বামনের ঘরে চাঁদ পর্ব ১৭।

0
601

বামনের ঘরে চাঁদ

সাজিয়ানা মুনির

১৭.

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )

সাইকোলজি বলে, যে মানুষ নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে পারে, আঘা/ত পেলে সে মানুষ অবিশ্বাস্য ঘৃ/ণা করতে জানে। চাঁদের ক্ষেত্রেও যেন তাই! একপাক্ষিক ভালোবাসার টানে ঐশ্বর্য ঘেরা বিলাসী জীবন ছেড়ে, আষাঢ়ের ছোট্ট টিনের চালের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলো। বাপভাইদের সাথে ঘোর বিরোধিতা করে, অনেক যুক্তিতর্ক নানারকম নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে আষাঢ়ের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ভেবেছিল, দুজনের মধ্যে হয়তো দ্বিধাদ্বন্দের জন্য দূরত্ব। সময়ের সাথে ধীরেধীরে এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হবে। কিন্তু চাঁদ ভুল ছিল। আষাঢ়ের মতো এমন কঠোর ব্যক্তিত্বের হৃদয়হীন মানুষের মনে কখনো কেউ জায়গা করতে পারে না।
বিয়ের পর খুব অল্প সময়েই চাঁদ নিজেকে এখানকার পরিবেশ, জীবনযাপনের সাথে পুরোপুরি ভাবে মানিয়ে নিয়েছে। যদিও তার জন্য সহজ ছিল না। ছোট থেকে বিলাসিতায় বেড়ে উঠা চাঁদের জীবনে আচমকা মোর ঘুরানো পরিবর্তন! এমন সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া মোটেও তার জন্য সহজ ছিল না। পদেপদে নানারকম অসুবিধা, বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত করেনি মেয়েটি। চুপচাপ অভিযোগহীন সহ্য করে গেছে সব। নিজের একপাক্ষিক ভালোবাসার সামনে অন্ধ হয়ে পড়েছিল। আষাঢ়ের দায়িত্ব গুলোকে তার ভালোবাসা ধরে নিয়েছিলো। দুচোখ জোড়ায় আশার স্বপ্ন মেলে বসে ছিলো। ভাবেছিলো, কোনো একদিন দ্বিধার দেয়াল ডিঙিয়ে, আষাঢ় তাকে আপন করে নিবে। কিন্তু চাঁদ ভুল ছিল। আষাঢ় কোনোদিন তাকে একমুহূর্তের জন্য ভালোবাসেনি। সবটাই ছিল তার কঠোর স্বভাবের দায়িত্ববোধ। যাকে চাঁদ ভালোবাসা মনে করেছিল। আষাঢ়ের কাছে নিশ্চয়ই চাঁদ ভীষণ বিরক্তির ছিল, তাইতো খুব সহজে নির্দ্বিধায়, নিসংকোচ দূরে ঠেলে দিলো। চাঁদের হাজারো আহাজারির পর তাকে জোর করে ভাইদের সাথে বাড়ি পাঠালো। নিজের স্ত্রীর বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগলো। শুধুমাত্র এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে, নিম্নতম জ/ঘন্যরকম ট্রিকস ব্যবহার করলো। তার সাথে এতবড় অ/ন্যায় প্রতা/রণা করার আগে বিন্দুমাত্র বুক কাঁপলো না আষাঢ়ের? এতই যখন বিরক্ত ছিল, চাঁদকে একবার ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতো, সে নিজেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। যেখানে তার ভালোবাসার কদর নেই। আর যাই হোক সেখানে অন্তত বসত হবে না তার। মালা বেগমের জোরাজোরিতে বাড়িতে উঠলেও, আষাঢ়ের সাথে চাঁদের বিশাল দুরত্ব।যা সবার চোখে লাগার মত। চাঁদের আচার-আচরণে বিশাল পরিবর্তন। এতবড় একটা ধাক্কা মেয়েটিকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে। যেই আষাঢ়ের জন্য একদিন সবকিছু ছেড়ে এসেছে, তাকেই বেশ সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে চলছে। প্রচন্ডরকম আঘা/তে পেলে বোধহয় মানুষ এমন করে বদলে যায়!

আষাঢ় চাঁদের সাথে একটু কথা বলার জন্য নানারকম চেষ্টা করে চলছে, পারছে না। চাঁদ যেন চোখকান বুজে নিয়েছে। চাঁদের কাঠখোট্টা রূপটা যে এত কঠিন হবে তা কারো ধারণাও ছিলো না।
এই অসুস্থ শরীর নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে ভর্তির সকল কাজ সেরে নিয়েছে চাঁদ। এখানে আষাঢ়ের আশেপাশে থাকা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। একই ছাদের নিচে থেকে বারবার মানুষটার মুখোমুখি হওয়া, পুরানো সকল স্মৃতি মনে পড়া, সবকিছু মিলিয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোরকম এই পরিস্থিতি, আষাঢ় থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে।
এখন মোটামুটি সুস্থ চাঁদ। খুব শীঘ্রই ক্লাস শুরু হবে। আপাতত শেখহাসিনা হলের গণরুমে উঠবে। তারপর আস্তেধীরে রুম পেলে সেখানে শিফট হবে। মালা বেগম সাথে থেকে সেখানে যাবতীয় যা কিছু লাগবে সব কিনে দিয়েছে। চাঁদের হাজার বারণ করার পরও তিনি শুনেননি।

আগামীকাল জাহাঙ্গীরনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আষাঢ় এখনো বাড়ি ফিরেনি। হাতে যথেষ্ট সময় আছে, এই সুযোগে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিবে চাঁদ। অনেকদিন পর আষাঢ়ের ঘরে ঢুকল আজ। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাতে বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। বিয়ের পর এই ঘরেই প্রথম সংসার বেঁধেছিল। চোখে হাজার স্বপ্ন নিয়ে বর্ষণের সেই আঁধার ঢাকা রাতে এই বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিল আষাঢ়ের। চুপিচুপি মনের মাঝে হাজারো স্বপ্ন বুনে নিয়েছিল নিভৃত যতনে। সেই স্বপ্ন একদিন এভাবে ভাঙবে, বাস্তবতা এতটা ভ/য়ানক হবে জানা ছিলো না চাঁদের। চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এলো। বুক চিড়ে ভারী নিশ্বাস ফেলল। চাঁদ জানে, এ বাড়িতে আর কোনো দিন ফিরে আসা হবে না তার। আগামীকাল চিরদিনের জন্য বিদায় জানাবে এই বাড়িকে। অনেক তো হলো, ভালোবাসার খোঁজে আর কতবার ঠকবে, প্রতা/রিত হবে! চাই না আর কারো ভালোবাসা। চাই না কোনো আপনজন। সকল পিছুটান ছাড়িয়ে একান্ত নিজের জন্য বাঁচবে। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছে নিলো চাঁদ। দ্রুত হাতে ব্যাগ গোছাতে লাগলো।
অমনি ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। চোখ উঁচিয়ে এক পলক তাকালো চাঁদ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আষাঢ়। র/ক্তিম দৃষ্টি, শক্ত চোয়াল তার। চাঁদ চোখ নামিয়ে নিলো, ব্যাগের চেইন আটকে আষাঢ়কে না দেখার মত পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে। আচমকা আষাঢ় চাঁদের হাত চেপে ধরলো। হাত ছাড়াতে চাইলো চাঁদ। আষাঢ় ছাড়লো না। সামনে এনে দাঁড় করালো শক্ত করে চেপে আরো কাছে টেনে, চাঁদের দিক ঝুঁকে, কঠিন গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো।’
আষাঢ়ের দিকে না তাকিয়ে, হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল চাঁদ,
‘ আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার। ছাড়ুন হাত।’
আষাঢ় ভারী আওয়াজ করে বলল,
‘ চাঁদ! আমার কথাটা একবার শুনো।’
চাঁদ শুনলো না। হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে সে। আষাঢ় এবার রেগে গেল। এই কয়েক দিনে অনেকবার চাঁদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাঁদের রাগ, জেদ বরাবরই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকবার আষাঢ়কে এড়িয়ে গেছে। আর পারছে না ধৈর্য্য ধরে রাখতে। আষাঢ় বেশ ভালো করে জানে আগামীকাল চাঁদ বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে গেলে, এই বাড়িতে সহজে ফিরে আসতে চাইবে না আর। না চাঁদকে আটকাতে পারছে, না নিজের কাছে ধরে রাখতে পারছে আষাঢ় । কি করে আটকাবে? চাঁদের স্বপ্ন পূরণের কথা দিয়েছে যে। কিন্তু আজকের রাতটা চাঁদকে নিজের কাছে আটকে বোঝানোর একটা সুযোগ আছে।
হাত টেনে চাঁদকে বিছানায় বসিয়ে তার মুখোমুখি বসলো আষাঢ়। চাঁদের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিতে চাইলে, চাঁদ নিজেকে গুটিয়ে নিলো। চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আষাঢ় কষ্ট পেল, প্রকাশ করল না। বেশ স্বাভাবিক ভাবে চাঁদকে বুঝাতে চেষ্টা করল। বলল,
‘ চাঁদ আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে। তোমার রাগ, জেদ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রত্যেকের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। তুমি তোমার দৃষ্টি থেকে দেখেছ। তোমার কাছে আমি অপ/রাধী। আমি মানলাম। একবার আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবো। তোমার কি আদৌ মনে হয়, আমি অন্যকারো সাথে তোমার বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারি? এতটাই কি নিষ্ঠুর, নিম্ন চরিত্রের আমি?’
চাঁদ ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
‘ যেই মানুষটা আমাকে প্রথম থেকে এড়িয়ে চলছে, সম্পর্ক ছিন্ন করে বারবার বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে, স্ত্রী মানা তো দূর আপনজন ভাবতে দ্বিধাবোধ করেছে, আমার হাজার আহাজারি কান্না, নিষেধের পরও আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করেছে! আমার দৃষ্টিকোণ থেকে সে নিম্ন চরিত্রের না হলেও, অবশ্যই নিষ্ঠুর হৃদয়হীন মানুষ।’
আষাঢ় চুপ। চাঁদ আবার বলল,
‘ প্রথম থেকে এই সম্পর্ক আমি একাই বয়ে বেড়িয়েছি। আপনি ছিলেন না কোথাও। আমার রাগ, অভিমান, অভিযোগ কোনো দিন কোনো কিছুর পরোয়া ছিল না আপনার। শুধুমাত্র আপনাকে পাওয়ার আশায় আমি রোজ নিজেকে একটু একটু করে জ্বা/লিয়েছি। অধৈর্য আমি প্রতিমুহূর্ত ধৈর্যের বাঁধ বেঁধেছি। কিন্তু আপনি খুব সহজেই সেই বাঁধ ভে/ঙে দিয়েছেন আষাঢ়। আপনার যুক্তিতে আমি ছোট, আমাকে কাছে টানা নিষেধ।আমার ভালোবাসা আবেগ। তো আমি মেনে নিলাম। সবকিছু আমার ছেলেমানুষী আবেগ ছিল। আগামীকাল এখান থেকে চিরকালের জন্য চলে যাবো। খুব শীঘ্রই লিগ্যাল সেপারেশনের পেপার পাঠাবো। তবে হ্যাঁ, একটা আবদার মা আপার উপর সবসময় বরাবর অধিকার থাকবে আমার।’

কি সহজে কঠিন ধা/রালো কথা গুলো মেয়েটি স্বাভাবিক স্বরে বলে যাচ্ছে। আষাঢ়ের পাথর সম হৃদয়ে ভালোবাসার আবেশ জড়িয়ে এত সহজেই সব শেষ করে চলে যাবে চাঁদ! না কখনোই না। শান্ত বুঝদার মানুষ যখন অধৈর্য হয়ে পড়ে, ভয় আকুতি যখন হৃদয় জড়িয়ে নেয়, আদর্শ মূল্যবোধ তখন বিলীন হয়। ব্যক্তিত্বের বিপরীত আচরণে প্রভাবিত হয়।
আষাঢ় ক্ষে/পে উঠলো। চাঁদের কোমর টেনে নিজের সাথে মিলিয়ে নিলো। আজ তার নীতি, আদর্শ, কঠিনত্ব সব খোলস ছেড়েছে। এভাবে চাঁদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ছেড়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না। মাথায় র/ক্ত চড়ে উঠেছে যেকোনো মূল্যেই হোক চাঁদকে নিজের করবে। তার উন্মত্ত চোখমুখে পাগলাটে ভাব। রাগী কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ আমি তোমাকে চাইনি তুমি আমার জীবনে এসেছিলে চাঁদ। এখন যখন আমি তোমাকে নিজের কাছে রাখতে চাইছি, ভালোবেসে ফেলেছি সব ছেড়ে চলে যেতে চাইছ তুমি! এভাবে সব শেষ হয় না। তোমার অল্প বয়স আবেগের কথা চিন্তা করে, সময় দিয়েছি, যদি তা আমার নিষ্ঠু/রতা হয়। তাহলে ঠিক আছে তুমি যা চাও তাই হোক।’
বলেই চাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠ হলো আষাঢ়। ঘাবড়ে গেল চাঁদ। নিজেকে আষাঢ় থেকে ছাড়াতে চাইলো, পারল না। আষাঢ় আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। উন্মাদের মত এলোপাতাড়ি চাঁদের গলায় মুখে ঠোঁটে চুমু এঁকে দিচ্ছে। নিজের সাথে ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। রাগের বসে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। এলোমেলো হাতজোড়া শাড়ি বেদ করে চাঁদের কোমর ছুঁইছে। ধীরেধীরে হাতটা উপরের দিক উঠছে। ততক্ষণে চাঁদকে নিজের সাথে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ঘাড়ে অজস্রবার ঠোঁট ছুঁয়েছে আষাঢ়। চাঁদ নিজেকে ছাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, যেই স্পর্শের জন্য এতদিন কাতর ছিল, সেই স্পর্শকে বি/ষাক্ত লাগছে আজ। চাঁদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো, রাগের মাথায় সজোরে আষাঢ়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাগের বশিভূত, এলোমেলো আষাঢ়ের হুঁশ ফিরলো।অধৈর্য হয়ে, রাগের বসে এ সে কি করতে চাইছিলো! হিতাহিত জ্ঞান ফিরতে থমকে গেল। নিজের সাথে চোখ মিলাতে পারছে না।
দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে চাঁদ। শাড়ির আঁচল তখনো এলোমেলো ঝুলছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
‘ ছি, এতটা নিম্ন চিন্তাভাবনা আপনার! আপনার কি মনে হয় আমি এই শরীরি চাহিদার পাগল ছিলাম। একজন মেয়ের না মানে ‘না’। আপনারা পুরুষরা কবে বুঝবেন তা? আমি আপনার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিলাম, ভালোবেসে সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু সেসব কারণ মুছে গেল আজ। আপনার কি ধারণা শরীর ছুঁয়ে দিলে মন পাওয়া যায়? না, কোনোদিন না। আমি আপনাকে ঘৃ/ণা করি আষাঢ়।’
আষাঢ়ের চোখে জল। একজন পুরুষ ঠিক কতটা আঘা/ত পেলে তার আঁখিপল্লবে জল নামে? নিগূঢ়, আকুল কণ্ঠে ডাকলো আষাঢ়। গভীর আকুতি সুরে বলল,
‘ চাঁদ! ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।’
চাঁদ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখেমুখে তিক্ত ঘৃ/ণার প্রলেপ মেলে বলল,
‘ ঘৃ/ণার পর কি করে ভালোবাসতে হয় জানা নেই আমার।’
শাড়ির আঁচল তুলে অকপট পায়ে বেরিয়ে গেল চাঁদ। আষাঢ় দাঁড়িয়ে, চাঁদের যাওয়ার দিকে নিস্তেজ, নিমিষ চেয়ে রইল। কথায় আছে, সময় গেলে সাধন হয় না। আষাঢ়ের সাথে যেন সেই উক্তিটি শতভাগ মিলে গেল।

বর্তমান………

‘ কোনো দিন অন্ধকার ঘেরা সকাল হতে দেখেছ? আমি দেখেছি। চাঁদের বাড়ি ছাড়ার সেই সকাল আমার জন্য আঁধার ঢাকা ভয়/ঙ্কর এক সকাল ছিলো। যাওয়ার সময় চাঁদ ফিরে তাকায়নি, না একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো। তার মুখশ্রীতে আমার প্রতি অজস্র ঘৃ/ণা ফুটেছিলো। সেদিনকার পর থেকে আমার জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন আসলো।অদ্ভুতভাবে আমার রাতের ঘুম, দিনের শান্তি সবকিছু কেউ কেড়ে নিলো। চারিদিকে অশান্তি, যার বোজ আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।’
‘ কি কমতি আছে আপনার! দেশবিদেশে বড়বড় বিজনেস ডিল করছেন। এত ভালোবাসেন, অথচ সামান্য একটা মেয়েকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না! নিজের কাছে জোর খাটিয়ে রাখতে পারেননি।’
আষাঢ় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বলল,
‘ সে সামান্য না, অসামান্য। ভালোবাসি বলেই জোর খাটাতে পারিনি। আমাদের প্রায়শই উৎসব পার্বণে দেখা হয়, চাঁদ বাড়িতে আসে মায়ের সাথে দেখা করে। বাহিরের মানুষের মত ড্রইং রুমে বসে গল্প গুজব করে চলে যায়। যদিও আমাকে বেশ এড়িয়ে চলে। একবার বাড়িতে এসে থাকতে বলেছিলাম, তর্কবিতর্কে লিগ্যাল সেপারেশনে গিয়ে ঠেকলো আলোচনা। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, তারপর ছয়মাস লাপাত্তা। আত্মসম্পূর্ণ, স্বাধীনচেতা মেয়ে সে। কোনো বাঁধনে বাঁধবে না। চাইলে, ওর উপর খুব সহজেই জোর খাটানো যায়। কিন্তু আমি চাই না। ওর উপর যতবার জোর খাটিয়েছি প্রত্যেকবার হিতের বিপরীত ঘটেছে। আমাদের এই দুরত্বটাও আমার জোর খাটানোর জন্য। তাই এখন ভয় হয়। তাকে হারিয়ে আমার বেঁচে থাকার সাধ্যি নেই। দূরে থাক, তবুও আমার নামেই থাকুক চাঁদ।পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক থাকে ভীষণ কমপ্লিকেটেড। আমাদেরটা তেমনি একটা। ছন্নছাড়া সংসার তবুও এক সুতায় বাঁধা।’

আইমান হাসলো। পড়াশোনা শেষ করে দীর্ঘ চারবছর পর দেশে ফিরছে আজ। ইউকে থেকে বাংলাদেশের ফ্লাইট ধরেছিলো, তুর্কি ট্রানজিটে ভিআইপি লাউঞ্জে আষাঢ়ের সাথে দেখা হলো। এত এত বিদেশীর মধ্যে স্বদেশের মানুষকে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো। একই ফ্লাইট। ট্রানজিটের দীর্ঘসময় দুজন গল্পগুজব করছিলো। গল্পগুজবের এক পর্যায়, আষাঢ়কে ভালোবাসার মানুষের কথা জিজ্ঞেস করতেই, বর্ষণের দিনে হুট করে বামনের ঘরে চাঁদের আসার গল্পটা বলছিলো।
আইমানের মনে অনেকক্ষণ যাবৎ একটা প্রশ্ন উশখুশ করছিল। জড়তা মাড়িয়ে কৌতূহলের বসে জিজ্ঞেস করল,
‘ যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো?’
সবেই কফির কাপে চুমুক দিয়েছিল আষাঢ়। আইমানের কথায় কাপ নামিয়ে বলল,
‘ হুহ, বলো।’
আইমান জড়তা ছাপিয়ে বলল,
‘ সামান্য কারখানা থেকে হুট করে এত বড় সাফল্য কি করে…মানে…
আষাঢ় আইমানের কথার ধাঁচ ধরতে পেরে বলল,
‘ আমার সাফল্য হুট করে, লটারি পাওয়ার মত আসেনি। এর পেছনে ছিল আমার কঠোর পরিশ্রম আর দীর্ঘ সময়। চাঁদ ছেড়ে যাওয়ার পর আমি সর্বোক্ষণ ছটফট করেছি। নিজেকে চাঁদের স্মৃতি থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সবসময় কাজে ডুবিয়ে রাখতাম। সেই সময়টা আমার জীবনের মোড় ঘুরানো সময় ছিলো। চারবছরে্র পরিশ্রম, অনেক কিছু হারানোর পর আজ আমি সফল, ইউরোপে আমার প্রথম বিজনেস ডিল ছিলো। কথায় আছে, টাকায় টাকা বাড়ে। জীবন প্রত্যেকে সুযোগ দেয়, আমারও এসেছিলো। কিন্তু বাঁধ সাজে অর্থ। মায়ের কথায় বাবার শখের বাড়িটা বিক্রি করতে হয়। কথায় আছে কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। বাজারের সাথে হওয়ায় বাড়ি বিক্রি করে মোটামুটি ভালো অর্থ পাওয়া যায়। সেই পুরো টাকাটা ব্যবসায় খাটাই, খুব অল্প সময়ে বেশ লাভ হয়। আস্তে আস্তে ব্যবসা বড় হয়। শাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি রেডিমেড গার্মেন্টসের ব্যবসায় ইনভেস্ট করতে শুরু করি। সাফল্যের আশি ভাগ নিশ্চিত করে সঠিক ইনভেস্টমেন্ট। বছর ঘুরতেই সেই গার্মেন্টসের একজন অংশীদার শেয়ার বিক্রি করে, যা আমি নিজের নামে কিনে নেই।’
আইমান হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,
‘ বাহ্! ব্রিলিয়ান্ট! জীবন এতটাও নাটকীয় হয়, আপনার সাথে পরিচয় না হলে জানতাম না।’
আষাঢ় মৃদু হাসলো। বলল,
‘ জীবন সিনেমা থেকেও বেশি নাটকীয়।তারপর বলো, তোমার অজানা সেই প্রেয়সীর গল্প!’
আইমান হতাশ নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ সে খানিকক্ষণের জন্য আমার জীবনে এসেছিল। এক পড়ন্ত বিকেলে ছাদে দেখা হয়েছিলো। কয়েক মুহূর্তে হৃদয় হ/রণ করে নিয়েছিলো। যার কল্পনা আজও আমার স্মৃতিতে ভয়ঙ্কর ভাবে জড়ানো। চারবছর আগে আমার খালার বাড়ির ছাদে দেখা হয়েছিলো, সে তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো।ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবো হয়তো। আমি পারিনি। সে আমার বুক পিঞ্জিরায় আবদ্ধ। মাকে পাঠিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে, যেয়ে জানতে পারলো বছর তিনেক আগে বাড়ি ছেড়েছে। পোস্টিং হয়েছে অন্য কোথাও। নাম ছাড়া বাকি সব অজানা। এবার দেশে ফিরে তাকে খুঁজে বের করবো, একবার পেলে হারাতে দিবো না আর কোথাও। জানেন আপনার সাথে আমার মিল কোথায়? তার নামও চাঁদ। ‘
আষাঢ় খানিকক্ষণের জন্য থমকে গেল। পরক্ষণেই মুচকি হাসলো। আইমান আবার বলল,
‘ আপনার জন্য দোয়া রইল, মান অভিমান ছেড়ে তাড়াতাড়ি আপনার কাছে ফিরে আসুক আপনার চাঁদ।’
‘ তোমার জন্যও, শীঘ্রই যেন তোমার চাঁদকে খুঁজে পাও।’

পুরো ফ্লাইটে দুজনের গল্পগুজব চললো। ফ্লাইট বাংলাদেশে ল্যান্ড হলো। একে অপরকে বিদায় জানিয়ে, বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
বাহিরে আষাঢ়ের জন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়িতে উঠে সিটে গাঁ এলিয়ে দিলো আষাঢ়। চাঁদকে দেখার প্রচন্ডরকম তৃষ্ণা জেগেছে তার। তাকে দেখেই যেন বাইশ ঘন্টার জার্নির কান্তির নিস্তার। চোখ বুজে নিরস সুরে বলল,
‘সাভার,জাহাঙ্গীরনগর চলো।’

চলবে……

🌺

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here