#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৫.
তিন্নির ড্রেস মধুর শরীরে হলো না। অনেক ঢোলা হয়। তাই রাহীর থেকে আরেকটা ড্রেস এনে দিল তিন্নি। মধু ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোঁকড়ানো চুল আঁচড়ে পিঠে ছেড়ে দিল। মুখে পাউডার দিল হালকা করে। চোখে কাজল ও ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখল ভালো করে। তারপর গলায় স্কাইপ পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল। তিন্নি নিচে চলে গিয়েছে ওকে রেখেই। ওর কাছে গহনার ব্যাগ দিয়ে রেখেছে। মধু গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে হাঁটছিল। হঠাৎ একটা শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত ওর বাহু শক্ত করে খামচে ধরে। মধুর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মধু কে টেনে একটা রুমে এনে ফেলে। মধু কে ঠেসে ধরে দেয়ালের সাথে। আচমকা ধাক্কায় নিজেকে সামলাতে পারে না মধু। দেয়ালে বারি খেয়ে মাথায় আঘাত পায়। ও চোখ খিচে ঠোঁট কামড়ে ধরে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। নজর তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠে। দেখতে পায় রাগান্বিত, লাল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এক জোড়া চোখ। চোখের মালিক আর কেউ নয় ফুয়াদ। ওর চোখ উপচে পড়ছে অঢেল রাগ। ফর্সা লম্বাটে শক্ত মুখটা রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পুরুষালী শক্ত হাতে খামচে ধরে আছে মধুর নরম হাত। মধু থমকানো, হতবাক, নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের রাগী চোখ, মুখের দিকে। আড়চোখে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে তাকাল ফুয়াদের ধরে রাখা হাতের দিকে। এতো জোরে ধরেছে মনে হচ্ছে ওর হাতের হাড্ডি ভেঙ্গে ফেলবে। ব্যথায় ওর ডাগর ডাগর চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ও ফুয়াদের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। ওর শুধু কান্না পাচ্ছে।
ফুয়াদ গমগমে গাঢ় গম্ভীর গলায় বলল,,” হে ইউ তোমার মতলব কি সত্যি করে বলো। মিথ্যে বলার চেষ্টা ও করবে না। মাইন্ড ইট। কে তুমি? আমাদের বাসায় কেন ঢুকেছ? কার হয়ে কাজ করছো! কে পাঠিয়েছে তোমাকে এ্যান্সার মি!”
মধু ঝরঝর করে চোখের জল ছেড়ে দিল। ফুয়াদ বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে মধুর মুখের দিকে। উত্তর না দিয়ে মেয়েটা কাঁদছে কেন? ওর হাত থেকে বাঁচতে? সঠিক বলার ভয়ে? মেয়েটার খারাপ মতলব ও ধরে ফেলেছে তাই এমন ন্যাকা কান্না করছে বাঁচতে। কিন্তু এই চোখের জলে ফুয়াদ কে ভুলানো এতো সহজ নয় মেয়েটা কি জানে? হাতের বাঁধন আরো শক্ত জড়ালো করল। এবার আর মধু শান্ত থাকতে পারল না আহ করে উঠল। ব্যথায় মধু ঠোঁট কামড়ে ধরেছে।
” একদম ন্যাকা কান্না করে আমার সামনে অ্যাক্টিং করবে না। যা বলছি তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল ফুয়াদ।
” আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমাকে কেউ পাঠায় নি। বিশ্বাস করুন। আমি তি…..
” ইউ লায়ার। তোমার এতো বড় স্পর্ধা আমার সাথে মিথ্যাচার করো?” রাগে ফেটে পড়ল ফুয়াদ।
ভয়ে মধু এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। ব্যথার পাচ্ছে বলতে লাগল কিন্তু তাতে একটু ও নরম হলো না ফুয়াদ।
সেভাবেই ধরে রেখে বলল,,” গতকাল রাতে তুমি আমায় ফলো করেছো কেন? সোফার পেছনে লুকিয়ে ভেবেছ আমার নজর থেকে বেঁচে যাবে! হাহাহা এতো সহজ আবরার ফুয়াদ এর নজর থেকে বাঁচা? তখন তাড়ায় ছিলাম তাই তোমাকে নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু তাই বলে ছেড়ে দেব ভেবো না। আমার বা আমার পরিবারের ক্ষতি করার জন্য যদি এসে থাকো খুব ভুল করেছ। আমি থাকতে তুমি সফল হতে পারবে না উল্টো তোমার….
ফুয়াদ কথা শেষ করতে পারল না। মধু ফুয়াদের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,,” আপনি বরাবরের মতো আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আপনাদের ক্ষতি করতে আসিনি। আর আসবোই বা কেন? আমি তো আপনাদের চিনতামই না। ওই রাতে দেখা না হলে হয়তো কোনদিন চিনতাম ও না। আর আপনারা আমাকে সাহায্য করেছেন আমার বিপদে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমি কখনোই আপনাদের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারব না।”
ফুয়াদ ধমক দিয়ে বলল,,” বাহ ভালোই তো অভিনয় জানো। তোমার অভিনয়ের অস্কার দেওয়া উচিত।”
ফুয়াদ হাতের বাঁধন কথা বলতে বলতে হালকা করে দিয়েছে। মধু ফুয়াদের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। লোকটা কাছে এসেছিল খুব বেশি কাছে। এতো কাছে যে তার প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাস ওর মুখে পড়ছিল। একটা পুরুষ ওর এতো কাছে এসেছে ও সহ্য করতে পারেনি। ওর হৃদস্পন্দন জোরে জোরে বিট করছে। হাত পা কাঁপছে। এদিকে হাত নাড়াতে ব্যথা লাগছে। ওর হলুদ ফর্সা হাতে লাল দাগ পড়ে গেছে। অশুর নাকি লোকটা এমন নির্দয়ের মতো কাউকে ধরে কেউ। টলমল চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ফুয়াদের পরনে ট্রাউজার ও নীল গেঞ্জি।
ফর্সা গায়ে নীল রঙটা দারুন মানিয়েছে। এতো সুন্দর একটা লোক এতো রুঢ হতে পারে। নিজের হবু বউয়ের সাথে তো কত আদ্যিখেতা করে। আর ওকে শত্রু বলে যা নয় তাই বলল ধমক দিল, ব্যথা দিল। পাষাণ। ফুয়াদ রেগে আবার এগিয়ে আসছিল।
তা দেখে মধু হাত দিয়ে ওকে থামতে বলে বলল,,”একদম আমার কাছে আসবেন না। লজ্জা করে না? অসভ্যের মতো একটা নিরিহ মেয়ের উপর নির্যাতন করতে। ছিহ কেমন পুরুষ আপনি আমার মতো একটা নিরিহ, শান্ত, ভদ্র মেয়ের উপর এমন বাজে দোষারোপ করছেন। যার কোন কিছুতেই আমি এক বিন্দু ও নেই।”
মধুর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে ফুয়াদ বিষ্ময় এ হতভম্ব হয়ে গেছে। সাথে রাগে ওর কপাল কুঁচকে এসেছে।
মধু আবার বলল,,”হ্যা আমি রাতে আপনাকে লুকিয়ে দেখেছি। কিন্তু সেটা আপনার জন্যেই। আপনি মাঝরাতে ভূতের মতো বাসা থেকে বেরিয়ে যাবেন আর আমি কৌতুহল নিয়ে একটু দেখতে পারব না! প্রথম দিন ও আপনাকে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দেখে আমি ভূত বা অতীপ্ত আত্মা ভেবেছিলাম। গতকাল আপনাকে আমি সন্দেহ করেই লুকিয়ে দেখেছি। আর লুকিয়ে ছিলাম জাস্ট আপনার চোখের আড়ালে থাকতে আমাকে দেখলে আপনি চিৎকার করতেন আর তাতে আমার লজ্জা লাগত কারণ আমি সবার আড়ালে খাবার খেতে গিয়েছিলাম নিচে। আপনার উপর নজর রাখা আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল না।”
বাইরে থেকে তিন্নির চিৎকার ভেসে আসছে। মধু, মধু বলে চেঁচিয়ে বাসা মাথায় তুলছে। মধু দরজা খুলে ফুয়াদের দিকে আরেকবার তাকিয়ে বলল,,” আমার মতো কিউট, সুইট, লক্ষী একটা মেয়ে কি কারো ক্ষতি করতে পারে বলুন তো? আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। তারপর না হয় আমাকে জেরা করবেন।” মধু ব্যথা পাওয়া হাতে ফূ দিতে দিতে চলে গেল।
বিষ্ময় এ ফুয়াদের মুখটা কিশ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। ও কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। থমকানো, কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে হ্যাবলার মতো চঞ্চল, দুরন্ত মেয়ে মধুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল বিস্মিত নয়নে।
মধু সিঁড়ি বেয়ে নামছিল নিচে তখনি সমুদ্র উপরে উঠে আসছিল। মধু কে হাত ধরে নিচে নামতে দেখে অবাক হয়ে তাকায়। লাল হয়ে আছে। ও কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,,” তোমার হাতে কি হয়েছে মধু?”
মধু চমকে দাঁড়িয়ে পরে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,,” আপনার ভাই আ…
কথা শেষ করতে পারে না। পেছনে থেকে ফুয়াদের কর্কশ আওয়াজ পেয়ে মধু থেমে যায়। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। ফুয়াদ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল ফুয়াদ,” ভাই উপরে আসো কথা আছে তোমার সাথে।”
সমুদ্র মধুর দিকে এক পলক তাকিয়ে সিঁড়ি ধাপ অতিক্রম করতে লাগল। মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফুয়াদ তাকাতেই ভেংচি কেটে নিচে নেমে এল। তিন্নি ওর হাতের অবস্থা দেখেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কিভাবে এসব হলো। মধু সব বলতে গিয়ে ও চেপে গেল। তিন্নি ব্যথার মলম লাগিয়ে দিল রুম থেকে এনে। তারপর বড়দের থেকে সম্মতি নিয়ে বাইরে গেল।
” হ্যা বল।”
উপরে এসে বলল সমুদ্র। ফুয়াদ বলল,,” কি বলব?”
সমুদ্র চমকে উঠে বলল ,,” এইমাত্র কিছু বলবি বলে ডাকলি।”
” ওটা তো মিথ্যা ছিল।”নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ফুয়াদ।
সমুদ্র হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে।
” তুই আমাকে বোকা বানিয়ে আনলি। আচ্ছা মধুর হাতের জন্য তুই দায়ী নয়তো?”
” বাহ ভাইয়া তুমি অনেক বুদ্ধিমান। কত সহজেই বুঝে গেলে।”
” আমার ধারণা সত্যি। এমনটা কেন করছিস এখনো মধু কে সন্দেহ করছিস। ও তিন্নির ফ্রেন্ড শুনিস নাই?”
” হ্যা শুনেছি। ফেসবুকে পরিচিত একটা ফ্রেন্ড তিন্নি ওকে কতটুকু চেনে ভাইয়া বলো তো।”
” দেখ সবাইকে অবিশ্বাস করার রোগ থেকে বের হ। আমার মধুকে মোটেও সন্দেহ হয় না। এইটুকু মেয়ে আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। তুই ওকে সন্দেহ করা বন্ধ কর।”
” এই দিনেই মেয়েটাকে এতো বিলিভ করে নিলে? ভাইয়া তুমি আবার সুন্দর চেহারা দেখে প্রেমে পরে গেলে নাকি?” অবাক স্বরে বলল ফুয়াদ।
সমুদ্র কপট রাগ দেখিয়ে বলল,,” দেখ ছোটো ভালো বলেছি বলেই তাকে ভালোবাসি বলিস না। সব জানিস তুই তাই এসব বলে আমাকে বিব্রত করিস না।”
” আমি এখন বিয়ে করার মতো বড় তাই ছোটো আমাকে না বলে ফাহাদ কে বলো। আমি বুঝিনা তুমি ওকে রেখে আমায় কেন ছোটো বলো!”
সমুদ্র বলল,,” শোন তুই যখন হলি তখন আমি চারবছরের শিশু কিন্তু বোন হওয়ার বদলে তুই হওয়াতেও আমি একটু ও কষ্ট পাইনি। বরংচ খুশি হয়েছিলাম। কারণ তুই দেখতে এতো সুন্দর হয়েছিলি তোকে সবাই মেয়েই বলত এক দেখায়। সবাই বলত দুর্ভাগ্যবশত তুই মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়েছিস। ছোট বেলায় তো তোকে আমি মেয়েদের পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতাম। তারপর ফ্রক পরিয়ে সাজিয়ে দিতাম মেয়েদের মতো।”
ফুয়াদ গাল ফুলিয়ে বলল,,” কি অত্যাচার না করেছ ভাইয়া আমার উপর।”
সমুদ্র হাসতে হাসতে বলল,,” অ্যালবাম তো লুকিয়ে রাখছিস। ওটা দে তো তোর ছোটো বেলার যমজ বোনের ছবি দেখি একটু।”
” ওটা বের করে আর নিজের মান ইজ্জত নষ্ট করতে চাই না।”
সমুদ্র ফুয়াদের মুখের অবস্থা দেখে হাহাহা করে হাসতে লাগল।
#চলবে…..