বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
১০.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
আজকাল আষাঢ়ের মাঝে পরিবর্তন এসেছে। যেই চাঁদকে এতবছর এড়িয়ে এসেছে। ইদানীং তাকে চোখে হারাচ্ছে। সর্বক্ষণ বুক জ্বালাপোড়া করে। প্রথমে ভেবেছিল এসিডিটির কারণে। কত ঔষধ খেয়ে নিবারণের চেষ্টা করেছে। কোনকিছুতেই মুক্তি মিলেনি। ক্ষণে ক্ষণে নিশ্বাস ভারী হচ্ছিলো। হ্ঠাৎ অনুভব করল এই রোগের ঔষধ চাঁদের মাঝে সীমাবদ্ধ। মেয়েটি চোখের সামনে থাকলে সকল যন্ত্রণা, ক্লান্তি গুছিয়ে যায়। বুক জুড়ে স্বস্তির শীতল হাওয়া বয়। যেই অনুভূতি গুলো এতবছর লুকিয়ে, অদেখা করে এসেছে। সেই অনুভূতি গুলোই আজ তার মাথায় চড়াও করে উঠেছে।
আরশির শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা চলছে। বিয়ের এতবছর পরও তারা আরশিকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। দায়িত্ব নামক বোজা চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার ঘাড়ে। দিনরাত কাজের লোকের মত খাটাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলে তাকে বাপ ম/রা, ছোটলোক মুখে যা নয় তা বলে গা/লাগা/লি করছে। রাজিবকে উঠতে বসতে মধ্যবিত্ত পরিবারে বিয়ে করার কারণে কথা শোনায়। কাজের তাগিদে বেশিরভাগ সময় তার শহরে থাকা হয়। সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে আসা। এতদিন সবকিছু মেনে নিলেও এখন আর পারছেনা রাজিব। আরশি প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার বলেছে সম্পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন এখন। কিন্তু বাড়িতে সবাই সবটা জেনেশুনে তার ঘাড়ে সবকাজ চাপিয়ে দিচ্ছে। ‘কাজের ভয়ে আরশি নাটক করছে’ এসব বলে কাদা ছুঁড়ছে। ব্যাপারটা চোখে পড়লো রাজিবের। মায়ের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলে, তিনি ক্ষেপে যায়। দুইএক কথায় কথা বাড়ে, মা ছেলের তুমুল ঝগড়া হয়। সবকিছু থেকে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে রাজিব আরশিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শহরে তার অফিসের পাশে দুই রুমের মোটামুটি বড় রকমের একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছে। আপাতত টুকটাক কিছু ফার্নিচার কিনে বাড়িতে উঠেছে।
ভর্তি পরীক্ষার ধকলের পর একদম নেতিয়ে পড়েছে চাঁদ। দুইদিন পরপর শরীর খারাপ হচ্ছে। জেলায় জেলায় যেয়ে পরিক্ষা দেওয়া, রাত জেগে পড়াশোনা করা সব ক্লান্তি যেন মাথা চড়াও দিয়ে উঠেছে। বিয়ের পর মেয়েটির কোথাও যাওয়া হয়নি। এক জায়গায় থেকে থেকে নিশ্চয়ই মন বিষিয়ে যাচ্ছে মেয়েটার। ওইদিকে আরশিও একা, পোয়াতি মেয়েটা। এসময় কেউনাকেউ তার পাশে থাকা দরকার। চাঁদ সেখানে যেয়ে কিছুদিন থাকলে আরশির ভালো লাগবে। চাঁদেরও এসব ক্লান্তি ছাপাতে সতেজতার প্রয়োজন আছে। তাই মালা বেগম সিদ্ধান্ত নিলেন, চাঁদকে কিছুদিনের জন্য আরশিদের বাড়িতে বেড়াতে পাঠাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। চাঁদকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। বাড়িতে আরশিদের দাওয়াত করলো। রাজিব কাজের ফাঁকে সময় বের করে এসেছে। আজকেই তাদের ফিরতে হবে। তাই বিকালে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে বলে ঠিক করেছে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে ঢুকে চাঁদকে ব্যাগ গোছাতে দেখে কপাল কুঁচকে নিলো আষাঢ়। চাঁদের পাশে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর সুরে বলল,
‘ ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন! কোথাও যাচ্ছ?’
আলমারি থেকে কাপড় বের করে ব্যাগে রাখতে রাখতে ব্যস্ত কন্ঠে উত্তর দিলো চাঁদ,
‘ হ্যাঁ, আপার বাড়িতে। কিছুদিন থাকবো সেখানে।’
‘ কেন? ‘ আষাঢ় অনেকটা বিরক্তি, নাখোশ কণ্ঠেই বলল।
চাঁদের ব্যস্ত গলার ঝটপট উত্তর,
‘ কেন মানে কি! আপা অসুস্থ, এসময় কেউ না কেউ সবসময় আপার সাথে থাকা প্রয়োজন।’
‘ আমাকে আগে জানাওনি কেন?’
‘ কেন আপনি জানতেন না! মা সেদিন রাতে খাওয়ার সময় বলল। আপনি বোধহয় খেয়াল করেননি।’
‘ তোমার এখানকার কাজ, পড়াশোনা এসব কে করবে?’
আষাঢ়ের কণ্ঠে বি/রোধ। চাঁদকে আটকানোর যথাসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে।
চাঁদ যেন সকল প্রশ্নের উত্তর মাথায় আগে থেকে প্রস্তুত করে রেখেছে। আষাঢ় জিজ্ঞেস করলে ঝটপট জবাব দিবে।
‘ আমার এখানে এখন কিসের কাজ। এডমিশন টেস্টের ঝামেলা শেষ। আপাতত কিছুদিনের জন্য ছুটিতে আছি। রেজাল্ট বের হলে, আপার বাড়ি থেকে এসে কোমর বেঁধে নামবো।’
‘ ততদিন সেখানে থাকবে?’
‘ হ্যাঁ’ চাঁদের বেশ স্বাভাবিক উত্তর।
আষাঢ়ের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হলো। চোখেমুখে রাগ যেন স্পষ্ট। অধৈর্য সুরে বলল,
‘ আর আমার প্রয়োজন গুলো?’
চাঁদ থামলো। পিছন ফিরে চোখ উঁচিয়ে আষাঢ়ের মুখপানে চেয়ে বলল,
‘ আমাকে আটকাতে চাইছেন! কেন? আমার জানামতে, আমাকে আপনার কোন প্রয়োজন নেই। ভালোবাসেন না, স্ত্রী মানেন না আমায়। আমি চলে গেলেই তো আপনার ভালো। কিছুদিন একা শান্তিতে থাকতে পারবেন। তাহলে বারবার বাঁধা দিতে চাইছেন কেন?’
আষাঢ় চুপ। চাঁদ ব্যাকুল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, আষাঢ়ের উত্তরের অপেক্ষা করল। ঘর জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সামনে থেকে কোন জবাব এলো না। বাহিরে মালা বেগমের হাঁকডাক শোনা গেল। প্রতিবারের মত আশাহত হলো চাঁদ। অশ্রু ঘেরা ভাসা ভাসা চোখজোড়া নামিয়ে নিলো। কাপড় নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো। যাওয়ার সময় অভিমান ঢালা অস্বাভাবিকরকম শান্ত সুরে বলল,
‘ কাঙ্খিত জিনিস না পাওয়ার চেয়ে। তা পেয়েও অধিকার না খাটানোর দ/হন বেশি ভয়/ঙ্কর হয়।’
চাঁদের যাওয়ার দিক তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেলল আষাঢ়। ভারী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ এই দ/হনে প্রতিনিয়ত পু/ড়ছি আমি। এই য/ন্ত্রণা কতটা ভয়/ঙ্কর তা আমার থেকে কেউ ভালো জানেনা চাঁদ।’
সূর্যের আলো খানিক মিয়িয়ে আসতেই চাঁদ আরশিদের সাথে রওনা হলো। যাওয়ার সময় চারিদিকে চোখ বুলালো। বিদায় দিতে আষাঢ়ের আসার কথা ছিল, আসেনি। নিরাশ হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো চাঁদ। বুকে অভিমান জমলো। কঠিন অভিমান।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরল আষাঢ়। রোজ এত দেরি হয়না।কিন্তু আজ বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। অনিহা ঝেঁকে ধরেছিল। জুতা খুলে ঘরে ঢুকতে মাকে খাবার টেবিলে বসে থাকতে দেখলো। আষাঢ়ের জন্য খাবার বেড়ে অপেক্ষা করছিল। বারবার ঘুমে চোখ বুজে আসছে তার। আষাঢ় হাতমুখ ধুয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ সকালে তোমাকে কলেজে যেতে হবে। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এসবকিছু আমি গুছিয়ে রাখবো।’
মালা বেগম নাকচ করল। বলল,
‘ রাত জেগে ভোরে উঠার অভ্যাস আছে আমার। আমি ঠিক সকালে উঠতে পারবো। অনেকক্ষণ আগে খাবার বেড়েছি। ঠান্ডা হয়ে গেছে। গরম করে এনে দিচ্ছি।’
আষাঢ় আটকালো। বলল,
‘ প্রয়োজন নেই। গরমের দিনে ঠান্ডা ভাত খেতে ভালো লাগে।’
মালা বেগম অপেক্ষা করতে চাইল। আষাঢ় একপ্রকার ঠেলেঠুলে ঘরে পাঠাল। মালা বেগম ঘরের দিক পা বাড়ালে, আষাঢ় পেছন থেকে ডাকলো। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আরশিরা ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছেছে! ফোন করেছিল? চাঁদ কেমন আছে। জ্বর-ট্বর বাঁধায়নি তো আবার।’
‘ না, সবঠিক আছে। কেন যাওয়ার পর চাঁদ ফোন করেনি?’
মাকে কি বলবে? অভিমান করেছে চাঁদ। আষাঢ় কয়েকবার ফোন করেছিল। মেয়েটি ফোনটা পর্যন্ত তুলেনি। চোখ লুকাল, কণ্ঠ গম্ভীর ভাব এঁটে বলল,
‘ চাঁদ ফোন করেছিল। ব্যস্ত ছিলাম তাই তুলতে পারিনি।’
মালা বেগম সব জানে। সন্ধ্যায় ফোন করেছিল চাঁদ। বলেছে, আষাঢ় ফোন করেছিল বতুলতে পারেনি।
ছেলেটা ছোট থেকেই চাপা স্বভাবের। অনুভূতি লুকাতে বেশ জানে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটছে। প্রতি মুহূর্ত চাঁদের জন্য অস্থির হয়ে পড়ছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট চেপে হাসলো মালা বেগম। ছেলের উদ্দেশ্যে বলে গেল,
‘ চাঁদ বলল, সেখানে খুব ভালো লাগছে। বেশ কয়েকদিন থাকবে।’
মা চলে যেতে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আষাঢ়। খুদা মরে গেছে তার। খাবার প্লেট গুছিয়ে ঘরে গেল। ভেতরে ঢুকতে অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরলো। নিজের এত বছরের পুরানো ঘরটাকে কেমন যেন পরপর লাগছে। সবকিছুতে চাঁদের ছোঁয়া। কিন্তু কোথাও সে নেই। বুক চি/ড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শূন্যতা চেপে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাঁপাশের খালি বালিশটায় অজান্তেই হাত বুলালো। ভেতরের শূণ্যতা যেন মাথা চড়াও করে উঠলো। মনে বিষণ্ণতা ভর করলো। চোখের সামনে কয়েক বছর আগে প্রথমবার চাঁদকে দেখার সেই স্মৃতি ভেসে উঠলো।
সালটা ঠিক মনে নেই। সেই বছর রাজনৈতিক দলে শিকদার সাহেব বেশ বড় পদ পেল। তার কিছুদিন পর রমজান শুরু হলো। সারা মাস অক্লান্ত বর্ষণ চলল। ইফতারের দাওয়াতের যেই ঘটা আয়োজন করবে বলে ভাবছিল, তা বাতিল হলো। ঈদের দিন সেই দাওয়াতের আয়োজন করবে বলে ঠিক করল।হ্ঠাৎ কোনো এক কাজে রুবেল আটকে পড়ায়। তার কাজগুলো আষাঢ়কে সামলাতে হয়। ভালো বন্ধুত্ব হওয়ায়, না করতে পারেনা। দাওয়াতের পুরো আয়োজনটা নিজ হাতে সামলায়। ঈদের আগের দিন রাতে বাড়ির সামনের বাগানের সাজসজ্জা দেখছিল। চারিদিক আলোকসজ্জায় সজ্জিত। রুবেলের সাথে এতবছরের বন্ধুত্ব থাকলেও। শিকদার বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকেনি কখনো। অন্দরমহল কেবল বাড়ির মানুষের জন্য। এতে অবশ্য আষাঢ়ের মাথা ব্যথা ছিলনা কখনো। রুবেলের সাথে দেখাসাক্ষাৎ বাড়ির সামনে অফিস অবধি ছিল। রুবেলের হাজার জোরাজোরিতে বাড়ির ভেতরে আসার আগ্রহ করেনি কখনো। সেদিন রাতে তদারকি করার সময় হ্ঠাৎ ছাদের উপর থেকে একটা মিষ্টি মেয়েলি আওয়াজ ভেসে এলো। কেউ একজন আওয়াজ করে বলল,
‘ ভাবি, দেখো কি সুন্দর ঈদের চাঁদ।’
সেই আওয়াজে অদ্ভুত এক টান ছিল। মিষ্টি কণ্ঠের খুব সাধারণ কথাটা অসাধারণ মনে হলো। নিজের অগোচরেই আষাঢ় পেছনে ফিরে তাকালো। চোখ উঁচিয়ে উপরে চাইতে থমকে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। সময় যেন থেমে গেল। অপলক, নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ছাদের আলোকসজ্জা সাদা পর্দার ভিড়ে এক কিশোরী দাঁড়িয়ে। টকটকে মেরুন রঙের ওড়না তার মাথায়। চোখ বুজে কোথাও মগ্ন সে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ, বিড়বিড় করে কিছু বলছে। অবাধ্য দমকা হাওয়ায় মাথার ওড়না পরে গেল হটাৎ। ফড়ফড় করে খোলা কেশ চোখেমুখে এসে লাগছে। হরিণ টানা আঁখিজোড়া পিটপিট করছে। মেয়েটির চেহারায় মুগ্ধতা, চন্দ্রসুধা ছড়িয়ে , যেন মায়াপুরির অপূর্ব রাজকন্যা সে। কি করছে মেয়েটি! চাঁদের কাছে আর কি চাইছে? মেয়েটি কি আদৌ জানে পৃথিবীর অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারীনি সে। সকলে আকাশের চাঁদ দেখতে ব্যস্ত , অথচ আষাঢ় ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদে মগ্ন। সাদা পর্দা গুলো যেন মেঘেদের মত চাঁদের মুখটা ঢেকে দিচ্ছে। অজান্তেই ফিসফিসিয়ে বলল সে, ‘ অমূল্য চাঁদ।’
ধীরে ধীরে মেয়েটি পিছিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকে কোথাও যেন হারিয়ে গেল। আষাঢ়ের অস্থিরতা বাড়লো, বুকে অদ্ভুত এক অনুভূতি প্রচন্ডরকম অনুভব করল। হুশ ফিরতেই যেয়ে চোখে মুখে পানি ছেটাল। মাথা ঠান্ডা করলো। খানিক পূর্বে অনুভব করা সেই অনুভূতিটা ভুলতে চাইল। আদৌ কি পারলো! মন থেকে অনুভূতি মুছে ফেলা যে অসম্ভব।
চলবে…..
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺