#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ০৭
১৩.
হৃদের সাথে দাঁড়িয়ে আছি “তাজ রেস্টুরেন্ট” এর সামনে। আমাদের কফি শপে যাওয়ার কথা হলেও সেখানে আর যাওয়া হলো না। নিতু আপুই যেতে দিলোনা। আমাদের সাথে নিতু আর রাফিন ভাইয়াও দাঁড়িয়ে আছেন। বারবার ভেতরে যাওয়ার কথা হলেও কোনো এক উহ্য কারনে দাঁড়িয়ে আছেন রাফিন ভাই। আর ফর্মালিটির কারনে আমাকে আর হৃদকেও অগত্যাই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তার সাথে।
—-” ওকে ওকে। আমরা আসছি!”
কারোর সাথে ফোনে কথা বলে কল কাটলেন রাফিন ভাই। নিতু আপু আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-” ভেতরে সব কাজ কমপ্লিট সো আমরা যেতে পারি। নিধি, অর্নব কাম। নিতু এসো।”
এই বলে নিতু আপুর হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন রাফিন ভাই। নিতু আপুও রাফিন ভাইয়ের পা ফেলার ধাপে ধাপে পা ফেলছে। হৃদ বেশ বিরক্ত! চোখে মুখে তা বেশ স্পষ্ট হয়েই আছে। হৃদের বিরক্তির কারন অবশ্য এই রেস্টুরেন্টটা। বিশাল বড় একটা রেস্টুরেন্ট। সাথে বেশ নাম করাও। হৃদের বেশি বড়োলোকিপানায় সর্বদা এলার্জি। লাইফ ইজ সো সিম্পল। আজ আছি তো কাল নেই। তাতে এতো সাহেবিয়ানা না করে সিম্পল জীবন অতিবাহিত করাই তার অভ্যাস।
রাফিন ভাইকে আসার পথে হৃদ অবশ্য বলেছিলো সে আসবে না! কিন্তু রাফিন ভাই শুনলেন না। একপ্রকার জোর করেই সাথে নিয়ে এলেন আমাদের। আমি হৃদের মন পড়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—-” দাঁড়িয়েই থাকবেন জনাব? ভেতরে যাবেন না?”
হৃদ কাচুমাচু মুখে তাকালো আমার দিকে। আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েও নিলোনা। এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা দেখা যাচ্ছে ওর মুখে। রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো হৃদ। কিছু একটা ভেবে গম্ভীর গলায় বলল,
—-” চলো।”
দু’জন আহত পথিকের মতো আস্তেধীরে সিঁড়ি ভেঙে দো’তলায় চলে গেলাম। বাইরের দরজাটা টান দিতেই হাট করে খুলে গেলো সেটা। আমি খানিক থতমত খেয়ে হৃদের দিকে তাকালাম। হৃদ ইশারায় আমায় ভেতরে যেতে বলল। আমিও সাদা মনে পা বাড়ালাম, কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই চোখ আমার চড়কগাছ। চারপাশে পুরোই হুলস্থূল কান্ড। ম্যাক্সিমাম কাপেলেই গিজগিজ করছে চারপাশ! সেই সাথে লাইটিং এর তীব্র নি/র্যা/ত/নে চোখ ধাঁধিয়ে আসছে আমার। চেয়ার টেবিল বাদ রেখে একদম কর্নার সাইডে কিছু অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে সফ্ট মিউজিকে বল ডান্স করছে। সত্যি বলতে এদের আমোদিত পরিবেশে আমার একটু বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি তে মনে হচ্ছে রীতিমতো কেউ আমার গলা চে/পে ধরেছে। বড্ড উদ্ভট লাগছে পরিবেশটা।
চারপাশে নজর দিতে দিতে খেয়ালই করা হয়নি, ইতিপূর্বে আমার সঙ্গে হৃদ দাঁড়িয়ে থাকলেও, এই মুহুর্তে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। এতো অস্বস্তির মাঝে হৃদকে হঠাৎ কোথাও চোখে পড়ছেনা! চারপাশে লাল,নীল,হলুদ মানুষ গুলোর মাঝে হৃদকে চাতক পাখির মতো নজর ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলাম! কাপলগুলোর মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের আশেপাশে খুঁজতে যেন আরও বেশি অস্বস্তিতে ঘীরে ধরলো আমায়।
এখানে প্রত্যেকটা মানুষই তাদের প্রিয় মানুষ টার সাথে নিজেদের মতো করে আলাদা প্রাইভেসি নিয়ে আছে। সেখানে আমি বোকার হদ্দ হয়ে কি করে হস্তক্ষেপ করতে পারি! ভাবলেই তো ভীষণ অকওয়ার্ড লাগছে। কিন্তু এই হৃদ টা হঠাৎ কোথায় গেলো। এখন এমন একটা জায়গায় কোথায় কোথায় হাতড়ে খুঁজবো তাকে? আচ্ছা হৃদ কি এখানের এই সিচুয়েশন দেখে চলে গেলো? এটা কোনো কথা? না বলে চলে গেলো? আমি তো ওর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলাম? হাউ ইরেস্পন্সিবেল!
—-” হ্যালললো গাইজ।”
খনখন শব্দ করে কারোর গর্জনে আচমকা ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি। কিছুক্ষণের জন্য মনের মধ্যে মনে হলো কেউ ঠাস ঠাস করে বেতের বারি বসিয়ে দিয়ে গেলো। উফফ,বুকটা এখনো ধড়ফড় করছে। কে বে? কোন দেশের গাঁ/জা খেয়ে এতো মোটা স্বরে মাইক নিয়ে চেঁচাচ্ছে? মে/রে বালিশ চা/পা দিয়ে দেওয়া উচিৎ।
—-” আই হোপ অল অফ ইউ গাইজ আর এঞ্জয়িং দ্যাট মোমেন্টসস!”
আবারও চেঁচিয়ে উঠলো লোকটা। আমি ক্ষেপা চোখে তাকালাম। এতো ছোট জায়গায় লোকটা কোন দুঃখে যে এমন বিকৃত গলা নিয়ে মাইক দিয়ে চিল্লাচ্ছে বুঝতে পারছিনা!
আর বোঝাবুঝির সুযোগ পেলাম না। পুরো হল কাঁপিয়ে প্রত্যেকটা মানুষ চেঁচিয়ে উঠলো। “ইয়েস ইয়েস” ধ্বনিতে ঝনঝন করে কাঁপছে রুমটা। মানুষ গুলো বড্ড অদ্ভুত! আমি এদের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিনা! খুব বেশি অস্বস্তি হচ্ছে। হৃদটাও না বলে চলে গেলো! আমিও থাকবো না, আমাকেও যেতে হবে।
—-” অর্নব! ইয়া রাইট। দেখেছিস আমিও কি মনভুলো হয়েছি! অর্পার সাথে রুমডেটে…..”
পেছন মুড়ে হাঁটা ধরতেই বাতাসের সাথে সুর মিলিয়ে ভেসে আসলো কথাটা। পুরো কথাটাও শুনলাম না। মাঝপথেই আবার মিলিয়ে গেলো। “অর্নব” নামটা শুনতেই না চাইতেও থেমে গেলো আমার পা। চটপট পেছন তাকিয়ে নাম নেওয়া মেয়েটাকে খুঁজতে লাগলাম! এই এক্ষনি যারা আমার পেছন দাঁড়িয়ে ছিলো তারাও এখন নেই। মানুষ গুলো সব জটলা হচ্ছে মিউজিকের জায়গাটায়। বোধহয় কাপল ডান্স হবে এখন। যে মেয়ে টা অর্নবের নাম নিলো তার গলাও আর শুনতে পাচ্ছি না! চারপাশে চাতক পাখির মতো দৃষ্টি দিলেও ঠাহর করতে পারলাম না ঠিক কোন মেয়ে নাম টা নিলো?
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে কিছুক্ষণ মনের সাথে যু/দ্ধ করলাম। মেয়েটার আলোচনার মূল টপিকের অর্নব আর আমার অর্নব এক জন নয় তারই যু/দ্ধ। মন পরাজিত হলো আর মস্তিস্ক হেরে গেলো। মনের মধ্যে প্রশান্তির বাতাস বইতেই আবারও ঘুরে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য এখান থেকে চলে যাওয়া। ফের হৃদকে নিয়ে কোনো এক কফিশপে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে একদম বাসায়।
বের হওয়ার দরজাটা আবারও বাইরে ঠেলে দিতেই হাট করে খুলে গেলো। এবার আর থতমত খেতে হলো না আমায়! আমি নির্দ্বিধায় বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই যেন বাতাসের তীব্র গতিতে ভেতরে ঢুকে এলাম। চমকে উঠে পরিস্থিতি বোঝার জন্য আশেপাশে তাকাতে বিশেষ কাউকে চোখে পড়লো না। পরমুহূর্তেই ঠাহর হলো যে কেউ হাত ধরে হেঁচকা টানে নিয়ে এসেছে আমায়। বুকের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে ধড়ফড় করতে লাগলো। মন বলছে কেউ হাত ধরে হেঁচকা টান মে/রে ভেতরে ঢুকিয়েছে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে না, এমন কাউকে তো আমার থেকে দশহাত দূরেও তো দেখছি না। কেননা, তার কাছে এক্সট্রা কোনো পাওয়ার নেই যেটা থেকে সে চোখের পলকে স্থান পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু মস্তিষ্কের ভাবনা ঠিক হলো না! মনের ভাবনাই ঠিক হলো, কেউ আমায় হেঁচকা টান দিয়েই ভেতরে নিয়ে এসেছে। আর তার প্রমাণ সরূপ আমার বাম-হাতের ভাজে নীল রঙের ছোট একখানা চিরকুট।
চারপাশে রঙ বেরঙের লাইটিং এর মাঝে সফ্ট মিউজিক আর তার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে! হাতে একটা চিরকুট নীল কাগজে মোড়ানো আর তার মাঝে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা! শরীরে অদ্ভুত রকমের রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে কাঁপুনি হচ্ছে। কপালের মাঝে কিছু চিন্তারা দৌড়াদৌড়ি করার দরুন বিন্দু বিন্দু ঘামের সূচনা ঘটছে। নিঃশ্বাস আপনাআপনিই ঘন হয়ে এসেছে। না চাইতেও নিঃশ্বাস বার বার আঁটকে যাচ্ছে আবার সেই সাথে কিছুক্ষন পেরোতেই লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস আসছে।
” তোমায় নিয়ে ভাবতে বসলে যে ভাবনারাও কুল কিনারা হারিয়ে ফেলে। বিরক্ত হয় আমার প্রতি,তিক্ত হয়। ধৈর্য্য হারায়,অতিষ্ট হয়! তবুও মন পাত্তা দেয়না। মনের সাথে তাদের তুমুল যু/দ্ধ লেগে যায়! কেন? কেন মন শুধু তোমাকেই ভাবতে বলে? ভাবতে চায়! মন খুব শক্ত গলায় বলে, ভাবতে হবে। শুধু এবং শুধু তোমাকেই ভাবতে হবে! আর ভাবনারা কি বলে জানো??”
আমায় প্রশ্ন করলো? ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম আমি। লেখাগুলো পড়ার পর আমার মাথার উপর দু-তিন টা করে ঠা/ডা পড়ে আমি ম/রে গেলেও খুব বেশি একটা অবাক হবো না। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। কে করলো এই কাম? কে দিলো চিরকুট? আমি সিউর বেটা এখানেই আছে। এদের মাঝেই কেউ একজন এই চিরকুটদাতা। এই হাতের লেখার মালিক! কিন্তু কে সে?
১৪.
ঘড়িতে রাত ১০ টা। না খেয়েই শুইয়ে পড়েছি আজ। রোজ ঘড়ি ধরা ঠিক ১০ টা বাজে বাবা বাসায় ফিরে আসে। আর আমরা বাবা মেয়ে ১১ টার মধ্যে ডিনার কমপ্লিট করে ফেলি। কিন্তু আজ সন্ধ্যা ৭ টা বাজতেই বাবা বাসায় এসে হাজির। চোখে মুখে কিছু অপ্রাপ্তির ছাপ! হতাশায় ঘেরা ছিলো তার মন। হয়তো বাবার শরীর ঠিক নেই আজ! বাসায় ফিরে আমার সাথে ভালোমন্দ কোনো কথাই বলল না। শুধু আমি যা বলেছি তাতেই কেবল “হু, হা” করে গিয়েছে। বাবাকে খাইয়ে দাইয়েই এসে শুয়ে পড়লাম।
বাবার প্লেট গোছাতে গিয়ে দেখলাম বাবা ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে। যা আগে কখনোই করেনি! সবসময় নিয়ম মেনে আমার ঘরেই বাবা আড্ডা দিতো রাত ১ অব্দি। আর তারপর আমাকে ঘুম পারিয়ে তবেই বাবা নিজে এসে ঘুমোতো। মনটা খুব ছটফট করছে। বাবার ঘরে একবার যাওয়া উচিৎ। বাবার কি হয়েছে আমার জিজ্ঞেস করা উচিৎ! মাথার মধ্যে ধপধপ করছে আমার। শুয়ে থেকেও যেন শান্তি পাচ্ছি না। ধাপ করে উঠে বসলাম। উদ্দেশ্য বাবার রুমে যাওয়া। যদিও পাঁচ-সাতবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছি,
“বাবা তোমার কি হয়েছ?” কিন্তু উত্তরে বাবা একটা শুঁকনো হাসি দিয়ে বলেছে, “কিছুনা রে মা। তুই খেয়ে শুয়ে পড়। আজ আর বোধহয় আড্ডা হবেনা। অফিসের সামান্য কাজ আছে। ওটা নিয়েই বসতে হবে!”
কিন্তু কোথায় কি? বাবা যা বলে গেলো তা কিছুই করলো না। চুপচাপ গম্ভীর মুখে রুমে ঢুকে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেলো!
বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে অগোছালো চুল গুলোকে হাত খোঁপায় পেছিয়ে একখানা বিদঘুটে রূপ দিলাম। অগোছালো চুলে খোঁপা বাঁধা সেটা বরাবরই আমার কাছে বিদঘুটে লাগে। সচারাচর আমার চুল এভাবে অযত্নে অগোছালো হয়ে পরে থাকেনা। আমার সব কিছুর অনিয়ম হলেও চুলের অযত্ন কোনো কালেই হয়না। কিন্তু এই মুহুর্তে চুল গুলোকে গোছালো করার চেয়ে বেশি জরুরি বাবার কাছে যাওয়া। বাবাকে সময় দেওয়া। হয়তো বাবা কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা হাতে নিতে গিয়ে ফোনটার দিকে চোখ পড়লো।
বাসায় ফিরে হৃদকে কম করে হোক ১০ বারের উপর কল দিয়েছি। কিন্তু সে রেসপন্সই করলো না! ইদানীং একটু বেশিই ব্যস্ততা বুঝি তার। বুক চিঁড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাসের ঘনঘটা মিলতেই মনে হলো প্রিয় মানুষটার প্রতি মনের আকাশে অভিমানের সুর তুলেছে। ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে মেঘ গুলো জড়সড় হচ্ছে। অভিমানে বিষন্ন হয়ে এলো মন। কিন্তু বিশেষ পাত্তা দিলাম না। ফোনটা কে ওভাবেই অসহায় করে ঘোষণা দিয়ে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু ধাপ বেশি পেরোলো না। হাতে গোনা তিন ধাপ ফেলতেই ফোনের রিংটোনে মনের আকাশের সব মেঘ কেটে গিয়ে রোদের ঝিলিক তুললো। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা প্রসারিত করে ধপ করে বিছানায় বসে ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললাম। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা আর চেপে রাখতে না পেরেই অভিযোগের সুরে বলে উঠলাম তাকে,
—-” এতক্ষণে মনে হলো কল দিতে? জানো কতবার কল করেছি? দেখোনি বুঝি? নাকি দেখেও না দেখার ভান করেছো?”
আবারও খানিক অভিমানেরা উপচে এলো মনে। ভারী কন্ঠে আবারও বলে উঠলাম,
—-” আজকাল অকারনে তোমায় একটু বেশিই মিস করছি হৃদ! কিন্তু দেখো,এতো মিস করেও সঠিক সময়ে হাত ধরার মানুষ হিসেবে তোমাকে খুঁজে পাইনা। খুব বিজি থাকো! জানি সামনেই তোমার ফাইনাল। অনেক পড়াশোনা কিন্তু কি করবো? সব ভেবেই তো সারাদিন আর রাত মিলিয়ে তোমায় তিনবার কল দেই। তাতেও মনে করো দুই বেলা আশা করলে এক বেলা কথা হয়। মাঝে মাঝে তো সেটাও হয়না! আজকাল বড্ড একা লাগে নিজেকে। তোমায় ভীষণ দরকার হৃদ। বাবাও আজকাল খুব অন্যমনস্ক হয়ে থাকে! আগের মতো বাবার কন্ঠে আর উচ্ছ্বাস পাইনা। আর আজতো বাবা তার মেয়েকে রেখেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। যা এ কালে কোনে দিনও হয়নি! তুমি তো সবই জানো।”
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে তবেই ক্ষান্ত হলাম আমি। কেন জানিনা মনে হচ্ছে ওপাশের মানুষ টা হৃদ নয়! হৃদের কল ভেবে কলটা রিসিভ করে কানে তুলেই তো বকবক করলাম! নাম্বারটাও তো দেখা হলো না! মনের মধ্যে কামড় দিলো! ফোনের ওপাশে হৃদ না হলে তবে কার সাথে এতো গুলো কথা বলে ফেললাম? ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নিবো এমন সময় ওপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙে সেই মোহনীয় স্বরটা ভেসে আসলো,
—-“আজ দিনটা আমার জন্য খুব বেশিই স্পেশাল ছিলো নীলাদ্রিতা। কিন্তু আমি সেটাকে কিছুতেই স্পেশাল করে নিতে পারছিনা! ভেতরটা খামখাই ভীষণ হা-হুতাশ করছে। আহত হয়ে র/ক্ত/ক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু আমি জানি এখানে হা-হুতাশ করার কিছুই নেই! তবুও করছে! কি করবো বলো? মন তো! কারোর বারন তার পায়ের ধুলোও ছুঁতে পারে না। বারবার হাহাকার করেও ম/র/ছে সে! বলছে আমি আ/হ/ত হচ্ছি! আমি ছি/ন্ন বিচ্ছি/ন্ন হচ্ছি! আরও কত অভিযোগ তার!”
ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। লোকটার কন্ঠে সর্বদাই এতো মোহনীয়তা কেন বুঝতে পারিনা আমি। আজ হঠাৎ তার মনটা আ/হ/ত হওয়ার কারনটা খুব করে উদঘাটন করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না! আমি তো এই লোকের সাথে কথাই বলতে চাইনা! তবুও কেন কলটা না কেটে চুপ করে তাকে শুনে যাচ্ছি। কেন মনের অজান্তে গুনে যাচ্ছি তার থেকে থেকে ফেলা নিঃশ্বাস গুলোর পেছনে ঠিক কতটা অভিমান লুকিয়ে আছে? তার অভিমানে কেন আমার মনটাও ভারী হয়ে যাচ্ছে?
—-” নীলাদ্রিতা, পৃথিবীর হাতে গোনা স্রেফ কিছু মানুষই বরাবর কেবল আনকমন খুঁজে। আর সেই হাতে গোনা মানুষ গুলোর মাঝে আমিও একজন অন্যতম। আমি তোমার মাঝে বরাবরই শুধু আনকমন টা খুঁজে পাই! আর যা আমায় খুব বাজে ভাবে আহত করে! আমি আহত হই তোমার হাসিতে। লন্ডভন্ড হই তোমার র/ক্তি/ম আভায় ঘিরে থাকা সেই চাহনীতে। আমি… আমি আজও আ/হ/ত হয়েছি নীলাদ্রিতা! এখনও হচ্ছি! খুব বি/শ্রী ভাবে আমি আ/হ/ত হচ্ছি! তুমি কি ফিল করতে পারছো তা?”
লোকটার কথা শুনে আমি কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি। কথাগুলো গোছাতে ব্যর্থ হয়ে কপট রা/গ দেখিয়ে বললাম,
—-” শুনুন মি. আবেগি ম্যান! আপনি কি বলছেন আমি তার একটা শব্দও ঠিক করে বুঝতে পারছিনা! কারন আপনি মানুষ টা সব আনকমন খুঁজলেও আপনার সো কল্ড ডায়লগ গুলো খুব বেশিই কমন! সো, আমি এগুলা শুনতে ইন্টারস্টেড নই! নই মানে একদমই নই! আমি আপনার নাম্বারটা না দেখেই রিসিভ করে ফেলেছি! কারন আমি ভেবেছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে কল দিয়েছে। সেজন্যই তখন হঠাৎ করে ওসব কথা বলে ফেলা। দয়াকরে আমাকে রোজ রোজ এভাবে কল করে এসব অবান্তর কথা বলে কনফিউজড করবেননা! আমি জানিনা কে আপনি? আর জানতে চেয়েও আমার বিশেষ উপকার হবে বলে মনে হয়না! আর আমি এও খুব ভালো করে জানি যে আপনি কখনোই আপনার পরিচয় আমাকে দিবেন না! না দিন সমস্যা নেই! নেক্সট টাইম প্লিজ আমাকে এভাবে কল করে ডিস্টার্ব করবেন না। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন!”
—-” বাবা আজ সাথে খায়নি বলে এতো মন খারাপ? আচ্ছা, বাবার মিষ্টি মেয়েটা কি জানে? বাবা মাঝে মাঝে একটু অনিয়ম করে ফেললে মেয়েকেও অনিয়ম করে বসে থাকতে হয়না! বরং নিয়ম মাফিক সবটা করে নিজের মনটাকে ভালো রাখা উচিৎ! বাবা একদিন অনিয়ম করে একটু বেশিই দুঃখ দিয়েছে মিষ্টি মেয়েকে কিন্তু মিষ্টি মেয়ে হয়তো জানেনা, বাবা তার মিষ্টি মেয়েটাকে দুঃখ দিয়ে একদন্ডও শান্তি পান না! তার মিষ্টি মেয়ে মন খারাপ না করে একটু অপেক্ষা করুক, বাবা খানিক বাদেই খাবার নিয়ে আসলো বলে!”
কথা গুলো শেষ হতেই লাইনটা কেটে গেলো। কল কাটার শব্দে আমি নিঃশ্বাস আঁটকে ধরলাম! লোকটার অভ্যাসই খুব খারাপ! নিজের কথা সম্পূর্ণ হলেই হলো লাইনটা মুখের উপর কেটে দিবে! অদ্ভুত।
—-” নিধি মা?”
দরজার পাশ থেকে বাবার গলা ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম আমি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দরজার পানে তাকাতেই যেন ধাক্কা খেলাম! বাবা খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফেনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে এগিয়ে গেলাম বাবার কাছে। বাবার হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বাবার হাত ধরে ভেতরের নিয়ে এসে অভিযোগের সুরে বললাম,
—-” এখনো ঘুমোওনি কেন? আর হঠাৎ খাবার নিয়ে আমার ঘরে? কাহিনি কি?”
বাবা বাচ্চাদের মতো করে কান ধরে বলল,
—-” মেয়েটাকে ছাড়াই কেমন স্বার্থপরের মতো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম! কিন্তু এদিকে মেয়েটা যে রোজ বাবার হাতের প্রথম লোকমা না খেয়ে খাবার খেতে পারেনা!! সেই কথা মনে হতেই আবারও ছুটে এলাম রে মা।”
আমি মলিন হাসি দিয়ে বললাম,
—-” দিন দিন একটু বেশি বুঝে ফেলছো। শরীর খারাপ নিয়ে সেই আবার উঠে এলে। তবে আগে খেয়ে আগে শুয়ে হলোটা কি?”
বাবা ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাত মাখালো। ভাতের প্রথম লোকমা আমার মুখের সামনে দিয়ে বলল,
—-” মনটা বড্ড অশান্তি করছে রে মা! কাছের মানুষ গুলো থেকে একটু সাবধানে থাকবি!”
#চলবে_________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেনে।]