বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১০

0
610

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ১০
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম

পরীক্ষায় দু নম্বরই হচ্ছে। এ পরীক্ষা বয়কোট করা হোক!

কিরণ সিট থেকে বের হয়ে খাতা নিয়ে চলে গেলো সামনে। শিক্ষকদের টেবিলে গিয়ে খাতা জমা দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। নম্রভাবে শিক্ষকদের অবগত করলো,

স্যার! আমরা কষ্ট করে দিনের পর দিন পড়াশোনা করার পর চোখের সামনে কেউ বা কারা ধোঁকা করে পরীক্ষায় নাম্বার বেশি পাবে তা তো অবশ্যই সহ্য করবো না।

কিরণ ভালো ছাত্রী! ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ সকলেরই অবগত তা। ভালো শিক্ষার্থীর মুখে এমন কথা শুনে শিক্ষকগণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অাভ্যন্তরিন আলোচনায় সরে গেলেন জায়গা থেকে। একই রুমে উপস্থিত তিন্নি সিট থেকে ওঠে এলো। ইতিমধ্যে কক্ষটাও পরীক্ষার দেওয়ার পরিবেশের অনুপযোগী হয়ে দাঁড়ালো। সকলের মাঝে চাপা উত্তেজনা শুরু হলো। তিন্নি উদ্বিগ্ন হয়ে কিরণের কাছে এসে দাঁড়ায়। চোখে মুখে চিন্তার রেশ। কিরণের হুট করে এমন আরোপে তিন্নি বেশ অবাক হয়েছে। তারসাথে আশঙ্কাও বাঁধছে মনে। কিরণ অবশ্যই অযথা এতো বড় আরোপ লাগাবে না। দু হাত দিয়ে চুপি চুপি কিরণের হাত চেপে ধরে। কিরণ হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে পাশ ফিরে তাকায়। তিন্নির চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছে তিন্নি কি বলতে চাইছে। মেয়েটার হাত কাঁপছে। এ মেয়েটা এতো অল্পতেই কেনো যে ভয় পেয়ে যায় কিরণ বুঝে না। চোখের পাতা ফেলে আশ্বস্ত করলো তিন্নিকে। ঠোঁট খানিকটা তিন্নির কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

প্রশ্ন সম্ভবত ফাঁস হয়েছে।

তিন্নিও ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলো,

বুঝলি কি করে? কে বললো তোকে?

আমার সামনে ও পাশের চার ডাব্বাকে দেখছিস না? কি অবলীলায় লিখে গেছে না দেখলে বুঝবি না। মনে হো যেন প্রথম শাড়ির ছাত্র ওরা। এবং ওরা নকল করছে তা আমি খেয়াল করেছি।

নকল করছে বলেই ভেবে নিলি প্রশ্ন ফাস হয়েছে?

হ্যা! নিজেরদের মধ্যে কথা বলতে গিয়ে আমি শুনে নিয়েছি। আর ওদের কাছে ওইসব নকলের কাগজই আছে যেগুলো পরীক্ষায় এসেছে।

বুঝলি কিভাবে?

কিরণের এবার রাগ হলো। পাশে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। এটুকু বোঝতে পারা খুব কঠিন কিছু না। দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিন করে বলে,

তোর মতো গোবর পোড়া মাথা না বলে বুঝেছি। গাধী! আমি পাশে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। বুঝবো না?

ওহ্ হ্যা হ্যা!

এমন রাশভারি মুহুর্তেও কিরণের হাসি পেলো তিন্নির কথায়। মিটমিট করে হেসে পাশ ফিরতেই শিক্ষকরা কক্ষে ফিরলেন। ডিপার্টমেন্টের প্রধান এসেছেন। তিনি প্রবেশ করতেই পরীক্ষা কক্ষে এ যাবৎ সময়ের কানাঘুষা সবকিছু থেমে গেলো। পিনপতন নীরবতায় তিনি এসে দাঁড়ালেন কিরণের সামনে। কিরণ বিনীতভাবে সালাম দিলো। ডিপার্টমেন্টের প্রধান সালাম গ্রহণ করে গম্ভীর স্বরে বলল,

তুমি যে আরোপটা দিয়েছো তার গভীরতা জানো তো?

কিরণ এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত। কোনো প্রকারের কোনো সংশয় নেই। তবুও ওর বুক কাঁপছে। কারণ ও জানে এই ব্যপারটা প্রমাণ হলে অপরাধীদের বিতারিতও করা হতে পারে। কিরণ ঘাড় ঘুরিয়ে অপরাধী চারজনের দিকে তাকালো। প্রত্যেকের চোখে যেমন ভয় তেমনই আবার ক্ষোভও রয়েছে। ক্ষোভের প্রভাবে হয়তো কিরণকে মা*রতেও দুবার ভাববে না। পাতি নেতা হিসেবে আখ্যায়িত তারা। বড় বড় ছাত্রনেতাদের চামচাগিরি করে পাতি নেতাতে উপনিত হয়েছে। তাই কারো কোনো পরোয়া ওদের নেই। তাই পরীক্ষার হলে পাশে কিরণ থাকতেও অবলীলায় নিয়ম বিরোধী কাজ করতে বুক কাঁপে নি। অথবা হয়তো ভাবতে পারে নি কেউ সাহস করে ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে। কিরণ দৃষ্টি সরিয়ে আত্নবিশ্বাসের সাথে বললো,

জ্বি স্যার আমি জানি। আর আমি এটাও জানি আমার দেওয়া আরোপ শতভাগ নিশ্চিত। আমি ওদের পাশে বসেই পরীক্ষা দিয়েছি। প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারছি।

প্রমাণ আছে কোনো?

হয়তো মজবুত প্রমাণ দিতে পারবো না তবে কিছু করার মাধ্যমে অবশ্যই প্রমাণ করা যেতে পারে ওরা অপরাধ করেছে।

কি সেইটা?

স্যার ওদের চারজনকে অনুগ্রহ করে যদি সামনে আসতে বলতেন।

কিরণের অনুরোধে ওদের চারজনকে সিটের বাহিরে বার করে আনা হলো। কিরণের মুখোমুখি দাঁড়ালো রাকিব, তমাল, পিয়াস ও জসিম। কিরণ এবার পুনরায় ডিপার্টমেন্টের প্রধানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

প্রথমত ওরা নকল করেছে তা প্রমাণ করছি…

কিরণ নম্রভাবে নিজ অবস্থান থেকে সরে রাকিবের খাতা ও প্রশ্ন নিয়ে আসলো। স্যারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খাতা ও প্রশ্ন এগিয়ে দিয়ে বললো,

স্যার! এখান থেকে পরপর প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করলেই বুঝতে পারবেন ওরা নকল করেছে। ওদের উত্তর ও খাতায় লেখা উত্তরের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন। আমি নিশ্চিত ওরা পারবে না।

কিরণের কথামত সে পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো এবং প্রমাণ হলো সত্যিই তারা নকল করেছে। তাদের উত্তর মিলে যাওয়া তো দূরের কথা উত্তর করতেই সক্ষম হয় নি। কিরণের ভয় ধীরে ধীরে কমে আসছে। অপরাধীদের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

এবার প্রশ্ন ফাঁসের ব্যপারে খোলাসা প্রয়োজন। ওদের তালাশ নেওয়া হোক। নকলগুলো এখনো ওদের কাছেই রয়েছে। ওগুলো খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন প্রশ্নে যা যা এসেছে ওদের কাছে কেবলমাত্র সেই চিটগুলোই রয়েছে। প্রশ্ন পূর্বে থেকে জানা না থাকলে এতো মিল করে নকল আনা কি সম্ভব স্যার?

উপস্থিত প্রতিটি শিক্ষক কিরণের সাথে সহমত পোষণ করলো। কথামত তালাশ করতে একজন কর্মচারি আসতেই বাহির থেকে ভেসে এলো বিশাল গোলমালের আওয়াজ। মুহুর্তেই সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিছু সংখ্যক উৎসুক হয়ে উঠলো ঘটনা জানতে। কিছু সংখ্যকের মুখশ্রীতে দেখা মিললো ভয়। কিরণ কেবল দোটানায় ভ্রু কুচকে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। পরীক্ষার সময় রাজনৈতিক ঝামেলা তাদের কখনো হয় না। তবে আজ এবং এখনই হঠাৎ করে কেন? কিরণের মনে সন্দেহ জাগলো। উপস্থিত শিক্ষকগণ এ বিষয় পরে দেখবেন বলে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে পরীক্ষার এ বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করে গেলেন। তাদের পিছু পিছু ফাঁকা হয়ে গেল পুরো কক্ষ। কিরণ চোখ তুলে রাকিবদের দিকে তাকাতেই দেখলো ওদের মুখে বিজয়ের হাসি। কিরণের চিন্তিত মুখ দেখে রাকিব হেসে ওঠলো। পিশাচীয় হাসি। হাসতে হাসতে সিটে গিয়ে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশে বসে বললো,

আমাকে ফাঁসাবে তুমি? তোমার মতো চুনোপুটি? এতো সহজ নাকি?

কিরণ এবার বিষয়টা বুঝতে পারলো। ঝামেলাটা রাকিবেরই সংঘটিত। রাকিবের হাতে মোবাইল। বন্ধুক নিজের দিক থেকে সরাতে বাহিরে কারো সহায়তায় এ কাজ করলো। রাগে মাথা ধপ করে ওঠলো। রাকিবের ঠোঁটে উপহাসের হাসিটা যেন ওর রাগে আরো ঘি ঢেলে যাচ্ছে। রেগে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে তিন্নি এসে হাত চেপে চুপিচুপি বলে,

কিরণ এখন কিছু বলিস না। ওরা কতটা খারাপ তা আমরা জানি সবাই। খামোখা এখন কথা বলে ঝামেলা না বাড়িয়ে বাহিরে চল। যা করার শিক্ষকদের সাহায্যে করিস।

কিরণের বোধ হল তিন্নি ঠিক বলছে। এখানে এখন কিছু বলা মানেই ঝামেলা বেড়ে যাওয়া। শিক্ষকদের উপর যখন সমাধান ছেড়েছে তখন এটা উনারাই করবেন। এদের সাথে লাগতে যাওয়া মানে বাড়তি একটা ঝামেলায় পড়া। কিরণ তাই আর কিছু না বলে ব্যাগ সংরক্ষিত স্থান থেকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো কক্ষ থেকে। বের হওয়ার সময় পেছন থেকে রাকিব হুমকি দিয়ে বললো,

এর ফল ভোগ করতে হবে তোকে। কার বিপরীতে কথা বলেছিস হারে হারে টের পাবিইই।

তিন্নি কিরণের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বাহিরে। রাকিবের শেষের কথায় কিরণ পাত্তা না দিলেও তিন্নি বেশ ঘাবড়ে গেলো।

টানা দু ঘন্টা যাবৎ মনিটরের সামনে বসে আছে অর্ণব। আজ ওর অফিস বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কাজের জন্য বের হয়েছিলো সকাল আটটা নাগাদ । একটা গোপন কাজের সূত্রে বিশেষ এক পেন ড্রাইভ আনতে গিয়েছিলো। তারই কিছু ফলকচিত্র অনুধাবন করতে সামনে এক মনিটর নিয়ে বসে আছে গত দু ঘন্টা যাবৎ। বিশেষ কিছুর আগমনের অপেক্ষায় অপলক তাকিয়ে আছে সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে। তার মন বলছে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটেছে এই ফুটেজে। কিন্তু ধরতে পারছে না। চোখের পলকেই কিছু হয়েছে। কিন্তু ধরা পরছে না। অর্ণবের চোখ রীতিমতো লাল হয়ে যাচ্ছে তাকিয়ে থাকার ফলে। তখনই কেঁপে ওঠলো বিছানা। অর্ণব পাশ ফিরে দেখে নিলো মোবাইলটা। এখন কোনো মোবাইল ধরার মতো পরিস্থিতি তার নেই কিন্তু ফোন দাতার নাম দেখে তা উপেক্ষা করার আস্পর্ধাও সে রাখে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা তুলে কানে নিল। কোলে থেকে ল্যপটপটা নামিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে নম্র ভাবে সালাম বিনিময় করে বলে,

জ্বি বাবা! কেমন আছেন?

শাফিউদ্দিন সাহেব জামাতার নম্রতায় বরাবরই সন্তুষ্ট। তিনিও খুশ মেজাজে বললেন,

আল্লাহ রহমতে ভালো আছি তবে মেয়েকে কাছে পেলে আরো ভালো থাকা যেত। তো মেয়ের জামাই কি মেয়েকে বাবার কাছে আজ একবার পাঠাতে পারবে?

অর্ণব শ্বশুর মশাইয়ের সূক্ষ্ম খোঁচাটা বোঝতে পেরে হাসলো। কিরণের বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। চাইলেই ঘুরে আসা যায়। কিরণ বিগত কয়েকদিন অসুস্থ ছিল বলে ও বাড়িতে এক ঘন্টার জন্যও যেতে পারে নি। না পেরেছে বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেখানে কথা ছিল প্রতি দশ দিন পর শাফিউদ্দিন সাহেব তার মেয়ের দর্শন পাবেন। অর্ণবে হেসে উত্তর দিলো,

শুধু মেয়েকেই পাঠাবো নাকি মেয়ের জামাইকেও পাঠাবো?

সে তুমি পাঠালে পাঠাতেই পারো। তবে মেয়েকে আমার অবশ্য চাই।

সাতটা বছর মেয়ের থেকে দূরে রেখে এখন আবার দূরে রাখার পরিকল্পনা করছেন? এসব কিন্তু এখন না জায়েজ বাবা। আমি আর দূরে থাকছি না আপনার মেয়ের থেকে।

শাফিউদ্দিন সাহেব হেঁসে উঠলেন। দু চারটা কথা বলেই ফোন কেটে দিলো অর্ণব। অর্ণবের মস্তিকে চলছে অন্যকিছু। টেবিলে ফোন রেখে পুনরায় ল্যপটপের কাছে যাওয়ার জন্য পিছু ঘোরতেই আচমকা সরু কন্ঠে চমকে ওঠলো অর্ণব,

আব্বু আপনাকে আমার থেকে সাত বছর দূরে রেখেছে মানে কি অর্ণব?

অর্ণব পিছু ফিরলো। কিরণ ভার্সিটি থেকে এসে মাত্রই ঘরে ডুকতে যাবে তখনই এমন কথায় থমকে যায় ওর পা। চোখের আনাচ-কানাচ পরিপূর্ণ কৌতুহলে। এক অবিশ্বাস্য কৌতুহলে।

চলবে ~~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here