ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় পর্ব ১

0
1782

–” বড়ো মা, গ্রামের সকল মেয়েদের মত আমাকেও কী ষোল বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিবে?”

মধ্যরাতের সময়। বড়ো মা তন্দ্রাচ্ছন্ন। তবে আমার আঁখিদ্বয়ে তন্দ্রার ভাব গতি নেই। মনটা বিষন্নতায় ঘিরে আছে। কারণ আছে বৈকি! গতকাল আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী নীলাকে জোর করে, বিয়ের পিড়িতে বসানো হয়। বর ছিল চাচার সমেত। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। নীলার বয়সের ব্যবধানে চাচা বলছি। বড়ো মাকে বার পাঁচেক ডাকার পর ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বরে হু হু করে আবারো ঘুমিয়ে গেলেন। আমার প্রশ্নের উওর এখনো অজানা। বড়ো মাকে আবারো ডাকলাম। রক্তিম চোখ দেখে ভয় পেলাম বটে। তবুও প্রশ্নে অনড়। –“বলো না বড়ো মা!”
–” ঘুমোতে দে মনা! সকালে মক্তব পড়তে না উঠলে তোর বাবা খুব বকবে।”
দম বন্ধকর অবস্থা। বড়ো মায়ের লাঠির বাড়ি হজম করা যাবে তবে সকালে বাবার কথার ঝুড়ি সহ্য করা দুষ্কর হয়ে যাবে। ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। রূপকথার জগতের রাজপুত্রের দেখা না পেলেও স্বপ্নে ভূত প্রেতদের দেখা পাই। বন্ধুত্ব করতে আসে, তবে অসুস্থ করে যায় আমাকে।

ভোর সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে শোনা যাচ্ছে। যেন তারা বলছে,’ উঠো উঠো সময় হয়ে গেছে।’
ফজরের সময় বড়ো মা একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে আমাকে উঠালেন মক্তবে যাওয়ার জন্য। আমি প্রতিদিনের মতো আজও আলসেমি করছি, না যাওয়ার জন্য। কিন্তু বড়ো মার সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব। ঘুম জড়ানো চোখে ঢুলে ঢুলে নামাজ পড়ে মাথায় হিজাব পরে ছুঁটছি মক্তবে উদ্দেশ্যে।

চারদিক এখনো অন্ধকার হয়ে আছে। পাশের বট গাছ থেকে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। সূর্যের আলো থেকে বাঁচতে মাথার উপর দিয়ে বাদুড় নিজের গন্তব্যে যাচ্ছে। শুধুমাত্র মাঝরাস্তায় বড়ো মা এবং আমাকেই দেখা যাচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে অন্যতম মক্তব। কাঙ্খিত জায়গায় আমাকে রেখে বড়ো মা চলে গেলেন বাসায়। কারণ তিনার এখন অনেক কাজ।

আমি মেহরিন মায়া চৌধুরী। জামান চৌধুরীর মানে আমার দাদাজানের দুই সন্তান। একজন আমার বাবা রৌনক রহমান চৌধুরী অপরজন জবরুল চৌধুরী। আমি আমার বাবা অর্থাৎ রৌনক চৌধুরীর বড়ো মেয়ে। ছোট এক ভাই, এক বোন আছে। তারা দুইজন জমজ। নাম মালা,মেহেদী। জমজ হলেও তাদের দুই জনের মধ্যে কোনো মিল নেই। সুরজাহান বেগম আমার মা। আরো একজন আছেন ফুলবানু। তিনি আমার বড়ো মা অর্থাৎ সৎ মা। বড়ো মা বন্ধ্যা। কোনো সন্তান না হওয়াতে বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। আমরা তিন ভাইবোন বড়ো মা বলতে পাগল। সবকিছুতে বড়ো মা কে চাই-ই চাই। ঐ যে বলে না! কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন! নাড়ির টান না থাকলেও মোহব্বতের টান রয়েছে। বড়ো মার কাছেই আমাদের সকল আবদার।
গজীপুরের ধলি পাড়ায় থাকি আমরা। আমাদের বাসার দুই গলির পর তিন তলা বিশিষ্ট এক দালানে রাজিয়া আন্টির কাছে আরবি পড়ি রোজ। রাজিয়া আন্টি অত্যন্ত ভদ্র মহিলা। উনার কথার আওয়াজ বাহিরে যায় না। উনার কোরআন তেলওয়াত শুনলে অশান্ত মন ও শান্ত হয়ে যায়।
মক্তবে এসে নিজের পড়া শেষ করে রাজিয়া আন্টির কাছে সবক (পড়া) দিতে বসি। সবক দেয়া শেষে নিত্যদিনের মতো রুমু, সুমুকে পড়া শেখাতে চলে যাই। রুমু, সুমু দুইজনের বয়স পাঁচ বছর হবে। দুইজন চাচাতো বোন, খুবই দুষ্টু। এদের যদি কেউ আয়ত্ত করতে পারে সে হচ্ছি আমি।

–” কিরে দুষ্টুগুলো পড়া হয়েছে?”

সুমু, রুমুর সামনে আসন পেতে বসলাম। আমি জানি এই বিচ্ছুদের আজও পড়া শিখা হয়নি। আর হবেই বা কী করে! পড়তে এসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌঁড়াদৌড়ি করে বেড়ায় এই দুইজন।

–“মায়া আপু, তুমি জানো তুমি অনেক ভালো। এর সাথে বুদ্ধিমতি,কেশবতী, রূপবতী।” রুমু বলে ওঠে। পাশ থেকে রুমুর পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে সুমু বলে ওঠে,”শুধু রূপবতী না ঐ কি যেনো বলে! গুনবতী গুনবতী নয়তো এতো সুন্দর করে আমাদের মতো গাঁধীদের পড়াতে পাড়ে!”

–” কী ব্যাপার!আজও পড়া হয়নি তোদের তাই না!তাই তো এজন্য আমাকে এমন তেল মাখছিস। আজ তো রাজিয়া আন্টিকে বলব-ই বলব। তোদের এমন পাকা পাকা কথা বের করছি দাঁড়া।

মুখ ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীতে দুইজন দুইপাশে বসে আছে। শেষে দেখা যাচ্ছে রোজকারের মতো আজও বেচারি দুইজনকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ।
—————————-
সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুর আসতে যেখানে দুই ঘন্টা সময় লাগে সেখানে চার ঘণ্টা সময় লাগল যাবির ভাইয়ার। কেননা আজকের ঢাকা শহর, ব্যস্ততায় ভরপুর। ছুটির দিন বলে কথা। যেহেতু দুইদিন আগে কর্মস্থল মানুষদের বেতন হয়েছে। তাই তো ছুটির দিনে আপনজনদের জন্য কেনাকাটা করতে এসেছে সবাই। আর সন্ধ্যা হলো উওম সময় কেনাকাটা করতে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর পড়তে ঢাকায় আসা যাবির ভাইয়ার। বড়ো ভাইয়া আল মাহমুদের বাসায় থেকে পড়ে। অবশ্য যাবির ভাইয়া হোস্টেলে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু নুসরাতের ভাবির জন্য থাকা হয়নি। আছেন দুই বছর ধরে। উনার ভাবির মতে হোস্টেলে থাকলে নাকি যাবির ভাইয়া অসুস্থ হয়ে যাবেন তাছাড়া পড়াশোনা হবে না।
লম্বা জার্নি করে ঘুমিয়ে সকাল সাতটা বাজিয়ে ফেলেছেন যাবির ভাইয়া। মক্তব থেকে এসে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম। ভাবীর কাছে গতকাল শুনেছিলাম আসবেন। প্রায় আড়াই মাস পর এসেছেন তিনি। উনাকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম এই কয়েকদিন। উনার সাথে দেখা হওয়ায় ঘটনা ছিল ঠিক এই রকম,

দুই বছর আগের কথা,সপ্তম শ্রেণীতে ছিলাম তখন। মাথায় তেলে চুবচুবে। দুই বিনুনি করে দিয়েছেন বড়ো মা। পরিধানে গোল ফ্রক। হেলে দুলে ছাঁদ থেকে নামছিলাম। কপোল বেয়ে ঘামের সহিত তেলও ঝড়ছিল। এমনিতেই আমি শ্যামবরণ, তেলের কারণে পাতিলের তলার কালো রঙের মত দেখাচ্ছিল। গেটের কাছের রাস্তায় ভাবীর সাথে হাঁটছিলেন তিনি। নুসরাত ভাবী আমার খুব প্রিয়। পাশের বাসায় থাকেন। সম্পর্কে কিছুই না। যাবির ভাইয়াকে তখনো দেখিনি। ভাবীকে দেখে লাফিয়ে উঠি। লোকজনের পরোয়া না করেই ভরা রাস্তায় জাপটে ধরি। আকস্মিক আ’ক্র’ম’ণে’র জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ভারসাম্যহীন হয়ে দুজনই পড়লাম যাবির ভাইয়ার উপরে।
মেয়ে লোকের শরীরে মাংসের তুলনায় হাড্ডি বেশি, তারজন্য ওজনও বেশি থাকে। দুই রমণীর নিচে পড়ে যাবির ভাইয়ার অবস্থা নাজেহাল। কন্ঠনালী থেকে আস্তে স্বরে শুধু বলছে, –” ভাবী বস্তা উঠাও কষ্ট হচ্ছে।”
যা লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। মালা,মেহেদী এসে আমাদেরকে উঠায়। লাজে যাবির ভাইয়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এমনই ছিল আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। বলে রাখি, যাবির ভাইয়ার কাছে মালা-মেহেদী প্রাইভেট পড়ে। সেই সুবাদে আমিও কিছু ফায়দা লুটে নেই। কখনো বীজগণিতের সূত্র নিয়ে তো কখনো রসায়নের রাসায়নিক বিক্রিয়া অধ্যায় নিয়ে হাজির হই। প্রথম প্রথম খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতো কিন্তু পরবর্তীতে উনার আসল রুপ দেখায়। কথায় কথায় ধমক, আর শাস্তি। আমার জীবনটা তেজপাতার মত পাতলা করে দিয়েছেন।

যাবির ভাইয়ার ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে সময়ের হিসেব ভুলে গেছি। নড়াচড়া করতে দেখলাম উনাকে। দেখতে পেলে নির্ঘাত শাস্তি দিবেন। চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু তা আর হলো কোথায়! ঐ যে কথায় আছে না, অভাগী যেদিকে তাকায় সেদিকেই বিপদ দেখতে পায়! আমার বেলাও তাই।

–” মায়া! ভেতরে আসো। চো’রে’র মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছো কেনো?

জরিনা, ছকিনা, খালেদা,হামিদা এসব বলে সম্বোধন করতো! শেষ চোর বানিয়ে ফেলল! কী এমন চুরি করেছি? মনটাই তো! তবুও উনার অজান্তে।

ভাবীদের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চঞ্চল চোখ জোড়া যাবির ভাইয়াকে খুঁজতে ব্যস্ত। অবশেষে সামনাসামনি দেখা মিলল উনার। পাঞ্জাবী পরতে পরতে এগিয়ে আসছেন। দুই হাত উপরে তুলে শরীরের আলস্য দূর করার ভঙ্গিতে বললেন, –” কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো বিশ মিনিট। কথার নড়চড় হলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।”

পাংশুটে মুখশ্রীতে তাই করলাম। রাস্তার পথচারীরা কেউ হাসছে তো কেউ ‘বড়ো মেয়ে কানে ধরেছে’ বলে উপহাস করছে।
–” অপরাধটা বলুন?”
ব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে ব্যস্ত উনি। টুথপেস্ট শেষের পথে। দুই হাতে চেপে একটুখানি বের করে ব্রাশের আগায় লাগালেন। যেন উনি আমার কথা শুনতে পাননি।

–” অপরাধীদের ঘাট বলতে নেই, শাস্তি দিতে হয়।”
–” কোন আইনে আছে এই বার্তা?”

উওর পেলাম না। যাবির ভাইয়া ব্রাশ করতে করতে কল পাড়ে চলে গেলেন। আমার অবাধ্য চঞ্চল মন কি আর বেঁধে রাখা যায়! যথাস্থান থেকে সরে ভাবীর ঘরে উঁকি দিচ্ছি কারণ শাস্তি মওকুফের জন্য। সময়ের খেয়াল হতে পূর্বের স্থানে চলে এলাম।

–” চিঠি লিখতে জানো, মায়া?”
–” গরুর রচনা লিখতে পারি। লিখে দেখাবো?
জিহ্বা কে’টে উনার দিকে তাকালাম। হাতের কাছে তোয়ালে না পেয়ে পাঞ্জাবীকে তোয়ালে বানিয়ে ফেলেছেন। নিচু হয়ে মাথা মুছে এখন হাত মুছছেন। মায়া হলো খুব। আমাকে বললে পরিধানের ওড়না এগিয়ে দিতাম! তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করলে খারাপ লাগতো না। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কি দুর্দান্ত চিন্তা ভাবনা আমার! মাথায় আঘাত পেলাম। যাবির ভাইয়া ভ’য়া’ন’ক দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন আমায়।
–” তোমার থেকে মালা,মেহেদী খুবই চতুর। পড়াশোনায়ও ভালো। আক্কেল আছে তাঁদের। কি করতে এসেছিলে?”

–” আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।”

–” আমি দেখতে কী ভ’য়ং’ক’র লাগে! নাকি চিড়িয়াখানার প্রাণী?”

মুখে রসের ‘র’ নেই। ভালো ছাত্ররা হয়তো এমন-ই। পূর্বে তো হেসে কথা বলতো। বর্তমানে মুখটাকে পেঁচার মত ফুলিয়ে রাখে। মনে হয় কেউ জোর করে শ-খানেক মার্বেল মুখে ঢুকিয়ে রেখেছে। নিজে যা বুঝে তাই। কান থেকে হাত ছেড়ে দিলাম। উওর দিতে হবে। নয়তো শান্তি পাবো না। মাটির উঠোন। কাদায় চুবচুবে। সাবধানে পা না ফেললেই কাম সাবার। আমার বেলায়ও তাই। পা পিছলে পড়ে গেলাম সাথে এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটালাম। নিজেকে বাঁচাতে সদ্য পরে আসে যাবির ভাইয়ার পাঞ্জাবীর বক্ষঃস্থল থেকে নিচ পর্যন্ত ফ্যারফ্যার করে ছিড়ে ফেললাম। শুভ্র,শুকনো বক্ষঃস্থল সম্মুখে দৃশ্যমান। ছাটনির হাড্ডি গননা করা যাবে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছি সেদিকে। নিজের দিকে লক্ষ্য করে যাবির ভাইয়ার করুণ স্বর,
–” এটা কী করলে মায়া! তুমি কী আর ভালো হবে না?”

চলবে…..

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|প্রথম পর্ব |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here