#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_৬৪
#নিশাত_জাহান_নিশি
অবশেষে সেই শুভক্ষণ এলো! বিয়ের সাজে পরিপূর্ণ সজ্জিত নীহারিকা। সুদূর কানাডা থেকে রূপল নীহারিকার জন্য বিয়ের লাল লেহেঙ্গা হতে শুরু করে স্বর্ণ গহনাও নিয়ে এসেছিল! মনে মনেই তার জানা ছিল বিধাতা তার ভাগ্যে নীহারিকাকেই লিখে রেখেছেন। রূপলের আনা সব সাজ সরঞ্জাম পড়েই নীহারিকা আজ লাল টুকটুকে বউ সেজেছে।
লাল শেরওয়ানি ও মাথায় টোপড় পড়ে রূপল আজ রাজার বেশে বর সেজে এসেছে তার স্বপ্নের রাজকুমারীকে রানী করে নিয়ে যেতে। হাসিখুশি উপচে তার বিস্তীর্ণ মুখশ্রীতে। স্বপ্ন যেন আজ সত্যি হতে চলছে তার। উচাটন হয়ে উঠছে মন। তুলি, দিশা ও নীহারিকার দুঃসম্পর্কের সব কাজিন বোনরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করে বিয়ের গেইট ধরেছে। ব্যস, বেঁধে গেল দুই পক্ষের মধ্যে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া। মেয়ে পক্ষ যেমন গেইট ধরার টাকার জন্য হরদমে নিজেদের মুখ চালিয়ে যাচ্ছে তেমনি বরপক্ষের সজল ও শাকিল মিলেও রূপলের পকেট খরচ বাঁচানোর খাতিরে অনর্গল তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাড় দিচ্ছেনা। বিয়ের আসল মজা হয়ত এখানেই! চাপা ও বুদ্ধির জোরে লড়াইয়ে কে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারে।
রূপলও বসে বসে উভয় পক্ষের রঙ দেখছে! মাঝেমধ্যে দিশা ও তুলির সাথে তর্কেও জড়িয়ে পরছে। কৃপণতা দেখাচ্ছে বেশ। বিষয়টকতে সে বেশ মজা নিচ্ছে। মেয়ে পক্ষের জোর দাবি হলো দশ হাজার টাকার কমে তারা একটাকাও হাতে নিবেনা! ছেলে পক্ষের দাবি হলো তিন হাজার টাকার বেশি তারা একটাকা ও দিবেনা! এদিকে এখনও মরিচ মেশানো শরবত ও খাওয়ানো হয়নি রূপলকে। কিছুই মুখে তুলছেনা রূপল! শালিরা যে তাকে নাজেহাল করার জন্য উঁৎ পেতে আছে বেশ বুঝতে পেরেছে রূপল। তাইতো দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে সে।
মেয়ে পক্ষরাও কম যায়না। পথ আটকে রেখেছে বর পক্ষের। তাদের আবদার না মেটানো অবধি কিছুতেই তারা বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিবেনা বরপক্ষকে। বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে নিহালকে ডেকে আনল পিয়াসা! ভাইয়ের হয়ে সুপারিশ করল নিহালের কাছে। নিহাল আসতেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেল! মেয়েপক্ষরা প্রায় দমে গেল। আওয়াজ তুলে নিহাল মেয়ে পক্ষকে বলল,
“আরে তোমরা থামো তো। তারা এখন যা দিতে চাইছে তাই নিয়ে নাও। সামান্য কিছু টাকার জন্য সিনক্রিয়েট করার কোনো মানে হয়? কাজী সাহেব সেই কখন থেকে বসে আছে। বিয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। শুভ কাজে দেরি করতে নেই। দেখি সাইড দাও তাদের।”
নিহালের নির্দেশ মেনে সবাই চুপ হয়ে গেলেও দিশা চুপ হলোনা! নম্র ভদ্র গলাতেই সে নিহালকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“প্রথমেই সরি ভাইয়া। কারণ আমি আপনার মুখের উপর কথা বলছি। কিন্তু একটু হিসেব করে দেখুন তো আমরা মেয়েপক্ষের লোক কতজন। মাত্র তিন হাজার টাকায় হবে বলুন? কমচে কম পাঁচ হাজার প্লাস তো লাগবেই। বিয়ে করতে এসে এত কিপ্টেমি করলে কী চলবে বলুর? শালিদের মন খুশি করাও তো জিজুর দায়িত্ব। শালিদের বদদোয়া একবার লাগলে কিন্তু শেষ! সংসার আর করা লাগবেনা জিজুর।”
তখনি রূপল চেয়ার ছেড়ে ওঠে সোজা দাড়িয়ে পরল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে গুনে গুনে দশ হাজার টাকা বের করে দিশার হাতে ধরিয়ে দিলো! উপস্থিত সবাই উজবুক দৃষ্টিতে রূপলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সজল ও শাকিলের মাথায় তো হাতই চলে গেল! এতক্ষণ যাবত তর্ক করে তাদের লাভটা হলো কী? খামোখা এনার্জি লস হলো। এই টাকা থেকে যদি কিছু টাকা তারা ভাগে পেত তাহলেও না হয় মনটাকে শান্তনা দেওয়া যেতো! মাথা থেকে টোপড়টি খুলে রূপল এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করল। গলা ঝেরে ভাবশূণ্য গলায় বলল,
“আমার ও নীহুর এই স্পেশাল দিনে আমি কারো কাছ থেকে কোনো বদদোয়া চাইনা! শালিদের আবদার পূরণ করা যেমন আমার দায়িত্ব ছিল তেমনি আমার পথ ছেড়ে দাড়ানোটাও এখন শালিদের দায়িত্ব বলে মনে করছি। দেখি হাঁটো সব। বিয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
খুশিতে গদগদ হয়ে গেল মেয়েপক্ষরা। রাস্তা ছেড়ে দাড়ালো তারা। নিহাল বেশ সাদরে ছেলেপক্ষদের ভেতরে নিয়ে এলো। রূপল ও তার কাজিন এবং তার বন্ধু-বান্ধবদের পালাক্রমে স্টেজে বসিয়ে দিলো। বরপক্ষের সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বিয়ে পড়ানো হবে। নীহারিকাকে কখন দেখবে সেই পেরেশানিতে রূপলের খাওয়াদাওয়া একদমই হচ্ছেনা! বেসামাল হৃদয় ও অস্থির দৃষ্টি তার কনে সেজে বসে থাকা নীহারিকার রুমের বেলকনির দিকে স্থির। নীহারিকা ও এখনও অভুক্ত অবস্থাতে আছে। বিশেষ করে এই কারণেই রূপল কিছু মুখে তুলেনি।
হৃদিকে কোলে নিয়ে সবিতা মাথা নুইয়ে বসে আছে নীহারিকার মুখোমুখি! দীর্ঘ পাঁচমাস জেল খেটে ফিরে এসেছে সবিতা।আকাশ ও সবিতা একই দিনেই তাদের সাজা থেকে রেহাই পেয়েছিল। দুজনের মধ্যেই এখন ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। বিয়ে করার প্ল্যানিংও চলছে তাদের! সবিতা তার ভুল বুঝে নীহারিকার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। সরল মনে নীহারিকাও ক্ষমা করে দিয়েছিল সবিতাকে। আজ নীহারিকার বিয়েতে সবিতা ও আমন্ত্রিত ছিল। সবিতাকে পেয়ে যেন হৃদি সোনায় সোহাগা! সবিতার আশপাশ থেকে নড়ছেই না সে। যদিও সময়ের সাথে সাথে হৃদি এখন বুঝতে পেরে গেছে সবিতা তার আসল মা নয়! এমনকি শাফকাতও তার আসল বাবা ছিলনা! হৃদি এখন তার আসল মা-বাবা বলতে নীহারিকা ও রূপলকেই চিনে। তবে রূপল এখনি হৃদিকে তার আসল বাবার পরিচয় দিতে চাইছেনা। একজন খু’নিকে রূপল হৃদির বাবা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে ইতস্তত বোধ করছে! লজ্জাবোধ করছে। এতে হয়ত হৃদির মন ছোটো হয়ে যেতে পারে। তবে সময় হলে রূপল একদিন হৃদির বাবার সাথে হৃদির পরিচয় করিয়ে দিবে!
নীহারিকার সাথে কথা বলতে বেশ জড়তা কাজ করছিল সবিতার! তাই সে অপরাধী ভাব নিয়ে মাথা নুইয়ে বসে রইল। বিষয়টি বুঝতে পেরে নীহারিকা গলা ঝাকালো। সবিতাকে স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে আগ বাড়িয়ে তাকে নরম সুরে শুধালো,
“তা আপনারা বিয়ে করছেন কবে?”
চোখ তুলে সবিতা প্রশ্নবিদ্ধ নীহারিকার দিকে তাকালো। বিনিময়ে মুচকি হেসে নম্র সুরে বলল,
“এইতো কিছুদিনের মধ্যেই।”
“আমার ও রূপলের জন্য দোয়া করবেন। বোনের মৃত্যুর শোক মনে পুষে রাখবেন না! নতুনভাবে জীবনটাকে শুরু করুন। তাছাড়া আমি ভাবতেই পারিনি আপনি আমাদের বিয়েতে আসবেন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সবিতা। পুনরায় মাথা নুইয়ে নিলো। পরিশোধিত গলায় জোরপূর্বক হেসে বলল,
“তোমাদের জন্য মন থেকেই দোয়া করি নীহারিকা। বোনের মৃত্যুর শোক পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি আমার বোন তার পাপের শাস্তি পেয়েছে! তাছাড়া তোমরা দুজন আমার প্রিয় মানুষ বলেই তোমাদের বিয়েতে আসা।”
“শুনে ভালো লাগল আপু। যখনই মন চাইবে আমাদের কাছে চলে আসবেন। তাছাড়া হৃদি তো এখনও আপনার জন্য পাগল প্রায়। মাঝেমাঝে মেয়েটাকে এসে দেখে যাবেন। ভালো লাগবে তার।”
তৎক্ষণাৎ সবিতা আবেগী হয়ে হৃদিকে জড়িয়ে ধরল। মৃদু হাসল হৃদি। উৎফুল্ল হয়ে সবিতাকে জড়িয়ে ধরল। হৃদির কপালে অজস্র চুমু খেয়ে সবিতা বেশ আদুরে সুরে বলল,
“অবশ্যই। তা আর বলতে? মেয়েকে দেখতে আসব না বলো?”
ইতোমধ্যেই নীহারিকার রুমে কাজি সাহেবের আগমন ঘটল৷ হুড়োহুড়ি করে হৃদিকে কোলে তুলে সবিতা রুম থেকে বের হয়ে গেল। কাজি সাহেবের পিছু পিছু এক এক করে নীহারিকার পরিবারের সবাই এলো। চতুর্দিক থেকে তাকে সবাই ঘিরে রাখল। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন কাজি সাহেব। নীহারিকার চোখে তখন ভাসা ভাসা জলের ছাপ! মাঝেমাঝে দু-এক ফোঁটা জল গড়িয়ে ও পরছে। তা দেখে মারজিনা বেগম ব্যাকুল হয়ে কান্না জুড়ে দিলেন! নিহাল তার মাকে সামলে রাখতে পারছিলনা। কাজী সাহেব নীহারিকাকে বললেন কবুল বলতে। তবে অতিরিক্ত কান্নাকাটির প্রভাবে নীহারিকা কবুল বলতে পারছেনা! হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠছে বারংবার। কিছুতেই থামছেনা তার এই হেঁচকি। নীহারিকার এই করুন অবস্থা দেখে তার পরিবারের সবাই ঘাবড়ে গেল!
হাঁকডাক পরে গেল পুরো বিয়ে বাড়িতে। রূপল স্টেজ থেকে ছুটে এলো। হন্তদন্ত হয়ে নীহারিকার পাশে বসল। চোখেমুখে বিষাদের ছাপ নীহারিকার। অস্থির হয়ে উঠল রূপল। চিৎকার করে সবাইকে বলল রুমের ভীড় ভাট্টা কমাতে। অপ্রয়োজনীয় লোকজনকে রুম থেকে চলে যেতে। একে একে সবাই রুম থেকে বের হয়ে যেতেই রূপল সযত্নে নীহারিকার মাথাটি তার কাঁধের উপর রাখল। নীহারিকার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল সুরে বলল,
“কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?”
অস্ফুটে দৃষ্টি নীহারিকার। শরীরের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। বমি বমি ভাব পাচ্ছে, দুর্বলতা কাজ করছে, দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে! এই বুঝি জ্ঞান হারাবে সে। হাল ছাড়লনা রূপল। পুনরায় শান্ত গলায় নীহারিকাকে বলল,
“কবুল বলবেনা? বিয়ে করবেনা আমায়? দেখো আমি বর সেজে এসেছি তোমাকে বিয়ে করতে। ফিরিয়ে দিবে আমায়?”
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল নীহারিকা। তবুও যেন স্থির করতে পারছিলনা নিজেকে! রূপলের চোখে তখন দ্বিধার ছাপ। সংকীর্ণতা ও ভীতসন্ত্রস্ততা। আদো নীহারিকা কবুল বলতে পারবে কিনা সেই উদ্বেগ। রূপলের বিষণ্ন চোখের পানে তাকিয়ে নীহারিকা বিমূর্ষ অবস্থা নিয়েও তিন কবুল বলল! তৎক্ষনাৎ সে লুটিয়ে পরল রূপলের বুকে। উপস্থিত সবাই ব্যস্ত হয়ে পরলেও রূপল ব্যস্ত হলোনা এতে! কাজি সাহেবকে বলল বিয়ে পরাতে। এবার পালা এলো রূপলের তিন কবুল বলার। শীঘ্রই রূপল তিন কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন করল।
#চলবে…?