ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )
২৪.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
গ্রাম জুড়ে আজকাল সেই রাতের চর্চা। আয়েশা বেগম আর প্রিয়কে একঘরে করে দিয়েছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতী দেখে কলেজ থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়েছেন আয়শা বেগম। এদিকে স্কুলের সবাই বেশ কায়দা করে এড়িয়ে চলছে প্রিয়কে। জুবাইদা তানহা আজকাল দূরে দূরে থাকে। কেন থাকে? তাদের বাড়ি থেকেও কি প্রিয়’র সাথে মিশতে নিষেধ করেছে! হয়তো।
আজ পরিক্ষা শেষ। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই হতভম্ব প্রিয়। খালা তার সব কাপড় গোছগাছ করতে ব্যস্ত। দরজার কাছে দাঁড়ালো প্রিয়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘ খালা! কোথাও কি যাচ্ছি আমরা?’
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে উত্তর দিলো আয়েশা,
‘ আমরা না। শুধু তুই যাচ্ছিস।’
চমকাল প্রিয়। বিহ্বল কন্ঠে বলল,
‘ আমি? কিন্তু কোথায়?’
‘ ঢাকায়। বিকালে তোর বাবা আসবে নিতে।’
এই পরিস্থিতীতে খালাকে একা ফেলে ঢাকায় যেতে একদম অনিচ্ছুক প্রিয়। অনিহা প্রকাশ করল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ আমার কোচিং প্রাইভেট সব কামাই যাবে খালা। সামনে পরিক্ষা…
কথা কেটে বলল আয়েশা,
‘ তা নিয়ে ভাবতে হবেনা। তোর কোচিং প্রাইভেটের স্যারদের সাথে কথা হয়েছে। টেস্ট পরিক্ষা শেষ।বাড়িতে থেকে বারবার সিলেবাস রিভিশন দিলেই চলবে এখন।’
‘ আমি চলে গেলে তুমি একা কি করে থাকবে খালা?’
‘ তুই আসার আগে আমি একাই থেকেছি।’
‘ সেই সময়কার কথা আলাদা। এই পরিস্থিতীতে এখানে একা কি করে সামলাবে তুমি? তুমিও আমাদের সাথে ঢাকায় চলো। কিছুদিন সেখানেই থাকবে।’
প্রিয়’র চোখমুখে খালাকে নিয়ে গভীর চিন্তা, ভ*য়। এসব থেকে কি বেরিয়ে আসতে পারবে খালা? দুর্বল হয়ে পড়ে প্রিয়’র মুখপানে তাকিয়ে মলিন হাসলো আয়শা। বলল,
‘ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমার সাথে প্যাঁচিয়ে তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কোন মানে হয়না প্রিয়। এমনিতে লোকের মুখে আমাদের বাড়ি এখন ব্যা* বাড়ি নামে পরিচীত।’
শেষ কথাটা বলার সময় আয়েশা বেগমের গলা কেঁপে উঠল। সারাজীবন সৎসাহস নিয়ে বেঁচে। এত মানসম্মান কুড়িয়ে শেষে কিনা ব্যা* নামক নিকৃ*ষ্ট উপাধি পেল?
পুরো ঘটনায় বেশ দারুণ ফয়দা হয়েছে ছবি বেগমের। এতদিন যে কথাগুলো ইনিয়েবিনিয়ে বলেছেন। আজকাল বেশ বড় গলায় ভাইয়ের সামনে তুলে ধরছেন সেসব। কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ কুমিরের কান্না করছে। মেয়ে লুবনার দোহাই দেখিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে। বারবার বলছে, এমন চরিত্রহীন বাবার মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
আজ সকালে খাবার টেবিলে বেশ কায়দা করে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে লুবনাকে শতাব্দের বউ করে আনার আবদার করলেন। ‘হ্যাঁ ‘ ‘না’ কোন কিছুই বললেন না শাহরিয়ার সাহেব। তবে চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে বোনের কথায় মন গলেছে।
অভিলাষা বেগম ক্ষিপ্ত গতিতে লাগেজ গোছাচ্ছে। স্ত্রীর অহেতুক রাগের উপর বিরক্ত চেয়ারম্যান সাহেব। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বললেন,
‘ শুধু শুধু ঝামেলা করার কোন মানে দেখছিনা অভিলাষা।আমি হ্যাঁ না কোনকিছু কি বলেছি?’
আলমারি থেকে কাপড় বের করে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে রাগী কন্ঠে উত্তর দিলেন অভিলাষা,
‘ জবাবের বাকি রেখেছ কি? তোমার বোন দৌড়াদৌড়ি করে মেয়ের বিয়ের কেনাকাটায় করছে। তোমার অনুমতি না পেয়েই কি করছে!’
‘ সকালে সেখানে তুমিও ছিলে। যা কথা হয়েছে তোমার সামনেই হয়েছে।’
‘ তোমার মৌনতাই যে সম্মতির লক্ষণ তা তোমার বোন বেশ ভালো করেই জানে।’
‘ যদি সম্মতি দিয়েও থাকি তাতে ক্ষতি কি? তোমার ভাই যা করেছে, এতকিছুর পর আমার কি বলার থাকবে আর? লুবনার ভবিষ্যতের কি হবে?’
‘ আর প্রিয়? ওর কি হবে ভেবেছ একবার! বোন ভাগ্নীর প্রেমে এত অন্ধ হইয়ো না শাহরিয়ার। এখনকার যুগে এসব কথার কেউ ধা*র ধারেনা। অনেক বছর আগে যেই অঘটন ঘটেছে তা পূর্নবৃত্তি করিও না। এবার ধ্বং*স হবে সব।’
শাহরিয়ার স্ত্রী’র দিক শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। গম্ভীর কন্ঠে আওড়ালেন,
‘ ওই মেয়েকে নিয়ে তোমার এত মায়া, চিন্তার কারণ আমি বুঝি। রক্তের টান। তাই না?’
‘ প্রিয়কে দেখে তোমার মায়া হয়না? অথচ মেয়েটার জন্ম কিন্তু চোখের সামনে হয়েছে তোমার।’
শাহরিয়ার সাহেব ছোট নিশ্বাস ফেললেন। সত্যি বলতে মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয়। কিন্তু বোন ভাগ্নীর জীবন গোছানো বেশি জরুরী আপাতত। দুনিয়ার প্রত্যেক জীবই স্বার্থপর। নিজ স্বার্থটা সবার আগে।
অভিলাষা বেশ একটু ক্ষান্ত হলো। ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল,
‘ এবার আগের ঘটনার পূর্নবৃত্তি হবেনা। শোয়েব ভাই দুর্বল ছিল, শতাব্দ না। তুমি এখনো তোমার ছেলেকে চিনতে পারোনি। প্রিয়’কে পাওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয় সব করবে। যাওয়ার সময় আমাকে স্পষ্ট বলে গেছে, ওর প্রিয়’কে চাই মানে প্রিয়’কেই লাগবে। এখন হোক বা পরে।’
স্ত্রীর কথায় আ*তঙ্কিত শাহরিয়ার সাহেব। শতাব্দের রাগ জেদ সম্পর্কে বেশ ভালো মত অবগত সে।
অভিলাষা বেগম বেশ স্বাভাবিক শান্ত স্বরে বললেন,
‘ তোমাদের বাপ ছেলের ঝামেলায় আমি নেই। স্বামী সন্তান দুইজনই আমার। কারো একজনের পক্ষ টানতে পারবো না আমি। আর মূলকথা, তোমার ভাগ্নি লুবনাকে পছন্দ না আমার। ভীষণ রকম অপছন্দ। প্রিয়’র সাথে তুলনা করলে দশে শূন্য দিবো। তবুও যদি শতাব্দকে রাজি করিয়ে বিয়ে করাতে পারো তাতেও আপত্তি নেই কোন। আপাতত এইসব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চাই। শান্তি চাই আমার!’
‘ এত তেজ! কোথায় যাবে? বাপের বাড়িতে। যেই বাড়িটা আমার দয়ায় এই পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে আজ। ভুলে যেও না। তোমার ভাই যা কিছু করতে পেরেছে আমার জন্যই পেরেছে।’
অভিলাষা আহত হলো। শাহরিয়ার এভাবে মুখের উপর তাকে খোটা দিতে পারল? এমনি এমনি তো সব হয়নি। শাহরিয়ার পুঁজি দিয়েছিল শুধু। এরপর ব্যবসা বাণিজ্য অর্থ সম্পদ যা হয়েছে শোয়েবই করেছে। টলমল চোখে তাকিয়ে আছে অভিলাষা।
শাহরিয়ার আভিলাষাকে এভাবে বলতে চায়নি। রাগের মাথায় মুখ ফুসকে বেরিয়ে গেছে। কিছু বলবে তার আগেই অভিলাষা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ ভুলে যেওনা প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর হাত। অতীত ঘেঁটে দেখো তোমার খারাপ সময় পাশে শুধু আমিই ছিলাম।’
বলেই লাগেজ উঠিয়ে হুড়হুড় করে বেরিয়ে গেল অভিলাষা বেগম। পেছন থেকে ডাকলো শাহরিয়ার সাহেব।
‘ গাড়ি নিয়ে যাও ড্রাইভার পৌঁছে দিবে।’
অভিলাষা বেগম সামনে ফিরেই শক্তপোক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ মায়ের পেট থেকে গাড়ি নিয়ে বের হইনি। গাড়ি ছাড়া আর আটদশটা সাধারণ মানুষের মত চলতে পারি।’
স্ত্রী’র এমন তেজী উত্তরে কি বলবে ভেবে পেলেন না শাহরিয়ার সাহেব। ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর যাওয়ার দিক তাকিয়ে থাকলেন। পুরুষ মানুষ বাহিরে যতবড় বাঘই হোকনা কেন! স্ত্রীর সামনে নিতান্তই ভেজা বিড়াল।
ঢাকায় ফেরার পর থেকেই মনমরা প্রিয়। মন বসছেনা কোথাও। মাথায় হাবিজাবি হাজারো চিন্তা। শতাব্দের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে অনেকবার। হচ্ছেনা। কখনো বন্ধ বলছে। কখনো আবার ফোন তুলছেনা। গতরাতে জুবাইদা ফোন করেছিল চুপিচুপি। বাড়িতে শতাব্দের সাথে লুবনার বিয়ের পাকাপাকি কথা চলছে। এসব থেকে বিরক্ত হয়ে অভিলাষা বেগম বাড়ি ছেড়েছে। আগাগোড়া সবটাই প্রিয় শুনেছে। সেই থেকে অস্থিরতা ঝেঁকে ধরেছে। ছটফট করছে সারাক্ষণ! অনেক ভেবেছে সারারাত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ নেই কোন। শতাব্দকে অন্যকারো সাথে দেখতে পারবেনা কখনো।
সকালে প্রভাকে নিয়ে মা স্কুলে চলে যাওয়ার পর। মায়ের ব্যাগ থেকে কিছু খুচরা টাকা আর নিজের কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রিয়। শতাব্দের এপার্টমেন্ট গন্তব্য। রাস্তাঘাট সামান্য মনে থাকলেও চৌরাস্তায় এসে গুলিয়ে ফেলল। কোন দিকে যাবে এখন? সিএনজি ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে বারবার। ঘাবড়ে গেল প্রিয়। আশেপাশে সব অজানা। এতদূর এসে বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেনা। কোনদিক যাবে বলতে না পারায় সিএনজি ড্রাইভার রাস্তায় নামিয়ে দিলো। এমন বাজে পরিস্থীতির শিকার হয়নি কখনো। চিন্তা ভয়ে আরো বেশি ঘাবড়ে গেল প্রিয়। ফুটপাতে টঙ্গের দোকান ঘেঁষে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে শতাব্দের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার বেজে কেটে গেল। আবারো ফোন করল প্রিয়। এবার শতাব্দ ফোন তুলল। শতাব্দ কিছু বলবে তার পূর্বেই কান্না ভেজা কন্ঠে প্রিয় বলল,
‘ বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। রাস্তা ভুলে গেছি। আপনার বাড়ির সামনে চৌরাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে আছি।’
হতভম্ব শতাব্দ। যেন আকাশ থেকে পড়ল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা সে। শান্ত কন্ঠে আওড়াল,
‘ সেখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।’
মিনিট দশেক পর একটা বাইক নিয়ে ছুটে এলো শতাব্দ। গায়ে সাদা এপ্রন। তবে কি ক্লাসে ছিল শতাব্দ?
বাইক থেকে নেমে রাগী ক্রো*ধান্বিত দৃষ্টিতে প্রিয়’র দিক তাকালো। চোখ দিয়ে ঝলসে ফেলবে যেন। কাছে এসে নিচে থেকে ব্যাগ তুলল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ বাইকে উঠো দ্রুত।’
বাধ্য মেয়ের মত শতাব্দের বাইকের পেছনে উঠল প্রিয়। শতাব্দ বাইক স্টার্ড করে প্রিয়দের বাড়ির রাস্তায় ঘোরাতেই আঁতকে উঠল প্রিয়। আওয়াজ করে বলল,
‘ বাড়ি যাবো না। আপনার বাড়িতে যাবো আমি।’
পেছন ফিরে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো শতাব্দ। চোখমুখ শক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে প্রিয়। শতাব্দ শুনলো না। বাইক প্রিয়দের বাড়ির দিক ঘোরালো। স্প্রিডে টান দিতেই চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়। বলল,
‘ আপনি কি নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। নাকি আমি চলন্ত বাইক থেকে রাস্তায় ঝাপ দিবো? ভয় দেখাচ্ছিনা। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঝাপ দিবো!’
আচমকা বাইক থেমে গেল। পেছন ফিরে তাকালো শতাব্দ। গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল,
‘ কি চাও?’
‘ আপনি এখন আমাকে বিয়ে করবেন। এখন মানে এক্ষুনি!’
সোজাসাপটা জবাব প্রিয়’র।
চলবে…….
( ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।)
টাইপোগ্রাফি : মুগ্ধ তা আপু🌺🥀