পাত্র হিসেবে কিশোরীকালের পছন্দের মানুষকে দেখে থমকে গেল তটিনী। আজ এতোগুলা বছর পর আবারো সেই মানুষটিকে দেখে পুরোনো ভালো লাগা যেন তার হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেল। পাত্রের ছবি তার মা তাকে দেখাতে চেয়েছিল কিন্তু নিজের জেদের বশে ছবিটা সে উল্টিয়েও দেখেনি, ইচ্ছেই যে জাগেনি তার। এখন আফসোস হচ্ছে কেন সে তখন দেখল না।
শরবত দেওয়ার সময় তটিনীর হাত হালকা কাঁপতে লাগল। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে।
” তটিনী বসো।” মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙল তার। ইতঃস্তত হয়ে পাত্রের সামনাসামনি বসল। সবার আড়ালে আড়চোখে সামনে বসা মানুষটিকে কিছু সময় পরখ করে নিল। বয়স বৃদ্ধি পেলেও নামের মতো তার মুখশ্রীর সেই মাধুর্য আজো তার মধ্যে বিদ্যমান বলে মনে হলো তটিনীর। নাম তার মাধুর্য, যাকে কিশোরীকালে তটিনী পাগলের মতো পছন্দ করত। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি, তার আগেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল সে। ভালোলাগা, লজ্জা, অস্বস্তি সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হলো মেয়েটির মনে।
গাছের ফুলগুলো দেখছিল মাধুর্য। তটিনী উত্তেজনায় অজান্তেই গাছের পাতা ছিঁড়ে চলেছে।
” এভাবে গাছের পাতা ছিঁড়বেন না। তাদেরও কষ্ট হয়।” কেঁপে উঠল তটিনী। নিচে তাকিয়ে দেখল সে ইতোমধ্যে পাঁচ ছয়টা পাতা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলেছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাধুর্যের দিকে চেয়ে হাতে থাকা পাতাও দ্রুত ফেলে দিল।
” আসলে.. আসলে আমি…” কথা আটকে যেতে লাগল তার। মাধুর্য তাকে হাতে ইশরায় থামিয়ে দিলো।
” শান্ত হোন। এতোটা হাইপার হওয়ার দরকার নেই।”
চুপ হয়ে গেল তটিনী। মাধুর্য বলল, ” আপনাকে অস্থির লাগছে। শরীর খারাপ আপনার?”
” না না সেরকম কিছু না। আসলে নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে একটু অস্বস্তি লাগে তাই আরকি।”
মুখে এটা বললেও মনে মনে সে ঠিক বিপরীতমুখী কথাটিই আওড়াল।
” অস্থির তো লাগবেই, স্বাভাবিক নয় কি? এককালের ক্রাশকে নিজের সামনে দেখলে তো অস্থির অস্থির লাগবেই।”
” কিছু ভাবছেন কি?”
” না না, আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন। আমি শুনছি।”
” সবকিছু আমিই বললে কি করে হবে? আপনি তো কিছুই বলছেন না।”
” কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছিনা।” পুনরায় মনে মনে তটিনী বলল, ” এই কিভাবে কী বলব বুঝতে না পেরে সেইসময়ও বহু সুযোগ হাতছাড়া করেছি৷ আমার মুখ তো আছে ঠিক কিন্তু তা থেকে প্রয়োজনের সময় কোনরূপ কথা বের হয়না।”
” আঙ্কেল থেকে জানলাম পূর্বে ঢাকায় আমরা যে পাড়ায় থাকতাম তার আশেপাশেই তোমাদের বাড়ি ছিল। তোমার কলেজও আমার ইউর্নিভার্সিটির সামনে দিয়ে যেতে হতো। তোমাদের কি আগে কখনো দেখা হয়েছিল?”
তটিনী তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারল না তার কি বলা উচিত। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে বোঝাল না তাদের কখনোই দেখা হয়নি, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।
” চলো নিচে যাওয়া যাক। তুমি তো কিছুই বলছ না, হয়ত তুমি বোর হচ্ছো।”
আগে মাধুর্য নামতে লাগল তার পেছন পেছন তটিনী ধীরগতিতে নামছে।
” তটিনী তুমি এখন আর কলেজে পড়ুয়া মেয়ে নেই। মাস্টার্স পাশ করেছ তুমি, এখন কিশোরী মেয়েদের মতো আচার-আচরণ একদম মানানসই নয়। ইশ…কি এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। না জানি সে কি না কি ভাবল আমার ব্যপারে। কেন যে আমি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারিনা।”
.
.
মা তটিনীকে ভীষণ বকাঝকা করছে। কারণ সে এই প্রস্তাবে না করে দিয়েছে। তার বাবা বোঝাতে এলে তিনি উল্টো ওনাকেই ঝাড়ি দিলেন।
” তুমি মাঝে আসবে না। তোমার কারণে এই মেয়ে বারবার পাত্রকে রিজেক্ট করছে। কখনো নাকে সমস্যা, কখনো হাইটে তো কখনো চোখে। বাকিসব না হয় মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু এই ছেলেতে কি সমস্যা তোমার মেয়ে তো যুক্তি দিয়ে তাই বলতে পারছেনা।”
বাবা তটিনী পাশে দাঁড়িয়ে মাথা হাত রেখে জানতে চাইলেন, ” ছেলের কোন দোষ কি তুমি পেয়েছ মা? দেখে থাকলে বলো আমরাই মানা করে দেব। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আগে যখন কারো হাতে তোমাকে তুলে দেয়নি আজো দেব না। কারণ সংসার তুমি করবে আমরা তো শুধু একটা মাধ্যম মাত্র।”
” আবারো নরম করে কথা বলছ তুমি। প্রস্তাব নাকোচ করার যৌক্তিক কারণও তো তাদের বলতে হবে। তোমার মেয়েকে বলে দাও যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ আমাকে দেখাতে। যদি দেখা পারে ভালো না হলে এখানেই তার বিয়ে হবে। ”
বাবা-মা চলে যেতেই তটিনী বালিশে মুখ গুঁজে ফেলল। কোন এক কারণে মিটিমিটি হাসছে সে।
ফোনের শব্দে ঘুম হালকা হয়ে এলো তটিনীর। বিকালের দিকে শুয়ে হাজারটা চিন্তা ভাবনা করতে করতে কখন যে ঘুমে পড়েছিল সে টেরও পাইনি। মিটমিট করে চোখ খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখল এখনো আবছা আবছা আলো আছে। এদিকে অনবরত ফোনের রিংটোনের শব্দে কপাল কুচকে এলো তার৷ আধো আধো চোখ খোলা অবস্থায় হাতড়িয়ে কোনরকমে ফোনটা খোঁজে পেল সে।
” হ্যালো কে বলছেন?” চোখ বন্ধ করে ঘুম জড়ানো কন্ঠে সে বলল।
” তটিনী?”
” হুম আপনি কে? কাকে চাই?”
” তোমাকে।” ঘুম হালকা হয়ে এলো তার। কানের কাছ থেকে ফোনটা সরিয়ে দেখল আননোন নম্বর। পুনরায় কানের কাছে নিয়ে প্রশ্ন করল, ” বুঝলাম কিন্তু আপনি কে?”
” মাধুর্য, সকালে যার সাথে আপনার দেখা হলো।”
একপ্রকার লাফ মেরে শোয়া থেকে উঠে বলল তটিনী, বুক ধকধক করছে তার। এক নিমেষে যেন ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গেল। হাত দিয়ে চুলগুলো কোনরকমে ঠিক করে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” মাধুর্য! আপনি হঠাৎ ফোন করলেন যে?”
” বিরক্ত করলাম বুঝি? ব্যস্ত ছিলেন?”
” না না সেরকম কিছু নয়। একটু চোখ লেগে এসেছিল এই আরকি।”
” তাহলে তো আপনার ঘুমের ব্যঘাত ঘটালাম।”
” কোন সমস্যা নেই। কিছুক্ষণ পর এমনিতেই উঠে যেতাম। হঠাৎ ফোন করার কারণ?”
” মায়ের থেকে শুনলাম আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করতে রাজি না। কারণটা কি জানতে পারি?”
চুপ হয়ে গেল তটিনী। সে আশা করেনি মাধুর্য এতো তাড়াতাড়ি তাকে ফোন করে কারণ জানতে চাইব। কথা সাজাতে লাগল সে।
” তটিনী আছেন?”
” হ্যাঁ। আসলে কয়েকঘন্টার পরিচয়ে তো কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করা যায় না। বিয়ে একটা স্থায়ী সম্পর্ক। যার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবো তার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই আমি। তাই কয়েকঘন্টার পরিচয়ে আমার পক্ষে সম্ভব না তার দোষগুণ সব নজরে আনা। আমি এরকম কারো সাথে নিজের জীবন অতিবাহিত করতে চাই যার সাথে আমার চিন্তাধারণা মিলবে। আমার মনে হয়নি আপনার সাথে আমার কোনকিছুর মিল হবে।” কথাগুলো বলার সময় অনেক কষ্টে তটিনী নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।
” ও বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা আজ রাখি পরে কথা হবে।” তাকে পরবর্তীতে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল মাধুর্য। তার কন্ঠস্বর শুনেই তটিনী অনুধাবন করতে পারল তার বলা কারণ মাধুর্যের মোটেও পছন্দ হয়নি। অবশ্য হওয়ারও কথা নয়। তটিনী কথায় কথায় তার মায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছে মাধুর্যই তাকে পছন্দ করেছে। সে আসতে চেয়ে বলেই তার বাবা-মা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন।
মৃদুস্বরে হেসে উঠল তটিনী। ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মাধুর্যের ইনস্ট্রাগ্রাম স্ক্রল করতে লাগল সে। একটা ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, ” আপনি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াতে কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম তা শব্দে প্রকাশ করা যাবে না। জীবনে কাউকে প্রথম এতোটা পরিমাণ ভালো লেগেছিল আর তা জানানোর আগেই সে হারিয়ে গেল। এতোগুলা বছর আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলাম এবার আপনার হওয়ার পালা। আপনাকে আমি এতো সহজে ধরা দেব না। আকাশ থাকা সাদা মেঘের মতো আমি আপনার সামনেই থাকব তবে চাইলেও আপনি ছুঁতে পারবেন না। আমি ধরা দেবো তবে আপনি বিরহের অনলে দগ্ধ হওয়ার পর।”
চলবে….
#বলবো_বলবো_করে_বলা_হয়নি
#পর্ব_০১
#অনন্যা_অসমি