#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩৬.
ফুয়াদ অস্বস্তি নিয়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মধু হয়তো বা এখানেই আছে। আজ ওর যে অবস্থা হয়তো দরজা বন্ধ করার কথা মাথাতেই নেই। ভেতরে কেউ আছে তেমন কোন সংকেত ও পাওয়া যাচ্ছে না আবার ফুয়াদ ভেতরেও যেতে পারছে না। যদি মধু এখানেই থাকে। ফুয়াদ ওয়াশরুমের দরজার সামনে থেকে সরে এল। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে কিছুক্ষণ। ও রুমে দুইবার পায়চারি করল। ফুয়াদ কপালে আঙুল দিয়ে চালিয়ে নিজের টেনশন কমাতে চাইছে। মাথা ব্যথা করছে। ফুয়াদ ফ্লোরে দিকে তাকিয়ে থেকেই হাঁটছিল হঠাৎ ওর চোখ যায় খাটের বাম প্রান্তে। খাটের কোনায় ভেতরে থেকে মধুর ওরনার অংশ দেখা যাচ্ছে। ওর কপাল কুঁচকে এল। ভ্রু উঁচু করে ফুয়াদ এগিয়ে গেল। নিচু হয়ে ওরনা টেনে নেওয়ার ট্রাই করল। ও অনুভব করল ওরনা ওর টানে ওর হাতে আসছে না। তারমানে ভেতরে থেকে কেউ টেনে ধরেছে কে? খাটের তলায় কে আছে? ফুয়াদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল নিচে। আর মাথা ঝুঁকিয়ে তাকাল খাটের তলায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর নজর আটকালো খাটের তলায় থাকা মধুর দিকে। মধু জড়োসড়ো হয়ে খাটের তলায় বসে। মুখে হাত চেপে আছে। গরমে ঘেমে নাজেহাল অবস্থা। ফুয়াদ কে দেখেই মধু মুখ থেকে হাত সরিয়ে দাঁত কেলিয়ে তাকাল।
ফুয়াদ চোখ মুখ শক্ত করে ওকে বলল,,” তুমি এখানে কি করছো?”
মধু বলল,,” বাইরে ভূত আছে। তাই আমি এখানে লুকিয়ে আছি। যাতে ভূত আমাকে খোঁজে না পায়।”
ফুয়াদ চোখ ছোটো করে হতবুদ্ধি গলায় বলল,,” হোয়াট? কি সব বলছো? বের হও দ্রুত।”
মধু ঠোঁট উল্টে বলল,,” না আমি বের হবো না। তুমি পঁচা। আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলে। আমি বের হবো না।”
ফুয়াদের রাগে কপালের রগ ফুলে উঠল। মধুর উপর চরম রাগ নিয়ে একটা ধমক দিল। আর মধুর হাত ধরে টেনে ওকে খাটের তলা থেকে টেনে বের করল।
মধু বেরিয়েই ফুয়াদের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,” তুমি পঁচা ছাড়ো আমাকে।”
ফুয়াদ মধুর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,,” পাগল হয়েছ? খাটের তলায় গেছো কেন? তোমাকে না দেখে কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো? দেখো তো শরীরের কি অবস্থা করেছো?”
মধু খাটের তলায় গিয়ে ড্রেস এ ময়লা লাগিয়ে ফেলেছে। ফুয়াদ নিচু হয়ে ওর জামার ময়লা ঝাড়তে লাগল।
ফুয়াদ মধুর জামার ময়লা ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মধু ওকে বলল,,” তুমি আমাকে একা ভূতের কাছে রেখে কোথায় গিয়েছিলে?”
ফুয়াদ বলল,,” তোমাকে আমি ঘুমাতে বলেছিলাম! না ঘুমিয়ে খাটের তলায় কেন গিয়েছিলে?”
মধু ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,,” একটা ভূত আমার ঘাড় মটকাতে এসেছিল। আমি ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম।”
ফুয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” গলায় এতো তেজ। সে সামান্য ভূতের ভয়ে খাটের তলায় চলে গিয়েছিল?”
ফুয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,,” চলো, আমাদের এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে।”
মধু হামি দিয়ে বলল,,” আমি ঘুমাব।”
বলেই ফুয়াদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মধু বিছানায় শুয়ে পড়ল। মধুর কান্ড দেখে ফুয়াদ ওকে উঠানোর জন্য এগিয়ে এল।
” মধু উঠো আমাদের এখানে থাকা রিস্ক।”
মধু উঠল না। শুয়েই আছে। ফুয়াদ ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে বলল,” কথা শোনো। চলো।”
মধু ফুয়াদের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,,” তোমার হাতের ওই আঙুলের আংটিটা সুন্দর ওটা আমাকে দাও। আমার একটা ও আংটি নাই দেখো।”
বলেই মধু নিজের ডান বাম দুই হাতের আঙুল দেখালো। মধুর আজাইরা কথা শুনে ফুয়াদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এখন এখানে থেকে পালাতে হবে আর এই মেয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলছে। ওর নেশা কাটাতে হবে। ফুয়াদ মধুর হাত ছেড়ে বাইরে যাবার চিন্তা ভাবনা করল।
এদিকে মধু দৌড়ে এসে ওর হাত জড়িয়ে ধরে বলল,,”তুমি আবার আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছ?”
ফুয়াদ থেমে মধুর দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আমার সাথে চলো। নয়তো একা ভূতের কাছে রেখে চলে যাব।”
মধু ভয়ে সিটিয়ে গেল। ওর চোখ মুখ আতঙ্কে শুকিয়ে গেল। কাঁপা হাতে ফুয়াদের বাহু জড়িয়ে ধরল। ফুয়াদ মধুর আতঙ্কিত ভয়ার্ত মুখ দেখে বাঁকা হাসল।
ফুয়াদ মধু কে নিয়ে হোটেলের বাইরে এল। বের হওয়ার সময় হোটেল ম্যানেজার থাকার জন্য আর এসব পুলিশ কে জানাতে বারণ করল ফুয়াদ গম্ভীর মুখে চলে এল শুধু। বলবে কি বলবে না কিছুই বলল না।
মধু কে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। ফুয়াদ মধুর দিকে আবার ঝুঁকে ওর সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। সরে আসতে যাবে মধু ফুয়াদের হাত ধরে ফেলল আবার।
ফুয়াদ প্রশ্ন বিদ্ধ চোখ ওর দিকে তাকাল।
তারপর বলল,,” সুইটহার্ট মাতাল হয়ে তোমার তুমি ডাকটা শুনতে ভালোই লাগছে। হৃদয়ে গিয়ে লাগছে।”
মধু আবার ওর হাতের রিং দেখিয়ে বলল,,” ওটা দাও।”
ফুয়াদ মধুর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল,,” দেব যেদিন তুমি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করবে। এখন এই মাতাল মেয়েকে রিং পরাতে চাই না। তুমি সজ্ঞানে এর অধিকার পাবে। ”
বলে ফুয়াদ ওর কপালে অধর স্পর্শ করে সরে আসে। মধু গাল ফুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফুয়াদ ওর গাল ফুলানো দেখে আবার হাসল।
মধু ওর হাসি দেখে আরো গাল ফুলায়। চোখ সরিয়ে নেয়।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে মধু সিটে হেলান দিয়ে আছে। ওর খারাপ লাগছে। মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,” বমি পাচ্ছে।”
বলতে বলতেই ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। ফুয়াদ তাড়াতাড়ি গাড়ির ব্রেক কষল। দরজা খুলে বেরিয়ে দৌড়ে নামল। মধুর সিট বেল্ট খুলে তাড়াতাড়ি ওকে গাড়ি থেকে নামালো। মধু গাড়ি থেকে নেমেই বমি করে ভাসিয়ে দিল। ফুয়াদ ওকে ধরে ছিল বিধায় ওর শার্টেও বমি লাগল। বমি করে অবস্থা নাজেহাল করে ফেলল। বমি করে ক্লান্ত হয়ে মধু ফুয়াদের বুকে ঢলে পড়ল শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে। ফুয়াদ দুহাতে মধু কে জড়িয়ে ধরে ওর গালে হাত দিয়ে বলল,,” ঠিক আছো?”
মধু বিড়বিড় করে বলল,,” খারাপ লাগছে।”
যে এই কাজ করেছে তার উপর ফুয়াদের রাগ তরতর করে বাড়তে লাগল। তাকে সামনে পেলে কি করত ও নিজেও জানে না।
গাড়িতে এক ফোঁটা পানিও নাই থাকলে মধু কে একটু পানি খাওয়াতে পারত। তাহলে ওর ভালো লাগত। বমি দিয়ে ওর হাতার শার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। ফুয়াদ মধু কে বুকে নিয়েই গাড়িতে বসালো। তারপর দরজা আটকে দিল। মধু চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। ফুয়াদ হাতার দিকে তাকিয়ে নাক মুখ বিকৃত করে শার্ট খুলে ফেলল তারপর গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চালাতে লাগল। এখন ফুয়াদের গায়ে শুধু সেন্ডু গেঞ্জি। জিন্সের প্যান্টের সাথে সেন্ডু গেছি। ফুয়াদ মধু কে নিয়ে প্রান্তের বাসায় আসলো এখানে থেকে ওর বাসাটাই কাছে। প্রান্ত কে কল করে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছে প্রান্ত ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরা আসতেই খুশি হয়ে এগিয়ে এল। ফুয়াদ দেখল মধু ঘুমিয়ে গেছে ফুয়াদ শার্ট বিহীন গাড়ি থেকে নেমে মধু কে কোলে তুলে নিল। প্রান্ত ফুয়াদ কে এমন ড্রেস আপ ও তার সাথে অপরিচিত এক মেয়েকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে ফুয়াদ আর মধু কে দেখতে লাগল। প্রান্তের ফ্লাটে গিয়ে মধুকে ফুয়াদ প্রান্তের রুমের বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর নিজে প্রান্ত কে বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল গোসল করতে। প্রান্ত নিজের পোশাক দিল ফুয়াদ কে। প্রান্ত এক কামরা একটা ভাড়া বাসায় থাকে। ওর পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে। ও কাজের জন্য শহরে থাকে একাই। ওর বাসাটা ছোটো। একটা বেডরুম। একটা কিচেন রুম। একটা ওয়াশরুম। একটু খানি বসার জায়গা আছে সেখানে দুইটা সোফা রাখা। এক সোফায় প্রান্ত বসে আছে গভীর ভাবনা নিয়ে। ওর ভাবনা ফুয়াদের সাথে থাকা মেয়েটি কে? এতো রাতে দুজন কোথা থেকে এল। কিছুই বলেনি ফুয়াদ ওকে শুধু হঠাৎ কল করে বলেছে ওর বাসায় আসছে। প্রান্ত তো চমকে গিয়েছিল কোনদিন ফুয়াদ ওর ফ্লাটে আসেনি আজ হঠাৎ এতো রাতে আসবে বলছে? ও দ্বিমত করেনি খুশির সাথেই রাজি হয়েছে। প্রান্ত বসে আছে ফুয়াদের অপেক্ষায়। ওয়াশরুম থেকে বের হলেই সব প্রশ্নের জবাব পাবে সেই আশায়।
ফুয়াদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে তাকাল বিছানার দিকে। মধু ঘুমিয়ে আছে। ফুয়াদ এগিয়ে এসে বসল ওর শিয়রের কাছে।মুখটার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ফুয়াদ মধুর গালে হাত বুলিয়ে হাত নিয়ে মাথায় রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। রুম ছেড়ে বেরিয়ে গ্লাসে পানি এনে মধুকে ঘুমন্ত অবস্থায় জোর করে একটু পানি খাওয়ালো। বমির পর কিচ্ছু খায়নি পানি ও না তাই খাওয়ালো। উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে তোয়ালের এক কোনা ভিজিয়ে ওর মুখটা মুছিয়ে দিল। প্রান্ত ফুয়াদ কে রান্না ঘরে যেতে দেখেই চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেও ফুয়াদ উত্তর দেয় না। প্রান্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুয়াদের কাজ থেকে আরো হতভম্ব হয়ে যায়।
মধু ঘুমের মাঝেই নড়ে উঠে। ফুয়াদ উঠে বাইরে আসে। প্রান্ত ও দেখার আগেই নিজের স্থানে এসে বসে পড়ে। ফুয়াদ ওর পাশের সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,,” এক রাত না ঘুমিয়ে থাকতে পারবে?”
প্রান্ত মাথা নাড়িয়ে পারবে বলে।
ফুয়াদ বলে,,” এক কাপ কফি হবে?”
” আমি এখুনি করে আনছি।”
বলেই প্রান্ত উঠে রান্না ঘরে চলে যায়। নিজের ও ফুয়াদের জন্য কফি করে নিয়ে আসে। ফুয়াদ ছোটো ছোটো চুমুক দিতে থাকে কফিতে। সাথে প্রান্ত জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে কোথা থেকে এতো রাতে এখানে আসলো।
ফুয়াদ হোটেল ও সমুদ্রের থানায় থাকার কথা জানায়। প্রান্ত সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়।
#চলবে…….