমানই ঠিক। এবারো এর পেছনে রয়েছেন সাসপেন্ড এয়ার কমোডর রফিকউল্লাহ খান।
চলবে~~
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ অনুগ্রহ করে নেক্সট এবং নাইস বাদে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। আপনাদের মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ভীষণভাবে আশাবাদী। অগ্রিম ধন্যবাদ। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।