#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩৫.
ফুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল ম্যানেজার। তার মাথা নিচু। ফুয়াদ রাগে গজগজ করছে তখন। চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠেছে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। ফুয়াদ রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে।
ম্যানেজারের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠল ফুয়াদ,,” কে এই কাজ করেছে? কার এতো বড়ো স্পর্ধা আমার খাবারে ডিংক্স মেশায়?”
মধু ঘোলা চোখে তাকিয়ে আছে ফুয়াদ আর ম্যানেজারের দিকে। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মধু। ফুয়াদ কে অনেক কষ্টে ম্যানেজারের কাছে থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সবাই কিন্তু ফুয়াদ এতোটাই শক্ত করে ধরেছে কেউ ওকে সরাতে পারে না। মধু এখনো সজ্ঞানে আছে তাই ও নিজেই এগিয়ে এসে ফুয়াদের ডান হাতের বাহু শক্ত করে ধরে বলে,,” কি করছেন ছাড়ুন উনাকে!”
ফুয়াদ মধু কথায় লোকটাকে ছেড়ে দেয়। লোকটা রাগে চোখ মুখ লাল করে আছে। ছাড়া পেতেই কলার ও শার্ট ঠিক করে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়ায়।
ম্যানেজার খোঁজ নিয়ে খবর নিয়ে ফুয়াদের কাছে এসে জানাল। যে লোকটা ফুয়াদের খাবার দিয়েছিল তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফুয়াদ মধুকে এই অবস্থায় রেখে কোথাও যেতেও পারছে না। এখনি ও সিসি ক্যামেরা চেক করতে চাইছিল। কিন্তু আগে মধুকে রুমে রেখে আসতে হবে। মধু ওকে টেনেটুনে ম্যানেজারের থেকে ছাড়িয়ে আবার চেয়ারে বসে টেবিল মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।
ফুয়াদ মধুর দিকে এক নজর তাকিয়ে ম্যানেজার কে হুমকি দিয়ে বলে, কে এই কাজ করেছে? কেন করেছে? তাকে ওর সামনে নিয়ে আসতে না হলে ও ওদের হোটেল বন্ধ করে দিবে।
ম্যানেজার ফুয়াদের হাত ধরে বলে,,” স্যার এমন করবেন না। আমাদের হোটেলের একটা সুনাম আছে। এখানে কখনো এমন টা হয়নি। আজই প্রথম এমন কাজ হয়েছে তার জন্য আমরা অনেক লজ্জিত।”
ফুয়াদ ম্যানেজারের সাথে আর কোন কথা বলে না। তার সামনে থেকে সরে সোজা মধুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মধু তখন চোখ বন্ধ করে ছিল। ফুয়াদ ওর দিকে ঝুঁকে মাথা নিচু করে আর ডেকে উঠে মধু বলে। মধু চোখ পিটপিট করে ওর দিকে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলে উঠে,,” আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।”
বলেই মাথার দুই পাশে হাত রেখে সোজা হয়ে বসতে চায়।
ফুয়াদ মধুকে বলে,,” উঠো রুমে চলো।”
মধু ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,” উঠতে পারছি না।”
ফুয়াদ মধুর হাত ধরে বলে,,” আমাকে ধরে উঠো!”
বলেই ওকে ধরেই দাঁড় করায়। মধু কেমন জানি লাগছে। ও ফুয়াদের হাত দুহাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে চায় দুই কদম হেঁটেই ফুয়াদের হাত ছেড়ে দেয় আর ঠাস করে পরে যেতে নেয় ফুয়াদের তাড়াতাড়ি ওকে ধরে নেয়।
” মধু সাবধানে হাঁটো।”
” আমি হাঁটব না।”
বলেই ফুয়াদ দিকে তাকায়। ফুয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,,” হাঁটবে না কেন? না হাঁটলে রুমে যাবে কি করে?”
মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা চোখ মুখ করে বলে,, আপনি আমাকে কোলে করে রুমে নিয়ে চলুন। আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পা ব্যথা করছে।”
ফুয়াদ বিস্মিত কন্ঠে বলে,,” আমি তোমাকে কোলে নিবো? তুমি নিজে বলছো?”
মধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
” সব সময় তো কোলে তুলতে গেলে ঝামেলা করো এখন এতো কোলে উঠতে চাইছ যে! বাই এনি চান্স তোমার কি আমার কোলে উঠতে ভালো লাগে মধু?”
মধু বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগল। আর বলতে লাগল,,” কোলে তুলুন নয়তো আমি এখানে বসে পড়ব।” বলেই মধু লাফানো অফ করে বসার প্রস্তুতি নেয় ফ্লোরে।
ও গড বলেই ফুয়াদ তাড়াতাড়ি ওকে কোলে তুলে নেয়। মধুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে ও ফুয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে দুহাতে। ফুয়াদ পেছনে তাকায়। রেস্টুরেন্টের সব কাস্টমার এদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। থাকবেই তো একটা ছেলের কোলে একটা মেয়েকে দেখেছে যে সবাই এখন রোমান্টিক ড্রামা দেখছে। ফুয়াদ বিরক্তিকর চোখে ওদের দেখে রুমের দিকে হাঁটা ধরল। মধু এমনিতে কোলে উঠলে কখনোই ওর গলা ধরে না ভালো করে আর আজ এতো সুন্দর করে ধরেছে আর নিজের মুখ একদম ওর বুকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ফুয়াদ মধু কে নিয়ে রুমে আসার রাস্তায় একটা কাপল এর সাথে দেখা হলো মেয়েটা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ছিল। ওদের পাস করার সময় ফুয়াদ শুনল মেয়েটা ছেলেটাকে ফিসফিস করে ধমক দিচ্ছে মেয়েটাকে ছেলেটা কোলে নেয় না কেন? ফুয়াদ ওদের এসব কান্ড দেখে নিজের মনেই হাসল।
মধু ভ্রু উঁচু করে ফুয়াদের হাসি দেখে বলল,,” আপনি হাসছেন কেন?”
ফুয়াদ ওর প্রশ্নের জবাবে বলে,,” মাতাল হয়ে আমার কোলে উঠার শখ জেগেছে তোমার? তা কোলে উঠে কেমন লাগছে সুইটহার্ট?”
মধু ফুয়াদের কথা বুঝল কিনা কে জানে। মধু গলা থেকে এক হাত ছাড়িয়ে ফুয়াদের গালের দাঁড়ি টেনে ধরল।
“আরে কি করছো? পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
মধু ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে কিন্তু হাত থেকে দাঁড়ি ছাড়ে নি। জোরে টান দিয়েছিল। ফুয়াদের কথা শুনে আলতো করে ধরেছে। প্রথম টানে ফুয়াদ ব্যথা পেয়েছিল। এখন ব্যথা পাচ্ছে না কিন্তু মধুর কাজে অবাক হচ্ছে।
” কি করছো ছাড়ো!”
মধু ছাড়ল না। ধরে রেখেই বলল,,” আপনি জোর করে আমার হাত ধরে রাখেন আমি বললেও ছাড়েন না। আমিও ছাড়ব না।”
” এটা আমার হাত না। হাত ধরে রাখো সারাজীবন কিচ্ছু বলব না। দাঁড়ি কেন ধরেছ? উফ আগে জানলে ছোট করে আসতাম। বড় করে ফেলেছি এখন তোমার টান খেয়ে আধমরা হবো।” মধু আবার জোরে টেনে ধরেছে। ফুয়াদ মধুকে তাড়াতাড়ি কোলে থেকে মধুকে নামিয়ে দেয় রুমের সামনে এসে। মধুর হাত থেকে রক্ষা পায় দাঁড়ি। ফুয়াদ নিজের দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে মধুর দিকে তাকিয়ে বলে,,” সুইটহার্ট মাতাল হয়েও আমাকে ব্যথায় দিলে। কোথায় মাতাল হয়ে আদর সোহাগ করবে। মাতাল হলেও তালে ঠিকিই আছো।”
মধু আবার এগিয়ে এসে ওর দাঁড়ি ধরতে চায়। ফুয়াদ ওর হাত ধরে ওকে আটকে এক হাতেই জড়িয়ে ধরে লক খুলে দরজার।
মধু ধরতে না পেরে অসহায় গলায় বলে,,” ধরতে দিন।”
ফুয়াদ ওকে টেনে রুমে এনে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে,,” চুপচাপ ঘুমাও।”
বলেই ওকে রেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। বাইরে থেকে দরজা লক করে দেয়। পেছনে থেকে মধু কিছু বলছিল ও পাত্তা দেয় না। ফুয়াদ বাইরে এসে কাজে লেগে পরে। সবার আগে সিসি ক্যামেরা চেক করতে যায়। সেখানে গিয়েও কোন কাজ হয় না। সিসি ক্যামেরায় ফুয়াদ দের রেস্টুরেন্টে আসা থেকে কোন ফুটেজ নাই। ফুয়াদ এবার নিশ্চিত কেউ ইচ্ছা করে এসব করেছে। আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল তার। ফুয়াদ পকেটে থেকে ফোন বের কাউকে কল করে।
এইদিকে ম্যানেজার ভেবেছে পুলিশে কল করেছে তিনি তো কেঁদে দেবেন এমন অবস্থা। হোটেলের মালিক যিনি তিনি থাকেন লন্ডনে তাকে কল করে সব জানান। এসব এখনো পাবলিক জানে না। ফুয়াদ কে অনেক অনুরোধ করে গোপন রাখা হয়েছে। এসব সবার মাঝে জানাজানি হয়ে গেলে তাদের হোটেলের রিপুটেশন নষ্ট হবে।
ফুয়াদ তার ভয় পাওয়া দেখে ও কিছুই বলে না। ও কলে কথা শেষ করে আবার রুমে ফিরে আসে। এখানে আর এক মুহূর্তও না। বড়ো কোন শত্রু ওর পিছু লেগেছে ও বুঝে গেছে। ম্যানেজারের কাছ থেকে সেই সার্ভেন্টের ঠিকানা নিয়ে। কাউকে মেসেজ করে খোঁজ নিতে বলে মধুর কাছে যাবে ভাবে। এক্ষুনি এই হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবে। এখন বাজে দশটার উপরে। এসব ঝামেলা হবে জানলে এখানে আসতোই না।
এইদিকে পুলিশ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে মামুন আর সাফিন। আজকেই রাহী বিদায় হলো। পরিবেশ ছিল থমথমে তার মধ্যে ফুয়াদের অনুপস্থিতি। আবার এরা আসছে একটু পর পর ঝামেলা করতে সব মিলিয়ে সবার মন মেজাজ হয়ে আছে খিটখিটে।
এবার রাজিব খান নিজেও রাগে রুম থেকে বের হয়নি যা কথা বলার সব সমুদ্র বলছে। এখন পুলিশ বলছেন সমুদ্র কে তাদের সাথে থানায় যেতে হবে।
তিন্নি আর ফাহাদ হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নাফিসা বেগম রাগে মধু কে গালিগালাজ করছে।
সমুদ্র নিজেও হতবাক নির্বাক হয়ে গেছে। ফুয়াদের উপর সবাই রাগে বোম হয়ে আছে। এদিক ফুয়াদের ফোন এই মাত্র খোলা পেয়েছে তিন্নি।
ও ফোন কানে ধরেই ড্রয়িংরুম থেকে সরে গেল।
” হ্যালো ভাই।”
” হ্যা বল। কি হয়েছে?”
” সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাই। মধুর ভাই বাসায় পুলিশ নিয়ে আসছে। সমুদ্র ভাইকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাবে বলছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি আসো।”
ফুয়াদ বলল,,” আমি এখন বাসায় ফিরতে পারছি না তিন্নি। মধু কে বাসায় নিয়ে আসলে ওকে ওর ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু আমি এখনি মধু কে যেতে দিতে পারব না। এখনো মধু আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেনি আগে ওকে আমায় ভালোবাসতে হবে।”
” তাহলে সমুদ্র ভাইকে কি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। চাচি খুব কান্নাকাটি করছে। চাচা বাবা রা রুম থেকে বের হচ্ছে না। রাগ করে আছে।”
” তুই টেনশন করিস না। ভাইয়ের কাছে ফোনটা দে।”
তিন্নি ফোন দেওয়ার জন্য এসে দেখল সমুদ্র কে নিয়ে চলে যাচ্ছে পুলিশ রা। আর চাচি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সোফায়। তিনি বিলুপ করে কাঁদছেন।
তিন্নি ফোন কানে ধরে বলে দিল সব ফুয়াদ কে। ফুয়াদ মায়ের কাছে ফোন দিতে বলল।
নাফিসা বেগম ফোন নিয়ে ফুয়াদ কে বললেন,,,” এক্ষুনি বাসায় আসো।”
” আম্মু আমার কথা শোনো।”
নাফিসা বেগম কথা শুনলেন না ফোন ফিরিয়ে দিলেন তিন্নি কে।
ফুয়াদ তিন্নির আওয়াজ পেয়ে বলল,,” আব্বু কোথায়?”
” রাগ করে রুম থেকে বের হয়নি, সবাই তোমার উপর খুব রেগে আছে ভাইয়া। তুমি বাসায় আসো।”
” তিন্নি মায়ের খেয়াল রাখিস। চিন্তা করিস না ভাইয়া কে আমি জেলে থাকতে দেব না।”
বলেই ফোন কেটে দেয়। ফুয়াদ মধুর রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় মধু কে নিয়ে এখানে থেকে যাওয়াটাও রিস্ক আবার এখানে থাকাও রিস্ক।থানায় যাওয়া ও দরকার। ফুয়াদ কপালে আঙুল রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটা শ্বাস ফেলে লক খুলে ভেতরে আসতেই ওর বুক ধক করে উঠে। রুমের কোথাও মধু নাই। সম্পূর্ণ রুম ফাঁকা। চিন্তায় ভাঁজ পরে ওর কপালে।
#চলবে…..