ফেরারি প্রেম পর্ব ১৮

0
890

#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_১৮
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এমন তেজী মেয়েই আমার খুব পছন্দ বেয়াইন সাহেবা! হবেন না-কী আমার জীবনের নাইকা?”

পরিস্থিতির চাপে পড়ে নীহারিকা মুখ বুজে রাতুলের সব ইয়ার্কি সহ্য করে নিলো! চোখে জল মনে অদম্য জেদ নিয়ে সে হনহনিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেল! জেঁচে পড়ে অপমানিত হওয়ার মত সহ্যশক্তি আর অবশিষ্ট নেই তার। সবিতা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কী করছে সে সম্পর্কেও তার কিছু জানা হলোনা। রূপল যে কেন তাকে সহ্য করতে পারেনা তাই বুঝতে পারেনা নীহারিকা! সময়ে অসময়ে তার উপরে ক্ষোভ ঝেড়ে নেয়। কী এমন ক্ষতি করল সে রূপলের? যার রেশ ধরে রূপল যেখানে সেখানে তাকে অপদস্থ করতে ছাড়ে না? তবে রাতুলকে সে দেখে নিবে। এমন ফা’ল’তু টাইপ ছেলে তার পছন্দ নয়। বেয়াই হয়েছে তো কী মাথা কেটে নিয়েছে? যখন তখন তার সাথে ইয়ার্কি করবে? সবকিছুর তো একটা লিমিট থাকা উচিৎ। লিমিট অতিক্রম করা তার মোটেও পছন্দ নয়।

রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে নীহারিকা পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো! দিক-বিদিক তাকানোর সময় নেই তার। রূপলকে আর কখনও প্রশ্রয় দিবেনা সে! এজন্যই বলে, মানুষের উপকার করতে নেই। এই উপকারই এক সময় গলায় ধরে। তাই সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নেওয়া ভালো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। রাতুল তার মা-বাবাকে নিয়ে পিয়াসাকে দেখতে তার শ্বশুড়বাড়িতে এলো। অসুস্থ পিয়াসা তার মা-বাবা এবং রাতুলকে দেখে বড্ড খুশি হয়ে গেল। বিশেষ করে রাতুলকে দেখে তার মন খুশিতে ভরে উঠল। রাতুলকে জড়িয়ে ধরে সে আবেগাপ্লুত গলায় বলল,

“কত বছর পর তোমাকে দেখলাম ভাইয়া। মনটা সত্যি শান্ত হয়ে গেল।”

রাতুলও মুদু হেসে পিয়াসাকে জড়িয়ে ধরল। বিনিময়ে আবেগঘন গলায় বলল,

“সত্যিই অনেক বছর পর আমাদের দেখা হলো রে। বিশেষ করে তোকে, রূপলকে খুব মিস করছিলাম। ভাবছিলাম কবে আমরা একসাথে হব। আজ যেন ষোলোকলা পূর্ণ হলো। এখন বল তোর শরীরের কী অবস্থা?”

“এখন মোটামুটি ভালো আছি ভাইয়া। তোমাদের পেয়ে তো আরও ভালো হয়ে গেলাম।”

ফিক করে হেসে দিলো রাতুল। প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন ছুড়ল,

“তোর বর কোথায়? দেখতে পাচ্ছিনা যে?”

“নিহাল তো অফিসে ভাইয়া। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে।”

পিয়াসাকে ছেড়ে রাতুল তার পাশে হেলান দিয়ে বসল। নিজেদের মধ্যে নানা রকম আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিয়াসা তার বিয়ের দিনের সমস্ত ঘটনা এক এক করে রাতুলকে শুনাতে লাগল। রাতুলও সব মনযোগ দিয়ে শুনছিল। মাঝে মাঝে কটমট করে রাগও প্রকাশ করছিল! এরই মধ্যে নাজনীন বেগম হঠাৎ কৌতূহল বশত পিয়াসার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,

“কী রে পিয়াসা? তোর শ্বশুড় শ্বাশুড়ি কোথায়? তাদের দেখছিনা যে? বাড়ির কাজের মেয়ে এসে দেখি দরজা খুলে দিলো।”

শুকনো গলায় পিয়াসা জবাবে বলল,

“নীহারিকাকে খুঁজতে ব্যস্ত সবাই মা!”

রাতুল হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল! সবাইকে থামিয়ে সে পেরেশানি গলায় বলে উঠল,

“হোয়াট? কোথায় নীহারিকা?”

“জানিনা ভাইয়া! সকাল থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।”

“আরে কী বলিস এসব? দুপুরের দিকেও তো তার সাথে আমার কথা হলো, দেখা হলো, দুষ্টুমিও হলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে সে কোথায় গেল?”

অমনি ঘাবড়ে ওঠা গলায় পিয়াসা বলল,

“জানিনা ভাইয়া কোথায় গেল। তবে নীহারিকা কখনও এমন করেনা। আজই প্রথম এমন করল। খুব টেনশন হচ্ছে তার জন্য।”

সবার মধ্যে এবার আতঙ্ক কাজ করতে লাগল। ছটফটাতে লাগল সবাই। অমনি ওয়াশরুম থেকে ছোট্টো হৃদি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বের হয়ে এলো! কারো দিকে না তাকিয়েই সে আনমনা হয়ে পিয়াসাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তোমার ঘরে কে এলো গো পিয়ু আন্টি?”

তৎক্ষণাৎ পিয়াসার মা জায়গা থেকে নড়েচড়ে উঠলেন। বসা থেকে সোজা দাড়িয়ে পড়লেন তিনি। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে হৃদির দিকে তাকালেন। হতবাক গলায় বললেন,

“এই মেয়েটা এখানে কী করছে?”

রাতুলও আচমকা পিয়াসার পাশ থেকে ওঠে দাড়ালো! হৃদির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো নামিয়ে নিলো। পকেটে থাকা ফোনটি হাতে নিয়ে সে ফোন ঘাটতে ব্যস্ত হয়ে গেল! তৎপর গলায় সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আচ্ছা আমি একটু আসছি। একটা জরুরি কল এসেছে।”

বলেই রাতুল তৎক্ষনাৎ পিয়াসার বেডরুম থেকে বের হয়ে গেল! এদিক ওদিক ফিরেও তাকালো না। রাতুলের যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হৃদি হঠাৎ ভয় পেয়ে দৌঁড়ে এসে পিয়াসার পাশে চুপটি করে বসল। শঙ্কিত গলায় বিড়বিড় করে পিয়াসাকে বলল,

“ওরা কারা আন্টি? কেন এসেছে তোমার ঘরে?”

মৃদু হেসে অবুঝ হৃদির মাথায় হাত বুলালো পিয়াসা। হৃদির ভয় ভাঙানোন জন্য নরম স্বরে বলল,

“ওরা আমার মা-বাবা হৃদি। আমাকে দেখতে এসেছে।”

পিটপিটে চোখে হৃদি পিয়াসার মা-বাবার দিকে একবার তাকালো। তাদের রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই সে আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলো! ভয়ে আবারও সিঁটিয়ে উঠল। পিয়াসার পেছনে মুখ লুকালো। অমনি পিয়াসার বাবা হঠাৎ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে পিয়াসাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“মেয়েটা ঐ সুহাসিনীর ভাগনী না?”

পিয়াসা স্বাভাবিক স্বরেই বলল,

“হ্যাঁ বাবা।”

“মেয়েটা তোর এখানে কী করছে?”

“নীহারিকা হৃদিকে আমার কাছে দিয়ে গেছে বাবা।”

“কারণ কী?”

“পরে বলছি। হৃদির সামনে কিছু বলতে চাইছিনা।”

অমনি পিয়াসার মা মুখটা বাঁকিয়ে নিলেন! মুখমণ্ডলে তিক্ততার ছাপ ফুটিয়ে তুললেন। খরতর গলায় পিয়াসাকে বললেন,

“এখন দেখি তোদের দুই ভাই বোনের সাথে সাথে ঐ নীহারিকারও ভীমরতি ধরেছে! দয়ার সাগর একেক জন! দরদ একেবারে উতলে উঠছে!”

বিরক্তি নিয়ে পিয়াসা তার মাকে বলল,

“আহ্ মা চুপ করো তো। মেয়েটার দিকে একবার স্বচক্ষে তাকিয়ে দেখো, কতটা মায়ায় ভরা মেয়েটার মুখ। কেমন যেন পরিচিত মনে হয় তাকে! যেন যুগ যুগ ধরে তাকে চিনি!”

__________________________________

বাড়ি থেকে অদূরে একটি বিশাল রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে রূপল এবং নীহারিকা! রাগে ফোঁস ফোঁস করে রূপল ঝুঁকে আছে নীহারিকার দিকে। মনে হচ্ছে যেন এক্ষণি তাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে! অথচ সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নীহারিকার। সে ব্যস্ত একত্রে বার্গার, স্যান্ডুইচ, কোল্ড ড্রিংকস খেতে! তার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে যেন কত যুগ ধরে সে অভুক্ত! নীহারিকাকে একই প্রশ্ন বার বার করতে করতে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছে রূপল! তবুও যেন নীহারিকার মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের হচ্ছেনা। সে ব্যস্ত তার খাবার খেতে। অবশেষে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রূপল টেবিলে সজোরে এক আঘাত করল! গলা উঁচিয়ে বলল,

“আমার কুয়েশ্চনের কোনো আনসার দিচ্ছেন না কেন?”

অমনি নীহারিকা ভয় পেয়ে খানিক কেঁপে উঠল। বার্গার মুখে নিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রূপলের দিকে একবার তাকালো। রেস্টুরেন্টে থাকা মানুষজন সব বিরক্তিকর দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে! সবার রাগী ভাবমূর্তি দেখে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এগিয়ে এলেন রূপলের দিকে। নম্র ভাষায় রূপলকে বুঝিয়ে বললেন,

“আস্তে স্যার। এটা একটা পাবলিক প্লেস। সবাই বিরক্ত হচ্ছে। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাইছি?”

পরিস্থিতি সামলাতে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রূপল জোরপূর্বক হাসল। ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বিনয়ী সুরে বলল,

“ওকে।”

ম্যানেজার চলে গেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে রূপল পুনরায় ভীতসন্ত্রস্ত নীহারিকার দিকে তাকালো। চোয়াল উঁচু করে পুনরায় তাকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“শাফকাতের সাথে আপনি একা এখানে কী করছিলেন? তাও আবার বাড়ি থেকে এত দূরের একটা রেস্টুরেন্টে?”

সব শুনে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলো নীহারিকা! বার্গারে পুনরায় কামড় বসিয়ে সে ছন্নছাড়া গলায় বলল,

“আপনার এতকিছু জেনে কী দরকার? আমি কার সাথে কী করছি না করছি এটাতো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার!”

“শুনুন? আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এসে নাক গলানোর। এমনিতেই আমি আছি মহা শোকে। নেহাত আপনার মা এসে আমার কাছে রিকুয়েস্ট করে বলেছিলেন আপনাকে খুঁজে দিতে! খবর নিয়ে জানতে পারি আপনি শাফকাতের সাথে এখানে বসে চুটিয়ে প্রেম করছেন! মেয়েদের মন বুঝা বড়ো দায় বুঝেছেন? কিছুদিন আগে যাকে সহ্য করতে পারছিলেন না আজ তার সাথেই একই রেস্টুরেন্টে বসে প্রেমে করছেন!”

“বেশ করেছি প্রেম করে! শাফকাত আর যাই করুক আপনার মত কারণে অকারণে আমার গাঁয়ে হাত তুলবেনা। বুঝে শুনে এরপর হাত তুলবে।”

“কী বললেন আপনি? আমি অকারণে আপনার গাঁয়ে হাত তুলেছি? আগে বলুন আপনি বলা নেই কওয়া নেই হুট করে আমার গাঁয়ে টাচ করলেন কেন?”

“এই শুনুন? আমি অকারণে আপনার গাঁয়ে টাচ করিনি। আমি ঐ লেবেলের ফালতু মেয়ে নই যে অকারণে ছেলেদের গাঁয়ে টাচ করব। আপনাকে আমার একটা জরুরি কথা বলার ছিল। যা লোক সমাজে নয়, আড়ালে বলতে হত!”

ঝাড়ি মেরে রূপল বলল,

“তো এখন বলুন কী কথা?”

“আগে খেয়ে নিই এরপর বলছি! কাল রাত থেকেই অভুক্ত আমি!”

“বিল কে দিবে হ্যাঁ? শাফকাত তো আমার ভয়ে দৌঁড়ে পালালো!”

“কেন আপনি দিবেন! শাফকাতের হয়ে আপনি ডেমারেজ দিবেন। আপনার জন্যই তো শাফকাত দৌঁড়ে পালালো।”

“প্রেম করবেন আপনি আর বিল দিব আমি?”

“বেয়াইনের জন্য তো এতটুকু করতেই পারেন! তাছাড়া আমি তার সাথে প্রেম করছিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। খিদেও পেয়েছিল খুব। সামনে শাফকাতকে পেয়েছিলাম। তাই ভাবলাম তাকে মুরগি বানানো যাক! যাই হোক, এখন যেহেতু আপনি এসেই পড়েছেন তাই বিলটা আপনি দিলে খুশি হব!”

অপারগ হয়ে রূপল ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

“ওকে!”

মিটিমিটি হাসল নীহারিকা! রূপল যে বাধ্য হয়ে কথাটি বলেছে তা বুঝতে আর বাকী নেই তার। দাঁত গিজগিজিয়ে রূপল অপেক্ষা করছে কখন নীহারিকার খাওয়া শেষ হবে। ঐদিকে কত কাজ পড়ে আছে তার। সবিতাকে একা ফরেনসিক ল্যাবে রেখে এসেছে সে। না জানি ওখানে কী কী ঘটে যাচ্ছে। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। সুহাসিনীর কথা ভেবেও বুকের ব্যথাটা বাড়ছে তার। কোন দিকেই যেন শান্তি নেই তার।

হাতে থাকা বার্গারটি গপাগপ খেয়ে নীহারিকা পানি খেয়ে গলাটা ভিজালো। সক্রিয় দৃষ্টিতে রূপলের দিকে তাকালো সে। রূপলের মুখোমুখি ঝুকে এসে তৎপর গলায় বলল,

“আপনার মনে আছে? সুহাসিনী মৃত্যুর আগে আপনাকে কী বলে গিয়েছিল?”

রূপলও বেশ সক্রিয় গলায় নীহারিকাকে বলল,

“হ্যাঁ মনে আছে। হৃদিকে আগলে রাখতে বলেছিল।”

“ইয়েস। পয়েন্ট টু বি নোটেড! তার মানে কী দাঁড়ায় জানেন?”

“কী?”

“হৃদিকে ঘিরেই সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে!”

#চলবে….?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here