বামনের ঘরে চাঁদ পর্ব ১৯

0
613

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

১৯.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

ঢাকার কাছাকাছি মফস্বলে আরশিদের বাড়ি। গাছগাছালি ঘেরা সবুজের আড়ালে চারতলা বাড়ি। দোতলা বাদে বাকি সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। বাড়ির মালিক দেশের বাহিরে সেটেল্ড। বছরে, দুবছরে একবার দেশে আসা হয় তাদের। বাড়ি দেখাশোনা অন্যসব দায়িত্ব আরশিদের উপরে। বাড়ির মালিক রাজিবের ভার্সিটি জীবনের বন্ধু কি না!
সকাল থেকে প্রচন্ড ব্যস্ত আরশি। মেয়ের জন্মদিন আজ। মোটামুটি বড়সড় আয়োজন করেছে। রাজিবের কিছু কলিগ আর বিল্ডিংয়ের সবাইকে দাওয়াত করেছে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ছাদে পেন্ডেলে করেছে। ভোর থেকে খাটাখাটুনি শুরু হয়েছে। এক মুহূর্ত নিস্তার পাওয়ার জো নেই। ওইদিকে মেয়ের আরেক আবদার! তার মামনি না আসলে নতুন জামা গায়ে ছোঁয়াবে না, কেক কা/টবে না। চাঁদকে ফোন করেছে, আসছে। রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়েছে। এদিকে সাইফা তা মানতে নারাজ। মায়ের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে, গম্ভীর গলায় বলল সে,
‘ আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যা বলে তুমি জোর করে প্রতিদিন ভাত খাওয়াও । মামনি আসলে, তারপর আমি তৈরি হবো।’
আরশি মেয়ের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বয়সের তুলনায় মেয়েটি বড্ড বেশি পাকা আর চালাক। মামনির ভক্ত। মাঝেমধ্যে আরশির সন্দেহ হয়, মেয়েটা কি আসলেই তার! নাকি হাসপাতাল থেকে অন্যকারো বাচ্চা ভুলে তুলে এনেছে।
এমন সময় ডোরবেল বাজলো। দরজা খুলে চাঁদকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আরশি। বলল,
‘ বাঁচালে! ওইদিকে তোমার মেয়ে বায়না ধরেছে, মামনি না এলে গায়ে কাপড় জড়াবে না সে।’
খিলখিল করে হেসে ফেলল চাঁদ। বলল,
‘ আমার মেয়ে বড্ড বেশি জ্বা/লায় বুঝি?’
‘ হ্যাঁ, তার মামনির মতই জেদি।’
আবারও হেসে ফেলল চাঁদ। চাঁদের গলার ভাঁজ পেয়ে ঘর থেকে ছুটে এলো সাইফা। জড়িয়ে ধরে আধোআধো অভিমানী সুরে বলল,
‘ তোমাকে মিস করছিলাম মামনি।’
সাইফাকে কোলে তুলে নিলো চাঁদ। বুকে জড়িয়ে ধরে, আদুরে গলায় বলল,
‘ আমিও খুব খুব মিস করছিলাম আমার সাইফাকে।’
পাশ থেকে গিফট বক্সটা সাইফার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ তোমার বার্থডে গিফট।’
সাইফার চোখ খুশিতে চকচক করছে। তড়িঘড়ি হাতে জরি কাগজে মোড়ানো বাক্সটা খুলল। ভেতরে বারবি হাউজ দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। ঝটপট জড়িয়ে ধরে ধুপধাপ চাঁদের গালে চুমু দিয়ে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ মামনি।’
‘ মোস্ট ওয়েলকাম আমার বাচ্চাটা’
চাঁদ হেসে উত্তর দিলো। সাইফা অতি উৎসাহী মনে লাফিয়ে গিফট হাতে বাবাকে দেখাতে গেল। কাধের ব্যাগটা নামিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখলো চাঁদ। গা এলিয়ে চেয়ারে বসলো। আরশি বাদাম কুঁচি করছে, পায়েস রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক ফাঁকে চাঁদের দিকে ঠাণ্ডা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। তারপর আবার চপিং বোর্ডে ছুঁড়ি চালাতে চালাতে বলল,
‘ আসার সময় রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো? ‘
চাঁদ ক্লান্ত সুরে বলল,
‘ প্রচন্ড জ্যাম রাস্তায়। তার উপর ভাপসা গরম। লোকাল বাসের ধাক্কায় গরমে আরও ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা।’
‘ তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ এইতো চলছে, সামনে ফাইনাল।’
‘ পড়াশোনা পাশাপাশি টিউশন, খুব বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে না? পরিক্ষার এই কয়েক মাস না হয় বাড়িতে যেয়ে…
কথা কা/টলো চাঁদ। খুব সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে বলল,
‘ হলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না আপা। বরং টিউশন না করলে সময় যাচ্ছে না।’
কাজের ফাঁকে চোখ তুলে চাঁদের মুখপানে একপলক তাকালো আরশি। সে জানে চাঁদ মিথ্যা বলছে। পড়াশোনার পাশাপাশি চারটা টিউশনি করা কম কথা না। চাঁদকে সাহায্যের কথা বলে লাভ নেই। কারো সাহায্য, সহযোগিতা সে নিবে না। ভীষণ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটা মেয়ে। বাড়ি ছাড়ার পর, এ চারবছরে নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, তবুও কারো কাছে হাত পাতেনি। নিজের সমস্যা গুলো নিজেই সমাধান করেছে।

চাঁদ আশেপাশে চোখ বুলালো। বাড়িতে অনুষ্ঠান অথচ তেমন কাউকে দেখছে না। বিমূঢ় সুরে জিজ্ঞেস করল চাঁদ,
‘ এখনো তো কেউ আসেনি। অনুষ্ঠানের সময় চেঞ্জ করেছ নাকি?’
‘ মাকে ফোন করলাম। বলল, ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে যাবে। তোমার দুলাভাইয়ের কলিগ, বিল্ডিংয়ের সবাই সন্ধ্যায় আসবে।’
‘ আর সাইফার দাদু বাড়ির লোকজন?’
আরশি মলিন হাসলো। বেজার সুরে বলল,
‘ উনারা কেউ আসবে না। তাদের আমাদের মা মেয়েকে নিয়ে সমস্যা। বিয়ের পর এতবছর আমি উনাদের সমস্যা ছিলাম। এখন আমার মেয়েকে নিয়ে সমস্যা। ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো কেন? ‘
চাঁদ অবাক হলো। এ যুগের মানুষ হয়ে এতটা অসুস্থ যুক্তি ধরে বাঁচে! এখনো এমন মানুষ আছে? সাইফার জন্য চাঁদের ভীষণ খারাপ লাগলো। ছেলে মেয়ের মধ্যে ভেদাভেদ করে বি/কৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলো ফুটফুটে বাচ্চাটাকে পরিবারের আদর থেকে বঞ্চিত করছে। কোথাও যেন সাইফার সাথে নিজের জীবনের মিল পেল। সেও তো ছোট থেকে এতকাল পারিবারিক কুসংস্কারের স্বীকার হয়ে এসেছে। তফাত শুধু এইটুকু যে, সাইফার বাবা মা তাকে আগলে রেখেছে। আর অন্যদিকে চাঁদকে আগলে রাখার মত কেউ ছিল না। তার বাবা-ই তাকে চরম ঘৃ/ণা করে, তপ্ত অনলে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছে।
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল চাঁদ। বলল,
‘ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে আপা। শুধু সময়ের প্রয়োজন।’
আরশি তাচ্ছিল্য হাসলো বলল,
‘ কিছু ঠিক হবে না চাঁদ। কিছু মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তাধারা বি/ষাক্ত ভাইরাসের মত যার কোনো এন্টিডোট নেই।’

বিকালের পরপর মালা বেগম এসে পৌঁছালো।নাতনির জন্য সোনার গড়ানো চেইন উপহার এনেছে। সাথে সুন্দর লকেট। এসেই চাঁদের সাথে আড্ডা মজে গেল। সন্ধ্যার পর অতিথি আসতে শুরু করল। বেশ জাকজমকালো আয়োজনে সাইফার জন্মদিন পালন করা হলো।
আষাঢ়ের সন্ধ্যায় আসার কথা ছিল, কিছু ব্যস্ততায় আটকা পড়ে যাওয়ায়। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হবে। আপাতত রাস্তায় আছে। শোনার পর থেকে চাঁদের অস্থিরতা শুরু হলো। আষাঢ় এখানে আসবে, চাঁদ জানতো না। জানলে আরো আগে কেক কা/টার পরপর ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা হতো। যদিও আজকের রাত এখানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু বাহানা দেখিয়ে যেতে চাইলে আরশি মালা বেগম আটকালো। বাহিরের আবহাওয়া ভালো ঠেকছে না। কালবৈশাখী ঝড় নামবে হয়তো। তাদের কথার ফেরে চাঁদের কোনো যুক্তি কাজে লাগল না। সেই সাথে সাইফার কান্নাকাটি শুরু হলো। কোনো ভাবেই আজ চাঁদকে যেতে দিবে না। চাঁদের এখানে থাকতে সমস্যা নেই। কিন্তু আষাঢ়ের মুখোমুখি হতে চায় না। এত বছরের দুরত্ব মান অভিমানে দেয়াল এতটাই জোরালো হয়েছে যে, অদ্ভুত জড়তা কাজ করে এখন। চাইলেও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। ভেতরের অভিমান গুলো রাগ হয়ে বেরিয়ে আসে, দুজনের তুমুল কথা কা/টাকা/টি হয়। অনবরত যুক্তিতর্ক চলে। একটা সময় ঝগড়ার পর্যায় চলে যায়। তারপর আবার সেই জড়তা, পাঁচ মাস – ছয় মাস গা ঢাকা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখা।

ঝড়ের মাঝামাঝি আষাঢ় এসে পৌঁছালো। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা। গাড়ি থেকে বিল্ডিং অবধি আসতে আসতেই সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। কাপড় পাল্টে খাবার টেবিলে বসলো আষাঢ়। আরশি পাশে বসে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মালা বেগম অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিনের তোড়জোড়ে উনার মাথা ব্যথা করছে। আরশির চোখ ঘুমে টলমল করছে, আষাঢ় আসবে বলেই এতক্ষণ জেগে। বিদ্যুৎ নেই, লোডশেডিং হয়েছে। টেবিলের উপর চার্জার লাইট জ্বলছে। খাওয়ার ফাঁকে চোখ ঘুরিয়ে আষাঢ় আশেপাশে তাকাচ্ছে। কাউকে খুঁজছে। বিষয়টা আরশির চোখে পড়লো। মিটমিট হাসলো। আষাঢ় বেশ কায়দা করে জিজ্ঞেস করল,
‘ সবাই চলে গেছে?’
আরশি বুঝেও না বুঝার মত করে বলল,
‘ হ্যাঁ, চলে গেছে।’
আষাঢ়ের সামান্য রাগ হলো যেন। খানিক তেজি সুরেই বলল,
‘ সবাই?’
আরশি মুখ বুজে হাসি চাপলো। ভাইকে খুঁচিয়ে বলল,
‘ তুই ঠিক কার কথা জানতে চাইছিস?’
আষাঢ় উত্তর দিলো না। খানিক চুপ থেকে আরশি ভঙ্গিমা করে নিজে থেকেই বলল,
‘ তুই যার খোঁজ করছিস, সে সাইফার ঘরে। ঝড়ের মধ্যেই বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। যেতে দেইনি। কোনোরকম আটকে রেখেছি।’
আষাঢ় উত্তরে কিছু বলল না। চুপ রইল।

বাহিরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। সারাবাড়ি অন্ধকারে নিমজ্জিত। আরশি সব গুছিয়ে মাত্র নিজের ঘরে গেল। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে। সাইফার ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো আষাঢ়। ভেতরে হলদেটে রশ্মির রেশ। দরজাটা সামান্য ভিড়ানো। আলতো হাতে দরজা ঠেলল আষাঢ়। সারাঘরে চোখ বুলাতে বিছানার পাশে ঘুমন্ত চাঁদের উপর নজর আটকালো তার। খাটের মাথায় হেলান দিয়ে আধবসা হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পাশেই সাইফা ঘুমাচ্ছে। আষাঢ় ভেতরে গেল, চাঁদের পাশে যেয়ে বসলো। খোলা কেশ চোখেমুখে পড়ে আছে। পাশের টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। যার হলদেটে আলো চাঁদের মুখশ্রীতে পড়ছে। বাড়ন্ত হাতে পড়ন্ত চুল গুছিয়ে দিলো। চাঁদের ফুটন্ত গোলাপের মত সুশ্রী মুখখানা চন্দ্রের মত উজ্জ্বল ঝলমল করে উঠলো। ঘুমে ভারী, বুজে থাকা আঁখিপল্লব পিটপিট সামান্য নড়লো। অধর কোণে মিষ্টি হাসির রেশ। আষাঢ়ের বুকটা নড়ে উঠলো। হৃদপিণ্ডে উথাল-পাতাল ঝড় নামলো। অদ্ভুত এক সম্মোহন তাকে আঁকড়ে ধরলো। অস্থিরতা বাড়লো। মনের আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র হলো। চাঁদকে ছুঁয়ে দেওয়ার তৃষ্ণা বাড়লো। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছায় হাত বাড়ালো। অমনি চোখ মেলে তাকালো চাঁদ। আষাঢ়কে মুখোমুখি দেখে ধরফরিয়ে উঠলো। ছিটকে দূরে সরে বসলো। বিছানা ছেড়ে যেই সামনে পা বাড়াবে, অমনি আষাঢ় চাঁদের হাত আটকালো। টেনে এনে সামনে বসালো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ সামনে বসো একটু কথা বলবো।’
চাঁদের অস্থিরতা বাড়ছে। ঘুম থেকে জেগে আচমকা সামনে আষাঢ়কে দেখে চমকে উঠেছে। অনবরত ঘামছে, বুক কাঁপছে।আষাঢ়ের মুখপানে একবারে জন্য তাকালো না। অন্যদিকে চোখ ঘুরঘুর করছে তার। অত্যন্ত ব্যস্ত স্বরে বলল,
‘ আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার। ছাড়ুন হাত।’
আষাঢ়ের নিস্তেজ আওয়াজ,
‘ পাঁচ মাস পর হাত ধরলাম। তবুও এত অস্থিরতা? তুমি আমার বউ চাঁদ।’
চাঁদ থমকে গেল। নত চোখজোড়া তুলে আষাঢ়ের মুখপানে চাইলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। অনুভূতিপূর্ণ কঠোর চোখ। একটা সময় এই চোখজোড়া দেখার জন্য মন কাঁদতো। অথচ কি আশ্চর্য আজ ভয় করছে। মানুষটার চোখে এত অনুভূতি দেখে ভয়ে তার বুক কাঁপছে। চাঁদ নিজেকে শান্ত করল। বলল,
‘ কি চাই আপনার?’
আষাঢ় নিষ্প্রাণ আওয়াজ,
‘ আমার এই অমূল্য চাঁদ।’
‘ হারিয়ে ফেলেছেন আপনি। ম/রে গেছে ওই চাঁদ।’
আষাঢ় ঠোঁট মেলে হাসলো। বলল,
‘ এত সহজ? চার বছর হলো। আর কত? আমি আর পারছি না। তোমার বিরহে একটু একটু করে ম/রছি রোজ। এবার জেদ ছাড়ো, বাড়ি চলো?’
চাঁদের কঠিন আওয়াজ,
‘ কেন থাকবো আপনার সাথে?’
আষাঢ় নিগূঢ় তাকিয়ে। গভীর কণ্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসি চাঁদ।’
চাঁদের চোখজোড়া গোলগোল হয়ে এলো। আষাঢ় চাঁদের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আকুতি সুরে বলল,
‘ একটা সুযোগ কি আমায় দেওয়া যায় না চাঁদ?’
চাঁদের অশ্রুতে টলমল চোখজোড়া সরিয়ে নিলো। হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আষাঢ় ছাড়লো না। মুঠো আরো শক্ত করল। একটা সময় ধৈর্য্য হারা হয়ে পড়লো চাঁদ, চেঁচিয়ে উঠল,
‘ যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম তখন আপনার এই ভালোবাসা কোথায় ছিল..
পাশে বিছানায় সাইফা কেঁপে উঠলো। চাঁদ গলার আওয়াজ নামিয়ে আনলো। র/ক্তিম অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তেজি চাপা স্বরে বলল,
‘ যখন আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম তখন আপনার এই ভালোবাসা কোথায় ছিল? দেড়বছর আমার কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন আপনি? যখন অন্যকাউকে বিয়ের জন্য রুবেল শিকদারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন আপনার এই অধিকার কোথায় ছিল?’
আষাঢ় রেগে গেল। ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,
‘ আবারও সেই একই জেদ ধরছ চাঁদ? তুমি ভালো করে জানো আমি জানতাম না ওরা এমন জ/ঘন্য কাজ করবে। তোমার ভাই আমাকে ব্লাকমেইল করেছিল।’
‘ হ্যাঁ মানলাম সব। কিন্তু আমি জানতে চাই কি নিয়ে ব্লাকমেইল করেছিল। কি করণে আমার এত আকুতি মিনতির পরও আমাকে ওই ক/সাইখানায় যেতে বাধ্য করেছিলেন? ‘
আষাঢ় চুপ। ক্রোধান্বিত নিশ্বাসের শব্দ ঘর জুড়ে ঘুরঘুর করছে। আষাঢ়ের নীরবতায় তাচ্ছিল্য হাসলো চাঁদ। বলল,
‘ আপনার এ কেমন ভালোবাসা সামান্য অতীতে যেয়ে থমকে যায়। বিশ্বাস করুন, যদি আমার সাথে জড়িত না থাকতো। আমি কোনোদিন আপনার অতীত নিয়ে ঘাটতে যেতাম না। কিন্তু আমি সত্যি জানতে চাই, কি সেই কারণ? কেন আপনি ওদের সামনে এতটা বাধ্য? ‘
আষাঢ় নিশ্চুপ। চাঁদের চোখের কোণ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বলল,
‘বাড়ি ছাড়ার পর একবছর – দেড়বছর আপনি আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। যখন আপনার জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা এলো তখন আপনার মনে হলো আমাকে আপনার প্রয়োজন! কোন কালেই আমি ধন-দৌলত ঐশ্বর্য প্রেমি ছিলাম না, সর্বদাই সাদামাটা জীবন চেয়েছি। এইযে আপনার এখন অগাধ টাকা বিশ্বাস করুন এর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। আমার সব চাওয়া সেই পুরানো আপনাতে ছিল, যার জন্য আমি বিলাসী জীবন পায়ে ঠেলে এসেছি।’
এলোমেলো আষাঢ়। দৃষ্টিতে স্পষ্ট উন্মাদনা ছড়িয়ে। চাঁদের গালে হাত রাখলো আষাঢ় বোঝানোর সুরে বলল,
‘ কেন সেই অতীত টানছ? প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনো, মানছি তুমি ভালোবাসাটা প্রথমে অনুভব করেছ, কিন্তু সেই ভালোবাসার গভীরতা, য/ন্ত্রণা আমি অনুভব করেছি। প্লিজ আমার কাছে ফিরে আসো জান।’
আষাঢ়ের বলা প্রত্যেকটা কথা চাঁদের মনে গভীর দাগ টানলো। কিন্তু পেছনে ফেলে আসা দিন গুলোর ঝলক চোখে ভাসতে হাত সরিয়ে দিলো। অসার সুরে বলল,
‘ কোন অতীতের ভয়ে আপনি সেদিন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আষাঢ়? আপনার জীবনে তা কি আমার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সবসময় আপনার দ্বিধা, আপনার ভয়, আপনার কঠোর ব্যক্তিত্বের অনলে কেন আমি পু/ড়বো? হ্যাঁ আমি জানতে চাই কি ছিল সেই অতীত। যেই অবধি অতীতের সুরাহা না হচ্ছে, সেই অবধি এই দুরত্ব বাড়বে। যদি আমার জেদ ভাবেন, তবে তাই-ই। আপনার প্রতি আমার একটা না, হাজার অভিযোগ!’
চাঁদের অশ্রুসিক্ত, অগ্নিরূপী তেজি চাহনি দেখে থমকে গেল আষাঢ়। চাঁদের হাত ছেড়ে দিলো। চাঁদের কোনো অভিযোগ অযুক্তিযুক্ত নয়। প্রত্যেকটা অভিযোগ অভিমান মাখানো, যন্ত্র/ণায় ডুবানো। সেই অভিযোগের অনুতাপ কি করে সইবে এখন!
সাইফাকে বুকে জড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো চাঁদ। মাথার বালিশ শব্দহীন কান্নায় ভিজলো। আষাঢ় গেল না। সারারাত পাশে বসে নির্ঘুম রাত কাটালো। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো চাঁদ। আষাঢ় পাশে এসে শুয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো। ফিসফিস সুরে বলল,
‘ হাজার অভিমান, অভিযোগ করো। তবু্ও তুমি আমার থাকো।’

সকালে আষাঢ়কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে দেখে ছিটকে উঠলো চাঁদ। তড়িঘড়ি কোনো রকম তৈরি হয়ে, আষাঢ়ের জাগার আগে নাস্তা না করেই ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

রাতে বাড়ি ফিরে প্রত্যেক দিনের মত মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আষাঢ়। মালা বেগম ছেলের মাথা টিপে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবত উশখুশ করছে মালা বেগম। কৌতুহল চিড়ে বলল,
‘ গতরাতে মেয়েটাকে কি বলেছিস? সকালে না খেয়ে খালি মুখে বেরিয়ে গেল।’
চোখ বুজে আছে আষাঢ়। তার গম্ভীর আওয়াজ,
‘ কিছু বলিনি।সবসময়কার মত একই জেদ অতীত জানতে চায়।’
‘ বলছিস না কেন?’
আষাঢ় চোখ মেলল, অসার সুরে বলল,
‘ মা তুমি সবটা জানো। ও সবসময় বলে, আমার ব্যক্তিত্বকে ভালোবেসেছে। যখন জানবে, এই ব্যক্তিত্বের আড়ালে একজন আ/সামি আছে ও কি মানবে? ওর অভিমান সয়ে দূরে থাকতে পারবো। কিন্তু ওই দৃষ্টিতে ঘৃ/ণা দেখে আমি বাঁচতে পারবো না। ম/রে যাবো মা।’
আষাঢ়ের ছটফটানো য/ন্ত্রণা মালা বেগমের চোখে ভাসছে। ছেলের মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে, আশ্বস্ত সুরে বলল,
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মাত্র কয়েকমাস। এতদিন পড়াশোনা চলছে বলে, সময় দিয়েছি। পরিক্ষা শেষ হোক তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে চাঁদকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবো।’
মায়ের কথায় আশ্বস্ত হলো না আষাঢ়। সে জানে সবকিছু এত সহজ না। এইযে এই জটিল পরিস্থিতি এর অনেকটা তার কিছু ভুলের জন্য।

চলবে……

সবার কিছু প্রশ্নের উত্তর,

চার বছর অনেকটা সময় এর মধ্যেও কি চাঁদের ভুল ভাঙেনি?

– বাড়ি ছাড়ার পর আষাঢ় প্রথম এক-দেড় বছর চাঁদের সাথে সরাসরি কোনো যোগাযোগ রাখেনি। এতে চাঁদের অভিমান আরো জোড়ালো হয়েছে। যখন আষাঢ় বুঝাতে এসেছে, তখন চাঁদ নরম স্বভাব ছেড়ে অনেকটা শক্ত হয়ে এসেছে। ওর এই জেদ কাঠিন্য অযুক্তিযুক্ত নয়।

আষাঢ় চারবছরে কিভাবে দেশবিদেশে যাওয়ার মত এত বড়লোক হলো?

– যদি আমরা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ব্যপারটা কাছ থেকে দেখি এখানে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করাটা খুব বেশি কঠিন না। যদিও করোনার পর এখন অনেকটাই ডাউন হয়ে গেছে।কিন্তু দেশের বাহিরে আমাদের দেশের পোশাক GU, ZARA, Uniqlo নামিদামি জনপ্রিয় ব্যান্ড গুলোতে দেখেছি। যদি অর্থ আর ইনভেস্টমেন্ট ঠিক থাকে তাহলে চারবছর কেন, উঠার জন্য এক দেড়বছরই যথেষ্ট। বাস্তবে আমার নিজের চেনাজানা অনেক আছে। গল্পের প্রথম থেকেই বলা হয়েছিল যে আষাঢ়ের কারখানায় বড় অর্ডার আসলেও যথেষ্ট অর্থ না থাকায় ডিল গুলো হয়ে উঠতো না। তাঁতিবাজারে বাড়ি বিক্রি করে। বাজারের বাড়ি সহ জমি বিক্রি মোটামুটি ভালো অর্থ পাওয়া যায়। যার পুরো টাকা কারখানায় খাটায়। লাভবান হয়। যেই কোম্পানির সাথে ডিল হয়, পরবর্তীতে সেই কোম্পানির একজন মালিক নিজের শেয়ার বিক্রি করলে আষাঢ় তা কিনে নেয়। মোটামুটি বড় পরিমাণের অর্থ লাগে এটা ব্যবসায়ীক ঋণ থেকে নেয়। আর রইল দেশবিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটা, বিদেশে বায়াররা যখন কোনো কোম্পানির সাথে ডিল করে, তখন তাদের কাজের গতি, আসলেই তাদের দেশে কোনো কোম্পানির আছে কিনা, আরো নানারকম খোঁজখবর নিতে কোম্পানি থেকে লোক বাহিরের দেশে যায়। যার পুরো খরচটা কোম্পানি বহন করে। আর যেহেতু আষাঢ় তার কারখানা আর অন্য একটা কোম্পানির মালিকানায় জড়িয়ে সুতরাং একটা গাড়ি, বসবাস করার মত বিশাল না হোক ছোটখাটো মোটামুটি বিলাসবহুল বাড়ি এফোর্ট করতে পারাটা স্বাভাবিক। চারবছরে বড়লোক হওয়াটা অসম্ভব না যদি পরিশ্রম আর অর্থ থাকে। কথায় আছে টাকায় টাকা বাড়ে।

আর পৃথার ব্যাপারটা আমি এখনি খোলাসা করবো না। তবে একজন মানুষের সবদিন ভালো হবে এমন না। ভুল বোঝাবুঝি থাকতেই পারে।

সবকিছু গল্পে ক্লিয়ার হবে। হয়তো এভাবে সরাসরি ক্লিয়ার করা যাবে না। তাই পাঠকের বিভ্রান্তি দূর করতে লেখা।

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আজ রিচেক করা হয়নি। আর দুইদিন ব্যস্ত ছিলাম তাই গল্প দিতে পারিনি। সরি।

টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here