ফিলোফোবিয়া পর্ব ২৫

0
669

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )

২৫

( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি শেষ করল প্রিয়। হাতপা কাঁপছে এখনো। নড়বড়ে কাঁপাকাঁপি হাতে টেবিলের উপর গ্লাসটা রেখে ছোট নিশ্বাস ফেলল। নিচের দিক তাকিয়ে এক দমে বলল,
‘ বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানলে কোনদিন মেনে নিবেনা। গত কয়েকদিন যাযা হয়েছে তারপর তো এদমই না।তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।’
মুখোমুখি সোফায় বসে আছে শতাব্দ। শান্ত গম্ভীর মুখ। নিমিষ দৃষ্টিতে গভীর ভাবে পরখ করছে প্রিয়কে। ভীত চোখমুখ। হাতপা কাঁপাকাঁপিটাও চোখ পড়ছে শতাব্দের। এতবড় পদক্ষেপ নিয়ে ভীষণ ঘাবড়ে আছে নিশ্চয়ই!
শতাব্দের কোন সারাশব্দ না পেয়ে, উত্তরের অপেক্ষায় মাথা তুলে তাকালো। লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করে।আশান্বিত কন্ঠে বলল,
‘আমাকে বিয়ে করবেন? এখন না হলে আর কোনদিন হবেনা। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’
শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দ। চোখেমুখে ভাবান্তর নেই কোন। শান্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘ আমার পক্ষে তোমাকে এখন বিয়ে করা সম্ভব না প্রিয়।’
প্রিয় যেন আকাশ থেকে পড়লো। চোখমুখ জুড়ে হতভম্ব। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে আওড়াল,
‘ কিছুদিন আগেই তো আপনি বিয়ের কথা বলছিলেন। আজ..এখন..
‘ তোমার বয়স অল্প। আন্ডার এইট্টিন। এখন বিয়ে করা অসম্ভব।’
‘ আমি জানি, আপনি চাইলেই সব সম্ভব।’
‘ এই মুহূর্তে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
বলেই মুখ ফিরিয়ে জানালার দিক তাকালো শতাব্দ।
শতাব্দের আচরণে বরাবরই হতভম্ব প্রিয়। সেইরাতের ঘটনার পর প্রিয়’র সাথে একবারের জন্যও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি শতাব্দ। প্রিয় চেষ্টা করলেও শতাব্দ এড়িয়ে চলতো বেশ। আজও বাসায় আনতে রাজি হচ্ছিলো না প্রথমে। প্রিয় একপ্রকার জিদ করেই এলো। কয়েক সাপ্তাহ আগেও বিয়ের কথা বলছিল। এখন যখন প্রিয় নিজের থেকে বলছে। মুখ ফিরিয়ে নিলো। এটা কোন শতাব্দকে দেখছে প্রিয়? সেই প্রিয় চেনা মানুষটাকে এত অচেনা লাগছে কেন?
চোখ ভরে এলো প্রিয়’র। কান্নারা গলায় দলা পাকিয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। নিজেকে সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করল। ধীর আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার সব সম্পর্ক পিছনে ফেলে চলে এসেছি। আপনি ফিরিয়ে দিলে আমি কোথায় যাবো?’
শতাব্দ বাহিরে তাকিয়ে এখনো। আগের মতই শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তোমার বাবাকে ফোন করেছি। আসছেন উনি।’
বিমূঢ় প্রিয়। কান্না আটকে রাখতে পারল না আর। ডুকরে কেঁদে ফেলল। উপরের শক্তপোক্ত খোলসটা চুপসে, নরম সরল প্রিয় বেরিয়ে এলো। ছুটে গিয়ে শতাব্দের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। শতাব্দের হাত ধরে কাঁদছে প্রিয়। অনবরত হাতপা কাঁপছে তার। কান্না ভেজা কন্ঠে আকুতি করল,
‘ কিছুদিন আগে আপনি-ই তো বিয়ের কথা বলেছিলেন। এখন কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন?’
হাত মুঠোবন্দী করে চোখমুখ শক্ত করল শতাব্দ। কন্ঠে কঠিনত্ব এনে বলল,
‘ মজা করেছিলাম!’
হতভম্ব প্রিয়। নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সত্যি কি শতাব্দ সেদিন মজা করেছিল? সেই মজার রেশ ধরেই কি প্রিয় সব ছেড়ে মূর্খের মত ছুটে চলে এলো। আসলেই কি শতাব্দ এমন সস্তা মজা করার লোক! কোনটা সত্য? সেইদিনের সেই আকুল আবদার। নাকি আজকের এই রুক্ষ হয়ে মুখ ফেরানো। মাথা কাজ করছেনা প্রিয়’র। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল,
‘কেন এমন কঠিন হচ্ছেন! কি হয়েছে আপনার। আমি কি করেছি। কেন এভাবে শাস্তি দিচ্ছিলেন। সেই রাতের পর থেকে না কথা বলছেন। না যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। বরাবরই এড়িয়ে চলছেন। বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি। মিথ্যা বলছে লোকে। আমি খালা কেউই কোনরকম খারাপ কাজ করিনি। শোয়েব আঙ্কেল নিজেই এসেছিলেন। আমরা… ব্যা* না।’
ক্রো*ধান্বিত শতাব্দ ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলছে। চোখেমুখে ভয়*ঙ্কর রাগ। চোখ বুজে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে যথাসাধ্য।
শতাব্দের কোন সারাশব্দ না পেয়ে প্রিয়’র প্রচন্ড রাগ হলো। সবকিছু ছেড়ে ছুটে এলো শতাব্দের কাছে আর এখন শতাব্দ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? কেন এমন করছে। লুবনাকে বিয়ে করবে বলে।বুক চিড়ে হাউমাউ চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রিয় দমানোর চেষ্টা করল পারলো না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। মাথা আউলে গেল। ধপ করে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ এখন আর আমাকে ভালো লাগেনা আপনার? মন ভরে গেছে। পুরাতন হয়ে গেছি আমি। নতুন কাউকে চাই? কাকে চাই লুবনাকে চাই। আপনিও আপনার মামার মত। একজনকে দিয়ে মন ভরে গেলে নতুন কাউকে চাই। আমি..
আর কিছু বলবে তার আগেই প্রিয়’র গাল চেপে ধরল শতাব্দ। র*ক্তিম টলমল চোখ। প্রিয়’র চোখে চোখ রেখে। কঠিন গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমার সাথে কি করেছি? বেডে নিয়ে গেছি?’
আজ প্রিয়’র চোখে ডরভয় নেই। শতাব্দের মতই চোখে চোখ রেখে।নির্ভীক কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘ বেডে নিতে পারেননি বলে কি আফসোস হচ্ছে! কি ভাবেন আমাকে ঠকিয়ে লুবনাকে বিয়ে করে ফেলবেন। কেউ কিছু জানবে না? মুখে প্রকাশ না করলেও। ইমান্দিপুরের সবাই জানে আপনার সাথে প্রেমে কথা।’
শতাব্দের রাগ হলো প্রচন্ড। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
‘ লুবনাকে বিয়ে করছি তোমাকে কে বলল?’
প্রিয় জুবাইদার নাম বলতে গিয়ে আটকে গেল। জুবাইদা বারবার সতর্ক করে দিয়েছে। তার নাম যেন শতাব্দকে না বলে। অশ্রু স্নিগ্ধ চোখ জোড়া বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কান্না আটকানোর যথাসম্ভব চেষ্টা চালালো। হলো না। বারবার ভিজে আসছে চোখ। দুহাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ফেলল। ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শতাব্দের সামনে আর শক্তপোক্ত খোলস ধরে থাকতে পারছেনা সে। ভেতরের সহজ সরল ছোট্ট প্রিয় বেরিয়ে এলো। বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ ভালোবাসি শতাব্দ। আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিবেন না। আমি বাড়ি যাবো না। প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না।’
হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়। শতাব্দকে অন্য কারো সাথে দেখে সহ্য করতে পারবেনা কখনো। প্রথম প্রে্মের বিচ্ছিরি যন্ত্রণা। প্রিয়’র কৈশোর মন সেই ভার সইতে পারছেনা। কষ্ট হচ্ছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার।
শক্ত পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দ। চোখমুখ অস্বাভাবিক শক্ত কঠিন।
কলিং বেলের শব্দে কেঁপে উঠল প্রিয়। মাথা তুলে অসহায় দৃষ্টিতে শতাব্দের দিক চাইলো। বিড়বিড় করে বলল,
‘ প্লিজ.. ফিরিয়ে দিবেন না।’
শুনলো না শতাব্দ। দরজা খুলে দিলো। বাহিরে জাফর সাহেব দাঁড়ানো। বাবাকে দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল প্রিয়। লজ্জা ভয়ে মাথা নুয়ে নিলো। বাবার রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো মত অবগত। বড় আপার সময় দেখেছিল। ভয়ে থরথর কাঁপছে প্রিয়।
জাফর সাহেব ভেতরে এলেন। প্রিয়’র ব্যাগ হাতে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বাড়ি চল প্রিয়।’
জাফর সাহেব যথেষ্ট রাগী মানুষ। বাবার অতি স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠে বিমূঢ় প্রিয়। বেশ স্বাভাবিক চোখমুখ তার। যেন আগে থেকেই তিনি জানেন সব।
‘ আব্বা..
প্রিয় কিছু বলতে চেষ্টা করলে থামিয়ে দিলেন তিনি। আগের মত স্বাভাবিক গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ যা বলার বাড়িতে গিয়ে শুনবো। লেট হচ্ছে এখন চল।’
মেয়ের হাত টেনে তুলল জাফর সাহেব। এপার্টমেন্ট থেকে বের হবার সময় শতাব্দের সাথে চোখাচোখি হলো। দুজনের চাহনিতে অদ্ভুত কোন রহস্য।
দরজার কাছে যেতেই প্রিয় পিছন ফিরে চাইল। অশ্রুসিক্ত অসহায় চাহনিতে শতাব্দের দিক চেয়ে রইল। মনেমনে বলল,
‘ বাবাকে আটকান। আমাকে আপনার কাছে রেখেদিন প্লিজ!’
প্রিয়’র মনের কথা শতাব্দ অবধি পৌঁছালো না। আটকালো না সে। প্রিয়’র যাওয়ার দিক চেয়ে রইল নিমিষ।

শাওয়ারের নিচে দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে আয়েশা। বিষাদপূর্ণ চোখমুখ। পানির সাথে অশ্রু মিশে ঝড়ছে। সব শেষ। এত বছর পরিশ্রম করে যা সম্মান কুড়িয়েছেন আজ সব শেষ। সব!
পরিস্থিতী সামাল দিতে কলেজ থেকে ব্রেক নিয়েছিল। ছুটি কাটিয়ে আজ কলেজে গিয়েছিলো। প্রথম থেকেই সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। প্রথমে এসবের তোয়াক্কা না করলেও ধীরেধীরে আশেপাশে ফিসফিস কানে আসছে। গ্রামের লোকেরা তার নামের সাথে ব্যা* তোকমা লাগিয়ে দিয়েছে। এতদিন যেই মানুষ গুলো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস পেতনা আজ তারা কথা শোনাচ্ছে। সিনিয়র জুনিয়র কলিগ, স্টুডেন্ট সবাই তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে আড়ালে ফিসফিস করছে।গালমন্দ করছে।
টিফিন টাইমে টিচার রুম মোটামুটি খালি ছিল। রেজাল্ট শিট তৈরি করছিল আয়েশা। এমন সময় টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রদীপ স্যার। তিনি কলেজের একাউন্টিং-এর টিচার। বয়সে আয়েশা বেগমের বেশ জুনিয়র। প্রথমে কৌশল বিনিময় করে কথা বললেও।হঠাৎ আয়েশা বেগমের কাছে ঝুঁকে এসে কুপ্রস্তাব রাখলো। বলল,
‘ শুনলাম আপনার বাড়িতে নাকি মেয়ে ভাড়া দেন। কতটাকা ঘন্টা? আপনার ভাগ্নীও নাকি এই পেশায় আছে। যত টাকা লাগে আমি দিবো। শুধু আজকের রাতের জন্য প্রিয়কে যদি…..’
কথা শেষ করতে দিলোনা আয়েশা। প্রদীপ স্যারের গালে সজোরে চ*ড় বসালো। অ*গ্নিশিখার মত জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল,
‘ অমা*নুষ, জা*নোয়ার! মেয়ে বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে কুনজর দিতে লজ্জা করে না তোর? বাড়িতে বউ রেখে ভালোমানুষির মুখোশ পড়ে এসব করে বেড়াস বাহিরে। ছি!’
প্রদীপ গর্জন করে বলল,
‘ ব্যা*গো আবার ভাব। খালা ভাগ্নী যে চেয়ারম্যানের পোলা আর শালারে ফাঁ*সাইছ তা বুঝি আমরা জানি না? কতটাকা দেয় ওরা। আমি আরো বেশি দিবো।’
কলার চেপে ধরল আয়শা বেগম। ক্রো*ধে চোখ ঝলঝল করছে। ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে। অনেক লোক জড় হয়েছে সেখানে। লোকজন দেখে ভালো সাজার নাটক করল প্রদীপ। কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ আপনি অনেক সম্মানের ম্যাডাম। আপনার কাছ থেকে এমন কু*প্রস্তাব আশা করিনি। সামান্য কিছু টাকার লোভে প্রিয়কে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ও আমার মেয়ের বয়সী। আমার বাড়িতে বউবাচ্চা আছে। ওর সাথে রাত কাটানো। ছিছি!’
আয়েশা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আশেপাশে অন্য স্যার ম্যাডামদের ভেতর গুঞ্জন। এমন হাতাহাতি’র ঘটনা শুনে প্রিন্সিপাল ডাকল রুমে। সারা স্কুল কলেজ জুড়ে তখন চাপা গুঞ্জন।
প্রিন্সিপালের রুমে আয়েশা নিজের দিক তুলে ধরার চেষ্টা করল। শুনলো না কেউ। পুরো স্টাফ প্রদীপের দলে। আয়েশা প্রিয়কে নিয়ে আজেবাজে কথা রটিয়েছে ছবি বেগম। এতকিছুর পর কেউ বিশ্বাস করছে না তাকে। সমাজে একা নারীকে কেইবা মানে?
সব শুনে চাকরি থেকে আয়েশা বেগমকে বরখাস্ত করে দিলো প্রিন্সিপাল। এত বছর তিলেতিলে কুড়িয়ে আনা এই মান সম্মান মুহূর্তেই গুড়িয়ে গেল সব। এত মানুষের সামনে জঘন্য অপবাদ অপমানে গা ঘিনঘিনিয়ে উঠল তার। এত বছরের এত পরিশ্রম এত সম্মান বিফলে গেল সব। সেই সাথে প্রিয় নিষ্পাপ সুন্দর গোছানো জীবনটায় দাগ ফেলে দিলো বাজে। নিজে কাছে গোছাতে এনে আউলে দিলো তাকে। দাগ লাগিয়ে দিলো চরিত্রে!
আরো আধঘন্টা পানিতে ভিজে ঘরে চলে এলো আয়েশা বেগম। কাপড় পাল্টে ভেজা চুল নিয়ে চিঠি লিখতে বসলো টেবিলে। সন্ধ্যায় কাজের খালা এলে। কিছু টাকা দিয়ে চিঠি পোস্ট করতে পাঠালো বাজারে। সেই সাথে বলল,
‘ কাল থেকে আসতে হবে না আর।’
কাজের খালা ঘাবড়ে গেলেন। ভীতি কন্ঠে বললেন,
‘ কেন। আমি কি করছি আফা!’
‘ তুমি কিছু করোনি। আমার শান্তি চাই। দূরে বেড়াতে যাবো আমি।’
‘ কবে ফিরবেন?’
‘ জানিনা।’
অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলো আয়েশা। কাজের খালা আর কথা বাড়ালেন না। চিঠি নিয়ে চলে গেলেন।
রাতে টলমলে শরীর নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরেঘুরে দেখছেন আয়েশা বেগম। নিজ হাতে সাজানো বাড়িটাকে এটাই বুঝি শেষ বারের মত দেখা। সারাজীবন এত আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে এই বয়সে এসে এমন অপবাদ, অপমান সহ্য করছে পারছেনা শরীর মন। ধৈর্যের একটা বয়স সীমা থাকে। সেই বয়স পাড় হয়ে গেলে ধৈর্য সীমা নিতান্তই নিচে নেমে যায়। সারাজীবন তো শুধু লড়াই করল। কি পেল? না স্বামী পেল, না সংসার হলো। সারাজীবন শুধু ঠকেই গেল। বৈধ হয়েও সমাজের সামনে নিজের সন্তানের পরিচয় আনতে পারলো না। না প্রিয়কে জানাতে পারল তিনিই তার মা।
নিজের মেয়ের এত কাছে থেকে মা ডাক না শোনার মত আক্ষেপ কষ্ট, য*ন্ত্রণা দুনিয়াতে হতে পারেনা আর। কখনোই না। এমন নিরর্থক জীবন রেখে কি লাভ?
আচ্ছা, প্রিয় যখন সত্যিটা জানবে ক্ষমা করবে কি তাকে?
ভাবতে ভাবতেই শাড়ির ফাঁদে মাথা ঢুকালো । চোখ বুঝে শেষবারের মত প্রিয়’র চেহারাটা মনে করল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ক্ষমা করে দিস প্রিয়। আমি তোর ভালো মা হতে পারলাম না কখনো।’

শতাব্দের এপার্টমেন্ট থেকে ফিরে স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রিয়। আজকাল ঘর ছেড়ে বের হয়না কোথাও। এই চার দেয়ালই তার সব।চারপাশের সবকিছু যেন এলোমেলো। এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো। তাকে কেউ কোনকিছু জিজ্ঞেস করল না। না জানতে চাইল। সবকিছু একদম আগের মত স্বাভাবিক যেন। বাবার এই শান্ত স্বভাব প্রিয়কে ভাবাচ্ছে বড্ড।
আচমকা মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। কান্নার আওয়াজ। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠল প্রিয়। ড্রইং রুমে যেতেই হতভম্ব। মা হাত পা ছড়িয়ে ‘আপা, আপা’ বলে কাঁদছে। পাশেই চূর্ণবিচূর্ণ ফোনটা পড়ে।
বুক মোচড় দিয়ে উঠল প্রিয়’র। মায়ের কাছে ছুটে গেল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। অস্থির লাগছে খুব। মাকে ঝাকিয়ে বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,
‘ মা, কি হয়েছে খালার? ‘
আমেনা বেগম বিড়বিড়িয়ে এলোমেলো কন্ঠে বিলাপ করছে। কি বলছে বুঝল না প্রিয়। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ খালার কি হয়েছে?’
‘ আপা আর নেই প্রিয়। আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। অনেক দূর চলে গেছে…’
প্রিয় যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখের সামনে অন্ধকার লাগছে সব। চারিদিক ঘুরছে। মায়ের কথাটা কানে বাজছে বারবার।
চোখ বুজতে বুজতে বিড়বিড় করে বলল প্রিয়,
‘ খালা নেই? খালা আর নেই…’
বলতে বলতেই মাটিতে অচেতন হয়ে পড়ল।

( গল্পে প্রিয় কিশোরী। সাধারণত কিশোরী মেয়েরা আবেগী হয় বেশি। কারণ এই সময়টাই আবেগের। বিবেক নিয়ে কয়জনই বা বুঝে। তাদের মধ্যে ম্যাচুরিটি বরাবরই অল্প। আশাকরি আপনারা তা বুঝবেন। তবে হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ প্রথম খন্ডের প্রিয়’র সাথে দ্বিতীয় খন্ডের প্রিয়’র অনেক তফাত থাকবে।)

চলবে………

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।

টাইপোগ্রাফি : Maksuda Ratna আপু🌺🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here