ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ৩

0
615

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|তৃতীয় পর্ব|

নীল পাঞ্জাবী পরিহিত মানবের পাশাপাশি হাঁটছি। উত্তপ্ত রোদে একটু পর পর পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছেন। একটা বিষয় বুঝতে পারি না। উনি সবসময় পাঞ্জাবীকে তোয়ালে বানায় কেন? ছেলেরা তো পকেটে রুমাল বা টিস্যু নিয়ে ঘুরে। একমাত্র যাবির ভাইয়াই খালি পকেটে ঘুরে। কিছুক্ষণ আগেও ঝালমুড়ি খেয়ে হাত মুছে নেন পাঞ্জাবীতে। অবশ্য প্রথমে হাত ধুয়ে নিয়েছিলেন। ভাবছি দুইটা রুমাল দিব উনাকে। একটা রাখতে বলব বুকপকেটে অন্যটা হাতে যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। যথা স্থানে এসে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল। উনি বাড়ির রাস্তায় হাঁটা ধরেছেন আমি আমার রাস্তায়। পিছনে ফিরে বার বার তাকাচ্ছি যেন একটি পলক ফিরে তাকায়। কিন্তু আফসোস উনার কোনো ভাবান্তর নাই।

“আমার সারাদিনের ভাবনায় তুমি, তোমার বিরহে কাতর হয়ে আমি। দিক বেদিক ভুলে যাই, বেসামাল হয়ে যাই। তোমার জন্য পাগলাটে হয়ে যাই, প্রেম নদী স্থাপন করে সাঁতরে যেতে যাই।”
ডায়েরির পৃষ্ঠা ছিড়ে সযত্নে বইয়ের ভাজে রেখে দিলাম। আগামীকাল আরবি পড়ে ফিরার পথে ভাবীদের বাসায় যাবো। চার লাইনের শব্দাংশটুকু যাবির ভাইয়ার টেবিলের উপর রেখে আসবো। মাঝে মাঝে অন্তরে প্রশ্ন জাগে, দিবসের অর্ধেক সময়ে একজন বুঝদার মানুষের সম্মুখে যদি একটা চঞ্চল পাখি উড়ে বেড়ায় তো সেই মানুষটা অবশ্যই পাখিটা নজরে পড়বে। যাবির ভাইয়ার নজরে কি আমি একবারও পড়ি না? উওরটার জানা নেই।

সায়াহ্নের সময়। আমার পৃথিবীতে বড়ো মায়ের পর বাবার স্থান। ছোট দুই ভাই বোনের তুলনায় বাবা আমাকে বেশি ভালোবাসেন। সন্ধ্যার নাস্তা আমরা একসাথে করি এরপর যে যার কাজ করতে চলে যায়। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। বাবার ডাক পড়েছে। ইতিমধ্যে বসার ঘরে সবাই উপস্থিত হয়েছে। এই সময়ে মারও একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসতে হয়। প্রথমত নিয়ম, দ্বিতীয়ত বড়ো মা থাকবেন যদি স্বামীর ভাগ বসিয়ে দেন এই ভয়ে। আজ নাস্তায় বিশেষ কিছু না। চা এবং পাউরুটি। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে বাবা খেতে পছন্দ করেন সাথে আমরাও। বড়ো মা সবসময় দূর থেকে বাবার সব বিষয়ে খেয়াল রাখেন। কাছে এসে দুই একটা কথা বলেন। এই যেমন খাবারের টেবিলে কী লাগবে, নামাজে যাবেন অজুর পানি তুলে দিবো ইত্যাদি।
কোনোদিন যদি বড়ো মায়ের সাথে বাবা ইচ্ছে করে কথা বলতে যান তাহলে মা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন। অযথা সংসারে অশান্তি করে লাভ নেই তাই বড়ো মা যেচে কথা বলেন না। আমাদের নিয়েই উনার দিবস রজনী পাড় হয়। বড়োমার হাতে হাতে সবাইকে নাস্তা দিয়ে নিজেও বড়ো মার পাশে বসে পড়লাম। আমার পাশে মালা পর পর হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সাধারণত দুই থেকে একটা হাঁচি দেই সেই জায়গায় মালার হাঁচি শুরু হলে দশ থেকে বারোটাও দিয়ে ফেলে। শুনেছি এলার্জির সমস্যার জন্য নাকি হাঁচি বেশি হয়। গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছি যাবির ভাইয়ার কথা। কী করছে সে এখন? নিশ্চয়ই পড়তে বসেছে। আমি যেমন পড়াশোনায় কাঁচকলা উনি একদম বিপরীত। শুনেছি উনার ডিপার্টমেন্টে টপ পজিশনে আছেন। আমার ভাবনার মাঝে মালার বাম হাত না ঢুকালে হয় না। নাক ঘষে লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, –‘ বড়ো আপু, তোমার চা টা আমাকে দিয়ে দাও। আমার না এতটুকুতে পেট ভরে নাই।”

বড়ো বোন হলে একটাই সমস্যা। ছোটরা যত প্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল আছে সব করবে যতক্ষণ না নিজের কার্য হাসিল হয়। মালার চেহারার অসহায়ত্বতা দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। আচ্ছে বলে আমার চায়ের কাপ মালাকে দিয়ে দেই। মালা চলে যায় বাবার কাছে। শুকনো পাউরুটি কোনরকম গিলে নিয়ে উঠতে নিতেই চোখে পড়ে মালার চা ভর্তি কাপ। ছোটবেলা থেকেই বড়ো মা শিখিয়েছেন, অপচয়কারী শ’য়’তা’নের ভাই। রাজিয়া আন্টিও তাই শিক্ষা দিয়েছেন। মালা মিথ্যা বলে আমার চা নিয়েছে। কিছু না ভেবেই মালার উচ্ছিষ্ট চা নিজেই পান করে নিলাম। নাস্তা করা শেষ। হাত পা নাড়াচাড়া করছি সময় অতিবাহিত হওয়ার জন্য। এর ফাঁকে বাবার চোরা চাহনি দেখছি। যিনি ঘোমটার আড়ালে লুকায়িত বড়ো মাকে দেখার বৃথা চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর মালা এগিয়ে আসে। আমার হাতে তার চায়ের কাপ দেখে নাক সিটকে বলে, –‘ ইয়াক আপু, তুমি আমার নাকের হিতু পড়া চা সাবার করে ফেলেছো?”

নাকের হিতু মানে কী তা বুঝতে আমার সময় ব্যয় হয়নি। পেটের ভেতরে খাবারগুলো চড়কির মতো ঘুরছে। বাবা সামনে আছেন তাই চলে যেতেও পারছি না। মা বাবার পাশে আয়েশ করে বসে আছেন একটু পর পর বাবার সাথে কথা বলছেন। আজ যেন আসন পেতে বসেই থাকবেন এমন ভাব। মালা আমার অবস্থা দেখে জোরে আবারো বলল, –” আপু, তোমার পেটের ভেতর কী মাথা ঘোরাচ্ছে?” ব্যস এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল। পেটে যা ছিল সব বের করে দেই বাবার সামনেই। বড়ো মা, বাবা দুজনই বিচলিত হয়ে পড়েছেন আমার জন্য। মালা এই সুযোগে পালিয়েছে। মেহেদী ভোম্বল মার্বেল চোখে তাকিয়ে আছে এখনো। মা বসে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছেন আসল ঘটনা। বাবা আমার মাথা ধরে রেখেছেন আর বড়ো মা পেটে চাপ দিয়ে রেখেছেন। চিন্তিত স্বরে বললেন, –” ইশ আমার মেয়েটা, হালুমের মতো চা কেউ খায়? পাতিলে আরো চা পড়ে আছে। দেখ তো বিষম খেয়ে কি হলো?”

–” বিষম খেয়েছে না। তোমার ছোট মেয়ে কি যেন বলেছে। আমি দেখেছি।”

দুর্বল শরীরে খেয়াল করলাম, বড়ো মা নরম চোখে এক পলক বাবার পানে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।
বাবা আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মার চাহনি দেখে চুপ করে রইলেন। হয়তো বুঝতে পারলেন তাদের মাঝে শক্ত একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে যা খন্ডন করা সম্ভব না।

——-

বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। কারণ আছে বৈকি। ঘরে এসেও বমি করেছি। তেতো পানি বের করে ফেলেছি। এরপর আর খাবার পেটে পড়েনি। এখন রাত দশটা বাজে। বড়ো মা এসে লেবু পানি দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেটা খেতে ইচ্ছা করছে না। মস্তিষ্কে যাবির ভাইয়ার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দুপুরে কী লজ্জাটাই না পেলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে লজ্জায় সামনে যেতো না। কিন্তু আমি তো আমিই। আগামীকালই উপস্থিত হবো উনার সামনে। শোয়া থেকে উঠে আবারো সেই রুমাল এবং সুতা বের করলাম। এবার খুব সুন্দর করে মুখের হাসিটা এঁকে ফেললাম। শরীরের আকৃতিও ঠিকঠাক সেলাই করলাম। ছবিটা ঠিক বুক পর্যন্ত এঁকেছি এবং সেলাই করেছি। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে সবকিছু বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেললাম। মা এসেছেন ঘরে। সচরাচর মা আমার ঘরে আসেন না। আজ কেন এলেন বুঝতে পারলাম না। আয়েশ করে মা আমার পাশে বসলেন। আমাকে বসা অবস্থায় দেখে কি যেন চিন্তা করলেল। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –“এখন আমার মার শরীরটা কেমন আছে?”

–” ভালো লাগছে কিছুটা। কিছু বলবে মা? ঔষধ খেয়েছো?”

মা দরজায় উকি দিয়ে দেকলেন কেউ আসছে কিনা। এরপর আগের ভঙ্গিতে আবারো বললেন, –” তুই তো তোর বড় মার পাগল। সে ভাল কিনা মন্দ তা যাচাই করিস না। তুই জানিস তোর বড় মার কাছে আমার এক জোড়া বালা আছে। শুধুমাত্র আমার অধিকার সেটাতে। তোর দাদী আমাকে না দিয়ে তোর বড়ো মাকে দিয়ে দিলেন। আমি আমার বাবার বাড়ি থেকে কম সম্পত্তি এনে তো দেইনি। তোর বাবার ব্যবসায় লস খেয়েছিল তখনও টাকা এনে দিয়েছি তাহলে বালা আমি পাবো না কেন? বালা জোড়া আমার চাই। তোর বাবাকে বলছিলাম কিন্তু এনে দিচ্ছে না। তুই একটা কাজ কর। তোর বড় মার কাছ থেকে বালা জোড়া আমাকে এনে দিস তো?”

বিরক্তিকর অবস্থা। আমার ভাবতেই ঘৃণা লাগে উনি আমার মা। কীভাবে মনে এতো বিষ জমিয়ে রাখে? মায়ের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মার মনে শুধু হিংসা রয়েছে আর রয়েছে অহংকার। বিছানা থেকে নেমে গেলাম। আলগোছে খোঁপা করে দুর্বল স্বরে প্রত্যুওরে বললাম, –” তোমার বাপের বাড়িতে তো কম সম্পদ নেই। মামাদের তো চার পাঁচটা ফ্যাক্টরি আছে। মামাদের না হয় বলো যেন সেই বালা থেকে বড়ো এবং উন্নতমানের বালা যেন তোমাকে কিনে দেয়!”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মা রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে। মার তাকানো উপেক্ষা করে আবারো বললাম, –” বড়মা তো বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারেনি। তিনি গরীব ঘরের সন্তান। সে বালা জোড়া না হয় শাশুড়ির দোয়া এবং শেষ সম্পদ হিসেবে গচ্ছিত থাক!”

বর্তমানে মায়ের চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না। আলগোছে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম মা বলছে, –” ডাইনিটা আমার সব সন্তানদের হাত করে নিয়েছে। আমারও দিন আসবে। ঐ বালা জোড়া আমি নিয়েই ছাড়বো।”

————

সকাল সকাল আজ যাবির ভাইয়ার মুখ দর্শন হয়েছে। নামাজ পড়ে হাঁটছিলেন হয়তো। শুভ্র পাঞ্জাবীতে হিরো লাগছিল উনাকে। আরবি পড়ায় আজ মন বসেনি। পাখি হলে উড়াল দিয়ে চলে যেতাম উনার কাছে। সুমু রুমু কান ধরে আজও দাঁড়িয়ে আছে। দুই দুষ্টুদেরকে দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটল। মক্তব শেষে সুমু, রুমু সহ রওনা হলাম যাবির ভাইয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

পাঞ্জাবীর পরিবর্তে পরিধানে গেঞ্জি দেখে অনেকটাই অবাক হলাম। উনাকে সবসময় পাঞ্জাবী পরা দেখেছি। গেঞ্জি পরিধান করাতে বয়স আরো কম লাগছে। আমাকে এই সময়ে যেন আশা করেননি। মুখ লুকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমার কথায় থেমে গেলেন।
–” সুমু, রুমু আমার সাথে আরবি পড়ে। ওদের মায়েরা বলেছে আপনার থেকে পড়া পানি নিয়ে যেতে।”

থমকে দাড়ালেন উনি। খানিকটা রাগান্বিত স্বরে বললেন, –” এতো বড়ো মেয়ে হয়েও এসব বিশ্বাস করতে লজ্জা লাগছে না? আমি কী হুজুর, নাকি পীর দরবেশ যে পানি পড়া দিবো?”

–” আপনি তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আমারও দরকার।”

যাবির ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অপরপাশে ফিরে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। সময় নিয়ে ফিরলেন আমাদের দিকে। রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন রান্না ঘরে।
সুমু,রুমুকে বারান্দায় বসিয়ে আমি নিজের কাজ সম্পাদন করতে চলে গেলাম। যাবির ভাইয়ার ঘরটা খুবই গোছগাছ। একটা খাট, একটা পড়ার টেবিল, আর একটা আলনা তিনটা বস্তু রয়েছে ঘরটিতে। পড়ার টেবিলে একটা বইয়ের ভাজে গতকালের লিখা কাগজটা রেখে দিলাম। উনার ঘরে একটা জানালা রয়েছে রাস্তার পাশে যেখান থেকে আমি প্রতিদিন উনাকে লুকিয়ে দেখি এবং পরিশেষে ধরা পড়ে যাই। জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছি উনি প্রতিদিন আমাকে দেখেন কীভাবে। এমনিই কর্ণধারে যাবির ভাইয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। উনি শান্ত স্বরে বলছেন, –” আমাদের জীবনের নিদ্দির্ষ্ট লক্ষ্য থাকে। তোমার জীবনের লক্ষ্য কী, মায়া?

চাঁদ না চাইতেও হাতে পেলাম যেন। খুশিতে গদগদ হয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনের মানুষকে বিয়ে করা।”

কথা বলা শেষ হতেই যাবির ভাইয়া কাশতে শুরু করলেন। আমি বিচলিত হয়ে নার কাছে গিয়ে মাথা,বক্ষঃস্থল, পিঠে থা’প্প’ড়াতে থাকলাম। কাশতে কাশতে চোখ মুখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসছে। আমার হাত থেমে নাই। অনবরত কিল ঘুসি যাই পারছি দিয়ে যাচ্ছি। অবশেষে উনার কাতর স্বর শোনা যায়। উনি বলছেন, –” এভাবে স্পর্শকাতর স্থানে মারতে নেই মায়া। লজ্জা পাচ্ছি।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here