প্রেয়সী পর্ব ৩৩

0
450

#প্রেয়সী 🤎(৩৩)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৬৪.

আজ ক্যালেন্ডারে ইংরেজির নয় চলছে। আমাদের বিয়ের তারিখটা আরও দিন পনেরো পেরিয়ে হওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু হঠাৎ করেই তা আর ৪দিনের মাথায় নির্ধারিত করার সঠিক কোনো কারন আমি এখনও ধরতে পারলাম না! বড় খালামনি,মেঝ খালামনি,চাচা-চাচি,বড় খালু,মেঝ খালু সব গুরুজনরাই বিয়ের তারিখ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন! গবেষণায় বের হলো আর চারদিন বাদে শুক্রবার-১৩ তারিখ। শুক্রবারে বিয়ে পড়ালে অগ্রীম সওয়াব মিলবে। তাই আগামী ১৩ তারিখই বিয়ের জন্য নির্ধারিত করা হলো। গুরুজনরা সবাই বসে থাকলেও আমরা ছোটরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম! অবশ্য আমি দাঁড়াতে চাইনি! কিন্তু খালামনির কঠোর আদেশে আমাকেও দাঁড়াতে হয়েছে। ১৩ তারিখ বিয়ের ডেট ফাইনাল হতেই হুল্লোড় করে উঠলো সবাই। আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম মুহুর্তেই! ব্যাপারটা যেন
ভ/য়ং/ক/র লাগছে আমার কাছে। এখানে আমার বিয়ের তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে আর আমি কিনা লজ্জা-শরম খুইয়ে হা করে বড়দের কথা গিলছি!

রাহিয়ানের বন্ধুরা উনাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছেন! আর এদিকে রাই,নিতু আপু,রিম্মি আপু,বউমনি তারাও কম যায়না! একেক জনে বালতি ভরে ভরে লজ্জা ছুড়ছে আমার দিকে! আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না! লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা মুখ-খানা লুকাতেই দৌড়ে পালালাম সবার থেকে! কিন্তু পালিয়েও কি শান্তি আছে? ঠিকই পেছন পেছন সব দৌড়ে এলো।

কাল হবে বিয়ের শপিং! সেই নিয়েই লিস্ট নিয়ে বসেছে বউমনি আর রিম্মি আপু। সাথে যোগ হয়েছে নিতু আপুও। বিয়ের ক’টা দিন চাচা-চাচি,নিতু আপু আর হিমেল ভাই সবাই এ বাড়তেই থাকবে। রানিকেও আনার কথা বলা হলে চাচি জানালো ওর মায়ের শরীরটা ভীষণ খারাপ! তাই ও গ্রামে গিয়েছে। বিয়ের দিন যদি সুযোগ হয় তবে ঠিকই আসবে। রাইকে আন্টির থেকে পারমিশন করিয়ে একদম সাতদিনের জন্য রেখে দিয়েছি। আমার সব কিছুতে মেয়েটা না থাকলে যেন শান্তিই পাই না।

ফাহিম ভাইয়া গাল ফুলিয়ে আছে! তারও ইচ্ছে তার প্রান প্রিয় বোনের বিয়েতে যেন তার প্রান প্রিয় সখী শুরু থেকে শেষ অব্দিই থাকে! কিন্তু হিয়া আপুর রা-গী বাবা মেয়েকে বাইরে রাত কাটানোর জন্য পারমিশন দিতে অমত করছেন। বিয়ে হোক আর যাই হোক সে কিছুতেই রাজি হবেননা বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। সেই দুঃখেই ভাইটা আমার কাতর। কি বলে স্বান্তনা দেয়া যায় ভেবে কল ঠুকে দিলাম হিয়া আপুর বাবার কাছে। তাও আবার যে সে কল নয়, একদম ভিডিও কল। আমি বিয়ের কনে হয়ে তার কাছে অনুরোধ করাতে মানুষ টা হঠাৎই পানির মতো গলে গেলো। মিষ্টি করে হেসে আমায় স্নেহ ভরা কন্ঠে বারবার ডেকে বলল,

—-” আমার মেয়েটাকে তোমার ভরসায় পাঠাচ্ছি মা। আমার আর কোনো চিন্তা নেই! বিয়ের পর নতুন জামাই-বউ অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবে কিন্তু।”

আমিও বিগলিত হেসে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম,

—-” হিয়া আপুর এ বাড়িতে কোনো সমস্যা হবেনা আঙ্কেল। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকবেন। আর আমরা অবশ্যই আপনাদের বাড়িতে আসব। খুব শীঘ্রই আসব। সব কিছু জোগাড়যন্তর করে রাখবেন কিন্তু।”

লোকটা হাসতে হাসতে কল কাটল। হিয়া আসছে শুনে ফাহিম ভাইয়ার মেজাজও এবার বেশ ফুরফুরে। এই মানুষটাই আমাদের সবার থেকে একটু বিপরীত ধর্মী। সারাক্ষণ হাসি-মজার মধ্যমণি হিসেবে কিন্তু উনাকেই পাওয়া যাব। আর তারই যদি কোনো কারনে মন খারাপ থাকে তা কি দেখতে ভালো লাগে?

হঠাৎ বিয়ের তারিখ পড়ায় বেশিরভাগ মেহমানই যেন খাদে পড়লেন। এই চারদিনে কি করে কি হবে বাড়ির লোকের থেকে তাদেরই যেন মাথা ব্যাথা বেশি। অনেকে তাড়াহুড়োর উপর এসে হাজির হয়েছে! আর বাকিরা আজকাল এসে যাবেন বলে জানালেন! অল্পবিস্তর লোকজনেই বাড়ির এক কোন যেন কোলাহলপূর্ন। বিয়ের আমেজে রঙ লেগেছে সবার মনে। কমবেশি মানুষের নজর এড়িয়ে হঠাৎ আমায় একলা ডেকে পাঠালেন মহাশয়! ছাদে মানুষের আনাগোনা এখনও তেমন নেই বলেই আপাতত ছাদের যাওয়ার বার্তা নিয়ে পাঠালেন ফাহিম ভাইয়ার হাত থেকে। ফাহিম ভাইয়া চোখ জোড়া সরু করে হাতে ছোট্ট চিরকুট খানা গুঁজে দিয়ে বলল,

—-” শোন বুড়ি, আজ তুই আমার একটা ফেভার করলি বলে আমিও তোর একটা ফেভার করে দিলাম! তোর হবু বরের চিরকুট! কেউ দেখার আগে টুপ করে পড়ে নে তো!”

আমি লজ্জায় মাথা নুইয়েই চিরকুটটাতে চোখ রাখতে দেখা মিলল তার গোটাগোটা অক্ষরের লেখা!

—-” পাঁচমিনিটের জন্য ছাদে এসো!”

লেখাটা পড়তেই মনের মধ্যে অদ্ভুত সব অনুভূতি হতে লাগল। ওলট পালট অনুভূতিগুলো কে সামলে যাবো কি যাবো না ভেবে ভেবেই পার করে ফেললাম আধাঘন্টা! অবশেষে যদিও বা গেলাম তবে একলা যাইনি! সঙ্গে করে পুরো একখানা গ্যাং নিয়ে হাজির হয়েছি। উনি আমার সাথে এতো মানুষজন দেখে ভড়কে গেলেন বুঝি! বোবা চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলে উঠলেন,

—-” কথাগুলো দেখছি বিয়েটা সেরেই বলতে হবে। অন্যথা এই সিকিউরিটি গার্ড আমার ইজ্জতের বারোটা বাজাবে।”

কথাগুলো বাকিরা স্পষ্ট না শুনলেও আমি বেশ স্পষ্টই শুনলাম! বেচারা আর কিছু বলতে না পেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাথা চুলকে নীচে নেমে গেলেন। আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকা পাবলিক গন উনার যাওয়া দেখে মুখ টিপে হাসতে হাসতে শ-খানিক লজ্জার বান ছুড়ল আমার দিকে।

সারারাত ধরে মানুষগুলো হুতুমপেঁচার মতো জেগে থেকে ক্যাটারিং থেকে শুরু করে বিয়ের রান্না-বান্নার কি কি আইটেম হবে তা অব্দি ঠিক করে ফেললেন। আমার ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ফাহিম ভাই আর হিমেল ভাইয়ের চেঁচামেচির আওয়াজে! ধড়ফড়িয়ে উঠে বিছানার চাদর আকড়ে বসে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর আবারও চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসতেই লাফিয়ে নেমে দৌড়ে এলাম ব্যালকনিতে। চেঁচামেচির আওয়াজ পেছনের গার্ডেন থেকেই আসছে! ব্যলকনি ধরে দাঁড়াতেই বোধগম্য হলো তারা রান্নার লোকেদের কাজ বোঝাচ্ছে! খুব সম্ভব তাদের টিম লিডার কানে কালা! ফাহিম ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া দাঁত কেলাতে কেলাতে চেঁচাচ্ছে তার সাথে! বারবার হিমেল ভাইও তাল মেলাচ্ছে উৎসাহিত কন্ঠে। আরফান ভাইয়া আছেন তাদের পাশেই। কান্ড দেখছেন বদের হাড্ডি গুলোর। আমি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পাশের ব্যলকনিতে তাকাতেই দেখি জনাবেরও একই দশা! গোছালো মানুষটা ঘুমের রেশ কাটানোর বৃথা চেষ্টায় অগোছালো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে যে একরাজ্য ঘুম নিয়ে দাঁড়িয়ে তা তার হাই তোলার ধরনেই বেশ বুঝতে পারলাম।

চোখে ঘুম থাকলেও মনের মাঝে চেপে আছে একরাশ বি-র-ক্তি! খুবই স্বাভাবিক, এই ভোর বেলায় কেউ কানের পাশে থেকে এভাবে চেঁচামেচি করলে রাগে দুঃখে পঁচা পানিতে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে। তবে ইচ্ছেটা নিতান্তই তার করলেও আমার করল না। মেয়েদের বিয়ের দিন ঠিক হতেই নাকি তারা বিয়ে হওয়ার আগ অব্দি আর দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনা! তারা যে আগাম ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় মশগুল তা কিন্তু নয়! কেবলই অহেতুক ব্যাপার। এর বিশেষ ব্যাখা কার কাছে পাবো জানিনা। জানার আগ্রহও করলাম না! কেবল জেনে রাখলাম এটাই নিয়ম। বিয়ের আগ অব্দি মেয়েরা আর ঘুমোতে পারেনা মুলত এটাই নিয়ম। আমিও সেই নিয়মই পালন করে চলেছি। রাহিয়ান করছেন কি না জানিনা! তবে এই মুহুর্তে মুখের এমন দশা দেখে বোঝা যাচ্ছে রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি তার।

—-” সুপ্রতাম ম্যাডাম।”

উনার ঘুমঘুম কন্ঠে ভাবনার জগতকে ছুটি দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। উনার স্নিগ্ধ শীতল চাহনি আমাতেই আঁটকে আছে। ফাহিম ভাইয়াদের ছেড়ে কখন আমাতে আঁটকালেন খেয়াল করা হলো না। আমি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি জুড়লাম। চোখের ভারি পল্লব ফেলে নরম কন্ঠে বললাম,

—-” সুপ্রভাত।”

—-” রাতে ঘুম কেমন হলো?”

সত্যি বলা বাহুল্য হলেও মিথ্যে বলেই চালালাম। চোখ ঝাপটে মাথা নেড়ে বললাম,

—-” বিন্দাস ঘুম হয়েছে। এরকম বিন্দাস ঘুম বোধহয় কয়েক বছরেও ঘুমোইনি!”

সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলেন উনি। আমার ন্যায় মাথা নেড়ে বললেন,

—-” আমারও তাই। এমন ঘুম বোধহয় বারো বছরেও হয়নি!”

আমি উৎফুল্ল স্বরে বললাম,

—-” সত্যি?”

—-” হুম একদম সত্যি। দেখো, এমন ঘুম হয়েছে যে এদের সামান্য চেঁচামেচি শুনে বাড়িতে ডাকাত পড়ল কিনা সেই ভয়ে তেড়েফুঁড়ে আসলাম!”

আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বললাম,

—-” আমি ভেবেছি মা/রা/মা/রি লেগেছে!”

আমার কথায় হেসে ফেললেন উনিও। মুহুর্তেই আর জবাব দিলেন না আমায়। ফাহিম ভাইয়াদের দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠে বললেন,

—-” কি রে ব্যাটা বিয়ের আগেই কি শান্তির ঘুমের ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দেওয়ার তালে আছিস নাকি?”

রাহিয়ানের গলা পেয়ে চমকে উঠে তাকাল সবাই। আরফান ভাই আর ফাহিম ভাই জিহ্বায় কামড় বসালেন তৎক্ষনাৎ। জিয়ান ভাই আর হিমেল ভাই মুখ চাওয়াচাওয়িতে ব্যস্ত। আরফান ভাই রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই উনার নজরে আমিও এলাম। বেচারার মুখখানা তৎক্ষনাৎ কালো হয়ে গেলো। হয়ত তাদের ভাবনাতেও ছিলো না তাদের গলা পেয়ে আমরা এভাবে উঠে পড়তে পারি!

জিয়ান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,

—-” ভাই, কয়ডা দিন একটু কষ্ট! তারপর সুখই সুখ!”

রাহিয়ান চোখ জোড়া সরু করে তাকালো। পাশ থেকে জিয়ান ভাইয়াকে ঠেলে আরফান ভাই বলে উঠলেন,

—-” সরি রে দোস্ত! আমাদের কথা যে তোদের রুম ভেদ করবে বুঝতে পারিনি! সরি নিধি!”

আমি না সূচক মাথা নেড়ে ছোট্ট করে হাসলাম। অর্থাৎ, চিন্তা নেই! আমার কোনো সমস্যা হয়নি!

রাহিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” বাট আমার অনেক সমস্যা হয়েছে! প্লিজ আমি ঘুমোতে চাই!”

উনার বাচ্চাসুলভ কন্ঠে আমি আরফান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। আরফান ভাইও হাসতে লাগলেন রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে। অতঃপর ভরসা চোখে তাকিয়ে বললেন,

—-” যা দোস্ত নিশ্চিন্তে ঘুমো। তোকে আর কেউ ডিস্টার্ব করবেনা!”

উনি হাসলেন মাথা চুলকে। আরফান ভাই তাদের কাজে মনোযোগ দিতেই উনি গলারস্বর টা খানিকটা নীচু করে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

—-” কাছে বউ থাকলে ড্যাম সিওর আমাকে কেউ টেনে হিঁচড়েও উঠাতে পারত না! কিন্তু কি করার? মাঝেমধ্যে বউয়ের টেনশনেও উঠে পড়তে হয়, বউটা আবার হারিয়ে গেলো কি না!”

কথাটা বলেই চোখ টিপলেন উনি। আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বললাম,

—-” মুখে অবশ্যই লাগাম টানতে হবে। এসব কথা কেউ বলে?”

উনি হেসে ফেললেন। মাথা চুলকে চমৎকার হেসে বললেন,

—-” বউয়ের সাথে মশকরাতেও কিন্তু ঝুড়িঝুড়ি সওয়াব আছে বিবিজান।”

৬৫.

কাঠফাটা রোদের মধ্যে একেক জনে হাতে কম করে হলেও দশটা দশটা শপিংব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় ফেরার তাড়া হচ্ছে। রোদকে মাড়িয়েই আস্তে ধীরে গাড়িতে উঠতে লাগল সবাই। আমি আগেই উঠে বসেছি জনাবের আদেশে। আদেশ কেবল উনার একার নয়, বাড়িসুদ্ধ সবার! বিয়ের কনে এভাবে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না।

বাকি গাড়ি গুলো আসতে আসতে ততক্ষণে আমাদের গাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হোক বলে বড়খালু এবং বড়খালামনির হুকুম। হুকুম পালনে রাহিয়ানও উঠে এলেন গাড়িতে। সেই সাথে উঠল ফাহিম ভাইয়া, হিয়া আপু,নিতু আপু আর রাফিন ভাইয়া। সকাল সকাল শপিংএর জন্য বের হয়ে বেশ তাড়াতাড়িই শেষ করা গেলো এই ঝামেলা। সময় কম হলেও কেউ বলতে পারবেনা এতোগুলো ড্রেস একত্রে কিনে কেউ ঠকেছে। সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিশেষ করে খালামনিদের।

মায়েরা বরাবরই এই শপিংএর ক্ষেত্রে বেশ কড়া। দোকানী যদি বলে,’আপা এই ড্রেসটা হাজার দুয়েকের নীচে হবেনা।’ দোকানীর রায় শুনে তারা বেশ স্বাভাবিক রিয়াকশন দেয় বটে কিন্তু বিপরীতে ঠিকই একখানা অস্বাভাবিক কথা বলে বসে। চুপচাপ শান্ত ভঙ্গিতে বলে বসবে, ‘চারশ দিলে দেন না দিলে উঠলাম!’ দোকানী অবশ্য থতমত খেয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন বটে। কিন্তু শেষ অব্দি মায়েদের ঠিক করা দামেই তারা ড্রেস প্যাক করে দিয়ে হাসি মুখে বলবেন, ‘আচ্ছা আপা আবার আসবেন কিন্তু।’ রিম্মি আপুর থেকেই শোনা মেঝ খালামনি নাকি বরাবর তাকে নিয়ে শপিংএ এসে এই কাজই করেন।

আজ যদিও টাকা খরচাতে কারোর কড়াকড়ি ছিলো না তবুও তাদের দাম মোতাবেকই দোকানীরা সব কিছু দিয়ে দিলেন। আমি তো কেবল দেখলাম আর অবাক হলাম। এতোসব কিছুর মাঝেও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সাক্ষী হলাম। আরফান ভাই রাইকে নিয়ে বেশ আগ্রহী। সবার নজর এড়িয়েই সে রাইয়ের বেশ ভালোই যত্নআত্তি করলেন দেখা গেলো। দেখতে বেশ লাগছিলো। আমার মনটা যেন না চাইতেও বলে উঠলো দু’জনকে বেশ মানাবে।

—-” তোমার এখনও ক্ষিদে পায়নি?”

ড্রাইভিং সিটে বসে দু’হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে কথাটা বলে উঠলেন রাহিয়ান। আমার ভাবনার তাল ঘেঁটে গেলো। দৃষ্টি সামনের অদূর থেকে তুলে এনে উনার উপর আঁটকানোর প্রচেষ্টা করলাম। যতক্ষণে সফল হলাম ততক্ষণে পেট চেপে কাতর কন্ঠে জবাব দিল ফাহিম ভাইয়া,

—-” ভাইয়া খুব জোর ক্ষিদে পেয়েছে রে! আশেপাশে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে দাঁড় করা না গাড়িটা?”

কথাটা বলার প্রায় সাথে সাথেই তার পেট বরাবর গুঁতো বসালো হিয়া আপু। আর সামনে থেকে উনার ক্ষে-পা গলায় উত্তর গেলো,

—-” খেয়ে খেয়ে নিজের হাল টা কি করেছিস দেখেছিস একবারও? এই দশমিনিট আগেও দুই প্যাকেট চিপস্ আর দুই লিটারের কোকের বোতলটা তুই একাই শেষ করলি! আবার এক্ষনি বলছিস খুব জোর ক্ষিদে পেয়েছে? এতো খাবার যে খাস সব কোন রাস্তা ধরে হজম হয় বলতো?”

রাফিন ভাইয়া হেসে উঠলেন বেশ শব্দ করে। তাল দিলেন নিতু আপু আর হিয়া আপুও। ফাহিম ভাই আহত নয়নে তাকালো হিয়া আপুর দিকে।

—-” তো কি ক্ষিদে পেলে বলবো না?”

হিয়া আপু হাসতে হাসতে না সূচক মাথা নাড়ল! আমি এদের কান্ড দেখে ফাহিম ভাইয়ার সাইড নিয়ে বললাম,

—-” ঠিকই তো। ভাইয়ার ক্ষিদে পেলে বলবেনা? এমন করে কেন বলছেন ভাইয়াকে?”

আমার কথায় ফাহিম ভাইয়া বুক ভরে শ্বাস নিলো। রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই রাহিয়ান বলে উঠলেন,

—-” ওর এতো ক্ষিদে পাওয়া তো স্বাভাবিক নয় নিধি। বেয়াদবটা তো দিনদিন অস্বাভাবিকে পরিণত হচ্ছে।”

রাহিয়ানের কথাটায় আরও একদফা হাসির রোল পড়ে গেলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম উনার দিকে। ফাহিম ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে ভাইয়াকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে উনাকে বললাম,

—-” আপনি মোটেই আমার ভাইকে অস্বাভাবিক বলতে পারেন না বলে দিলাম। ভাইয়া কিন্তু মোটেই অস্বাভাবিক নয় এবং অত বেশিও খায়না। আরে বাবা সামান্য একটু ফাস্টফুডে কি পেট ভরে নাকি? ভারি কিছু খেলেই না পেট ভরবে! আপনিও না পারেন বটে।”

আমার কথার তালে তাল মিলিয়ে ফাহিম ভাইয়া কথা বলতে নিলেই আবারও বাঁধ সাধলেন রাহিয়ান। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

—-” তুমি কাল রাত থেকে না খেয়ে। ভোরের দিকে নিতু তোমায় জোর করে একটু খাওয়ালো বলে খেলে। তাও কি খেলে একটা রুটি আর এতোটুকু গাজরের ভাজি। তারপর থেকে কিন্তু এই দুপুর তিনটে বাজে এখনও অব্দি খাওয়ার নাম নাওনি তুমি। আমি ফাহিম কে অস্বাভাবিক বলছি কিন্তু আমি তো ভুল। উচিৎ তো তোমাকে অস্বাভাবিক বলা। না খেতে খেতে দিন দিন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছ তুমি। আচরনও কিছু অস্বাভাবিকের থেকে কম নয়!”

আমি জ্বলে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে উনার বিরূদ্ধে কিছু বলতে নিলেই ফাহিম ভাইয়া আমার হয়েই প্রতিবাদ করতে লাগল। লোকটা রীতিমতো আমাদের দুই ভাইবোনকে অস্বাভাবিক বলছে। অস্বাভাবিক মিনস প্রতিবন্ধী! দিস ইজ টু মাচ। উনাকে বোঝাতে হবে আমরা মোটেই অস্বাভাবিক নই! বরং উনি উনার এমন অদ্ভুত আচরণে প্রমান করে দিচ্ছেন যে উনিই অস্বাভাবিক। কিন্তু এমন কথা বলার সাহস যে আমি বা আমার ভাই কেউই রাখিনা। তাই ফাহিম ভাইয়ের প্রতিবাদ করা দেখে আমি চুপ করে রইলাম। কি বলব? কিছুই বলার নেই।

#চলবে____________________

[ গল্পটা কি সামাজিক পর্যায়ে আছে নাকি অসামাজিক পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছে? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here