বামনের ঘরে চাঁদ পর্ব ১৮

0
597

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

১৮.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

পহেলা বৈশাখ। সারা বাংলা লাল সাদায় মুখরিত। নানা রঙে সজ্জিত জাহাঙ্গীরনগর। চারিদিকে হাজার হাজার লোক। মুক্তমঞ্ছে অনুষ্ঠান চলছে। যা দেখতে সকলে ভীড় ঠেলছে। আশেপাশে নানারকম স্টল বসেছে। উঁচু আওয়াজে গান বাজছে। ছোট নিশ্বাস ফেলল আষাঢ়। সে জানে তার চাঁদ এখানে নেই। এই ভীড়, গান বাজনার উঁচু আওয়াজ তার পছন্দ না। নির্জন নিরিবিলি কোথাও আড্ডায় মজে আছে নিশ্চয়ই। গাড়ি বটের মোড়ের দিকে ঢুকতেই, বটতলায় উঁচু বটের পাশে মোটা গাছটার গোড়ায় তাকাতে আষাঢ় থমকে গেল। চোখজোড়া সেইদিকটায় আটকে রইল। নিমজ্জিত সুরে বলল,

‘ গাড়ি থামাও।

রাস্তার কিনারা ঘেঁষে গাড়ি থামালো ড্রাইভার। নীল শাড়ি পরিহিত, দুই পা তুলে গাছের গোড়ায় বসে আছে চাঁদ। হাতে চায়ের মটকা, খোলা কেশ, কানের কাছে চুলের ভাঁজে সাদা কাঠগোলাপ। রাতের বিশাল আকাশে হাজার নক্ষত্রের ভিড়ে যেমন নজরকারা চাঁদ। তেমনি হাজার হাজার লোকের ভিড়ে আষাঢ়ের অমূল্য চাঁদ। যার স্নিগ্ধতা, হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চন্দ্রসুধা থেকেও উজ্জ্বল, মনোরম। মাটির মটকায় ঠোঁট ছুঁয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে চাঁদ। মাঝেমধ্যে খিলখিল করে হেসে বান্ধবীর গায়ে এসে ঠেকছে। আষাঢ়ের প্রচন্ডরকম অভিমান হলো। বাচ্চাদের মত কপাল কুঁচকে ফিসফিস স্বরে বলল,

‘ বাহ্ চমৎকার! আমার হৃদপিণ্ডের বারবিকিউ করে, এখানে হেসে হেসে গরম চা খাওয়া হচ্ছে।’

আষাঢ়ের কথা কি আদৌ চাঁদের মনে পড়ে? মনে পড়ে কি কা/টানো সেই মুহূর্ত গুলো! বুক চিড়ে বিষণ্ণতার নিশ্বাস ফেলল।
চাঁদকে কাছে থেকে দেখার, দমকা হাওয়ায় তার চোখেমুখে পড়ন্ত অগোছালো কেশ গুছিয়ে দিতে, এক তীব্র ইচ্ছা জাগলো। গাড়ির দরজা খুলে যেতে চাইলো একবার । পরক্ষণেই বিবেক বাঁধা দিলো। তাকে দেখলে চাঁদের চোখমুখ বিষণ্ণতায় ডুবে যাবে। এই সুন্দর, ভুবন ভুলানো হাসিটা মিলিয়ে যাবে। তারচে বরং সে দূরে থাক। কাছে যাওয়ার কি দরকার! দ/হন পুষে হৃদয় না হয় বিরহের গীত গাক। কালো কাচের জানালার আড়াল হতে নিমিষ তাকিয়ে রইল আষাঢ়। আজ কতদিন পর দেখছে? বারোদিন!
ছোট নিশ্বাস ফেলল, জানালার কাচের উপরে হাত ছুঁয়ে নিমিষ সুরে বলল,

‘ তোমাকে ছোঁয়ার অপেক্ষায় আমি দিনরাত পু/ড়ছি চাঁদ। কবে এই দুরত্ব কমবে? কবে তুমি আবারও আমার হবে?’

রাত সাড়ে দশটা বাজতে চলছে। ঘুম ভর্তি টলমল চোখ নিয়ে মালা বেগম ছেলের পাশে বসে। প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। আজকাল বড্ড বেশি ঘুম পায়, ঘড়ির কা/টা নয়টা পাড় হলেই অন্ধকার নামে চোখের পাতায়। বয়স বাড়ছে হয়তো এটাই সেই ছাপ।

অনেকক্ষণ যাবৎ একটা কথা জিজ্ঞেস করবে, কি করবে না ভেবে উশখুশ করছে মালা বেগম। কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না আর। নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল,
‘ তোর ফ্লাইট দুইটায় ল্যান্ড করেছে, বাড়ি ফিরলি সাড়ে নয়টায়। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’
সুক্ষ্মভাবে চোখ লুকিয়ে নিলো আষাঢ়। বেশ স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,
‘ ফ্লাইট দেরিতে পৌঁছেছে, ট্রানজিটে সময় নিয়েছে।’

সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো মালা বেগম। ছেলের কথাটা যেন বিশ্বাস হলো না। ভারী কণ্ঠে আওড়াল,
‘ দুইটার সময় ফোন করলাম, ড্রাইভার তো বলল, ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে।’
খানিকক্ষণ চুপ আষাঢ় উত্তর দিলো,
‘ অফিসে গিয়েছিলাম।’
‘ এত ঘণ্টা জার্নি করে, দূরদেশ থেকে ফিরে সাথে সাথেই অফিসে যেতে গেলি কেন? সেখানে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?’
মালা বেগমের কণ্ঠে স্পষ্ট চিন্তার ভাঁজ। মাকে আস্বস্ত করলো আষাঢ়, বোঝানোর কণ্ঠে বলল,
‘ চিন্তার কারণ নেই। তেমন কিছু না মা। একটু জরুরী কাজ পড়েছিলো।’
ছেলের কথায় শান্ত হলো মালা বেগম। খানিক চুপ থেকে বলল,
‘ আগামীকাল আরশির মেয়ের জন্মদিন। সকাল থেকে সাইফা কয়েকবার ফোন করেছে। বারবার বলছে, মামাকে সাথে নিয়ে আসবে। তোর কি কাল সময় হবে?’
আষাঢ় ব্যস্ত অকপট কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘ মা, সবে দেশে ফিরেছি। আগামীকাল একটা মিটিং আছে। কখন শেষ হবে ঠিক বলতে পারছি না। তুমি চলে যেও।’

মালা বেগম হতাশ নিশ্বাস ফেলল। ছোট থেকে ছেলেটার এমন কাঠখোট্টা, পানশে স্বভাব। এই কয়েকবছরে সেইসব স্বভাব যেন আরও গাঢ়রূপ নিয়েছে। অনুভূতিহীন পাথর হয়ে গেছে। সারাক্ষণ শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। কিন্তু এই পাথরেরও যে একটা দুর্বলতা আছে! মালা বেগম তা বেশ ভালো করেই জানে।
তিনি ইনিয়েবিনিয়ে কায়দা করে বললেন,
‘ ঠিক আছে, আগামীকাল যেহেতু তুই ব্যস্ত আমি চাঁদকে বলবো, যাওয়ার সময় যেন এদিক দিয়ে আমাকে সাথে নিয়ে যায়।’
চাঁদ যাবে শুনে আষাঢ়ের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো। একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ রাতের অনুষ্ঠান? কয়টা থেকে আরম্ভ হবে?’
মালা বেগমের সোজাসাপ্টা জবাব,
‘ সন্ধ্যায়, সাতটার পর।’
একটু নীরব থেকে আষাঢ় মিনমিন করে বলল,
‘ দেখি, যদি ব্যস্ততার ফাঁকে সময় বের করতে পারি আসবো।’

মালা বেগম মলিন হাসলো। তিনি জানেন আষাঢ় আগামীকাল অবশ্যই যাবে। ছেলের অস্থিরতা, ব্যাকুলতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে অবগত তিনি। চাঁদ যে আষাঢ়ের একমাত্র দুর্বলতা তা বেশ ভালো করে জানে। কিন্তু সবকিছু জানার পরও তিনি নিরুপায়। না ছেলের জন্য কিছু করতে পারছে, না তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে পারছে। এমন নয়, তিনি চেষ্টা করেননি। এই চারবছরে নানারকম ভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাঁদের জেদ, শর্তের সামনে বরাবর বাঁধা পড়ে গেছে। চাঁদকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনার সময় কথা দিয়েছিলো, তার নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তে কখনো বাঁধা দিবেনা। সেই ওয়াদায় আজও আবদ্ধ।
অন্যদিকে আষাঢ় চাঁদের উপর কোনো প্রকার জোর খাটাতে চায় না। সে বিশ্বাস করে জোর খাটিয়ে কারো মনে জায়গা করা যায় না। সম্পর্কটা যেমন করে চলছে, চলতে দিচ্ছে, অনুতপ্ততার দ/হনে সে আজও পুড়ছে। না চাঁদকে নিজের কাছে রাখতে পারছে। না ছেড়ে দিতে পারছে।
ওদের সম্পর্কটা ভীষণ কমপ্লিকেটেড। পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক থাকে, যেসব সম্পর্কের নিদিষ্ট কোনো নিয়ম নীতি নেই। ছন্নছাড়া ভিন্নরকম। তবুও যেন এক সুতায় গাঁথা থাকে। চাঁদ আষাঢ়ের সম্পর্কটাও এমন। তাদের জটিল সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ঢুকতে চায় না মালা বেগম। স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির তদারকিতে কোনো কালেই কল্যাণকর কিছু হয়নি। বরং হিতের বিপরীত হয়। গোছানোর বদলে, ঘেটে যায়। তারচেয়ে বরং সময়ের উপর সবটা ছেড়ে দিলেই ভালো। কিছু সম্পর্কের পরামর্শ না সময়ের প্রয়োজন।

রাতের খাবার শেষ করে নিজের ঘরে এলো আষাঢ়। বিশাল বিলাসবহুল কামরা। প্রাচুর্য বিলাসিতার কোনো প্রকার কমতি নেই। তবুও যেন বৃথা সব। ঘরণী শূন্য ঘর। যার শূণ্যতা এই ঘরের প্রত্যেক দেয়ালে দেয়ালে বাঁধাই করা। চাঁদের স্মৃতি থেকে বাঁচতে দিনের বেলা কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও, আঁধার নামতেই এলোমেলো হয়ে যায় সব। সকল ব্যথার মত, বুকের ব্যথাটাও বেড়ে যায়। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। পুরানো স্মৃতি চাঁদের সাথে কা/টানো সব মুহূর্ত অগোছালো ক্ষিপ্ত করে তোলে তাকে। নিজের করা পেছনের ভুল গুলোর কথা মনে করে অনুতপ্ততার আগুনে রোজ জ্বলে।

বারান্দায় এলোমেলো হাঁটছে আষাঢ়। হাতে একের পর এক জ্বলন্ত সিগারেট। বিকালে চাঁদকে দেখার পর থেকে ভীষণ অশান্ত, উত্তেজিত সে। চাঁদকে প্রচন্ডরকম মনে পড়ছে। তার একটুখানি গলার আওয়াজ শুনতে হৃদয় ছটফট করছে। ব্যকুল হয়ে পড়েছে। বারবার ফোন হাতে তুলে আবার রেখে দিচ্ছে। ফোন দিবে কি দিবে না বিভ্রান্তিতে ভুগছে। হ্ঠাৎ পায়চারি থামলো। কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়া, অগোছালো হাতে মোবাইলটা বের করল। চাঁদের নাম্বারে ফোন দিলো। দুইবার বাজতেই ফোন তুলল চাঁদ। অপর পাশ হতে মিষ্টি, সুমধুর আওয়াজ ভেসে এলো,
‘ হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম।’
চাঁদের মধুর সরু আওয়াজটা যেন আষাঢ়ের বুকে তীরের মত বিঁধল। চোখ বুজে প্রশান্তির ভারী নিশ্বাস ফেলল। পৃথিবীর সব সুখ, শান্তি যেন এই দুই বাক্যে মেশানো। কারো প্রতি ঠিক কতটা ব্যাকুল হলে, একটুখানি আওয়াজ শোনার জন্য এতটা ছটফট করে কেউ!
অপর পাশ হতে চাঁদের ক্রো/ধান্বিত আওয়াজে আষাঢ়ের হুঁশ ফিরল। বারবার ডাকছে চাঁদ। বলছে,
‘ কে আপনি? ফোন করে কথা বলছেন না কেন! আশ্চর্য!’
আষাঢ় একটু চুপ থেকে অসার কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যালো! আমি..’
বোধহয় চাঁদ আওয়াজটা ধরতে পারলো। খানিকক্ষণ নীরব থেকে সাথে সাথে ফোনটা কে/টে দিলো। আষাঢ় হতাশ নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এই নাম্বারটাও ব্লকলিস্টে ফেলে দিয়েছে চাঁদ।

চাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়। অনবরত ভারী-ভারী শ্বাস ফেলছে। নিজেকে শান্ত করল। ‘কিছু হয়নি’ বলে মনকে বুঝালো। ফোনটা টেবিলের উপরে রেখে, বিছানার কাছে যেয়ে অগোছালো শাড়িটা, গোছাতে হাত দিলো। পাশ থেকে তটিনী উঁকি দিলো। চাঁদের চিন্তিত মুখখানা দেখে বলল,
‘ কি হয়েছে আফা? কে ফোন করেছিলো?’
চাঁদ শাড়ি ভাঁজ করতে করতে উত্তর দিলো,
‘ অপরিচিত, রং নাম্বার।’
তটিনী পা ঝুলিয়ে চাঁদের বিছানায় বসলো। বেখেয়ালি স্বরে বলল,
‘ তোমার মোবাইলে অনেক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে আপা। নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলো।’
চাঁদ কপাল কুঁচকে বলল,
‘ উপায় নেই। টিউশনে সবার কাছে এই নাম্বার আছে। অনেক পরিচিত কন্ট্রাক্ট আছে। নাম্বার পাল্টালে বিভ্রান্তি বাঁধবে।’
তটিনী সায় দিলো। খানিক চুপ থেকে বলল,
‘ আগামীকাল আমাদের সাথে ডে ট্যুরে যাচ্ছো না? শুনো আপা আমরা কিন্তু সকাল সকাল সবার আগে বেরিয়ে বাসের সামনের সিটে বসবো। কি পরবে কাল? শাড়ি নাকি….’
চাঁদ কথা কা/টলো বলল,
‘ আমি কাল তোদের সাথে ডে ট্যুরে যাচ্ছি না।’
তটিনী হকচকিয়ে উঠলো। বলল,
‘ যাচ্ছ না মানে? কেন যাচ্ছ না। তোমাকে ছাড়া ঘুরাঘুরি ভালো লাগে না। চলো না আপা, প্লিজ।’
চাঁদ মৃদু হাসলো। বলল,
‘ কাল সাইফার জন্মদিন। যেতেই হবে, না গেলে কেক কা/টবে না হুম/কি দিয়েছে।’
তটিনীর মন খারাপ হলো। বলল,
‘ আর মাত্র কয়েকটা মাস তারপর তো ওদের সাথেই থাকবে।’
‘ ওদের সাথে থাকবো তোকে কে বলল? ‘
‘ ওমা! ভার্সিটির পর বাড়িতে থাকবে না! আচ্ছা, আপা তোমার পরিবারে কে কে আছে? তুমি কখনো বাড়ির কথা বলো না।’
‘ আমার পরিবারে মা, আরশি আপা, রাজিব ভাই, সাইফা, পৃথা ভাবি আর…
চাঁদ থেমে গেল। তটিনী ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আর?’
নিশ্বাস চিড়ে বলল চাঁদ,
‘ আর কেউ নেই।’
‘ পাশাপাশি শহরে থেকেও, পরিবারের সাথে থাকতে না পারাটা ভীষণ কষ্টের তাই না আপা?’
চাঁদ ঠোঁট মেলে হাসলো। উদাসীন কণ্ঠে বলল,
‘ উহু, পৃথিবীতে মন মস্তিষ্কের যুদ্ধে ফেঁসে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।’
তটিনী চাঁদের কথার অর্থ বুঝল না। ফ্যালফ্যাল চেয়ে রইল। চাঁদ আপা প্রায়শই এমন অদ্ভুত কথা বলে। যার মানে তটিনী বুঝে উঠতে পারে না।

চলবে……

🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here