#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ৬)
কলমে #রেহানা_পুতুল
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। তাকে ডিভোর্স দিবনা। কিন্তু কড়া শাস্তি দিব কৌশলে ও কায়দা করে।
কিছুদূর গেলে আমার চরণগতি মন্থর হয়ে আসে। ভাবছি বাদল ভাই আমার প্রতিবেশী। আজো উনার নয়নজুড়ে আমার জন্য প্রার্থনার মন্দির সজ্জিত। যদি আমার এই দুর্দিনে উনাকে পাশে পাই। তাহলে হয়তো বড় কল্যাণ হবে আমার। ব্যাগের ভিতর হতে বাদল ভাইয়ের ভিজিটিং কার্ডটা হাতে নিতেই মনে পড়ল,
আমারতো কোন ফোন নেই। নির্দয় মানুষটা ভেঙ্গে দিল। মনে মনে হায় হুতাশের ঝড় উঠল।
শিলা কোন সমস্যা?
খুব নিকট হতে বাদল ভাইয়ের ভরাট গলা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই,
ঘাড় ঘুরিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।
বাদল ভাই আপনি আমার পিছনে?
আমিতো সবসময় তোর পিছনেই ছিলাম শিলা। কোনদিন কি তোর পাশে বা সামনের আসার প্রশ্রয়টুকু পেয়েছি? বিপুল আক্ষেপের সুরে বলল বাদল ভাই।
আমি গোলগোল চোখে বাদল ভাইয়ের দিকে হা হয়ে চেয়ে রইলাম।
এতটা বছর পর কপালগুণে তোকে সামনে পেলাম কুড়ানো ঝিনুকের মতন। দৃষ্টির আড়াল করার সাধ্য যে আমার নেই। তাই তোকে অনুসরণ করেই তোর পিছু নিয়েছি। উদ্দেশ্য তোর বাসাটা চিনে ফেলা। এই দেখ রাখঢাক না করে বলেই দিলাম।
ম্লান বদনে স্মিত হেসে বললাম,
আপনি সেই তরুণ বয়সের বাদল ভাইই রয়ে গেলেন। যাইহোক আমি আপনাকে স্মরণ করেই একটু থামলাম। বাদল ভাই আমার বড় বিপদ। আমি আর কিছুই বলতে পারলামনা।
উনি হকচকিয়ে গেলেন। অস্থির কন্ঠে বললেন,
রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনব নাকি?কোন এক জায়গায় বসি?
বাদল ভাই লোকালয় ভাললাগছেনা। সামনে একটা শান্তিপূর্ণ জায়গা আছে। এই ৬ নং সেক্টরের দিকেই। চলেন সেখানে গিয়ে বসি।
উনি পট করেই একটা রিকশা ডেকে নিলেন। আমিও সাতপাঁচ না ভেবে উঠে পড়লাম। সেখানে গিয়ে নেমে একটি বেঞ্চের মাঝে দুজন বসলাম নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল। ওরা নিশ্চয়ই দুঃশ্চিন্তা করছে মায়ের জন্য। তাই প্রথমেই বাদল ভাইয়ের মোবাইল দিয়ে বাসায় ফোন দিলাম। এশার কাছে আমার আগের সস্তা মোবাইলটা আছে। ওরা গেইম খেলে সেই সেটে। এবং আমি বাইরে গেলেও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
মাহিন রিসিভ করল। কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
আম্মু তুমি কোথায়?
বাবা আম্মু এক্ষুনি চলে আসছি। তোমার আপু কই? আম্মু কাজেই বাইরে আছি। তারা দুজন কই?
জানিনা আম্মু। এশা আপু অন্যরুমে মনে হয়। তার ও নাকি জরুরি কাজ আছে। আমরা রুম থেকে বের হইনি। আব্বু কিছুক্ষণ পরপর এসে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।
আচ্ছা আব্বু থাক। আম্মু আসতে দুপুরের খাবার নিয়ে আসব।
ফোন রেখে তারপর বিস্তারিত জানালাম বাদল ভাইকে এ টু জেড়। বাদল ভাই বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। এরপর বিজ্ঞের মত করে বললেন,
আচ্ছা শোন। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয়। যদিও তখন মাথা খাটতে চায়না। মস্তিষ্ক অবশ হয়ে থাকে। তবুও মাথা খুলতে হবে। তোর জীবনের গল্প শুনেই আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাই আমার জীবনের গল্প আজ নাইবা বললাম তোকে।
বিষয়টা যদি এমন হয়। সেই তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিল?
এটা কস্মিনকালেও করবেনা সে। মর্যাদাকে সেও কম বেশি ভয় পায়। অপরদিকে তাদের সবাই আমাকে দারুণ পছন্দ করে। সে তাদের সামনে মিথ্যা কারণ ও দেখাতে পারবেনা আমাকে ছেড়ে দেওয়ার।
আচ্ছা তাহলে তুইও তাকে ডিভোর্স দিসনা। এতে তোর তিন সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অতল গহবরে তলিয়ে যাবে। হুট করে তুই যাবতীয় খরচ বহন কিভাবে করবি? পারবিনা। আবার যদি ধর আমিই দিলাম। তখন তোর সম্পর্কে তারও নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। নয়তো মোবাইল তোকে আমি আজই কিনে দিতে পারি। এতে অশান্তি হবে তোর। তাকে বল সেই মহিলাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে। যদি ভালর ভালো দিয়ে দেয়। তাহলেতো কোন কথাই নেই। আর যদি না দেয়, তাহলে তুই তোর তিন সন্তানকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে যাবি। তুই শুধু ততদিন এই বাসায় থাকবি। যতদিন তুই নিজে শক্ত পায়ে না দাঁড়াবি। তখন পরিবার, সমাজে তার মাথা এমনিতেই হেঁট হয়ে যাবে। তোর প্রতি সে হৃদয়হীন হতে পারে। কিন্তু সন্তানদের জন্যতো মায়া আছে তার। আর যখন তিন সন্তান তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। সেই প্রগাঢ় মানসিক যন্ত্রণা তাকে তিলেতিলে নিঃশেষ করে দিবে।
শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা বড় বেশি যাতনার। এটা অন্তত আমি রিয়েলাইজ করতে পারি শিলা।
আমি উনার কথার ইংগিত ধরতে পারলাম। তবুও নিরব রইলাম বোবা প্রাণীর মতো।
তুই কোন কাজ করতে পারবিনা? অর্থাৎ আত্মনির্ভরশীল হওয়া ?
আমি উদ্দমতার সঙ্গে জবাব দিলাম বাদল ভাইয়ের। পারব বাদল ভাই। আমাকে পারতেই হবে। তাকে ছাড়বনা। কিন্তু ধরবওনা। পঁচিয়ে মারব তাকে। আমি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাব আমার তিন সন্তানকে নিয়ে। আমার সন্তানেরা আমার দূর্বার শক্তি। ওরাই আমার অর্জিত সম্বল ও সম্পদ। আমার বেঁচে থাকার লড়াই হবে ওদের জন্য।
এইতো গুড় গার্ল। বাসায় চলে যা। আমাকে সব জানাবি কি হয় না হয়। ভরসা রাখ আল্লাহর উপর। আর কোন কর্ম করবি, কোনটা পারবি সেটা ভেবে ঠিক কর। আমি সর্বাত্মকভাবে হেল্প করব তোকে।
আচ্ছা বলে উঠে দাঁড়ালাম। বাদল ভাই অদূরে একটি হোটেল থেকে চার প্যাকেট বিফ খিচুড়ি নিয়ে দিল। আমি টাকা দিতে গিয়েও উনার অধিকারসুলভ চোখ রাঙানির কাছে হেরে গেলাম।
একটা রিক্সা ডেকে দিল উনি। আমি উঠে বসতেই ভাড়াও মিটিয়ে দিল বাদল ভাই।
আমি একটা ফার্মেসীর সামনে নামলাম রিকসা থেকে। এই ফার্মেসী এশার ক্লোজফ্রেন্ড তুবার বাবার। তিনি আবার প্যারামেডিক্যাল কোর্স করা ডাক্তার ও। তুবার মা রাইমা ভাবির সাথে আমার সম্পর্ক বোন বন্ধুত্বের মতই। তার বাবার সাথেও ভাল পরিচিতি রয়েছে আমার। ওর বাবাই ক্যাশে বসা ছিল।
আমি হাইডোজের দশটি ঘুমের ট্যাবলেট নিলাম। উনি আমি বলেই এক কথায় দিয়ে দিলেন কোন প্রশ্ন না করেই। নয়তো প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ফার্মেসীই এভাবে কাউকেই এতগুলো ঘুমের ট্যাবলেট দেয়না।
অবসন্ন বিকেলের মত ঝিমিয়ে আসা দেহমন নিয়ে বাসায় পা রাখলাম। কলিংবেল না চাপতেই ভিতর থেকে কোন পুরুষের গমগমে কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। মাহিন গেট খুলে দিল। আমি বাসার ভিতরে পা রেখেই ভাষাহীন, স্তব্দ,নির্বাক হয়ে গেলাম। দেখলাম আমার বড় ভাসুর ও তার স্ত্রী।
আয়রা আমাকে দেখেই মামনি বলে খরগোশের মত তিন পায়ে লাফিয়ে কোলে চড়ে গেল। এশার রুমের একপাশে খাবারের প্যাকেটগুলো লুকিয়ে রাখলাম।
শুনতে পাচ্ছি আমার ভাসুরের কথা,
তুই আমাদের সব ভাইবোনের ছোট। তোকে দিতে কোনভাবেই আমরা কম দেইনি। ঢাকা শহরে উত্তরায় দুটো দোকান থাকা চাট্টিখানি কথা। আমিই তোকে দিয়েছি। এই যে চাবি তোর থেকে নিয়ে নিলাম। তোর ব্যবসা করতে হবেনা। দোকান বন্ধ থাকবে। দোকানের চাবি ঠিক সেদিন পাবি। যেদিন তুই শুধরাবি। যেদিন এই অসভ্য লোভী নারীকে বিদায় দিবি। এই মহিলা যেন কোন রুমে না ঘুমাতে পারে। সে এই বাসায় আবর্জনা বা পতঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং তার স্থান যেন হয় কিচেনে,বারান্দায়,নয়তো স্টোররুমে।
আর এদের খরচ আমিই টানব। ও হ্যাঁ মনে রাখিস, কোনভাবে যদি তোর দিক হতে শিলা ও তার বাচ্চাদের উপর এতটুকু অবজ্ঞা, অনাদর শুরু হয়। তাহলে তোকে চৌদ্দশিকের ভাত আমিই খাওয়াব। তৃতীয় কেউ করা লাগবেনা কিছুই।
আমি গুটিশুটি পায়ে রুমের দরজায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম এহসান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে আছে একটি চেয়ারে। মিতাকে দেখা যাচ্ছেনা। সে নাকি ওয়াশরুমে আমাদের বিছানার চাদর, বালিশের কভার সব ধুয়ে দিচ্ছে এশার নির্দেশ পেয়েই। বাসার অবস্থা ভীতিকর হয়ে আছে। প্লিজ #রেহানা_পুতুল পেইজে লাইক ও ফলো দিবেন।
আমার বড় জা এসে শান্তনার বানী শুনালেন। বললেন, সবর কর শিলা। বদমায়েশটা তোর ভাইকে কথা দিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আমাদের খবর দিল এশা। বুঝলি। তাকেও আচ্ছামতে দোলাই দিয়েছে এশা। এশার হিম্মতের তারিফ করতেই হয় শিলা। এমন একটা মেয়ে পাঁচটা ছেলের সমান। আর কি চাই তোর। এই কি জীবনে কম পাওয়া? বল।
ভাবি দোয়া করবেন। এশাকে যেন আমি স্বপ্নের মত করে তৈরি করতে পারি। আমার জন্যও দোয়া করবেন। যেন একজন আদর্শ মা হতে পারি।
তারা এহসানকে আবারও কিছুকথা বলে গেল বোঝানোর ধাঁচে। এহসান মাথা নামিয়ে তাদের কথার সম্মতি দিল। অতঃপর ভাই ভাবি চলে গেল। আমি দরজা বন্ধ করে সন্তানদের নিয়ে খেলাম। তারাও বেশ আয়েশ করে খেল। শরীরে আলস্যতা ঝেঁকে বসল খাওয়ার পরেই। পরক্ষণেই তিন সন্তানকে আমার বুকের মাঝে নিয়ে মুরগির ছানার মত ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেলাম।
পরেরদিন ভোর গড়িয়ে বেশ বেলা হয়ে গেল। আমি এশার রুম থেকে বের হয়ে চুপিসারে খেয়াল করলাম। এহসানের এখনো উঠার কোন নাম নেই। আজ অন্য চাদর বিছিয়ে আমাদের রুমে আমি আর তিন সন্তান একসাথেই ঘুমালাম। তারা দুজন স্টোররুমেই ঘুমিয়েছে।
আমি মনে মনে বিজয়ের হাসি হাসলাম। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম। হুম কাজ হয়েছে তাহলে। ঘুমাও বৎস। এই পৃথিবীতে নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। ভুলের মাশুল না দিলে মানুষ ভুলের পরে ভুল করেই যায় ক্রমাগত। জেগে উঠো নারী। গর্জে উঠো নারী। আঁধার ভাঙ্গার শপথ নাও শক্ত হাতে।