ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ২

0
855

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|দ্বিতীয় পর্ব |

প্রভাতের হেলানো বাতাস। আবহাওয়া অশান্ত, শীতল। পলাশ গাছ তলায় ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে বাতাসে ফুল ঝড়ছে আর আমার মনে কাল বৈশাখী ঝড় তাণ্ডব চালাচ্ছে।
ধলি পাড়ার পরিচিত স্থান, যেখানে কপোত-কপোতিরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বসে গল্প করে। পরিচিত বলার কারণ, সেখানে একপাশে সবুজে সমারোহ আরেকপাশে মরুভূমির প্রান্তর। এজন্যই সকলে শুভ্রপুষ্প ডাকে জায়গাটাকে। আরো একটা কারণ আছে। ফাল্গুনে যেমন কৃষ্ণচূড়া,পলাশ ফুটে শরৎকালে মরুভূমিতে কাশবন গজে উঠে। সাদা কাশবনের পরিবেশ তখন শুভ্রপুষ্প হয়ে উঠে।

ওড়না ভর্তি পলাশফুল। সুই সুতার অভাবে বয়ে নিয়ে আসা। স্কুলের সময় হয়ে উঠেছে নয়তো শুভ্রপুষ্পে বসেই মালা গাঁথা শুরু করতাম।
চুপি চুপি ঘরে এসে মালা গেঁথে নিলাম। আঁখি দ্বয়ের সামনে মালা উঁচু করে সেখানে যাবির ভাইয়াকে কল্পনা করলাম। লাজুক হেসে উনাকে পরিয়ে দিচ্ছি। উনার বাঁকা দাঁতের হাসি দেখে ঘায়েল হচ্ছি। ভাবনায় রোধ করল মালা এসে। হাতের মালাখানি মালার গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে। চোখে আনন্দ,মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, –” বুবু, আমার জন্য আনছো? মেহেদীর জন্য আনো নাই? আমারটা দেখলেই চাইবে। আমি দিবো না।”

–” দিস না। তোদের মাস্টার আসছে। পড়াতে আসবে কখন?”

–” মা বলল বিকেলে। কেন? তুমিও পড়বা নাকি?

ছোট বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, দেখতে-শুনতে ভালো দেখায়। তবে তারা যদি বড়দের মত আচরণ করে তা অভদ্রতা দেখায়। মালার দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করলাম। বুঝেছে সে ব্যাপারটা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দুই পা পিছিয়ে বলল, –” আমাকে মারবা না।” দাঁড়ালো না মালা। পলায়ন করল ঘর থেকে।
স্কুল ড্রেস পরিধান করে, মাথার চুলে দুই বিনুনি করে পরিপাটি হলাম। বড়ো মা বসে আছেন আমাদের জন্য। খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যাবেন।

———–
ফাগুন লেগেছে অন্তরের গহীনে। ভাবছি তার কথা, কবে দিবে সে দেখা! অনেক কথা জমে আছে হৃদয়ের গোপন কক্ষে। আসবে কী সে! ভালোবাসার আবদারে!

–” মালার বইয়ের ভাজে কাগজ কে রেখেছে?”

দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। বসার ঘরে মালা মেহেদীকে পড়াচ্ছেন যাবির ভাইয়া। দুই মাসে দুজনের মাথায় গোবরে পোকা বাসা বেঁধেছে। আমি পড়িয়েছিলাম কতদিন কিন্তু তাদের মন মত হয়নি। তাঁদের ভাষ্যমতে,আমি নাকি পড়া চোর। পড়ার মধ্যে ডাল,ভাত মাখিয়ে পড়াই। যাবির ভাই নাকি মসলা মেখে গোস্ত রান্না করে পড়ায়। উদাহরণ শুনলে নিজের-ই মাথা ঘোরায়। পড়ার মধ্যে শুধু ডাল,ভাত বা মাংস কীভাবে আসে? মাথায় ঢুকে না। এজন্যই আমাকে গাঁধী বলে যাবির ভাইয়া। পুনরায় ধমকে উঠলেন তিনি। বুঝতে পারলাম আমার উদ্দেশ্যে কথা বলা, –” পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসো। আমি জানি তুমি এখানেই।”

পর্দা মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে মুখশ্রী ঢেকে নিলাম। মিনমিন করে বললাম, –” আপনি ভেবে নিন, আমি এখানে নাই।”

সম্মুখে যাওয়ার মত মনে সাহসটুকু নেই। লজ্জা,ভয় একসাথে গ্রাস করছে। পর্দার আড়ালে যে আমি নিশ্চিত হলেন কীভাবে? তারমানে উনি কি আমাকে অনুসরণ করেন? চোখ খিচে বন্ধ করে রাখলাম। আমি যে চুরি করে ধরা পড়ে গেছি।
–” আমি ভেবে নিয়েছি, আঙ্কেল একটু পর এলে তোমার সব তথ্য ফাঁস করব।”

অপরাধীর ন্যায় বেরিয়ে এলাম পর্দার আড়াল থেকে। নত মাথা তুলার ক্ষমতা নেই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বললাম,
–” আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম কথাগুলো।”
–” এখানে আসলো কীভাবে?”
–” মালা হয়তো রেখেছে।”
স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি ডায়ের ছেঁড়া পাতার অংশবিশেষ। যেখানে আমার কলমের ছোঁয়া রয়েছে। যাবির ভাইয়া সেটা চার ভাজ করে পকেটে পুরে নিলেন। চোখ বড়ো হয়ে আসলো আমার। পরমুহূর্তে উনার তিক্ত কথা শুনে মন ছোট হয়ে গেল।
–” কাগজখানা রেখে দিলাম। আগামীকাল আঙ্কেলকে দেখাবো যে তার মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার এই কারণ।”

ভোঁতা মুখশ্রীতে আবারো অবলোকন করলাম মাস্টারকে। যিনি এখন মালা,মেহেদীকে পড়াতে ব্যস্ত।

–” মায়া এদিকে আয় তো দেখি! বিছানা ছাড়তে পারছি না। আমাকে তোল?” মায়ের ডাকে ভয় পেলাম। বুকে থু থু দেয়ার ভঙ্গিতে সামনে ফিরে তাকালাম। যাবির ভাইয়া ভ্রু-দ্বয় কুঁচকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভেংচি কে’টে চলে আসলাম সেখান থেকে। সেখানে থাকা মানে ফ্রি ফ্রি মাস্টারের শাস্তি পাওয়া।
——–

–” কি রোগ হইলো রে মনা! উঠতে পারি না,বসতে পারি না। নে ধরে তোল আমাকে।”
–” ডাক্তার বলেছে তোমাকে হাঁটা চলা করতে। তা তো করবে না। সারাদিন শুয়ে আরো রোগ বাড়াচ্ছো।”

মাকে ধরে শোয়া থেকে উঠাতে সাহায্য করলাম। কোমড়ের হাড্ডি ক্ষয়ের সাথে কিডনির সমস্যা। হাঁটা চলায় সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়ে।
টেবিলের উপরে পানি ভর্তি জগ থেকে গ্লাসে ঢেলে মায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। পানি পান করে মা এদিক সেদিক কী যেন খোঁজ করছেন। বুঝতে পারলাম সাথে বিরক্ত হলাম প্রচুর। অবশেষে মা বলেই ফেললেন, –” তোর বাবা কোথায় রে? বড়ো আপার কাছে গেছে নাকি?”
আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাকে কখনো বড়ো মায়ের কাছে যেতে দেখিনি। তবুও আমার মায়ের এক কথন। সমাজের চোখে আমরা সুখী পরিবার কিন্তু আমরা জানি যে আমরা কতটুকু সুখী। মনের তিক্ততা আর ধরে রাখতে পারলাম না। হেয় হয়ে বললাম, –” তুমি জানো বাবা এখন চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। তুমি বড়ো মায়ের সাথে এত লাগো কেন, বুঝিনা।”
–” এসব বড়োদের ব্যপার তুই বুঝবি না। সতিনের ঘর করছি। বিছানায় পড়ে থাকলেও জামাইকে হাতের মুঠোয় রাখি।”

আপন মা হলেও, মায়ের সাথে আমার বনে কম। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন নাকি মা হয়। আমার ক্ষেত্রে আমার আপনজন বড়ো মা। মনের সকল কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। পড়ার বাহানা করে চলে আসলাম ঘর থেকে। আমি জানি সেখানে থাকলে মা বড়ো মায়ের বিরুদ্ধে নানান কথা বলবে। যা আমার সহ্য হবে না।
—————

প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে দশটা শ্রেণীকক্ষ। একই মাঠে প্রাইমারি এবং হাইস্কুল দুটোই বেশ সুনিপুণভাবে পরিচালনা করেন শিক্ষকরা।
টিফিনের ঘণ্টা বেজেছে। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে বাহিরে বের হয়েছে টিফিন খেতে কিংবা খেলতে।
বাহিরের পরিবেশ অবলোকন করে নিলাম একবার। শ্রেণীকক্ষে পনেরো মিনিট কেউ আসবে না। ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছবি এবং সাদা রুমাল বের করলাম। ছবিখানা যাবির ভাইয়ার। সাদা রুমালের উপর এই ছবি এঁকে নকশি করব, নিচে দুই হাত একসাথে করার চিত্র আঁকব। এবং নিচে লিখে দিবো,’ এই বন্ধন কখনো ছাড়বো না।’
বন্ধন তৈরি হয়নি অথচ ছাড়ার নাম নিচ্ছি। পেন্সিল দিয়ে আঁকতে চেষ্টা করছি। মুখের আকৃতি এঁকে বসে আছি কারণ আছে বৈকি। এত সুন্দর হাসির চিত্র যে আমার হস্ত দ্বারা সম্পন্ন হবে না। আঁকা বাদ দিয়ে হাস্যজ্বল মুখশ্রীর মানবটির প্রতিচ্ছবি দেখায় মনোযোগ দিলাম। তখনই আগমন ঘটে আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী সায়মার। আমাকে মনোযোগ দিয়ে উনার ছবি দেখতে পেয়ে বলল, –” আমরা সাত গ্রাম ঘুরে,খেলে চলে এসেছি। আর ইনি বসে বসে প্রিয়তমেষুর ছবি দেখছে।”
–” তুই বুঝবি কিরে সখি! প্রিয়তমেষুর প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি নৌকায়। ভাবছি মাঝি হবে সে, কিন্তু সে তো নৌকার ধারে কাছেই আসে না।”
–” তোর মাঝির তোর মনের খবর বুঝতে জনম পাড় করে দিবে রে মায়া! শেষে দেখবি নৌকা চালানোর বৈঠাও পাবি না।”

–” মাঝিকে তো পাবোই সাথে নৌকা,বৈঠাও পাবো।”

ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাসি বিদ্যমান। যার নাম জপে দিবস,রজনী পাড় করি সে আমার সামনেই ঘুর ঘুর করছে। অনেকের সাথে নাকি এমন হয়। আপনি যার কথা বেশি ভাবেন সে আপনার সামনে এমনিই চলে আসবে, মনের টানে। এসব কথা বিশ্বাস করি না। পরিস্থিতি মানুষকে যে কোন স্থানে নিয়ে আসতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। টিফিনের আরো দশ মিনিট সময় বাকি আছে। কাপড়,কলম,সুই সুতা ব্যাগে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে বের হয়ে আসলাম শ্রেণীকক্ষ থেকে।

আয়ুব চাচার হাতের বানানো ঝালমুড়ি অমৃত স্বাদ। সিদ্ধ ছোলা বুট থেতলে নরম বানিয়ে মুড়ির সাথে মাখায়। মুখে দিতেই যেনো গলে যায়। যাবির ভাইয়া এসেছেন মুড়ি খেতে। ভেবেছিলাম আমাকে বা অন্য কোন মেয়েকে দেখতে এসেছেন কিন্তু না, উনি মুড়ি খাচ্ছেন। মুখের ভাবগতি এমন যেন পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানি খাচ্ছেন। জিভে জল এসে পড়েছে। আমি শুধু যাবির ভাইয়ার ঠোঁট নাড়াচাড়া দেখছি। সুস্বাদু খাবার তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে ভাবনার জগতে বিচরণ শুরু করলাম, উনি নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন মাঝে মাঝে ঠোঁটের চারপাশের লেগে থাকা খাবার যত্ন সহকারে মুছে দিচ্ছেন। আমি লজ্জায় লাল নীল হচ্ছি। দুই হাতে মুখ লুকাচ্ছি।
ঘণ্টার আওয়াজে কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে চলে আসলাম। আমার ঠিক সামনে যাবির ভাইয়া দাঁড়িয়ে। হাতে ঝালমুড়ির ঠোঙা। বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি খুশি মনে হাত দিয়ে ধরতেই উনি বললেন, –” যতটুকু আছে সব তোমার। ঠোঁটের নিচে থুতনির উপরের লালাটুকু মুছে নাও। নয়তো বেঁচে থাকা সম্মানটাও হারাবে।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here