ফেরার কোন পথ নেই পর্ব ১৫

0
521

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১৫)
কলমে #রেহানা_পুতুল
নিশুতি রাত। ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁই ছুঁই। ঘুম ছুটে গেল। এক অজানা আশংকা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে পিষে মারছে। একসময় বীরদর্পে চলা মানুষটা নিজ কর্মদোষে আজ পথের মানুষ হয়ে গেল। তার পাংশুটে মুখচ্ছবিখানি ঘুরেফিরে উঁকি দিচ্ছে মনের আরশীতে। শত্রুর দুর্দিনেও মানুষ সহমর্মিতার হাত বাড়ায়। আর সেতো ছিল একসময় আমার সকল ভালো থাকার উৎস। বাচ্চাদের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু।

আমরা মানুষ। মানব ধর্মই আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্ম। যখন একজন মানুষ তার সমস্ত ভুল বুঝতে পারে। অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয় প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। ক্ষমা চায় আকূল নয়নে। তখন কি তাকে ক্ষমা করা উচিত নহে? আমার ধর্ম,শিক্ষা,মানবিকতা তাই জবাব দেয়। কি করব ভেবে দিশেহারা আমি। ভাবনার দোলাচলে দুলছি অনবরত। বিছানার এপাশ ওপাশ করতে করতে আঁখিকোণে আবার ঘুমেরা দল বেঁধে নেমে এলো।
পরের দিন ওদের স্কুলে দিয়ে দোকানে আসলাম। কাজের প্রয়োজনে বাদল ভাইকে ফোন দিলাম। বাদল ভাইয়ের সাথে দরকার না হলে কোন কথাই হয়না আজকাল। প্রসংগত এহসানের বিষয়টা শেয়ার করলাম।

শুনে বলল,
তুই এখন কি করবি। এটা সম্পূর্ণতই তোর পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত। আমি এ বিষয়ে কোন মত দিতেই ইচ্ছুক নই শিলা। তবে ভাবিয়া করিস কাজ। করিয়া ভাবিসনা।

দোকানের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। মাঝে মাঝে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারে যাই আমি। অল্পস্বল্প করে নিজেও মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দুচার কথা বলি। সবার করতালিতে আন্দোলিত হই। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় প্রবলতর। আমার প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডি আই এ পাশ পর্যন্ত। অপরিণত বয়সে বিয়ে,সংসার,পরপর তিন সন্তান জন্ম দেওয়া। এই ব্যস্ত নগরীতে একা সংসারে একা হাতে ওদের লালন পালন করা। সবমিলিয়ে কেটে গেল বসন্তের পর বসন্ত। আটপৌরে জীবনের ঘেরাটোপে বন্দী থেকে আমি ভুলে গিয়েছি আমার স্বপ্নের কথা। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উচ্চ পদের চাকরি করা। আমার পরিচয় হয়ে গেলো সচ্ছল পরিবারের স্মার্ট গৃহবধূ।
ভাবছি যেকোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের সাবজেক্ট এ অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করব। কেননা যেহেতু এখন ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে অনেকের সাথে উঠাবসা হয়। তাই জানাশোনার পরিধি বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়ছে।

ওদের নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। মায়ের ফোন বেজে উঠলে আমিই রিসিভ করি। সেজো খালার ফোন।

গভীর আক্ষেপের সুরে জানালেন,
শুনছিস। মিতা মারা গেল।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। শীতের কনকনে বায়ুর মতো কিছু একটা বয়ে গেল হৃদপিণ্ডের উপর দিয়ে। কম্পিত গলায় খালাকে জিজ্ঞেস করলাম,
কিহহ? কখন? কিভাবে?

খালা বলল,
আমিতো এতকিছু জানিনা। এখন বাড়িতে সবাই বলাবলি করছে মিতা এখন এই বাড়ির বউ নয়। তার মাটি কোথায় দেওয়া হবে? তার বড় ছেলে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছে,
মা হিসেবে ও মানুষ হিসেবে কারো কবর দেওয়া নিয়ে কোন বিধান নেই। যে কোথাও যে কাউকে কবর দেওয়া যায়। শোন রাখি। বাড়িতে কেয়ামত হচ্ছে যাচ্ছেরে। আল্লাহ!কি হইলো এসব। এমনিতেই মিতা অন্য দিকে খারাপ ছিলনা। ভালই ছিলরে।

খালার থেকে ফোন রাখলাম। ভাবছি একজন মানুষ যতই মন্দ হোক। মৃত্যুর পর আমরা তার ভালো গুনগুলোই প্রকাশ করি। মন্দটা বলে তার প্রাণহীন দেহটাকে আরও মন্দ করে তুলিনা। এটাই হওয়া উচিত। তাই এটাই হয়।

মাকে দিলাম মিতার মৃত্যুর সংবাদ। এশা, মাহিন,আয়রাও আমার পাশে এসে বসেছে। আমাদের বাসার পরিবেশটাও নিরানন্দ হয়ে গেল। মার মুখেও মিতার টুকটাক প্রশংসা শুনলাম। আগে গেলে মাকে ভাবি ভাবি বলে অনেক খাতির যত্ন করত। এটা ওটা দিয়ে আপ্যায়ন করতো।

ডোরবেল বেজে উঠলে আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল। এহসান কোনক্রমে বাসা চিনে চলে এলো নাকি। মাহিন গেট খুলল। ইন্টারনেটের বিল নিতে এসেছে এক ছেলে। মাঝে দিয়ে এসব কিছুই ছিলনা।

ডিসের সংযোগ খুলে ফেলেছি। রোজ দুধ নেওয়া, দৈনিক সংবাদ পত্র নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ছুটা বুয়া ছেড়ে দিয়েছি। এসি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছি। ডিপ ফ্রিজের সব বের করে সুইচ বন্ধ করে দিয়েছি। যতভাবে সম্ভব খরচ কমিয়ে এনেছি। কেবল তিন সন্তানের সব খরচ আগের মতই চলমান রেখেছি। কারণ তার একটাও বন্ধ করে ওদের লাইফে জটিলতা বা কোন অসুবিধা সৃষ্টি করতে চাইনি আমি।এখন আবার সব আগের মতই ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে।

মিতার মৃত্যুতে হুট করেই আমার ভাবনার মানসপটে বিপুল পরিবর্তন হলো। দৃশ্যপট বদল হলো। বাদল ভাইকে ও একরাম ভাই,তার স্ত্রীকে মিতার মৃত্যু সংবাদ দিলাম। একরাম ভাই ও ভাবিকে অনুরোধ করে বাসায় আনলাম।

উনাদের বললাম,
এহসানকে ক্ষমা করে দিয়ে ফিরিয়ে আনব বাসায়। কিন্তু এতকিছুর পর কিভাবে?

এশা উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার বয়সটাই এখন বেয়াড়ার,উত্তেজনার।

ভাইজান সিচুয়েশন ব্যাখ্যা করে এশাকে বুঝিয়ে নিলেন।
দেখ মা, যেহেতু সেই মহিলা এখন এই পৃথিবীতেই বেঁচে নেই। তাহলে তোর বাবা সেই পথে আবার যাওয়ার সুযোগ ও নেই। আল্লাহ তাকে যথেষ্ট পরিমাণে শাস্তি দিয়েছে। সবইতো হারাল সে।

এশা বুঝ নিল বড় চাচার কথা। বলল,
ঠিকাছে আম্মু ও তোমরা যা ভালো মনে করো। কিন্তু আম্মু আব্বুকে ছেড়ে দিয়েছে। কিভাবে একসাথে থাকবে?

আমার বড় জা বলল,
তুই চিন্তা করিসনা মা। আমরা বড় কোন ঈমাম থেকে এই বিষয়ে মাসালা জেনে নিব। যা হবে ধর্মীয় বিধান মতেই হবে। নয়তো নাহ। কারণ বিয়ে ছাড়া তোর আব্বু এ বাসায় থাকা সম্ভব নয়। তোর আম্মুর জন্য সে এখন বেগানা পুরুষ।

মাও ভাই ভাবির সাথে পূর্ণ সহমত প্রকাশ করল। ভাই বলল ওর হাতে কি মোবাইল আছে?

সেটা আমি জানিনা ভাইজান। তবে সেদিন বলল,
হাইকোর্ট মাজারের ভিতরেই সারাদিন থাকে। খুঁজে পেতে সমস্যা হবেনা আমাদের।

আচ্ছা তাহলে কালই তুমি গিয়ে নিয়ে আস তাকে।

ভাইজান আমি একা গেলে নাও আসতে পারে। আপনি সহ আমরা সবাইমিলে গেলে তখন না চাইলেই আসতে রাজী হবে।

আচ্ছা তাহলে কাল বিকেলে খালাম্মাসহ তোমরা সবাই তৈরি হয়ে থেক। ওদের মুখ দেখলে আর বিমুখ হতে পারবেনা।

ভাইজান ও ভাবী নাস্তা খেয়ে চলে গেল।

আমি খেয়াল করলাম একরাম ভাইয়ের অভিব্যক্তি। এহসানের কথা বলার সময় উনার চোখেমুখে দরদ ছিল। উনার মায়ের পেটের ভাই। মায়া থাকাটা অমূলক নয়। কথায় আছে রক্তের বন্ধন যায়নাকো খন্ডন। মনে হয় উনি পরিস্থিতি বুঝেই চুপ ছিল এই তিনবছর। পাছে বাচ্চারা ও আমি মা যদি ভুল বুঝি উনাকে।

রাতে বিছানায় ছটপট করছি। অনিয়ন্ত্রিত আবেগের পিদিম আমার বক্ষ পিঞ্জিরায় দপ করে জ্বলে উঠল। কি প্রখর উজ্জ্বল আভা তার। কি বর্ণিল। কি স্বপ্নময়।

আমি কল্পনা করছি এহসানকে নিয়ে। এখন ত আর মিতা নেই। এহসানের ও ঢের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। তাহলে ও বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করলে আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নিয়মানুযায়ী আবার বিয়ে হবে। তখন ও ব্যবসার হাল ধরলে আমি ভার্সিটি এডমিশন নিতে পারব। আমার অসমাপ্ত শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হবে ভালোর ভালই। নিজেকে সময় দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারব। বাচ্চারাও ফিরে পাবে তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া বাবাকে।

ব্রোকেন ফ্যামিলির তকমা নিয়ে ওদের বাঁচতে হবেনা। পরের সংসারেও মেয়েরা খোঁটা শুনবেনা। এমন উথাল-পাতাল চিন্তায় আমি নিমগ্ন। কিভাবে যে রাত পার হলো টেরই পেলামনা।

একটা উড়ু উড়ু ভাব অন্তরে শাখা গজিয়ে উঠছে। আমিও বাধা দিলামনা। হোক না মন আজ বাঁধনহারা। ভাবুক না যা তার ইচ্ছে। উড়ুক না পাখা মেলে আমার মেঘাচ্ছন্ন মৌনাকাশে।

পরের দিন আমি, এশা,মাহিন,আয়রা,মা,ভাবি,একরাম ভাই সহ চলে গেলাম একটা ক্যাবে করে হাইকোর্ট মাজারের ভিতরে। আমরা কেউই তার নাম্বারে আগে থেকে ফোন দিইনি। উদ্দেশ্য তাকে চমকে দিব। তব্দা খাইয়ে দিব।

আমরা সবাই বিশাল মাজারের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে এহসানকে খুঁজছি। এদিক সেদিক উদ্বিগ্ন চাহনিতে তাকাচ্ছি সবাই। মাজারের বাইরের পিছন দিকটায় গেলাম আমরা সবাই। বাস্তুহারা মানুষগুলো পিছন দিকেও শুয়ে বসে দিন পার করে। এদের যে আর কিছুই করার নেই এই পৃথিবীতে।

চোখে পড়ল বেশকিছু মানুষের জটলা। আমরা এগিয়ে গেলাম। ভীড়ের ভিতরে কি হচ্ছে দেখা ও বোঝা যাচ্ছেনা। উপস্থিত মানুষগুলোর মুখেও কোন রা নেই। তারা ধ্যানের মতো অবিকল চেয়ে আছে সামনের দিকে। ওদের সবাইকে পিছনে রেখে আমি লম্বা পায়ে এগিয়ে গেলাম। সেই ভীড়ের মাঝে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম শিকারি চোখের ন্যায়।

আমি এহসান বলে চাপা আর্তনাদে মাটিতে বসে পড়লাম।

ক্রমশঃ ১৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here