প্রেয়সী পর্ব ৩৯

0
605

#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩৯.

মধু ঘুম থেকে উঠল লেট করে।‌ আড়মোড় ভেঙে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ও তাকাল জানালার দিকে সরাসরি সূর্যের আলো চোখে পড়ছে ও চোখে হাত দিয়ে সরে দাঁড়াল। তারপর জানালা লাগিয়ে পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে র‌ইল দুই মিনিট থ মেরে। চোখ ঢলে আবার ফ্লোরে পা রাখল। হেঁটে চাপানো দরজা বেরিয়ে এল রুম থেকে। ও গম্ভীর মুখ করে ড্রয়িংরুমে এল। ফুয়াদের উপর রেগে বোম হয়ে আছে। জানালা নিশ্চিত উনিই খুলেছে ওকে ঘুম থেকে তুলতে। ঘুমের মাঝে মধু কয়েকবার ফুয়াদের ডাক শুনেছে ওকে ডেকে তুলছে। ও উঠেনি তাই লোকটা ওই কাজ করেছে। রোদের তাপের ওর নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ও এলোমেলো পায়ে হেঁটে ড্রয়িংরুমে আসলো। এসেই দেখতে পেল ফুয়াদ নাই। সারা বাসা ফাঁকা ও কপাল কুঁচকে তাকাল এদিকে ওদিকে। লোকটা ওকে এই নির্জন বাসায় ফেলে পালিয়ে যায়নি তো আবার? মধু ঢোক গিলে সদর দরজা খুলে বাইরে পা রাখল। এই বাসাটা একতলার। বাইরে সবুজ টিন দিয়ে দেয়াল করে চারপাশ‌ আটকানো। টিনের একটা দরজা ও আছে। সেই দরজা টা হাট করে খোলা। মধু সেদিকে পা বাড়াতে যাবে তখনি পশ্চিম দিক থেকে কারো হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় ও সেদিকে তাকিয়ে দেখে ফুয়াদ পকেটে হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে। পরনে নীল শার্ট।‌ তার পাশেই দুইটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে। একটা মেয়ে নীল থ্রি পিচ পরা আরেকটা লাল। দুজনের মাথায় ঘোমটা টানা। দুজনেই ফুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজন কিছু নিয়ে কথা বলছে আর গলা ফাটিয়ে হাসছে। মধু কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেল। ওরা দাঁড়িয়ে আছে ছোটো‌ একটা বিলের সামনে এই বাসার ভেতর বিল আছে গতকাল খেয়াল করেনি তো মধু। পুকুর থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরছে দুইজন পুরুষ ও তিন জন ছোটো ছেলে। মধু চোখ কপালে তুলে এগিয়ে এসে দাঁড়াল পুকুরের মাথায় ফুয়াদের পাশে। মেয়ে দুটো মধুকে দেখে কেমন করে যেন তাকাল।
মধু মেয়ে দুটোর দৃষ্টি কে অগ্রায্য করে ফুয়াদের দিকে তাকাল রাগী চোখে।‌ রেগে কিছু বলতে যাবে ফুয়াদ বলে উঠল,,” এতোক্ষণে তোমার ঘুম ভাঙল‌? দুপুর হলো বলে।”
মধু রাগে হিসহিসিয়ে কথা বলবে তখনি পাশ থেকে নীল ড্রেস পরা মেয়েটা ফুয়াদের কাছে জিজ্ঞেস করে,,” এটা কে? আপনার বোন?”
মধু তাকায় মেয়েটির দিকে। ফুয়াদ মধুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,” বোন না গার্ল…
মধু ফুয়াদের কথা বুঝে গেছে তাই তাড়াতাড়ি ওর কথা টেনে নিয়ে মুখে মেকি হাসি এনে মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলে,,” হ্যা। আমি তাহার বোন।”
ফুয়াদ শক্ত চোখে তাকায় মধুর দিকে। মধু মুখ বেঁকিয়ে ওদের কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,” আপনারা কারা?”
বোন বলাতে মেয়ে দুটোই খুশিতে হয়েছে। দু’জনেই দুজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার এগিয়ে এসে মধু হাত ধরে টেনে নিজেদের কাছে নিয়ে নিজেদের নাম বলল। নীল জনের নাম বৈশাখী। লাল জনের নাম নাসরিন।
মধুর ওদের হাবভাব ভালো লাগল না। দুজনেই কথা বলার মাঝে শুধু ফুয়াদের দিকে তাকাচ্ছিল‌ কেমন করে যেন। বিশেষ করে বৈশাখী। ওরা তিনজন একটু ফুয়াদের থেকে দূরে সরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল ফুয়াদ সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফুয়াদ ওদের কাছে এসে দাড়াতেই বৈশাখী লজ্জা মিইয়ে গেল। কেমন লাজুক চোখে তাকাচ্ছিল। মধু নাক মুখ কুঁচকে ওর হাবভাব দেখছিল।
” ফ্রেশ না হয়েই বেরিয়ে এসেছ?”
মধু বলল,,” আমি ভেবেছিলাম আমাকে এখানে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিলেন!”
ওর কথা শুনে ফুয়াদ হাহাহা করে হাসল। বৈশাখী আর নাসরিন ও তাল মিলিয়ে হাসছে। বৈশাখী বলল,,” তোমার ভাই তোমাকে ফেলে পালিয়ে যাবে কেন?”
মধু ওদের দুজনকে হাসতে দেখে অসন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে। দুজনকে এমনিতেই ওর পছন্দ হয়নি এখন আরো রাগ লাগল তাই তো ওদের মাঝখানে থেকে সরে হাঁটা ধরল।
ফুয়াদ বৈশাখী কে বলতে যাবে মধু ওর বোন নয় তখনি মধুকে রেগে যেতে দেখে আর কিছু না বলে ওর পিছু নেয়। দ্রুত হেঁটে ওর হাত চেপে ধরে।
“রাগ করলে নাকি?”
মধু ওর হাত ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে বলল,,” হাত ধরবেন না আমার।”
ফুয়াদ ফের হাত ধরে বলল,,” হাত তো ছাড়ব‌‌ই না।”
মধু কড়া চাহনি দিল। দুজনেই বাসার ভেতর চলে এসেছে।‌ ফুয়াদ ভেতরে এসেই ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,” কি বলেছিলে তখন?”
মধু ছটফট করতে করতে বলল,,” উফফ ছাড়ুন কি বলেছিলাম আবার?”
” তুমি আমার বোন?”
মধু ছটফটানি বাদ দিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,,” হ্যা।”
মধু হ্যা বলতেই ফুয়াদ একটা অভাবনীয় কাজ করে বসে মধু বিষ্ময় এ হতভম্ব হয়ে যায়। এমন একটা কাজ ফুয়াদ করবে ওর কল্পনাতে ও আসে নি। ফুয়াদ ছাড়তেই মধু এক ধাক্কায় ওকে নিজের থেকে সরিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে।
” আরো বলবে বোন?”
” অসভ্য লোক।”
” হ্যা।”

মধু ওরনা দিয়ে ঠোঁট ঢলতে ঢলতে লাল করে ফেলেছে। ও দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে ঠোঁট লাল টকটকে হয়ে গেছে। মধু বিড়বিড় করে ফুয়াদ কে বকছে। এতো ফাজিল লোক এভাবে আমার ঠোঁট ছিহ। মধু দরজা আটকে রুমে বসে আছে। খায় ও নি। খিদে পেয়েছে কিন্তু ফুয়াদের উপর রাগ করে খেতে ও যায় নি। ফুয়াদ এতো ফাজিল ওকে একটু ডাকতে ও আসলো না। ও ভেবেছিল এই কাজ টা করে ফুয়াদ ওর কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে। আর ও না খেয়ে আছে খেতে ডাকবে কিন্তু কত বড়ো ফাজিল কেমন দায়সারা ভাব নিয়ে আছে। মধু নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ড্রয়িংরুমে এসে দেখল পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে আছে ফুয়াদ।‌ মধু ওকে দেখেই আবার পিছু ঘুরে ফিরে আসতে চাইল। ফুয়াদের নজরে হয়ত ও পরে গিয়েছে তাইতো ফুয়াদ পিছনে থেকে ওর হাত টেনে ধরেছে।
মধু ওর সামনে আসতেও লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু লোকটা এতো বেহায়া ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মধু হাত মুচড়া মুচড়ি করছে ছাড়াতে। ফুয়াদ আরো দানবের মতো শক্ত করে ধরে রেখেছে। মধু দাঁতে দাঁত চেপে ঘাড় কাত করে পিছু তাকাল। ফুয়াদ ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে। ও তাকতেই শব্দ করে হেসে দিল। মধু চোখ মুখ লাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ফুয়াদ হাসি থামিয়ে বলল,,” না খেয়ে কোথায় যাচ্ছ?”
” খাব না আমি।” রাগান্বিত কন্ঠে বলল মধু।
ফুয়াদ ওকে এক টানে নিজের দিকে ফিরিয়ে মধুকে মুখোমুখি দাঁড় করালো।
তারপর ওর গালে হাত বুলিয়ে বলল,” ক্ষুধায় মুখটা শুকিয়ে গেছে আমার জান টার চলো খাবে।”
” আমি খাব না।” এবার অভিমানী কন্ঠস্বর ভেসে এল মধুর। অজান্তেই মুখটা অভিমানে একটুখানি হয়ে আছে। রাগটা ধরে রাখতে পারছে না। এতোক্ষণ খাওয়ার কথা বলতে একটু ডাকতে গেল ও না। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসে ছিল। আর এখন আদ্যিখেতা করছে যেন কত চিন্তা করে ওকে নিয়ে বদমাইশ লোক একটা। ফুয়াদ ওকে টেনে ড্রাইনিং টেবিলে বসিয়ে খাবারে প্লেট ওর সামনে রাখল।
” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে খাও।”
” খাব না আমি। আপনি একটা ফাজিল লোক এতোক্ষণ তো একবার ডাকতেও গেলেন না। আর এখন কত কেয়ার দেখাচ্ছন।”
ফুয়াদ অবাক হ‌ওয়ার ভান করে বলল,” সুইটহার্ট তুমি কি রুমে বসে আমার অপেক্ষা করছিলে নাকি? আমি কখন তোমার অভিমান ভাঙাতে যাব রাইট? আমি তো ভাবছিলাম তুমি রেগে বোম হয়ে আছো গেলেই বোম ফাটিয়ে আমাকে ফায়ার করে দিবে তাই ভয়ে তোমার কাছে ঘেঁষতে পারি নাই।”
ভয় পাওয়ার মতো মুখ করল।
মধু বিড়বিড় করে বলল,,” ড্রামা বাজ একটা।”
ফুয়াদ এতোক্ষণ মজার ছলে অনেক কথাই বলল কিন্তু মধু তাও খাচ্ছে না।‌ জেদ ধরে বসে আছে। তাই নিজেই জোর করে খাইয়ে দিতে লাগল। বৈশাখী আর নাসরিন বাসায় এসে দিকে ওদিক ঘুরছে। ঘুরে মধু আর ফুয়াদ কে খুঁজছে।
সাহিত্য দের বাসা দেখাশোনা করে কাসেম। তার মেয়ে বৈশাখী‌।
নাসরিন আর বৈশাখী বেস্ট ফ্রেন্ড। দুজনেই খাবার ঘরের দিকে এসেই দেখে মধু কে জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে ফুয়াদ। বৈশাখী ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,,” ইশ উনার বোনের জায়গায় আমি থাকলে কত রোমান্টিক হতো ভাব নাসরিন। উনি বোনের এতো যত্ন নেয় ব‌উয়ের‌ যত্ন না জানি কত নিবে।”
নাসরিন ওর বাহুতে চিমটি কেটে বলল,,” আস্তে বল শুনলে কি হবে বলতো।”
বৈশাখী চুপ করে গেল। তারপর দুজনে মিলে এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে। তারপর বৈশাখী দাঁত কেলিয়ে বলল,,” সকালের খাবার এখন খাচ্ছে বুঝি? কেমন রেগে আছে মধু খেতেই চাচ্ছে না! এতো রাগ কেন গো ভাইয়ের উপর। তোমার ভাই তোমাকে কত ভালোবাসে দেখো তো খাইয়ে দিচ্ছে।”
বলেই বৈশাখী লাজুক মুখে তাকাল ফুয়াদের দিকে। মধু গরম চোখে তাকাল বৈশাখীর দিকে। ভারি বেহায়া তো মেয়েটা। আবার চলে এসেছে। মেয়ে দুটো চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে ফুয়াদ কে। মধু কেন জানি বার বার ভাই ডাকটা অসহ্য লাগতে শুরু করল। মেয়ে দুটো যে ফুয়াদ কে পটাতে চাইছে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে মধু।‌ তাই ওর মেয়ে দুটোকে সহ্য হচ্ছে না। মেয়ে মানুষ এতো বেহায়া হয় এদের না দেখলে জানতই না। একটা ছেলেকে পটাতে এমন করছে। আর প্রত্যেক কথায় তোমার ভাই বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।
মধু নিরব থাকলেও ফুয়াদ নিরব থাকল না।

মধুর মুখে লোকমা তুলে দিয়ে বলতে লাগল,,”তোমাদের ভুল হচ্ছে। মধু আমার বোন নয় গার্লফ্রেন্ড।”
নাসরিন আর বৈশাখী চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। মধু খাবারের যন্ত্রণায় কথা বলতে পারছে না। ফুয়াদের গার্লফ্রেন্ড বলা শুনে ওর রাগ মাথায় উঠে গেছে। কিন্তু কথা‌ বলতে পারছে না। তাই তাকাল বৈশাখী আর নাসরিনের দিকে।মেয়ে দুটোর বড়ো বড়ো বিস্মিত চোখ ওদের দিকে চেয়ে আছে। ওদের চাহনি দেখে মধুর খুব হাসি পেল।
বৈশাখী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,,” মধু যে তখন আপনার বোন বলে পরিচয় দিল‌। এখন আপনি গার্লফ্রেন্ড কেন বলছেন? আমাদের মিথ্যা বলছেন কেন?”
ফুয়াদ বলল,,” আমার গার্লফ্রেন্ড রাগ করলে সবাইকে বোন বলে পরিচয় দিতে থাকে। এটা ওর একটা বদ অভ্যাস। তোমরা কিছু মনে করো না।”
বৈশাখী মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ফুয়াদ মধুকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে এসব দেখে ওর জ্বলছে। নাসরিন ওর হাত ধরে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here