হঠাৎ ধাক্কায় বই গুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ায় মেজাজ বিগড়ে গেলো। ভাবলাম দু কথা শুনিয়ে দিলে মন্দ হবে না। মাথা তুলে তাকাতেই যেন মাথাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলো। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির চোখ আমার দিকে। সেই চোখের অথৈ মায়ার সাগরে গা ভাসিয়েছিলাম একবার। সেই চোখ আজ আবার দিকে তাকিয়েছে,সেই একই রকম মায়া নিয়ে। হাটু ভেংগে বসে বই তুলে দিতে দিতে বললো,
– মৈথি না? কেমন আছিস? কত দিন পর দেখা বলতো!!
আসলেই কতদিন পর দেখা, সময়ের হিসেবটাও জানা নেই শুধু জানা আছে আজ আমরা সেই আগের ন্যায় নেই। বদলে গেছি, সময় আমাদের আবার এভাবে দাঁড়া করাবে কে জানতো!!
– কিরে বসেই থাকবি নাকি রাস্তায়??
তার কথায় আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হই। তার সাথে কি দিয়ে কথা শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
– তুমি এখানে? কবে আসলে আকিফ ভাই?
– তোর ভাই বলাটা গেলো না তাই না! এইতো গত মাসে, এখানে ট্রান্সফার হলো। তবে কেমন চলছে জীবন?
– চলছে আর কি!! আমি যাই তবে,দেখা হয়ে ভালো লাগলো।
বলেই ছুট লাগালাম, আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো দম বন্ধ হয়ে যেত। রাস্তার মোড়ে এসে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। এই এক সমস্যা, দুপুর বেলা রিক্সা পাওয়া ভার এখানে। রোদের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পাশ থেকে আকিফ ভাইয়ের ভুবন ভুলানো হাসি কানে এলো,
– তোর ছুট ছুট পালাই পালাই স্বভাবটা গেলো না তাই না?
– সত্যি কাজ ছিলো তাই। (লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছে)
– থাক আর লজ্জা পেতে হবে না, চল হাটি এখানে রিক্সা পাবি না।
উপায়ন্তর না দেখে তার পাশেই হাটা শুরু করলাম, আজ এতো দিন পর তাকে দেখছি। বহুত পাল্টে গেছে, তবে মন মাতাল করা স্বভাবটা রয়ে গেছে, সেই হাসি, সেই দৃষ্টি যেন আমার মায়ায় ফেলবে বলে বারবার মনে হানা দিচ্ছে।
– কতদিন পর তোকে দেখছি রে, বেশ গিন্নি গিন্নি লাগছে তোকে। তবে চোখের ভয়টা এখনো কাটলো না, সেই ভয়ার্ত চোখেই আমার দিকে তাকাস। ( হেসে বলে উঠলেন)
– কতোদিন হবে তুমিই বলো!
– ছয় বছর সাত মাস তের দিন।
বলেই একটা উদাস হাসি দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি যেন স্তব্ধ হয়ে রইলাম, কি বলা উচিত ছিল আমার জানা নেই। মূহুর্তেই একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম, সেটা কাঁটাতেই বলে উঠলাম,
– কোথায় থাকা হয়?
– কোম্পানির ডর্মেই আছি। পরে বাসা টাসা নিবো ক্ষন
– তা বিয়ে শাদী করলে? বউ কেমন হয়েছে?
আমার কোথায় মুচকি হেসে আকিফ ভাই হাটা শুরু করলো। কিছুদুর যেয়েই রিক্সা পেলাম, আমার হাতে বই গুলো দিয়ে বললো,
– দেখার সময়টা এতো কম হবে জানলে…, থাক যা, কি জানি আবার কোনো সময় দেখা হলেও হতে পারে।
মিনিট বিশেক পর বাড়ি পৌছে গেলাম। যে বাড়িতে থাকি সেটা দোতালা। নিচের তালায় ভাড়া থাকি, মফস্বল শহরে দোতালা বাড়ি খুব বেশি দেখা যায়। সামনে ফুলের বাগান, একটা উঠোনের মত খেলার জায়গা। বড় শহরে এগুলো দেখা ভার। কারণ শহরে ধুলো মাখা কুয়াশায় একবিন্দু শ্বাস নিতে ও বুক ভারী লাগে। ছোটখাটো সিমসাম বাসা, বেশি সাজসজ্জা, বিলাসিতা করার সামর্থ্য বা রুচি আমার নেই। ছোট একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি, মেয়ে নিয়ে আমার বেশ ভালোই চলে। আমার মেয়ে চার বছর হতে চললো, নাম নিতু। নিতুকে ছাড়া আমি যেন অচল। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই পাগলীটা আমায় জড়িয়ে ধরলো,
– মা, এতো দেরী করলা তুমি। আমার খিদা লাগছিলো।
– সেকি আম্মু, নানুকে বললে না কেন?
– নানুর কাছে খাবো না
– বেশ চলো, আম্মু খাইয়ে দিচ্ছি। নানুকে জ্বালাও নিতো মা
– উহু, জিজ্ঞেস করো।
মেয়ে আমার পাকা বুড়ি, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তার মা, না সে আমার মা। বাড়িতে আমরা তিন জন প্রাণী ই থাকি; মা, আমি আর নিতু। রাতে খাবার পর মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। এখন আমি একা, কোনো কাজ নেই চাপ নেই। এই সময়টা নিতান্ত একার, এই সময় বই পড়েই কাটাই। একটা পছন্দের বই হাতে নিলাম, “একা একা” – হুমায়ুন আহমেদ।
বইটা খুলে পড়া শুরু করলেও কেন যানে মন বসাতে পারছিলাম না। চোখের সামনে অতীত ভাসছে যেন আমি সিনেমার পর্দার সামনে বসে আছি।
সবে ইন্টার পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছি, আমার বিষয় ছিলো ফাইন্যান্স। আমাদের কলেজের সিস্টেম ছিলো যখনই কোনো নতুন ব্যাচ আসবে তাদের বিভিন্ন ক্লাবে ইনভাইট করতে বড় ভাইরা আসতেন যারা ক্লাবের মেম্বার। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না, ক্লাস শেষের দশ মিনিটের ব্রেকে কিছু ভাই আর আপু আসলেন আমাদের ক্লাসে। তাদের মধ্যে পাঁচ ফুট ১০ এর কাছাকাছি একজন ছিলো, পরণে কালো টিশার্ট আর ব্লু জিন্স, মুখ ভর্তি দাড়ি, চুল উসখো খুসখো আর উদাসীন চোখ। আমি অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। সেখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাচ ছিলো না, তাই তার ব্যাচ আন্দাজ করতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম, আচ্ছা অনার্সে উঠলে বুঝি মানুষ এমন হয়ে যায়। আফসারার ধাক্কায় হুশ ফিরলো,
– কিরে জয়েন করবি নাকি??
– আব্বু দিবে তোর মনে হয়?
– তুই তো ভালো গান গাস, চল না একটা ভালো স্টেজ পাবি।
– থাক না হুদাই কেন?
আফসারা আর ঘ্যান ঘ্যান করলো না। ক্লাস শেষে যখন বের হবো, কিছু ভাই আবার এলেন আমাদের নবীন বরণে আমন্ত্রণ করতে। বুঝতে পারলাম উনি আমাদের ই ডিপার্টমেন্ট এর। একটা ফাইন্যান্স এর ছেলে আমার থিয়েটার ও করে এটা যেন অবাক করছিলো আমায়। অনুষ্ঠানে আমি আর আফসারা সবার আগে হাজির নিজের প্রথম নবীন বরণ বলে কথা। ওমা উপস্থাপনায় যে আছেন সে আর কেউ না উনিই, কিন্তু এখন আর তাকে জংলী লাগছে না, ক্লিন সেভ, আকাশী পাঞ্জাবী যার হাতা কনুই অবধি তোলা,ব্লু জিন্স, চুল গুলা কপালে ফেলে রেখেছে। আমার বুকে বারবার বারবার টিপ টিপ করছে। বুঝতে পারছি প্রেমে পড়েছি। তখন তার নাম জানতে পারলাম, আকিফ। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ৩য় বর্ষে। পুরা চার ঘন্টার অনুষ্ঠানে আমি শুধু তাকেই দেখে গেসি। যখন আমাকে ফুলের তোড়া দেওয়ার জন্য ডাকা হলো আমার কানে যেন নাম ঢুকছিলোই না। আফসারার ধাক্কায় হুশ ফিরে। স্টেজে উঠতে গেলে আকিফ ভাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে তোড়াটা এগিয়ে দিলো। উনার হাসিটা যেন তীরের মত বুকে যেয়ে লেগেছিলো। এর পর থেকে শুরু হলো আমার উনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা। উনার সাথে প্রতি শুক্রবার দেখা হবে বিধায় থিয়েটারেও যোগ দিলাম, বাবার কাছে বকুনি কম খেতে হয় নি। ক্লাস শেষে উনাকে দেখা, উনার ক্লাসে সামনে ঘুরঘুর করা, কোনো কাজে জুনিয়র ডাকলেই দৌড়ে যাওয়া। এগুলো যেন নিত্যদিনের কাজ ছিলো। এইটা আফসারার চোখ এড়ালো না। আমাকে শুধু খোচা দিতো উনার সামনে আর বলতো,
– দেখ তোর হিরো চলে এসেছে।
দেখতে দেখতে দুটা বছর কেটে গেলো, উনার প্রতি একপাক্ষিক প্রেম আমার রয়েই গেলো। সাহস করে কখনো বলা হলো না। আমি তখন ৩য় বর্ষে কিছুদিন পর আকিফ ভাইরা বের হয়ে যাবেন। আমার মন এমনি খারাপ থাকতো। সেদিন দিনটা ছিলো ১২ জুলাই, শনিবার থাকায় কলেজে যেতে হয় নি। সকাল সকাল আফসারা এসে হাজির, আমাকে বললো,
– মৈথি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, আকিফ ভাই আমাদের খেতে নিয়ে যাবে।
– বাবা যেতে দিবে নারে।
– দেখ, উনি কিন্তু বেশিদিন থাকবেন না এই সুযোগ মনের কথাটা বলে দে। নাহলে পরে পস্তাবি।
ভেবে দেখলাম আসলেই, উনি চলে গেলে আর ফিরে পাবো না তাকে। অমনি উঠে একটা নীল শাড়ি বের করলাম। চুল আমার বরাবরি ছোট তাই অহেতুক আটকাতে গেলাম না। রেডি হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম আফসারাকে কেমন লাগছে আমায়, উত্তরে বললো,
– আজকে আকিফ ভাই চোখ ফিরাতে পারবে না দেখিস।
ওখানে আমরা একা ছিলাম না, প্রায় ছয় সাত জনের একটা টিম নিয়ে এসেছিলো আকিফ ভাই। পরণে সাদা পাঞ্জাবী, কালো জিন্স, শ্যামলা রং এ এতো মানিয়েছে। আমাকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসলেন। ওখানে সবাই তার প্রিয় জুনিয়র। খাওয়া দাওয়া শেষে গেলাম নদীর পাড়ে ঘুরতে। নদীর পাড়ে বেশ ভালো লাগছিলো বাতাসে চুল উড়ছিলো, মনে একটা ভয় ও ছিলো। এতো মানুষের মাঝে কিভাবে তাকে বলি। সন্ধ্যার দিকে যখন সবাই বাড়ি যেতে লাগলাম মনটা খারাপ লাগছিলো, বারবার মনে হচ্ছিলো ইশ আমার প্রেমটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যতবার বলতে চেয়েছি, বলা হয়ে উঠেনি। চলেই যাচ্ছিলাম,
– মৈথি, একটু দাঁড়াবি?
– হুম বলেন ভাই।
– কবে থেকে জানি না, তবে যেদিন প্রথম দেখছিলাম সেদিন তোর গোল গোল চোখে হারিয়েছিলাম। ক্লাসে শুধু তোর দিকেই চোখ আটকে ছিলো। হার্ট বিট যে এতো জোরেও হয় সেদিন বুঝেছিলাম। সেদিন দ্বিতীয়বার তোকে দেখার জন্য আবার তোদের ক্লাসে যাই। তুই যখন থিয়েটারে জয়েন করেছিলি, আমি যেন চাঁদ পাবার মতো খুশি হয়েছিলাম, বুঝতে পারলাম এই পিচ্চির প্রেমে পড়েছি। একে ছাড়া আমার চলবে না। কাজ শেষে তোর প্রাক্টিসে বসে থাকতাম যাতে তোর গান শুনতে পারি। অন্য অনেকে থাকলেও তোর সাথে আবৃত্তি করতে চাইতাম। বারবার তোকে বলতে চাইলাম, ভয় হতো তুই যদি মানা করে দিস। আমায় দেখলেই তো ছুট ছুট পালাই পালাই করতি। তবে আজ না বলে পারলাম না। মৈথি ভালোবাসি তোকে, খুব ভালোবাসি।
আমার বুকে যেন কেউ ঢোল তবলা বাজাচ্ছিলো, মাথাটা ফাকা হয়ে গিয়েছিলো। যাকে আমি ভালোবাসি সেও আমাকে ভালোবাসে। সাত পাঁচ না ভেবে দৌড়ে জড়িয়ে ধরলাম, যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। উনি কিছুক্ষণ ভেবলার মতো তাকিয়ে ছিলো। পিছনের শিসের আওয়াজে আমার হুশ ফিরলো। উনাকে ছেড়ে দুরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সারা রাস্তা আমাদের কোনো কথাই হয় নি। বাসার সামনে এসে, যখন ভেতরে যাচ্ছিলাম উনি হাতটা টেনে ধরলেন। পেছনে ফিরতেই উনি কাছে টেনে নিলেন আমায়,
– পরশু চলে যাচ্ছি, একটা চাকরির ব্যবস্থা না করে এখানে আসা হবে না। জানি না কতোদিন লাগবে, তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।
উনার কথাটা শুনে চোখ থেকে যেন পানি থামছেই না, মুখটা তুলে কপালে ঠোঁট ছুয়ে পানি মুছে দিলেন। উনার উষ্ণছোয়ায় আমার শরীর যেন জমে গেলো। মনে যেন হাজারো বসন্ত চলে এসেছিলো। নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না। পকেট থেকে চুড়ির থোকা হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– আমার জন্য অপেক্ষায় থাকিস, খুব তাড়াতাড়ি তোর কাছে চলে আসবো। তারপর একেবারে তোকে নিয়ে যাবো…….
চলবে
#বসন্তের_আগমন
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি