সৎ মায়ের হাতে সজোড়ে একটি চ’ড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সুহানা। তার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। চ’ড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েও কাঁদলো না সুহানা। ঠোঁট চেপে আগত কান্না আটকে রাখলো। এদিকে রশিদা বেগম শুধু চ’ড় মেরেই ক্ষান্ত হলেন না। বরং তিনি সুহানাকে কটু কথা শোনাতে উদ্যত হলেন। তীব্র রাগে গজগজ করতে করতে তিনি বললেন,
” কি রে পোড়া’মুখী, টাকার কি দাম নাই তোর কাছে? তোর বাপ কি শুয়ে বসে টাকা কামাই করে আনে?”
সুহানা নিরুত্তর। সে নত মস্তকে মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তার এর নিরুত্তর চাহনি ও কর্মকাণ্ড দেখে প্রতিবারের মতো এবারও রশিদা বেগমের মেজাজ পূর্বের তুলনায় তুঙ্গে উঠে গেলো। নিজের ক্রোধের আগুন নেভাতে তিনি নিচে বসে সুহানার মাথার চুল শক্ত মুঠোয় ধরলেন। দাঁতে দাঁত পিষে তীক্ষ্ণ সুরে বললেন,
” এই ভাত পোড়ার টাকা তুই দিবি। বুঝছিস? এই এক বেলা চাউলের দাম তুই তোর পকেট থেকে দিবি। আগে এই ভাতের টাকা পরিশোধ করবি। তারপর তোর গলা দিয়ে ভাত নামবে। বুঝছিস?”
সুহানা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনো উত্তরই দেয় না। পূর্বের ন্যায় নিরুত্তর বসে থাকে। চ’ড়ের ফলে তার গাল দুটো ভীষণ জ্বলছে। আবার চুলের গোড়াতেও ব্যাথা করছে। কিন্তু ব্যাথায় সে ‘আহ,উহ’ কোনো প্রকারের শব্দও করছে না। ওদিকে মায়ের গলার উচ্চস্বর শুনে পাশের রুম হতে ছুটে চলে এলো সাগরিকা। সকালে প্রাইভেট পড়ে এসে মাত্রই ঘুমিয়েছিলো সে। কিন্তু ঘুমের মাঝে টিনের ঘর ভেদ করে মায়ের উচ্চ গলা শুনে সে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে চলে এলো। সুহানার রুমে এসেই সে দেখলো তার মা সুহানার চুল মুঠি ধরে তাকে শাসাচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেখে সে তৎক্ষনাৎ রশিদা বেগমের নিকটে গিয়ে ক্ষীণ উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বললো,
” বুবুকে ছাড়ো মা। শুধু শুধু মারছো কেনো বুবুকে?”
এই বলে সে সুহানার মাথার চুল হতে মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু রশিদা বেগম তো চুল ছাড়লেনই। বরং পূর্বের তুলনায় আরো দৃঢ়ভাবে সুহানার চুল চেপে ধরলেন। এ পর্যায়ে অসহনীয় ব্যাথায় সুহানা চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিলো। রশিদা বেগম চুলসহ সুহানার মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
” শুধু শুধু মারতেছি ওরে? তোর মনে হয় ওরে শুধু শুধু মারতেছি? দুপুরের ভাত রান্না করার দায়িত্ব ওরে দিয়ে গেছিলাম। কিন্তু ওয় কি করছে জানোস? পুরো পাতিলের ভাত পুড়ায় ফেলছে।”
সাগরিকা তার প্রতিবাদী রূপে অটল রইলো। সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” তো কি হয়েছে? এক ভাত পোড়ার জন্য তুমি বুবুকে এভাবে মারবে! ছাড়ো আম্মা। বুবু ব্যাথা পাচ্ছে। ”
রশিদা বেগম মেয়ের কথায় ঘোর অখুশি হলেন। বললেন,
” তোর বাপ সারাদিন মাঠে কাজ করে টাকা দিয়ে চাউল কিনে আনে কি পোড়ানোর জন্য? আমি ওরে বলছি, আজকের ভাতের টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ার পর ওর গলা দিয়ে ভাত নামবে। ”
এই বলে তিনি ঝট করে সুহানাকে ছেড়ে দিলেন। ফলস্বরূপ সুহানা আবারো মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়লো।
সাগরিকা আবারো বললো,
” এসব কেমন কথা আম্মা? বুবু কোথা থেকে টাকা দিবে?”
” কেন? ওয় যে টিউশানি করায়? সেই টাকায় কি করে ও? ঐ টাকাই ওয় দিবে আমারে। আর আমি বলছি তো, আজকের ভাতের টাকা আমার হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত আমি ওর গলা দিয়ে ভাত নামাতে দিবো না। ”
” এভাবে এক বেলার ভাতের দাম কি করে দেয় আম্মা? ভালোমতো চিন্তা করে কথা বলো। ”
” চিন্তা কইরাই বলছি। আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। যা বলছি তাই।”
এই বলে রশিদা বেগম উঠে গটগট করে প্রস্থান করলেন। রশিদা বেগমের প্রস্থান করামাত্রই সাগরিকা সুহানার সম্মুখে বসে পড়লো। সুহানা ততক্ষণে সোজা হয়ে বসে পড়েছে। নির্বাক চিত্তে সে শরীরের ওড়নাটা ঠিক করলো। অতঃপর কৃত্রিমতা মিশ্রিত ম্লান হাসি দিয়ে সে সাগরিকাকে বললো,
” তুই বাড়িতে কখন এলি সাগরি?”
সাগরিকা সুহানার উক্ত প্রশ্নের জবাব দিলো না। তার দৃষ্টি চলে গেলো সুহানার ফর্সা গালে ছেপে উঠা পাঁচটি আঙুলের দাগের উপর। সে সুহানার পানে চেয়ে ভেজা চোখে বললো,
” তুই চলে যাস না কেনো বুবু? আর কতদিন এভাবে মা’র খাবি আম্মার হাতে?”
সুহানা ব্যর্থ হাসার চেষ্টা করে বললো,
” কোথায় যাবো সাগরি? তুই-ই বল। আমার কি যাওয়ার কোনো ঠিকানা আছে? ”
সাগরিকা নিরুত্তর রইলো। কারণ এর জবাব তার কাছে নেই। সুহানা পুনরায় বললো,
” যতদিন আছি এভাবেই থাকতে হবে। আর তুই তো জানিস, আমি আব্বাকে কতোটা ভালোবাসি। আব্বাকে ছাড়া কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই আমার বুক কেঁপে উঠে। ”
” কিন্তু এভাবে আর কতদিন?”
সুহানা ম্লান হেসে বললো,
” যতদিন এ দেহে প্রাণ আছে ততদিন। ”
সাগরিকা বলার কিছু পেলো না। সে নির্বাক চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য সুহানার পানে চেয়ে রইলো। সুহানা মৃদু হেসে বললো,
” এমন নজরে দেখিস না সাগরি। কষ্ট হয় খুব। ”
এই বলে সে উঠে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো,
” আমি পুকুরপাড়ে যাচ্ছি সাগরি। আম্মা তো এখন আমাকে রসুইঘরে আর ঢুকতে দিবে না। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকতে মন চাইছে না৷ ”
বলে সে রুমের বাইরে পা বাড়ালো। ঘর হতে বেরিয়ে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পুনরায় সাগরিকাকে বললো,
” আম্মা যদি আমাকে ডাকে তাহলে আমাকে পুকুরপাড়ে এসে জানিয়ে যাস কিন্তু। ”
সাগরিকা ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” আচ্ছা বুবু। ”
সুহানা আর দাঁড়িয়ে রইলো না৷ পরনের ওড়না মাথার উপর দিতে দিতে বাড়ি হতে বেরিয়ে গেলো সে। এদিকে সাগরিকা সিক্ত চাহনিতে সুহানার যাবার পানে চেয়ে বিড়বিড় করে বললো,
” তোকে এভাবে আর দেখতে পারি না বুবু। তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। শুধু ভাবি, আমার বিয়ের পর আম্মা তোর সাথে কতোটা খারাপ ব্যবহার করবে। এখন না হয় আমি আটকাতে পারি। কিন্তু আমার বিয়ের পর তোর কি হবে!”
.
গ্রীষ্মের দাবদাহে পরিবেশ যখন তপ্ত তখন নিম্নচাপের রেশ ধরে পরিবেশ শীতল করতে বৃষ্টির আগমনী বার্তা এলো। দরিয়া গ্রামের পুরো নভস্থল ধূসর কালো মেঘে ছেয়ে আসে। চারপাশে প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া শীতল হাওয়া বইছে। সে হাওয়ার তালে দুলছে মাঠের ফসলগুলো। তাদের নাচুনি দেখে উদাস মনটাও তৎক্ষনাৎ উৎফুল্লতায় ভরে উঠে। বহমান শীতল হাওয়ায় গ্রামের প্রতিটি বৃক্ষের পত্রপল্লবও নেচে বেড়াচ্ছে। সুহানা প্রকৃতির এ উজার করা সৌন্দর্য বিলিয়ে দেওয়া রূপ দেখতে দেখতে পুকুরপাড়ে যাচ্ছে। তাদের বাড়ি হতে পুকুরপাড়ের দূরত্ব এক মিনিটের কম সময়। এ পুকুরটি তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
বাড়ি হতে পুকুরপাড়ের পথে এক বিস্তর ধানক্ষেতের মাঠ পড়ে। সে ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বহমান শীতল হাওয়ায় সুহানার সর্বাঙ্গ অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলো। সে আর দাঁড়িয়ে রইলো না। বরং দ্রুত হেঁটে পুকুরপাড়ে চলে এলো।
বিশাল এ পুকুরের এক পাশে ইট সিমেন্টের গাঁথায় করা দুটো বসার স্থান রয়েছে। সহজ ভাষায় যাকে ঘাট বলে সম্বোধন করা হয়। সে ঘাটেরই দু পাশে দুটো বিশাল কৃষ্ণচূড়ার বৃক্ষ। কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ দুটি এ বছর মন উজার করে সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রতি ডালে ডালে পাতার সংখ্যা হাতেগোনা। উপরন্তু ফুলের সংখ্যা অগণিত। দূর হতে চাইলে মনে হবে এ জায়গাটা যেনো রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। বহমান হাওয়ার তালে ডাল হতে চার পাপড়িযুক্ত ফুলগুলো পুকুরের পানিতে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে। ফলে সম্পূর্ণ পুকুরটিই সিদুঁরি লালবর্ণে রঞ্জিত হয়ে আছে। এদিকে কৃষ্ণচূড়ার বৃক্ষরাজি লাল বর্ণে রঞ্জিত। অপরদিকে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় পুকুরপাড় রঞ্জিত। অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্যে ঘেরা পরিবেশে এসে সুহানা ক্ষণিকের জন্য যেনো বশিভূত হয়ে গেলো। মুহূর্তেই সে তার অন্তরালে স্থানকৃত দুঃখগুলো ভুলে যেতে আরম্ভ করলো। তার মনের কোনে জেগে উঠলো প্রকৃতির টানে হারিয়ে যাওয়ার এক সুপ্ত ইচ্ছে।
চারিধারে সোঁ সোঁ শব্দে প্রবাহমান হাওয়ায় গাছের পাতার দুলুনি শব্দ, ধানক্ষেতের নৃত্যের শব্দ, সব মিলিয়ে পরিবেশটি সংবেশিত হয়ে গেলো। এই মধুর আওয়াজেই সুহানা যেনো সম্মোহনে আটকে গেলো। নিমীলিত লোচনে সে মনোমুগ্ধকর পরিবেশটি সম্মোহনী হয়ে উপভোগ করতে লাগলো। অকস্মাৎ একটি পুরুষালী কণ্ঠস্বরে তার এ সম্মোহনের তার কাটা পড়লো।
” এক্সকিউজ মি মিস। ওমর মোল্লার বাড়িটা কোথায় একটু বলতে পারবেন?”
পশ্চাত হতে অচেনা পুরুষের কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হওয়া মাত্রই সুহানা চট করে নেত্রজুগল মেলে তাকালো। পরনের ওড়না ঠিক করে সন্দেহাতীত দৃষ্টিতে সে ঘুরে তাকালো। অকস্মাৎ তার সম্মুখে শহুরে পোশাকে আচ্ছাদিত সুদর্শন এক পুরুষকে দেখে সে ভীষণ অবাক হলো।
১.
#বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️
#লেখনীতে:সারা মেহেক
#চলবে?