#প্রেয়সী
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০৫
৯.
রকেটের গতিতে ব্রেন খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু ব্রেন যে আমার কচ্ছপের চেয়েও ধীরে চলছে! ঘন্টা খানিক বাদেই কুতুবউদ্দিন এবং তার পরিবার নিতু আপুকে দেখতে আসবেন। তারই তোড়জোড় চলছে পুরো বাড়িতে। চারপাশে সবার এতো উৎসাহ নিয়ে বাড়ি সাজানো দেখে মনে হচ্ছে তারা আজ নিতু আপুকে শুধু দেখতেই নয় বরং বিয়েটা সম্পূর্ণ করতে আসছেন। ব্যাপার টা গোলমেলে। চাচীকে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপার কি চাচী? তারা কি মেয়ে দেখতে আসছে নাকি মেয়ে নিতে আসছে?” চাচী জবাব দিলেন না। মুখে কুলুপ এঁটে তরকারি নিয়েই ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন। ব্যাপার টা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছেনা! কিছু তো একটা আছে। নিতু আপুর ব্যাগ গোছানো শেষ! সব প্ল্যানও করা হয়ে গেছে। কুতুবউদ্দিন সাহেবরা আসবেন রাত আট টা নাগাদ। আর নিতু আপু প্ল্যান মোতাবেক তৈরি হতে যাবে ঠিক আট টায়। নীচে সবাই যখন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ঠিক তখনই নিতু আপু বারান্দা থেকে ব্যাগ নিয়ে মই বেয়ে নীচে নেমে যাবে। রাফিন ভাইয়া গাড়ি নিয়ে নীচেই অপেক্ষায় থাকবে। তারপর পাখিরা ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবে। সবটা ভাবলেই কেমন চক্কর কাটে মাথার মধ্যে। নিতু আপুর ভেগে যাওয়ার প্ল্যানে আমি থাকলেও আমার মনটা সায় দিচ্ছে না। মন বলছে বড় চাচার সাথে নিতু আপু আর রাফিন ভাইয়ার ব্যাপার টা নিয়ে একবার কথা বলি! কিন্তু বড় চাচা আমার একটা কথাও শুনবেননা। আপাদমস্তক এক ঘাড়ত্যাড়া লোক। সে যা ভাববে তাই হবে! ব্যস আর কোনো কথা নেই। পরমুহূর্তেই মনে হলো চাচীকে তো বলা যায়! চাচী তো নিতু আপুর মা। সে নিশ্চয়ই বুঝবে নিতু আপুর মনের কথা! উঠতে গিয়েও থমকাতে হলো আমায়! আমার ধারনা সম্পুর্ন ভুল। চাচী যে বুঝেও কিছু করতে পারবেননা। হ্যাঁ_____ শেষ একটা পথ অবশ্য আছে। হিমেল ভাই। আমাদের বংশের শেষ বাতি। যদিও কাজের না, তবুও শেষ অব্দি কাজে আসলেও আসতে পারে। গুটি গুটি পায়ে চলে এলাম হিমেল ভাইয়ের ঘরের সামনে। দরজা তো খোলাই আছে। সরাসরি ঢুকে যাবো? নাকি ভদ্রতা দেখাবো? অবশ্যই ভদ্রতা দেখানো উচিৎ! মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে হিমেল ভাইয়ের দরজায় হাত রাখতেই কারোর ফিসফিসানো শব্দে আমার মনোযোগ ন/ষ্ট হলো। দরজায় নক করতে ভুলে গিয়ে দুই হাত দিয়ে দরজায় লেগে কান পাতলাম। কন্ঠটা ফিসফাস করে কথা বলছে। বারবার স্পষ্ট তো বারবার অস্পষ্ট। তবুও শোনার বৃথা চেষ্টা চালালাম।
—-” আরে হ্যাঁ। ওর বিয়েটা আজই হয়ে যাবে। বাবা তো তাই বলল। না না ও জানে না! আরে ওর এতো জেনে কি হবে? মেয়ে মানুষের এতো জানাজানি ভালো না। বাদ দাও তো। হ্যাঁ ঐ লোকের অনেক টাকা। হুম। বাবা.. বাবা বলেছেন তো। চিন্তা করো না। নিতু কিছু জানতেও পারবেনা। আর পারলেই বা কি?”
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার। যা ভাবছিলাম সেটাই হচ্ছে। বড় চাচা নিতু আপুকে মিথ্যে বলে ঐ কুমড়োপটাশের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এর একটা বিহিত না করলেই নয়! হয়তো নিতু আপুর ভাবনা গুলোই ঠিক। ওর পালিয়ে যাওয়াটাই উচিৎ হবে। হ্যাঁ, আমিই ওকে হেল্প করবো পালাতে।
দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলাম। হিমেল ভাইয়ার কথা গুলো বারবার বারি খেতে লাগলো মাথার মধ্যে। অসহ্য লাগছে খুব! হৃদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব!
আমার ফোনটা… ফোনটা পাশেই পড়ে আছে অসহায়ের মতো। বুক চিঁড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হতেই নিঃশ্বাসটা চেপে ধরলাম। ভ্রু কুঁচকে ফোনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। পরপর টানা আট বার কল এসেছে। আননোউন নাম্বার! কার এতো দরকার পড়লো নিধিকে? যে শ্বাস না নিয়েই এতোবার কল করেছে! আশ্চর্য! মাথায় এই অপরিচিত নাম্বারের কথাটা তুলে রেখেই হৃদকে কল দিলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছেনা! দু’বার রিং হয়ে এভাবেই কেটে গেলো। ধরলো না সে। হয়তো ব্যস্ত। আবারও দীর্ঘশ্বাস বের হতে চাইলো। এবার আর আঁটকাতে পারলাম না। হৃদকে তৃতীয় বার কল দিতে নিয়েও রেখে দিলাম ফোনটা। বাবা ফেরার সময় হয়ে গেছে! রাতের খাবারটা করে ফেলা যাক।
এসব ভাবনা নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে আসলাম। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজের ডান হাতের নীচে কালো তিলটার উপর নজর পড়লো। এই তিলটা বড় রহস্যময় তিল। সবসময় এটা দেখিনা আমি। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। খানিক বাদে আবারও মিলিয়ে যায়। আজ হঠাৎ চোখে পড়াতে মনের মধ্যে কামড় দিলো। হয়তো খুব ভালো কিছু বা হয়তো খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। অদ্ভুত!
হাত নামিয়ে সটান হয়ে দাঁড়ালাম। কিসব অদ্ভুত কথা ভাবছি আমি। আমার এসব ভাবনাগুলো বরাবরই অর্থহীন। তবুও বোকার মতো ভাবতে থাকি। ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে আবারও মনের মধ্যে কামড় দিলো। আচমকা ফোনের রিংটোনটা বড্ড বিদঘুটে লাগছে কানে। দ্রুতে পায়ে এগিয়ে গেলাম ফোনটার দিকে। ভাবলাম হৃদ কল দিয়েছে। কিন্তু না, হৃদ নয়। সেই অপরিচিত নাম্বার টা। মনটা দোমনা ভাবছে। কলটা রিসিভ করবো কি করবো না? ফোনের ওপাশের মানুষ টা পরিচিত কেউ নাকি অপরিচিত? কলটা কি সে প্রয়োজনে করেছে নাকি অপ্রয়োজনে?
ধড়ফড় করছে মনের মধ্যে। অর্থহীন কিছু ভাবনায় নিজের কাছেও বিরক্ত লাগছে সময়টা। এতো দ্বিধা কেন করছি কলটা রিসিভ করতে? প্রয়োজনীয় হলে কথা বলবো আর অপ্রোয়জনীয় হলে কেটে দিবো। ব্যস এটুকুই তো! কলটা রিসিভ করেই কানে তুললাম ফোনটা। গলা ঝেড়ে সুন্দর করে একটা সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কে?”
—-” নিধি আফা আম্মায় আফনেরে ডাকতিছে নীচে। আর রাতে আফনের বাবার জন্যি কিছু রাঁধতি বারন করিছে।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফোনটার দিকে তাকালাম। রানির গলা ফোনের মধ্যে কি করে বাজছে? অদ্ভুত! ফোনটা আবারও কানে তুললাম।
—-” হ্যালো কে বলছেন?”
—-” ও নিধি আফা? হুনছেন?”
আবারও ভড়কাতে হলো আমায়। রানি এবাড়ির কাজের লোক। ও হঠাৎ আমায় কল করে এসব কথা বলবে কেন? যখন নীচে ছিলাম তখনও তো বলতে পারতো। সামান্য কিছু কথা বলার জন্য এতোবার করে কল করতে হয়? মেয়েটা কি আহাম্মক নাকি? আমি বিরক্ত গলায় বলে উঠলাম,
—-” রানি তুই?”
পেছন থেকে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে কেউ ঝড়ের বেগে সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমে ঠাহর করতে না পেরে পরক্ষণেই আবার ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। একহাতে বিছানা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠতে রানি হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো। মুখটাকে সরু করে বলল,
—-” কি হইছে আফনের? কথা কন না কেন? আম্মায় নিচে ডাকছে আফনেরে। সন্ধ্যায় কিছু খাইছেন কিনা জিগাইছে!”
আমি বিরক্ত গলায় দিলাম এক ধমক। ও এতক্ষণ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বলছিলো কথা গুলো। আর আমি কিনা ভাবছি কলটা রানিই করেছে। নিজের বোকামির জন্য ধমকটা অবশ্য নিজেকেই দেওয়া উচিৎ ছিলো! কিন্তু নিজেকে না দিয়ে রানিকেই ধমকে দিলাম। আসলে মানুষ তো সবসময় অন্যকে নিজের অধীনে করতে পছন্দ করে। নিজেকে কারোর অধীনে রাখতে নয়। রানি আমার ধমক খেয়ে নড়লো না। এরকম ধমক রানি সচারাচর আমার থেকে খেয়েই থাকে! তাই বিশেষ ভাবাবেগ হলো না ওর। আমি মুখ কুঁচকে আবারও বকার সুরে বলে উঠলাম,
—-” তোকে আর কত দিন বলতে হবে রানি? কারোর ঘরে আসার আগে অবশ্যই দরজায় নক করতে হয়! এটা ভদ্রতা!”
রানি ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
—-” আই এতো ভদ্র নই আফা। আফনে নীচে চলেন। আম্মায় ডাকে। আইচ্ছা আফা? আফনে কি খাওন দাওন ঠিক ঠাক করেননা কন দেহি? দিন দিন তো চিংগি দিতাছেন!”
আমি ওর প্রায় অর্ধেক কথাই বুঝিনা! কিরকম করে যেন কথা বলে রানি। তিন চারটা অঞ্চলের কথা ও মিক্স করে ফেলে। তাই বেশিরভাগ সময় ওর কথা গুলো আমায় চাচীর থেকে ট্রান্সলেশন করে বুঝতে হয়।
আমি মুখ কুঁচকে বললাম,
—-” তুই যা আমি একটু পরে আসছি।”
রানি গেলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। আমি ওর কান্ড দেখে আবারও ধমক দিলাম। বললাম,
—-” দাঁড়িয়ে না থেকে যা ভাগ। আমি আসছি।”
রানি চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফেলে বলল,
—-” মা না থাওনের অনেক জ্বা/লা আফা। আই বুজি। আফনে সন্ধ্যাত্বন কিছুই খান নাই তাই না? আফনে জলদি নীচে আহেন আমি আফনের লিগা স্যূপ আর চপ বানাইতাছি। জলদি আহেন।”
আমি বোকার ন্যায় তাকিয়ে রইলাম রানির দিকে। রানি চোখের পলকে রুম থেকে চলে গেলো। কি বলে গেলো আমি সত্যিই বুঝিনি! আমি সত্যিই ওর বেশিরভাগ কথা বুঝতে পারিনা। হঠাৎ হাতে ফোনটার দিকে চোখ পড়লো! এই রে, কে যেন লাইনে ছিলো! রানির বকবকানি শুনতে শুনতে আমি তো কলের কথা বেমালুম ভুলেই গেছি! ফোনটা তৎক্ষনাৎ কানে তুললাম। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম,
—-” হ্যালো! কে বলছেন? দেখুন আপনি অনেক্ষন ধরেই লাইনে আছেন কথা বলছিলেন না! তাই আমিও ব্যাপারটা একদমই ভুলে গিয়েছি! তার জন্য দুঃখিত। আপনি আপনার পরিচয় টা দিয়ে দিলে ভালো হতো! আমার মনে হয় আপনি কোনো দরকারেই আমাকে এতো বার করে কল করেছেন। আবারও দুঃখিত! এবার বলুন কে বলছেন? আর আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
ওপাশে পিনপতন নীরবতা। কারোর নিঃশ্বাস ফোলারও শব্দ আসছে না। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার পর আমি আবারও বলে উঠলাম,
—-” জ্বী বলুন? আপনি কে বলছেন আর কি দরকারে আমাকে এতোবার করে কল দেওয়া?”
কারোর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো। আশ্চর্য মানুষ! এতোক্ষণ লাইনে থেকেও একটা বারও কল কাটলেন না। আমার আর রানির কথা গুলো হয়তো সবটাই শুনেছেন উনি! একটা শব্দ অব্দি করলেন না। কে মানুষ টা? হৃদ নয়তো?
—-” হৃদ এটা কি তুমি বলছো? আমি তোমার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম। তুমি ধরলেনা ভাবলাম বিজি আছো! এটা কি তোমার নাম্বার? নতুন নিলে?”
—-” সন্ধ্যা হয় পাঁচ পয়তাল্লিশ মিনিটে। এখন সময় সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। বাসায় ফিরেছো দুপুর তিনটে নাগাদ। দুপুরেও হয়তো খাওনি! সন্ধ্যায়ও কোনো নাস্তা করোনি। ফোনটা রেখে দৌড়ে নীচে চলে যাও। ফটাফট কিছু খেয়ে দেন নিজের রুমে এসে আধঘন্টা রেস্ট নাও। এরপরে যা খুশি করো। কোনো সমস্যা নেই!”
আমি থতমত খেয়ে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নিলাম। হোয়াট দ্যা হেল ম্যান! ভয়েসটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। স্নিগ্ধ শীতল! খুব বেশি আকর্ষনীয়। তার এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথা গুলোয় মনে হলো আমার হাত পা ঝিম ধরে গেলো! কে উনি? আমি চটজলদি ফোনটা কানে তুলে কিছু বলতে নিবো তার মধ্যেই উনি উনার শেষ কথা টা বলে উঠলেন,
—-” একদম নাক বরাবর দৌড় দিবে।”
বলেই কলটা কেটে দিলো। কলটা কাটার শব্দে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো। ঝাঁটকার উপর ঝাঁটকা খেয়ে চলেছি! মন মানলো না! এভাবে করে কেউ অপরিচিত নাম্বার থেকে আমায় কল করে এসব বলতে পারেনা! পারেনা না পারেনা, কিছুতেই পারেনা! নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ! নাম্বারটায় ডায়েল করলাম। এক সেকেন্ড সময়ও এই মুহুর্তে এক ঘন্টার মতো লাগছে। রিং হচ্ছে না কেন! নেটওয়ার্ক প্রবলেম হয়তো! দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। এখানে নেটওয়ার্ক রকেটের গতিতে পাওয়া যাবে। আবারও নাম্বারটায় ডায়েল করলাম! অদ্ভূত এক শব্দ হচ্ছে, মন বলছে রিং হবে! কিন্তু আমায় হতাশ করে ওপাশ থেকে এক মহিলা রুক্ষস্বরে বলে উঠলো,
—-” দুঃখিত, কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। Sorry the number you dialled is currently unreachable!”
হতাশ চোখে ফোনটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে এলাম রুমে। মনটা ছটফট করছে খুব! কে হতে পারে মানুষটা?
১০.
শক্ত চোয়ালে খাবার চিবোচ্ছি। আর ঐ লোকটার কথা ভাবছি। এমন সময় ধরাম করে টেবিলে বসলো হিমেল ভাই। চোখ মুখ চিন্তায় কেমন অদ্ভুত হয়ে আছে তার। পেছন থেকে রানি পানির গ্লাস নিয়ে ছুটে এলো। বড় চাচাও দেখছি হাতে ফোন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসছেন। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার রান্না ঘরের দিকে। এই বুঝি চাচীও হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে এসে চাচার সামনে দাঁড়াবেন। মনের কথা মনেই রইলো মুখে আনার সময় মিললো না। চাচী আঁচলে হাত মুছতে মুছতে চিন্তিত মুখে এসে দাঁড়ালেন চাচার সামনে। চাচীকে আসতে দেখে হিমেল ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিরবির করে কিছু একটা বলছে চাচা আর হিমেল ভাই। আমার কান অব্দি তাদের কথা ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না! আমি তাদের রেখে চাচীর মুখ চেয়ে তাকালাম। চাচীর এক্সপ্রেশন বলে দিবে চাচা আর হিমেল ভাই তাকে কি বলছেন।
চাচী আঁতকে উঠে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। প্রথমদফায় আমার মাথায় যা এলো, “হয়তো কারোর হার্ট অ্যাটাক এসেছে!” কিন্তু হিমেল ভাইয়ের এক্সপ্রেশন তা বলছেনা! কেননা, কোন ব্যাক্তির শারীরিক অবস্থা নিয়ে তার কোনো কালেই কোনো মাথা ব্যাথা থাকেনা। হোক সে খুব কাছের তবুও না। তাহলে এটা বাদ! চাচী মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে বলল,
—-” তাহলে এতো খাবার দাবার এসবের কি হবে? আর উনারা কবে আসতে পারবেন সেসব কি কিছু বলেছেন?”
চাচা ক্ষেপে গেলেন চাচীর উপর! চোখ লাল করে বেশ জোরেই বলে উঠলেন,
—-” এই মহিলা কি আহাম্মক নাকি?”
চাচা কথাটা বলেই আশেপাশে নজর দিয়ে গলার স্বর নীচু করে নিলেন! তারপর আর কিছু শোনা গেলো না। চাচীর মুখভঙ্গি এবার খুব স্বাভাবিক! কিছু ঘটছে বা ঘটেছে তা আর চাচীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না। আমিও নিরাশ চোখে তিনজনকে পর্যবেক্ষণ করে বাকি খাবার টুকু ফেলে রেখেই দৌড়ে গেলাম নিতু আপুর কাছে। নিতুর আপুর দরজা অর্ধেক খোলা। আশেপাশে নজর দিয়ে নীচু স্বরে ডাকলাম আপুকে। ভেতর থেকে আপুর উচ্ছ্বসিত কন্ঠটি ভেসে আসলো,
—-” নিধু? আয় আয়।”
আমি সাবধানতার সহিত পা টিপে টিপে আপুর ঘরে ঢুকলাম। দরজাটা চাপিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম জামাকাপড়ে ভরপুর দুটো লাগেজ রাখা জায়গাটা আপাতত শূন্য হয়ে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে আপুর দিকে তাকাতে দেখলাম আপুও সিম্পল সাজে বিছানায় গা এলিয়ে শুইয়ে আছে। সব ব্যাপার গুলোই আমার মাথার দশহাত উপর থেকে যাচ্ছে। যা ঘটছে সবটাই আমার আড়ালে।
—-” আপু.. তুমি এখনো রেডি হওনি? আটটা তো বেজে গেলো! কুতুবউদ্দিন সাহেবরা তো চলে আসবে একটু পরই! এখানে না তোমার লাগেজ ছিলো? কোথায় রাখলে? আর.. আর জানো? নীচে সবাইকে কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত দেখলাম! চাচা, হিমেল ভাই খুব টেনশনে আছে।”
নিতু আপু লাফ দিয়ে উঠে বসলো। দরজার পানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি নিতু আপুর দৃষ্টি অনুসরণ করছি। আপু আমার দিকে তাকাতেই আমি আবারও কিছু বলতে নিলাম! কিন্তু আপু আমার কথা থামিয়ে দিয়ে দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
—-” নিধু নিধু নিধু আমাদের সব প্রবলেম সল্ভ নিধু! আমাকে বিয়ে করার জন্য ঐ কুমড়োপটাশ আর আসতে পারবেনা! ওর যাত্রার মাঝপথেই ইতি ঘটে গেছে! আমার কি যে আনন্দ হচ্ছেরে নিধু বলে বোঝাতে পারছি না।”
আমি বোবা স্বরে প্রশ্ন করলাম,
—-” মানে?”
আপু আমোদিত গলায় বলল,
—-” রাফিন আর ওর ফ্রেন্ডরা মিলে বেটার বিয়ের সাধ একদম ঘুচিয়ে দিয়েছে। উফফ, আমার যে কি শান্তি লাগছেরে নিধু। রাফিন দশমিনিট আগে এসেছিলো আমার রুমে! নিজের মুখে সবটা বলে আমায় শান্ত করে গেলো। এখন আমি একদম চিন্তা মুক্ত। আর কোনো সমস্যা নেই বল। এখন আমার বাকি স্টাডি টুকু কমপ্লিট করতে করতে রাফিনও একটা ভালো জব পেয়ে যাবে। দ্যেন আমরা বিয়ে করে নিবো।”
আমার মাথা কয়েক মুহুর্তের জন্য হ্যাং হয়ে গেলেও নিতু আপুর স্বস্তিরময় মুখখানা দেখে আমারও মনটা ভরে গেলো। যাক, আপাতত কোনো ভাবে তো আঁটকে গেলো আপুর বিয়েটা।
—-” হ্যাঁ রে নিধু? কাল তোর ক্লাস আছে? না থাকলে চল না আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি!”
আমি ঘোর কাটিয়ে বললাম,
—-” ক্লাস! হ..হ্যাঁ ক্লাস তো আছেই।”
নিতু আপু চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বলল,
—-” আচ্ছা তাহলে নেক্সট যেদিন তোর ক্লাস থাকবে না সেদিন আমরা ঘুরতে যাবো। কেমন? এই তুই নাস্তা করেছিস?”
আপুর প্রশ্নে আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ভাবনার জগতে! ঐ অপরিচিত মানুষ টাও ফোন করেছিলেন কিছু একটা বলবে বলে! কিন্তু বলল না। হঠাৎ করে বললেন নাস্তা করে নিতে! আমার অবচেতন মনটা কেবল একটা প্রশ্নই করছে,
—-” কে সেই লোক?”
#চলবে____________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]