#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_৬
#লেখিকা_সারা মেহেক
” কোথায় তুমি?”
আদ্রিশের অবসন্ন কণ্ঠের প্রশ্ন ফোনের ওপাশে মিমের কানে পৌঁছালো। মিম জবাব দিলো,
” ওয়ার্ডে আমি। ”
আদ্রিশ চমকে উঠলো। এক লাফে শোয়া হতে উঠে বসলো। জিজ্ঞেস করলো,
” আজকেই ওয়ার্ডে! ছুটিতে না তুমি?”
মিম এপাশে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” কিসের ছুটি? আমি কি আপনার মতো চাকরি করি নাকি যে বিয়ে উপলক্ষে চারদিনের ছুটি কাটাবো?”
” চারদিনের না হলেও আজকের দিনটা এটলিস্ট ছুটিতে থাকতে।”
” ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আজকে দুটো আইটেম একসাথে হবে দেখে চলে আসলাম। রেগুলারে বসলে রিক্তা ম্যাম আইটেম নিয়ে বেশি ঝামেলা করে না। এজন্য আসলাম।”
আদ্রিশ এ ব্যাপার নিয়ে আর ঘাটালো না৷ জিজ্ঞেস করলো,
” কে দিয়ে গেলো সকালে?”
” আব্বু দিয়ে গিয়েছে।”
” ওহ। আচ্ছা শোনো।”
” জি বলুন।”
ততক্ষণে ওয়ার্ডে প্রফেসর স্যার চলে এলেন। মিম দ্রুত আদ্রিশকে বললো,
” স্যার চলে আসছে। আমি পরে কথা বলবো।”
বলেই আদ্রিশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো সে।
আদ্রিশের সামান্য মন খারাপ হলো। সে মিমকে লাঞ্চ অফার করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে সুযোগ পেলো কোথায়! পরে অবশ্য সে মিমকে ম্যাসেজ করলো,
” আজকে দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করবো। কলেজ শেষ করে রেডি থেকো।”
এই ম্যাসেজ দিয়ে আদ্রিশ ওয়াশরুমে গেলো। ওদিকে মিম ওয়ার্ডে ক্লাস শেষ করে আদ্রিশের ম্যাসেজ দেখলো। কি কারণে কে জানে, কিন্তু আদ্রিশের ছোট্ট ম্যাসেজটি দেখে তার অধর কোনে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সে উত্তর জানালো,
” আচ্ছা।”
———–
ক্লাস শেষে হোস্টেলে এসে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো মিম। আদ্রিশ হসপিটালের বাইরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিমকে দূর হতে দেখে মুচকি হেসে হাত নাড়ালো। যদিও মিম এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কিছু করেনি।
মিম এসে আদ্রিশের পিছনে বসলো, কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। আদ্রিশ তখনও বাইক স্টার্ট করলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। মিম জিজ্ঞেস করলো,
” কেউ কি আসবে দেখা করতে?”
আদ্রিশ হেলমেটের ভেতর দিয়ে জবাব দিলো,
” না।”
” তাহলে স্টার্ট দিচ্ছেন না যে?”
” ভাবছি, বাইক স্টার্ট দিবো কি না। কারণ আমার পিছনে একটা মেয়ে বসে আছে যার কাছে আমি এখনও অপরিচিত, অবিশ্বাসযোগ্য। এমন অবস্থায় কিছু হয়ে গেলে সব দোষ আমার ঘাড়ে পড়বে।”
মিম আদ্রিশের কথার সুর ধরতে পারলো। ফলে খানিক এগিয়ে এসে বসলো সে। বললো,
” এবার চলুন তাহলে।”
” উঁহু, এখনও না।”
মিম এবার আদ্রিশের কাঁধে হাত রাখলো। বললো,
” এবার হয়েছে?”
” নাহ। এবারও হয়নি। তুমি কি কখনো রোমান্টিক মুভি দেখোনি নাকি?”
বলতে বলতেই আদ্রিশ ডান হাত দিয়ে মিমের হাত তার কাঁধ হতে সরিয়ে নিলো। তার উদরের হাত বসিয়ে দিয়ে বললো,
” এই যে এভাবে ধরতে হয় সামনের মানুষকে। একটু শক্ত করে ধরো যেনো পিছন থেকে কোনো অঘটন না ঘটে।”
মিমের খানিক অস্বস্তি অনুভব হলো। তবুও সে আদ্রিশের কথামতো শক্ত করে ধরলো তাকে। এরপর আদ্রিশ বাইক স্টার্ট দিলো।
রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে বাইক পার্ক করে মিমকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো আদ্রিশ। দেখে দেখে কোনার দিকের একটা টেবিলে বসলো তারা। আদ্রিশ খাবার ওর্ডার দিলো। অতঃপর মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি জোর করে এসেছো আমার সাথে?”
মিম চারপাশ দৃষ্টি বুলিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ আদ্রিশের এহেন প্রশ্নে সে থতমত খেয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
” এমন কেনো মনে হলো আপনার?”
আদ্রিশ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। বললো,
” কেনো যেনো এমনটা মনে হলো। আচ্ছা, তুমি কি এখনও আমাকে একসেপ্ট করতে পারোনি?”
মিম স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
” একসেপ্ট করবো না কেনো? কবুল বলে শরিয়ত অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে। একসেপ্ট তো করতেই হবে।”
” অনেকটা জোরপূর্বক একসেপ্ট করছো তাই তো?”
” ব্যাপারটা সেরকম নয়। আপনার হয়তো এ কারণে মনে হয়েছে যে আমি আপনার সাথে কমফোর্টেবল না তাই। দেখুন, প্রথমত আপনি একজন ছেলে, আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। সে হিসেবে নিজেকে এ পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময়ের প্রয়োজন। আপনি পূর্বপরিচিত বলে একদিনেই আপনার সাথে সেরকম মিশুক হওয়া সম্ভব না। এমনও না যে আমাদের রিলেশন ছিলো বলে বিয়ের পর আমরা খুবই ক্লোজ হয়ে যাবো। যেকোনো মেয়ের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ পরবর্তী সময় কিছুটা এমনই যায়। এ বিষয়টা আপনাকে একসেপ্ট করতে হবে।”
মিমের ব্যবহারের কারণে ক্ষণিকের জন্য আদ্রিশের কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলো। তবে মিমের কথাগুলো শুনে সে বুঝলো, আসলেই এমন পরিস্থিতিতে মেয়েদের মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে। সে-ই বরং সবকিছু খুব দ্রুত আশা করছিলো। নিজের এ ভাবনার জন্য নিজেকে কিছুটা ভালোমন্দ শুনিয়ে দিলো সে।
গাম্ভীর্যপুর্ণ কিছু কথাবার্তা চলার পর দুজনের মাঝে উদ্ভট এক নীরবতা বিরাজ করলো। মিম এমন ধরণের মেয়ে যে এমন পরিস্থিতিতে কথা খুঁজে পায় না। আর আদ্রিশ এমন ছেলে যে এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশটাই অন্যদিকে নিয়ে যায়। যদিও সর্বদা সে এরূপ কাজ করতে ব্যর্থ হয়। যেমনটা এ মুহূর্তে ঘটছে। বেশ ঘেঁটেঘুঁটেও কথা বের করতে পারছে না সে। অতঃপর বেশ কিছু সময় বাদে সে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমাদের ক্লাসের সবাই আমাদের ব্যাপারে জানে? ”
মিম যেনো কিছুটা স্বস্তি পেলো। আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” সবাই জানে না। আসলে বিষয়টা ওভাবে সবাইকে বলাও সম্ভব না। কেউ কারোর মাধ্যমে জানলে সেটা এক ব্যাপার।”
” হুম। ঠিক বলেছো।”
” আপনার কলিগরা সবাই জানে?”
” হ্যাঁ, সবাই জানে।”
মিম কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” সবাই জানে! কার সাথে বিয়ে হয়েছে সেটাও জানে!”
আদ্রিশ হাসলো। বললো,
” হ্যাঁ সবাই জানে। তোমার সাথে যে বিয়ে হয়েছে সেটাও জানে।”
এবার মিম উদ্বেগপূর্ণ স্বরে বললো,
” একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেললেন দেখি। এখন উনাদের সামনে যাবো কিভাবে!”
” কিভাবে যাবে মানে? হেঁটে হেঁটে যাবে।”
মিম তেরছাভাবে চেয়ে বললো,
” মজা না। সিরিয়াসলি বলছি।”
” তো আমিও মজা করিনি সিরিয়াসলি বলছি। ওদের সামনে যেতে কি সমস্যা?”
” ইশ, আপনি কি বুঝেন না? যখন জানবে এ কলেজের একটা স্টুডেন্টই আপনার ওয়াইফ তখন তারা কেমন নজরে তাকাবে না!”
” আশ্চর্য! কেমন নজরে তাকাবে কেনো। স্বাভাবিক একটা জিনিস। এমন কত সিনিয়র জুনিয়র, ডাক্তার স্টুডেন্ট বিয়ে হয়েছে এখানে। নরমাল এসব।”
” হতে পারে নরমাল। কিন্তু আমার…..”
” আহহা, অকারণে এতো চিন্তা কেনো? বাদ দাও এসব চিন্তা। লাঞ্চ এঞ্জয় করো।”
ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে। ওয়েটার এসে খাবার দেওয়ার পর মিম নিকাব খুললো। আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,
” আহ, কতদিন পর দেখলাম তোমাকে! ”
আদ্রিশের এহেন কথায় মিম খানিক লজ্জা পেলো বোধহয়। মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসতে লাগলো। বললো,
” নাটক করবেন না। কালকে রাতেই দেখেছেন। একদিনও হয়নি এখনো।”
আদ্রিশ মিমের লাজুক হাসি দেখলো। টিপ্পনী কেটে বিস্মিত হবার ভান করে বললো,
” তুমি এমন লজ্জাও পেতে পারো!”
মিমের মুখখানা হতে চট করে হাসি উবে গেলো যেনো। ছোট ছোট চোখ করে বললো,
” আপনি মানুষটা আসলে খুবই খারাপ। এমন লজ্জা পেলেও দোষ। না পেলেও দোষ। খারাপ লোক একটা। হুহ।”
আদ্রিশ মিমের হেন কান্ডে ভীষণ হাসলো৷ বললো,
” আচ্ছা সরি সরি। এবার খাওয়া শুরু করো। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে খাবার।”
তারা খাবার খাওয়া শুরু করলো। খাবার মাঝে হঠাৎ কি মনে করে মিম জিজ্ঞেস করলো,
” আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
আদ্রিশ মুখে খাবার পুরে নিতে নিতে বললো,
” হ্যাঁ করো।”
” আমি যে হিজাব পরি, নিকাব আপনার সমস্যা হয় না এতে?”
” না। সমস্যা হবে কেনো? এটা সমস্যা হওয়ার মতো কিছু?”
” না মানে অনেক ছেলেরাই এগুলো পছন্দ করে না। তারা চায় তাদের পার্টনারকে সবাই দেখুক। কেমন দেখতে সেটা সবাই জানুক।”
আদ্রিশ এবার খাওয়া বন্ধ করলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
” আমি সেই ‘অনেক ছেলের’ মতো না৷ আমি চাই না আমার ওয়াইফকে কেউ দেখুক। তুমি কোনো প্রডাক্ট নাকি যে সবাই দেখবে আর কমেন্ট করবে তুমি দেখতে কেমন! আমি চাই, তোমার সৌন্দর্য, রূপ-গুণ সব আমিই দেখবো। বাইরের মানুষকে দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমার এগুলো পছন্দ না। আর তোমার হিজাব পরা নিয়ে যদি আমার কোনো সমস্যা হতো তবে সেটা শুরুতেই ক্লিয়ার করে নিতাম। সো, বুঝতেই পারছো এসবে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
মিম মনের মাঝে ভীষণ প্রশান্তি অনুভব করলো। আদ্রিশের এ মনোভাব তাকে মনের অজান্তে মুগ্ধ করলো। সে মনে মনে সবসময় এমনটাই চাইতো। ভাবতো, কখনো যদি বিয়ে হয় তবে তার এ বেশভূষায় যেনো তার স্বামীর কোনো ধরণের সমস্যা না হয়। সবসময় যেনো তার স্বামী তাকে সমর্থন করে। দিনশেষে আদ্রিশকে পেয়ে তার এ ছোট্ট মনোবাসনা পূরণ হলো।
খাওয়া শেষে আদ্রিশ বিল দিয়ে মিমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাইকে করে মিমকে নিয়ে খালি একটা প্লটে ঘুরতে এলো।
চারপাশে শুধু ঘাস আর ঘাস। কিছুদূরে কয়েকটি আম গাছ ও বিশাল এক কাঠগোলাপ গাছ। সবুজে সবুজারোণ্য বিশাল জায়গাটির শেষপ্রান্ত দেখে বোধ হচ্ছে গাঢ় নীলচে আকাশ মিলিত হয়েছে সেখানে। দূরের ঐ জায়গাটির মিলিত স্থান সবুজ ও নীলচে রঙে রঙিন হয়েছে। শরীর শীতল করা হাওয়া বইছে চারপাশে। আকাশের সাদাসাদা মেঘকুঞ্জ ধীরেধীরে ভেসে যাচ্ছে।
প্রকৃতির রঙ মিশেল এ শীতল পরিবেশটি দারুণ পছন্দ হলো মিমের। সে বাইক হতে নেমে কয়েক সেকেন্ড আঁখিজুগল বুজে পরিবেশটি উপভোগ করলো।
আদ্রিশ বাইকের চাবি খুলে পকেটে রাখলো। মিমকে এক নজর দেখলো। জিজ্ঞেস করলো,
” আদ্রিশের মিসেস, আপনার হাতটি ধরার অনুমতি আছে কি? ”
মিম চট করে চোখ মেলে তাকালো। ক্ষণিকের জন্য সময় নিলো আদ্রিশের কথা বুঝতে। আদ্রিশ পুনরায় শুধালো,
” আপনি যদি অস্বস্তি বোধ না করেন তাহলে আপনার হাতটি কি ধরতে পারি? ”
মিম মৃদু হাসলো। তার হাসিতে হেসে উঠলো তার আঁখিজুগলও। সে নিরূত্তর রইলো। অকস্মাৎ আদ্রিশকে বিস্মিত করে আদ্রিশের হাতের আঙুলে আঙুল রাখলো। চেপে ধরলো আদ্রিশের হাত। মৃদুস্বরে বললো,
” প্রথম সম্মতির ছোঁয়া।”
®সারা মেহেক
#চলবে