#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৮.
সমুদ্র আজ আগেই বাসায় চলে এসেছে। নিচে দুই একটা কথা বলে নিজের রুমে যাচ্ছিল তখন ওর নজর পরে মধু আর রাহীর উপর। দুজনে দৌড়ে আসছে ছাদের সিঁড়ির দিকে থেকে। তারপর দাঁড়িয়ে কি যেন ফিসফিস করল দুজনে। তারপর নিজেদের রুমে চলে যেতে নিল। সমুদ্র কপাল কুঁচকে গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠল দুজনে। দুজনেই চমকে দাঁড়িয়ে পরল। মধু ও রাহী বোকা হাসি দিয়ে তাকাল সমুদ্রের দিকে।
সমুদ্র দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি ব্যাপার দৌড়াচ্ছ কেন তোমরা? চোর তাড়া করল নাকি?”
মধু এখনো ছাদে পরে যাওয়ার জন্য ভয়ে ভীতু হয়ে আছে। তার উপর ফুয়াদের কাছে ওদের মিথ্যাচার ধরা পরে গেছে। তাই আর ও কথার উত্তর দিল না। অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাহী ঢোক গিলে বলল,,” কি হবে ভাইয়া? কিছু হয়নি তো!”
” এতো রাতে ছাদে কি করছিলি তোরা?”
” আসলে সমুদ্র ভাইয়া মধুর নাকি খারাপ লাগছিল তাই দুজনে একটু ছাদে গিয়েছিলাম।” রাহী মিথ্যা করে বলল।
সমুদ্র রাহীর থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল মধুর দিকে। মধু জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে। মুখটা যথেষ্ট শুকিয়ে আছে। আড়চোখে মধু একটু পর পর ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে ভয়ার্ত চোখ মেলে। দুহাত মুঠোয় বন্দি করে কচলাচ্ছে।
” হোয়াটস হাপেন্ড মধু? ভয় পেয়ে আছো কেন?” সরাসরি প্রশ্ন করল সমুদ্র। সমুদ্রের দৃষ্টি মধুর মুখের দিকে।
মধু ভয়ে থেকে থেকে শুকনো ঢোক গিলছে। বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। ফুয়াদের সামনে ওরা দুজনেই মিথ্যা কথা বলে ধরা খেয়েছে। ফুয়াদ জহুরি নজরে ওদের দিকে তাকিয়ে পুলিশের মতো জেরা করছিল। ওদের কথা সব তালগোল পাকিয়ে আসছিল। উল্টো পাল্টা জবাব দিয়ে ফেলেছে এজন্য। ফুয়াদ এমন এক ধমক দিয়েছে দুজনেই ভয়ে ছুটে নিচে চলে এসেছে। ফুয়াদের কথার জবাব না দিয়ে রাহী কখনো এভাবে আসতে পারে নি। আজ মধুর দেখাদেখি কথার অমান্য করল। এখন ভয়ে ওদের দুজনের হাত পা কাঁপছে। সমুদ্রের প্রশ্নে মধু ফাঁকা ঢোক গালে আমতা আমতা করতে লাগল।
” আমার কিছু হয়নি। আমি এখন ঘুমাব। ঘুমালে একদম ফিট হয়ে যাব।”
বলেই মধু তিন্নির রুমে দৌড়ে গিয়ে দরজা আটকে দিল। রাহী ও কিছু বলল না নিজের রুমে চলে গেল। তিন্নি খাটে শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ। মধু লাফিয়ে পড়ল বিছানায়। তিন্নির ঘুম ভেঙে গেল ধরফরিয়ে উঠে বসল বিছানায়। কেবলি ঘুম ধরেছিল তখনি ঘূর্ণিঝড় এল যেন। রাগী চোখে তাকাল মধুর দিকে। মধু চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে ততক্ষণে। মধু কে ধাক্কা দিয়ে বকা দিল তারপর নিজেও শুয়ে পড়ল।
ফুয়াদ রাগে ফুঁসছে ছাদে দাঁড়িয়ে। বাইরের বেয়াদব মেয়েটার সান্নিধ্য পেয়ে ওদের পরিবারের মেয়েগুলো অবাধ্য, ও বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আজ মধু এখানে না থাকলে রাহী এভাবে উত্তর না দিয়ে যাওয়ার সাহস করতে পারত না। ওই মেয়েটার জন্য এমন দুঃসাহস দেখালো বেয়াদবি করল। রাগে ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। মিথ্যাচার ও একদম পছন্দ করেনা। চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হবে। আর সেই আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে মধুর মতো বেয়াদব মেয়েকে।
ফোন না আসলে ওদের দেখে নিতো। এই মেয়েকে আর এই বাসায় রাখা যাবে না অনেক হয়েছে উপকার করা। মানিকগঞ্জের কোথায় মেয়ের বাসা? সেখানেই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে অতি দ্রুত। এসব ঝামেলা ঘাড়ে রেখে বিপদ বাড়ানো কি দরকার?
ফুয়াদ নিজের বেডরুমে এসে দরজা আটকে দিল। গায়ের শার্টটা এক টানে খুলে সোফায় ছুড়ে মারল। গলায় ও বুকের কাছে জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। কেমন যেন ব্যথা লাগছে। শরীর উন্মুক্ত করে ফুয়াদ থুতনি গলায় ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দেখল চামড়া ছুঁলে গেছে। ফর্সা বুকের উপর লাল লাল রক্তের বিন্দু দেখা যাচ্ছে। আঁচড় কাটা আছে লম্বা দাগ হয়ে। মুহুর্তেই মধুকে টেনে তোলার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। মধু ওর বুকের কাছে শার্ট খামচে ধরে রেখেছিল। তখনি মধু নিজের নখ গেঁথে দিয়েছিল ওর শরীরে। আর যার ফলস্বরূপ গলা থেকে বুক অবধি লম্বা করে আঁচড় কাটা। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা ছিল। এজন্য আরো নখ লাগাতে সুবিধা হয়েছে। মেয়ে না ডাইনি? চামড়া ছুঁলে নিছে। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জ্বালাপোড়া করছে। ফুয়াদ তর্জনী আঙ্গুলে ছুঁয়ে দিল আঁচড় লাগা স্থানে।
সমুদ্র বসে আছে মধুর রুমে। তিন্নি সকাল সকাল উঠে গেছে। ওর এক বান্ধবী এসেছিল তার সাথেই কোথায় জানি গেছে। মধু বিছানায় শুয়ে ছিল দরজা আটকে আজ সকালে খাবেও না ভেবেছে। ফুয়াদ না জানি ওকে কি বকা দেই সেই ভয়ে রুমে বাইরে যেতে পারছে না।
তখনি হঠাৎ দরজায় কড়াঘাত পরে। মধু ভয়ে ছিটকে উঠে। ওপাশ থেকে সমুদ্রের আওয়াজ শুনে অজ্ঞতা দরজা খুলতে হয়। সমুদ্র ভেতরে ঢুকেই পড়ার টেবিলের চেয়ার টেনে বসে। মধু কে সামনে বসতে বলে মধু খাটে সমুদ্রের সামনাসামনি বসে।
বসেই মধু মাথা নিচু করে বলল,,” সরি ভাইয়া কাল ওভাবে চলে আসার জন্য। আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাই..
সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,,” ভয় পেয়েছিলে কেন?”
মধু আমতা আমতা করতে লাগল।
” নির্ভয় এ বলতে পারো।”
কেন জানি মধুর সমুদ্র কে খুব ভরসার কেউ মনে হলো এক মুহুর্তের জন্য। মনে হলো উনাকে সব জানানো উচিত উনি হয়তো তার ভাইয়ের থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে। ফুয়াদ উনার ছোট। ছোট ভাইয়ের সামলানোর ক্ষমতা উনার ভালোই আছে। মধুর আমতা আমতা করে সব খুলে বলল। শুধু রাহী ওর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলছিল এটা লুকিয়ে গেল। রাতে মধু লুকিয়ে আরেকবার রাহীর রুমে গিয়ে সব জেনে এসেছে। রাহী সব স্বীকার করেছে।
সমুদ্র বলল,,” মিথ্যা কেন বলেছ ফুয়াদকে?”
” আসলে আমরা দুজন ছাদে ছিলাম উনি তা দেখে রেগে গিয়েছিল তাই মিথ্যে বলেছি।”
” আচ্ছা ভয় পেয়ো না। আমি ওকে বুঝাব তোমার উপর যেন রেগে না থাকে। কোন সমস্যা হলে আমাকে নির্ভয়ে বললে কেমন?”
” আচ্ছা ভাইয়া। থ্যাংকিউ।”
সমুদ্র চলে গেল। মধু সমুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উনি কত ভালো আর উনার ভাই! কেমন সারাক্ষণ রাগ আর ধমক নিয়ে থাকে। অসহ্য।
মধু ড্রয়িংরুমে এসে দেখল রাহী মাথা নিচু করে বসে আছে আর ওর পাশে বসে আছে আনিতা বেগম তিনি বিলুপ করে কাঁদছে। আর পাশের সোফায় বসে আছে নাফিসা ও ফুয়াদ। সমুদ্র ও মধুর পেছনে পেছনে নিচে এসে এসব দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করল।
ফুয়াদ ঘটনা খুলে বলল। রাহী প্রেম করছে তাও ফুয়াদের বেস্ট ফ্রেন্ড এর সাথে। ভাবা যায় কি সাহস মেয়েটার। সব শুনে মধু চোখ বড়ো বড়ো করে একবার তাকাল রাহীর দিকে তো একবার তাকাল ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদের ফর্সা মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে রাগে। ফোন বের করে কাউকে কল করে ধমক দিয়ে বাসায় আসতে বলল। রাহী ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মধুর দিকে তাকিয়ে ফুয়াদ ধমক সুরে বলল,,” তুমি এখানে কি করছো? এখন আমাদের পারিবারিক আলাপ আলোচনা হচ্ছে। তোমার উপস্থিত না থাকাটাই বেটার। তুমি নিজের রুমে যাও।”
মধু খেতেই নিচে এসেছিল পৌনে এগারোটা বাজে। খুব খিদে পেয়েছিল কিন্তু ফুয়াদের ধমক খেয়ে ওর খিদে পালিয়ে গেছে। সাথে চাপা কষ্ট ও অনুভব হয়েছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে দ্রুতই। ও সুরসুর করে আবার উপরে চলে এল।
নাফিসা ফুয়াদকে বললেন,,” শুধু শুধু বাচ্চা মেয়েটাকে ধমক দিলি কেন? মন খারাপ করে চলে গেল।”
” মম, ওতো বড় মেয়েকে তোমার বাচ্চা মনে হয়?” অবাক স্বরে বলল ফুয়াদ।
” বাচ্চাই তো বুড়ি তো আর হয় নাই।” নাফিসা বললেন।
দুজনের কথায় বেগরা দিয়ে সমুদ্র বলল,,” ফুয়াদ, নাঈমের সাথে রাহী প্রেম করছে আর তুই জানতি না?”
ফুয়াদ রাগান্বিত চোখে তাকাল রাহীর দিকে। তারপর বলল,,” আমার বোন না হয়ে অন্য কেউ হলে ঠিকি জানতাম।”
সমুদ্র আয়েশ করে বসল সোফায় তারপর রাহীর দিকে তাকিয়ে বলল,,” রাহী এজন্য কি সব বিয়ে ভেঙে দিচ্ছিলি? ভাইয়ের বন্ধু কে মন দিয়ে আর কোন পাত্র কে তোর চয়েজ হচ্ছিল না তাই না?”
লজ্জা মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে রাহীর। বড়ো ভাইদের সামনে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি পরতে হবে জানলে কখনোই এই প্রেম ও করতো না। আনিতা বেগম মেয়েকে একটা থাপ্পড় দিয়ে থেমে ছিল। সমুদ্রের কথায় আবার মাথা চারা দিয়ে উঠল রাগ। হাত উঠিয়ে থাপ্পড় মারতে চাইল।
সমুদ্রের কথায় থেমে গেল তার হাত।
” চাচি বিয়ের লাক মেয়েকে আর না মেরে চাচাজান কে ফোন করে বাসায় আসতে বলো।”
হাত গুটিয়ে নিয়ে নিজের স্বামীকে কল করতে রুমে দিকে ছুটে গেলেন আনিতা।
#চলবে……