#বিচ্ছেদময়_সুখ — [৭]
মুনিয়া মিরাতুল নিহা
? (অন্য কোথাও পোস্ট নিষিদ্ধ)?
_________________________
কলেজ থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরতেই বাড়িতে সবার মুখে কেমন হাসি হাসি ভাব দেখা দিচ্ছে। যার কারন আমি বুঝে ওঠতে পারছি না ঠিক করে। মায়ের কাছে যেতেই দেখতে পেলাম ডাইনিং টেবিলে হরেক রকম খাবারের আয়োজন করা হয়েছে এবং মা এখন সেগুলোই পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখে মা অযথাই ব’কা শুরু করে দিয়েছে কেনো সকালে না খেয়ে কলেজে গেছি। মা’কে কি করে বোঝাবো এই মুহুর্তে আমি খাওয়া দাওয়ার মতন কোনো ইচ্ছেই নেই। মা’কে জবাব দিলো বাবা।
-‘ মেয়েটাকে আর ব’কাব’কি করো না তো। আর তো অল্প ক’টা দিনই আছে মাত্র। ‘
বাবার কথা কর্নকুহুরে যাওয়া মাত্রই অবাকের সুরে দৃষ্টিপাত করলাম বাবার দিকে। বাবার সেদিকে খেয়াল নেই সে মনোযোগ দিয়ে টিভিতে খবর দেখছেন।
-‘ অল্প ক’দিন মানে? কি বলতে চাইছো খোলসা করে বলো বাবা।’
-‘ ওহ্ হ্যাঁ তোকে তো বলাই হয়নি। শোন একটু আগে তন্ময়ের বাবা মা এসেছিলো তোর জন্য সমন্ধ নিয়ে বুঝলি? উনারা তোকে তন্ময়ের বউ করে নিতে চায়। আর আমরাও তাতে সায় দিয়ে দিয়েছি এই তো সামনের সপ্তাহে তোদের গায়ে হলুদ তারপরের দিন বিয়ে।’
বাবার কথা শুনে মা’থা’য় বা’জ পড়লো এরূপ অবস্থা! বাবার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম তার মুখে লেগে আছে আনন্দের হাসি!
-‘ কিন্তু তোমরা একবারো আমার অনুমতি নেবার প্রয়জোনবোধ করলে না কেউ?’
-‘ আরে তুই রেগে কেনো যাচ্ছিস? তুই তো সারাদিন লিপিদের বাড়িতে পড়ে থাকিস। ওর সঙ্গে থাকিস সর্বক্ষন বলতে গেলে তো তন্ময়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তো তুই ওই বাড়িতে থাকতে পারবি না? তার উপর ওদেরকে তো আমরা সবাই চিনি উনারা কীরকম মানুষ তোকে ওখানে দিতে পেরে নিশ্চিত থাকবো। ‘
-‘ হ্যাঁ রে মা, তুই দ্বিমত করিস না রাজি হয়ে যা, আমরা যে কথা দিয়ে ফেলেছি ওদের। তোর ভালো হবে যদি খারাপ হতো আমরা কি মত দিতাম বল? কাছেপিটে আছিস ইচ্ছে হলে দেখা করতে পারবো, ওনারা কতো ভালো একটা ফ্যামিলি তুই সুখী থাকবি রে মা। ‘
বাবার কথা শুনে উপরে নিজের রুমে চলে আসলাম। উনারা কি বুঝবেন আমার সুখী থাকার কারন শুধু রুহিন নামক মানুষটির কাছেই আছে! যার কাছে আমার সুখ নিবদ্ধ সেই মানুষটিতো আমাকে চায় না তার কাছে আমি কি করে বাবা মা’কে মানা করবো এই বিয়েতে? মানা করার মতন তো কোনো কারনও নেই আমার কাছে, রুহিন কি জানে তার ভাইয়ের বৌ হতে চলেছি আমি? শেষ বারের মতন তার সঙ্গে একটিবার একটু কথা বলবো। বিছানায় থেকে মোবাইল ফোনটি হাতে নিতেই রুহিনের নম্বরে কল করলাম পরপর দু তিনবার ফোন বেজে গেলো কিন্তু রুহিন রিসিভ করলো না দিত্বীয়বার দিলাম এবার রিসিভ করলো।
-‘ সেদিন বলেছিলেন আমি ভালো থাকলেই আপনি সুখী থাকবেন যদি নিজে সুখী থাকতে চান তো এক্ষুনি সামনের পার্কে চলে আসুন। ‘
রুহিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম, লাল রঙ যেটা রুহিনের অপছন্দ কিন্তু তন্ময়ের পছন্দ! সেই লাল রঙের নিজেকে সজ্জিত করলাম। লাল থ্রিপিস, মুঠো ভর্তি লাল চুড়ি, কানেও লাল রঙের দুল, সবকিছু লাল রঙের পড়ে বসে আছি পার্কের বেঞ্চে। রুহিনের অপেক্ষা করছি অবশেষে তার দেখা পেলাম। রুহিন বরাবরের মতন কালো রঙের একটা শার্ট পড়েছে। এই মানুষটা কালো রঙ ছাড়া ধূসর, বাদামি, এই রঙের জামাকাপড় পড়ে। বাকি অন্য রঙ যদিও কোনো অনুষ্ঠানে পড়েন কিন্তু ভূলেও লাল রঙ পড়তে দেখিনি কখনো তাকে কারন লাল রং নাকি তার বড্ড অপ্রিয়! অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আমার পাশে এসে বসলো। গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলাম তার দিকে ইশশ চোখ দু’টো কোঠরে ঢুকে গেছে! চেহারায় সেই উজ্জ্বল বর্নও নেই! কেমন মলিন হয়ে আছে চেহারা খানি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ক’দিন ঘুমায়নি ভালো করে, নিজের যত্ন ও নেয়নি। কিন্তু উনার নিজেকে এভাবে কষ্ট দেবার কারন কি আমি? আপাততো এসব বাদ দিয়ে একটাই কথা মা’থায় ঘুরপাক খাচ্ছে সবকিছু শেষ বললেই শেষ হয় না, ঠান্ডা মা’থা’য় আরো একবার ভাবতে হবে।
-‘ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? যদি উত্তর না হয় তবে কেনো সেদিন ওভাবে ডেকেছিলেন? কালো রং আপনার পছন্দ আর সেই কালো রঙে সবটা সজ্জিত করেছিলেন আপনি এর পরেও বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? তার উপর তিশার সঙ্গে যে মিথ্যা নাটক করেছেন সেটাও তিশা বলে দিছে আমাকে এতোকিছুর পরেও কি বলবেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন দেখি। ‘
রুহিন এবার আটকাতে পারলো না নিজেকে। মিরার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে নিজের ক’পালে ঠে’কা’লো! কান্না করে দিলো হু হু করে। মিরার আর বোঝার কিছু বাকি রইলো না। মানুষটা যে বড্ড কষ্ট পাচ্ছে মিরাকে ছাড়া সেটা তার চোখের এই অশ্রুকনাই প্রমান করে দিচ্ছে!
-‘ নিজেকে সামলাতে পারছেন না, তবু কেনো এই বিচ্ছেদ? ‘
-‘ কোনো উপায় নেই আমার কাছে মিরা! জানো সেদিন তোমাকে নিজের মের কথা বলবো বলেই সবকিছু নিজের পছন্দসই করে সাজিয়েছিলাম। যখনই বেরোচ্ছিলাম তন্ময়ের সঙ্গে কথায় কথায় জানতে পারে সে-ও তোমাকে ভালোবাসে। তারপর আমি তন্ময়কে জিগেস করি যদি আমি ভালোবাসি তোমাকে সে কি করবে? বিনিময়ে তন্ময় আমার পা দু’টো আকড়ে ধরে তোমাকে ভিক্ষে চেয়েছে আমার কাছে! যে ভাই মুখ ফুটে বলার আগেই সবকিছু ওর সামনে তুলে দিতাম আমি সেই ভাই আমার পা দু’টো ধরে তোমাকে চাইছিলো মিরা শুধু তাই নয় ও তো এও বলছিলো তোমাকে না পেলে নিজেকে শেষ করে দিবে! এবার বলো আমি বড়ো ভাই হয়ে কি করে নিজের আদরের ছোটো ভাইকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী থাকি? । তুমি হয়তো জানো না আমার মা তন্ময়ের জন্মের দুই বছর পড়েই মা’রা যায় তখন মা আমাকে বলেছিলো ভাইকে যেনো কষ্ট না দিই। তখন আমিও বেশি বড়ো নয় কিন্তু মায়ের কথা এখনো মনে আছে। মা বিশ্বাস করে আমাকে বলেছিলো কারন ভাই আমার কথা শুনতো সবসময়ই আর আমিও ভাইকে স্নেহ করতাম। মা বলেছিলো ভাইয়ের সকল আবদার পূরন করে ভাইকে যাতে সুখে রাখি। ভাইকে যেনো সঠিক মানুষ করে তুলি কারন ভাই আমার কথা শুনে বেশি। কথাগুলা বাবাকে বলতে পারেনি বাবা সেদিন ছিলো না, আমাকে বলেছিলো ভরসা করে তাই আমিই চেষ্টা করি তন্ময়কে সবটা দি সুখে রাখার। যদিও বা আমিও মাকে বেশ পাই নি কিন্তু ভাইয়ের থেকে তো বেশি পেয়েছি? যদিও বা বাবা দিত্বীয় বিয়ে করবার পরেও আম্মা আমাদের কোনো কষ্ট দেয়নি, কিন্তু আমি আমার মৃত্যুশয্যায় থাকা মা’কে যে কথা দিছি সেটা তো রাখতেই হবে! যদি তা না করি তাহলে তো মায়ের দেওয়া কথাও রাখতে পারবো না! ভাইকে কখনো কোনো রকম কষ্ট দিইনি, সবসময়ই ছায়া হয়ে সঙ্গে মিশে রয়েছি যাতে ভাইয়ের কোনো ক্ষতি না হয়। এর পরেও যদি নিজে সুখের জন্য তা-ই করি তাহলে তো এ সুখ আমার কাছে সুখ নয় যন্ত্রনা ঘেরা।’
মিরার কাছে সবটা পরিষ্কার কেনো রুহিন তন্ময়ের কথা এতোটা ভাবছে! কোনো বড়ো ভাই যে ছোটো ভাইকে এতোটা ভালোবাসতে পারে তা মিরার জানা ছিলো না।
-‘ ভাইয়ের দিকটা ভাবলেন একবারো আমার দিকটা ভাবলেন না আমি যে আপনাকে ভালোবাসি, আমার কি হবে? আমি কি করে থাকবো আপনাকে ছাড়া?’
-‘ তন্ময়ের চোখে আমি সত্যিই তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি মিরা! ও সুখে রাখবে তোমাকে। আমার স্থির বিশ্বাস তুমিও একদিন ওর মায়ায় পড়ে যাবে, ভালোবেসে ফেলবে ওকে।’
-‘ কষ্ট হবে না আপনার আমাকে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখতে? ইচ্ছে করবে না নিজেকে আমার কাছে আনতে? মন চাইবে না এই মেয়েটিকে একটিবার ছুঁয়ে দিতে!’
রুহিনের কা’টা ঘা যেনো নুন দিচ্ছে এরকম লাগছে রুহিনের কাছে! কথায় আছে ছেলেদের কাঁদতে নেই কিন্তু রুহিন এখনো সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে! থামবার নাম নেই। অবশেষে মিরা পরম যত্নে রুহিনের চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিলো।
-‘ এতোই যখন কষ্ট হয় তাহলে কেনো এরকম করছেন রুহিন? ভাইয়ের জন্য শুধু নিজের সুখ নয় আমার ভালোবাসা বির্সজন দিয়ে আমাকেও কষ্ট দিচ্ছেন আপনি!’
রুহিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখ গেলো রাস্তার দূরে থাকা তন্ময়ের দিকে। তন্ময় এখানে আসার আগেই তাকে যেতে হবে মিরার সামনে থেকে। নিজেকে নরম নয় শক্ত করতে হবে যাতে মিরা নিজ থেকেই রুহিনের কাছ থেকে সরে যায়।
-‘ কানে কথা ঢুকছে না তোর? আমি যখন বলেছি তন্ময়ের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে তো তন্ময়ের সঙ্গেই হবে! আমি আমার ভাইকে বেশি ভালোবাসি তোকে নয় তাই তন্ময়ের জন্য আমি সবটা করতে পারবো। কোনো কষ্ট হবে না আমার তোর জন্য। আমি দিব্যি তোকে ভুলে যাবো দেখিস। তোর জন্য একটুও কষ্ট হবে না আমার।’
মিরার এবার চোখের পানি বাঁধ মানলো না! এতোক্ষণ রুহিনের সামনে শক্ত করে বসেছিলো নিজেকে কিন্তু রুহিনের এরূপ কথায় আর শক্ত থাকতে পারলো না সে-ও কান্না করে দিলো। কিন্তু পরক্ষনেই কান্না থেমে গেলো আবার রুহিনের কথা শুনে!
-‘ কাঁদবি না বলে দিচ্ছি! আমি বলেছি না তোর জন্য আমার কোনো কষ্ট হবে না। আমি তোকে ছাড়া দিব্যি ভালো থাকবো। তো দেখে নিস আমি কেমন করে থাকি তেকে ছাড়া। ‘
মিরার এবার রা’গ হলো। এইতো একটু আগে সবটা স্বীকার করছিলো কিন্তু হঠাৎ করে আবার এখন এরকম ব্যাবহার? মানে লোকটা সত্যিই মিরাকে ছেড়ে দিকে চাইছে? এত্তোবার করে মিরা বারবার তার কাছে এসেছে অথচ তার কোনো মূল্যই নেই।
-‘ তো ঠিকআছে রুহিন! আমিও দেখবো এবার আপনি ঠিক কতোটা সুখে থাকেন আমাকে ছাড়া। বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন তো? এবার আর ফিরিয় দেবার জন্য ও কাউকে পাবেন না আপনি!
মিরা রাস্তা ধরে যাবার সময় তন্ময়ের সঙ্গে দেখা হলো। তন্ময়ও মিরাকে দেখে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে! মিরা ইচ্ছে করে তন্ময়ের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো যাতে দূর থেকে রুহিন সেটা দেখে। সেও বুঝুক কিরকম লাগে। হাঁটার সময় মিরা একবার পিছন ফিরে রুহিনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো অদ্ভুত ভাবে।
রুহিনও সেটা দেখে নিজেও হাসলো! এতোক্ষণ মিরাকে খেয়াল না করলেও এখন বুঝেছে মিরা লাল রঙ পড়ে এসেছে যেটা রুহিনের সবচেয়ে অপছন্দ! মিরা চলে গেলো, রুহিন সেই বেঞ্চে বসে রইলো! যতুটুকু দেখা যায় ততটুকু অব্দি দেখলো মিরাকে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! এই ব্যাবহারটা জরুরি ছিলো নয়লে মিরা যেভাবে তন্ময়ের সঙ্গে গেলো এটা যেতো না! রুহিন নিজের ভাইয়ের সুখের জন্য এতোটুকু তো করতেই পারে। যেখানে সে ভাইয়ের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত সেখানে ভালোবাসা ছাড়া তো আরো সহজ! কিন্তু নিজের কি হবে? এই অগোছালো জীবনটা গোছাতে কে আসবে আর?
#চলবে?
[ পর্ব বড়ো করে দিছি বড়ো বড়ো কমেন্ট করবেন,?পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করুন, আল্লাহকে স্মরন করুন আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।]