#বলবো_বলবো_করে_বলা_হয়নি
#পর্ব_০২
#অনন্যা_অসমি
সোফায় শুয়ে গুণগুণ করে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে তটিনী। তার মা এবং ছোট ভাই ঘুমে আচ্ছন্ন। আপাতত তার ঘুম আসছে না বলে সে জেগে আছে।
কলিংবেলের শব্দে মনোযোগ ক্ষুণ্ন হলো তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ পর চারটা বাজবে। সাধারণ এই সময় আর্বজনা নেওয়ার লোকটা এসে থাকে। তটিনী ভাবল হয়ত আজো সেই এসেছে। কোনরকম ওড়না দিয়ে নিজেকে আবৃত করে আর্বজনার বালতিটা নিয়ে দরজা খুলল। প্রতিদিনের মতো আজো সেটা বাইরে রেখে সামনে থাকাতে সে থমকে গেল।
নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। এই অবেলায় মাধুর্য এখানে কি করছে? সারাদিন ভাবতে ভাবতে কোন দৃষ্টিভ্রম হলো না তো আবার।
” অতিথি এলে কি তাদের এভাবেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখেন আপনি?”
ধ্যান ভাঙল তটিনীর, বুঝল স্বপ্ন নয় সত্যিই মাধুর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাজারো রকমের অনুভূতির মিশ্রণে কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। পারলে এখুনি মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতো। ভাবল রুমের দিকে ছুট লাগাবে কিংবা দরজাই বন্ধ করে দেবে। তবে এসব চরম পর্যায়ের অভদ্রতামি হয়ে যাবে বলে কিছুই করল না।
” দুঃখিত আমি ভেবেছিলাম আর্বজনা নিতে এসেছে। আপনি আসুন ভেতরে।”
বালতিটা একপাশে সরিয়ে রেখে তটিনী ভেতরে এসে দেখল মাধুর্য সোফায় বসে আছে। সে দ্রুত হাত ধুয়ে মায়ের রুমে গেল।
মিসেস শায়লা মাধুর্যকে দেখে যে বড্ড খুশি হয়েছেন তা উনার মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
” বাবা কেমন আছো তুমি? হঠাৎ এভাবে না বলে এলে যে?”
” আন্টি মা এই আচারগুলো পাঠিয়েছেন। আপনি নাকি অনেক পছন্দ করেন কিন্তু সময়ের কারণে তৈরি করতে পারেন না। তাই মা এসব বানিয়ে পাঠিয়ে।”
” আরে আমি তো সেদিন কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম। তটিনী যাও মাধুর্যের জন্য কিছু তৈরি করে নিয়ে এসো।”
তটিনীও ভদ্র মেয়ের মতো রান্নাঘরে গিয়ে শরবত, কেক, বিস্কিটসহ যা যা পেয়েছে সব একটা ট্রে-তে করে মাধুর্যকে পরিবেশন করল। ট্রে-টা টেবিলে রেখে একমুহূর্ত দাঁড়াল না। একছুটে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে কপাল চাপড়াল সে। এলোমেলো চুল, সাধারণ একটা থ্রী পিস, অদ্ভুতভাবে গায়ে ওড়না পেঁচানো সব মিলিয়ে তার নিজের কাছেই নিজেকে অদ্ভুত লাগছে।
” যারা সারাদিন কাজ করে, পরিশ্রম করে তাদেরকেও আমার চেয়ে হাজারগুণ ভালো দেখাই। ঘর মোছার কাপড়ের মতো লাগছে একদম। এমনিতে ঘরে থাকলে কত সুন্দর লাগে, কিছু না করলেও একদম পরিপাটি লাগে আর আজ! আমিও আরেক, দেখে রাখা উচিত ছিল। একে তো আর্বজনার বালতি তার সামনে রাখলাম এরপর এই অগোছালো রুপ। না জানি আমার সম্পর্কে তার কিরুপ ধারণা তৈরি হলো। নিশ্চয়ই ভেবেছে আমি মেয়েটা অনেক অগোছালো। ক্রাশের সামনে আবারো মানসম্মান খোয়া গেল,আম্মু….” হতাশা আর কষ্ট মিশ্রিত কন্ঠে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল সে৷ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তটিনী হা-হুতাশ করতে ব্যস্ত সেই সময় কেউ তার দরজায় কড়া নাড়ল। ধরফরিয়ে উঠে বসল। দরজা না খুলেই জানতে চাইল, ” কে?”
” আমি, দরজা খোলো।”
মায়ের কন্ঠ শুনে তটিনী দরজা খুলল তবে পুরোটা নয়। আধা খোলা আধা বন্ধ অবস্থায় জানতে চাইল,
” কি চাই?”
” মাধুর্য তোমাকে ডাকছে। বিয়ে করবে না ভালো কথা তাই বলে হুট করে এভাবে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন? কতটা দৃষ্টিকটু লাগে জানো? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে?”
মায়ের ঝাড়ি খেয়ে মুখে কিছু বলার শাসন পেল না সে। কিন্তু মনে মনে বলল, ” যদি এই কাজের মাসির বেশভূষা নিয়ে আর কিছু সময় তার সামনে থাকতাম তবে আমি তো লজ্জায় গেলে বরফ থেকে পানি হয়ে যেতাম সেই সাথে আমি না সে মহাশয় বিয়েতে না করে দিত।”
” কি হলো? কিছু বলো।”
” কেন ডাকছে? তার সাথে আমার কি কাজ?”
” তার থেকে গিয়ে নিজে জিজ্ঞেস করো। আমি এবং তোমার বাবা অনুমতি দিয়েছি তো তুমি চাইলে সম্মতি দিতে পারো। হয়ত এতে তোমার মতামত পরিবর্তন হতে পারে।”
তিনি যেতে গিয়েও ফিরে তাকালেন।
” যাওয়ার আগে একটু পরিপাটি হয়ে যাও। নিজের যত্ন তো কখনো করোনি, অন্তত বাইরের কারো সামনে যাওয়ার পূর্বে একটু ভালো মেয়ের মতো যাও। না হলে তাদের মনে তোমাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। তাড়াতাড়ি যাও, ছেলেটা বসে আছে।”
দরজা বন্ধ করতে করতে তটিনী কান্না কান্না ভাব করে বলল, ” মাও লক্ষ্য করেছে আমাকে পেত্নীর মতো লাগছে। তার মানে সেও করেছে। আমার কপাল এতো সুন্দর কেন?”
” কেন ডেকেছেন আমাকে? কিছু বলার থাকলে মাকে বলতেন।”
” আন্টিকে বলার হলে আমি আপনার খোঁজ করতাম না।”
তার বাঁকা কথা শুনে চুপ হয়ে গেল তটিনী।
” আমি আপনার জন্যই এসেছি। তৈরি হয়ে নিন আমরা বের হবো।”
তার কথা শুনে তটিনী চট করে মাধুর্যের পানে তাকাল।
” বের হবো মানে? আমি আপনার সাথে বাইরে যাব কেন?”
” সেদিন না বলছিলেন কয়েকঘন্টার পরিচয়ে কিভাবে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করবেন, আপনার পক্ষে সম্ভব না। তাই ভেবেছি এখন থেকে রেগুলার আমরা টাচে থাকব, যেন আপনি আমার সম্পর্কে জানতে পারো।”
তটিনী তাকে মনে মনে অনুকরণ করে বলল,
” আমরা রেগুলার টাচে থাকব যেন আপনি আমার সম্পর্কে জানতে পারেন। টাচে থাকার প্রয়োজন নেই, আপনার সম্পর্কে আমি বহু আগে থেকেই জানি। কিন্তু সেটা আপনাকে তো ঘূণক্ষরেও টের পেত দেব না। কিছুদিন আপনাকে ঘোল খাইয়েই ছাড়ব। আমি তো ঠিক করেই রেখেছি আপনাকে আমি এতো দ্রুত ধরা দেব না।”
” মাঝে মাঝে কোথায় হারিয়ে যান আপনি?”
” ও কিছু না। আমি আপনার সাথে যেতে পারব না। আমার সন্ধ্যায় টিউশনে যেতে হবে, মিস হলে স্টুডেন্টের ক্ষতি হবে। তার থেকেও বড় কথা বাবা রাগ করতে পারে।”
শরবতের গ্লাস তুলে নিয়ে মাধুর্য বলল, ” আঙ্কেল কিছু বলবেন না কারণ আমি ওনার থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই এসেছি। আর আপনার আজকে কোন টিউশন নেই তাও আমি জানি। এতোদিন আপনি ব্যস্ত ছিলেন তাই আসিনি, আপনি যে আজ বাড়িতেই থাকবেন এটা আমাকে আঙ্কেল জানিয়েন। তাই অযথা বাহানা তৈরি না করে দ্রুত তৈরি হয়ে নিন।”
তটিনী পুনরায় বিরবির করে বলল, ” তাই তো বলি প্রতিদিন এতোবার করে কেন জিজ্ঞেস করছে আমি কখন বাড়িতে থাকব। শেষমেশ কিনা আমার বাবাই ঘর শক্র বিভীষণ এর ভূমিকা পালন করল। হায়রে কপাল।”
তটিনী যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে সে মূহুর্তে মাধুর্য তাকে থামিয়ে বলল, ” অতিরিক্ত সাজার প্রয়োজন নেই। নিত্যদিন যেরকম পোশাক পরিধান করেন তাই পরলে খুশী হবো।”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাধুর্যের অপেক্ষা করছে তটিনী। তার মায়ের সাথে কিসব কথা বলছে সে।
” চলুন।” বলেই আগে আগে নেমে যেতে লাগল সে। তটিনীর মুখশ্রীতে বিরক্তি হালকা চাপ ফুটে উঠল। বিরবির করে বলল, ” তখন কাজের মাসির মতো লাগছিল সেসময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল আর এখন পরিপাটি হয়ে সুন্দর করে তৈরি হয়েছি এখন কিনা ঘুরেও তাকাল না। তাকাবিই না যখন তখন তৈরি হতে বললি কেন? শয়’তান ছেলে।”
বিরবির করে তাকে বকতে বকতে তটিনী নিচে এসে দেখল মাধুর্য এক হাত কোমড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তটিনী বাঁকা সুরে বলল,
” এভাবে বুড়ি মহিলাদের মতো কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কোমড়ের হাড় দুর্বল হয়ে গিয়েছে নাকি? ব্যথা করছে বুড়ি মহিলাদের মতো?”
” এই আপনার সমস্যাটা কি বলো তো? প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি খুবই সাধারণ, শান্তশিষ্ট মেয়ে৷ কিন্তু আপনার যে এতো বড় একটা বাজে অভ্যাস আছে তা আপনার সাথে কথা না বললে ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম না।”
তটিনী আড়াআড়িভাবে দুই হাত ভাঁজ করে জানতে চাইল, ” তা শুনি কি সেই অভ্যাস?”
” এই যে ক্ষাণিক পর পর নিজে নিজে বিরবির করা। যা বলার স্পষ্ট করে বলবেন।”
” বিরবির কি আর সাধে করি? স্পষ্ট করে বললে যে মানসম্মান সব পদ্মানদীর স্রোতের সাথে ভেসে যাবে, সাথে পিঠেও কয়েক ঘা পড়তে পারে এই আশঙ্কা থেকেই তো স্পষ্ট করে জোরে বলতে পারিনা।”
” আবারো বিরবির করছেন আপনি।” খানিকটা রেগে বলল মাধুর্য। তটিনীও বিপরীতে হিসহিস করে বলল, ” করব আপনার সমস্যা? আমার মুখ, আমার চিন্তা আমার যা ইচ্ছে তাই করব।”
” অবশ্যই আমার সমস্যা। আপনি কয়েকদিন পর আমার একান্তব্যক্তিগত একজন মানুষ হবেন। আপনার ভালো মন্দ সব দিয়ে নজর রাখা আমার দায়িত্ব।”
‘ আমার একান্তব্যক্তিগত একজন মানুষ হবেন ‘ মাধুর্যের এই সামান্য কয়েকটা শব্দ তটিনীকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। পুনরায় শান্ত কন্ঠে সে বলল, ” কোথায় যাবেন তাড়াতাড়ি চলুন। অন্ধকার হয়ে যাবে না হলে।”
” হুম চলুন। আপনার সাইকেলটা বের করুন।”
অবাক হয়ে গেল সে। মাধুর্য কি করে জানল এই ভাবনা তার মাথায় আসার পূর্বেই সে উওর দিয়ে দিল।
” এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। আমি আপনার ব্যপারে মোটামুটি সব খোঁজখবর নিয়ে ফেলেছি। আজ আমরা সাইকেল ডেটে যাবো। সবাই গাড়ি, রিকশা চড়ে নিজেদের সময় কাটায় আমরা না হয় একটু ভিন্ন কিছু করলাম। এতে এই মূহুর্তগুলো আরো দীর্ঘসময় ধরে আমাদের স্মরণে থাকবে। এবার তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন, আমি গেটের বাইরে আছি।”
নিজের সাইকেলের তালা খুলতে খুলতে তটিনী ভাবল, ” এই কারণেই সে আমাকে নরমাল সাজতে বলেছিল যেন সাইকেল চালাতে কোনরুপ অসুবিধা না হয়। আমি আরো কি না কি ভেবেছিলাম।”
চলবে….